06/08/2025
❝ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কি আমি আবার ফিরে আসতে পারবো? জানি না। তবুও, আমি বাঁচতে চাই। একটা বার চেষ্টা করতে চাই। আবারও স্বপ্ন দেখতে চাই! ❞
দীর্ঘ ৩ বছর ৭ মাস ৬ দিন ধরে ব্লাড ক্যান্সার (BCP-ALL ) এর সঙ্গে কঠিন লড়াই করে ডা. পার্থ প্রতিম সেন (রামেক ২৭তম ব্যাচ, বিডিএস)নিজ জন্মদিনের ঠিক একদিন পরেই আজ ৬ আগস্ট ২০২৫ তারিখ বিকাল ৫ টা ১০ মিনিটে ২৯ বছর বয়সে চিরদিনের জন্য পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়েছেন।
গত ৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে পার্থর B-Cell Precursor Acute Lymphoblastic Leukemia (BCP-ALL) ধরা পড়ে। WBC count 193000, Hb : 3.69, Blast cell : 80% ছিল।
এরপর ১১ তারিখে জরুরী ভিত্তিতে পার্থকে Ever Care Hospital এ ডা. আবু জাফর মুহাম্মদ সালেহ স্যারের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করানো হয়।
হাস্পাতালে প্রায় ৪ সপ্তাহ ভর্তি রেখে কেমোথেরাপি (BFM 2009)। প্রতি কেমোথেরাপি সেশন বাবদ খরছ হচ্ছিল প্রায় ৩৫-৪০ হাজার টাকা। বেঁচে থাকার জন্য শেষ উপায় ছিল BONE MARROW TRANSPLANTATION, যার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা! এত টাকা পার্থর পরিবারের পক্ষে যোগাড় করাও প্রায় অসম্ভব ছিল, কেননা ততদিনে তারা ডাঃ চিকিৎসা বাবদ প্রায় ১২ লক্ষের অধিক টাকা ব্যয় করে ফেলেছিলেন।
ডাঃ পার্থ শেষমুহুর্তে সামাজিক মাধ্যমে দোয়া প্রার্থনা করেছিলেন। মৃত্যুর ঠিক ২৪ দিন আগে, ১৩ জুলাই ২০২৫ প্রার্থর শেষ কথাগুলো সারাংশ ঠিক এমনটাই ছিল..............
❝ আমি ডা. পার্থ।
মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণা ,আপনাদের অগাধ ভালোবাসা, দোয়া আর আশীর্বাদের কারণে আজও আমি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছি।
ঠিক ৭৭ দিন আগে, যখন আমি চরম অসহায় আর নিঃস্ব অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিলাম, অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাচ্ছিলাম, যখন কেউই আর আমাকে বাঁচানোর জন্য কোনো আশার আলো দেখাতে পারছিল না—এমনকি আমি নিজেও না। শরীর-মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল লড়তে লড়তে। ঠিক তখনই মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমি আপনাদের দ্বারে এসেছিলাম—একটু দোয়া,আশীর্বাদের ও ভালোবাসার আশায়।
বিশ্বাস ছিল, এই পৃথিবীতে এখনো ভালোবাসা আছে, এখনো মানুষ আছে যারা নিঃস্বার্থভাবে পাশে দাঁড়ায়। সেই ভালোবাসার জোরেই আমি আজ আবার লিখতে পারছি।
আমার কেমোথেরাপি শেষ হয়েছে। Bone Marrow Study with MRD রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।
আমার শরীরে আর ক্যান্সার সেল নেই— ঈশ্বর সহায়! / আলহামদুলিল্লাহ!
আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই সেই মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি এবং আপনাদের প্রতি—যারা আমার জন্য দুই হাত ভরে দোয়া করেছেন, পাশে থেকেছেন, ভালোবেসেছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন আমার Bone Marrow Transplantation (BMT) করানো যাবে।
এটি সম্পন্ন করতে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা (চল্লিশ লক্ষ টাকা) প্রয়োজন এবং আগামী ৫-৭ দিনের মধ্যেই আমাকে ভর্তি করাতে হবে। এই বিপুল অর্থের কথা ভাবলে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। আমার পরিবার কিভাবে এই ব্যয়ভার বহন করবে, জানি না। তবুও ভাবি—যদি আপনাদের সহানুভূতি আর সহযোগিতা পাশে থাকে, তাহলে হয়তো এই অসম্ভবও সম্ভব হয়ে উঠবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছ- তাহলে কি আমি আবার ফিরে আসতে পারবো? জানি না। আমার সামনে এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পথ। শরীর কতটা এই চিকিৎসার ধকল নিতে পারবে, Graft Rejection এর ঝুঁকি কতটা—সবই এখনো অজানা।
তবুও, আমি বাঁচতে চাই।
একটা বার চেষ্টা করতে চাই।
আবারও স্বপ্ন দেখতে চাই।
সেদিনের মতোই—যেদিন কেউ আর আশা দেখেনি, আমি শুধু আমার মা-বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আপনাদের কাছে দোয়ার জন্য সাহস করে হাত পেতেছিলাম। আজও সেই একই বিশ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছি আপনাদের কাছে।
আপনারা সবাই, দয়া করে আবারও একটিবার আমার জন্য দোয়া করবেন। এই ক্যান্সার যুদ্ধে জয়ী হওয়া শুধু আমার একার জন্য নয়—আমার মা-বাবার জন্যও যে খুব প্রয়োজন। আমার মা—যিনি আজও, এই বয়সেও, আমার জন্য রাতের পর রাত জেগে থাকেন, সারাদিন ছুটে বেড়ান, আর নিরবে চোখের জল ফেলেন— আমার সেই মা এর মুখে একটুখানি শান্তির হাসি দেখার জন্য হলেও, আমি বাঁচতে চাই। আমি চাই, একদিন তাঁদের সবার জন্য কিছু করতে, যে বা যারা আমাকে নি:স্বার্থ ভাবে ভালবাসা দিয়েছে - তাঁদের গর্বিত করতে।
আমি কি আর কখনো নামের পাশে ডা. পার্থ প্রতিম সেন লিখতে পারবো? আমি জানিনা। তবে আমি এখনো বিশ্বাস করি, সকলের দোয়া ও ভালোবাসায় হয়তো মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে সুস্থ করে দিবেন। যারা এই কঠিন সময়ে আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন—আমার প্রিয় বন্ধু-বান্ধবী, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ, বড় আপু-ভাই, ছোট ভাই-বোন, এমনকি অনেক অনেক অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষী—আপনাদের প্রতি আমি চিরঋণী।
জানি না, ভবিষ্যতে কখনো এই কৃতজ্ঞতা আপনাদের সামনে প্রকাশ করার সুযোগ হবে কি না। তাই আজই, এই মুহূর্তে, যদি আমার কোনো আচরণ বা কথায় কেউ কখনো কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
আমার একটাই অনুরোধ —আপনারা সবাই আমার জন্য আবারও একটু দোয়া করবেন। এই অনিশ্চয়তা আর সংগ্রামের পথ যেন আমি সাহস নিয়ে পাড়ি দিতে পারি, যেন আবার ফিরে আসতে পারি আপনাদের মাঝে, সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ হিসেবে।
আমি পার্থ, বিশ্বাস করি—আশীর্বাদ আর ভালোবাসায় মৃত্যুকেও জয় করা যায়। ❞
ডা.পার্থ প্রতিম সেন
২৭ তম বি.ডি.এস
সেশন : ২০১৫-১৬
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল ইউনিট।
✪ ছবি : ইটার্ণ ডাক্তার শপথ অনুষ্ঠানে ডাঃ পার্থ, বাবা-মাসহ