03/05/2024
সূরা আন নূর - (النّور) ১ ও ২ নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর-
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ
سُوۡرَۃٌ اَنۡزَلۡنٰہَا وَفَرَضۡنٰہَا وَاَنۡزَلۡنَا فِیۡہَاۤ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ لَّعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ
অর্থঃ এটা একটি সূরা, এটা আমি অবতীর্ণ করেছি এবং এটার বিধান-কে অবশ্যপালনীয় করেছি, এতে আমি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
اَلزَّانِیَۃُ وَالزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّلَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَلۡیَشۡہَدۡ عَذَابَہُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
অর্থঃ ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী-এদের প্রত্যেককে এক শত কশাঘাত করবে, আল্লাহ্ র বিধান কার্যকরীকরণে এদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহে এবং পরকালে বিশ্বাসী হও; মু’মিনদের একটি দল যেন এদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।
তাফসীরঃ
১. ‘একশত চাবুক’ এটা ব্যভিচারের শাস্তি। কুরআন মাজীদ ব্যভিচারকারী নারী-পুরুষ প্রত্যেকের জন্য এ শাস্তি নির্ধারণ করেছে। পরিভাষায় এ শাস্তিকে ব্যভিচারের ‘হদ্দ’ বলে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিভিন্ন বাণী ও বাস্তব কর্ম দ্বারা ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন যে, ব্যভিচার কোন অবিবাহিত পুরুষ বা অবিবাহিতা নারী করলে তখনই এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে এ অপরাধ যদি কোন বিবাহিত পুরুষ বা বিবাহিতা নারী করে, তবে সেক্ষেত্রে এ শাস্তি প্রযোজ্য নয়। তাদের শাস্তি হল ‘রজম’ করা অর্থাৎ, পাথর মেরে হত্যা করা। এ মাসআলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমার রচিত ‘আদালতী ফায়সালা’ শীর্ষক বইখানি দেখা যেতে পারে।
তাফসীর: মা’আরেফুল কুরআন
সূরা নূরের কতিপয় বৈশিষ্ট্যঃ এই সূরার অধিকাংশ বিধান সতীত্বের সংরক্ষণ ও পর্দাপুশিদা সম্পর্কিত। এরই পরিপূরক হিসাবে ব্যভিচারের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী সূরা আল-মু’মিনূনে মুসলমানদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্য যেসব গুণের উপ নির্ভরশীল রাখা হয়েছিল, তন্মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ ছিল যৌনাঙ্গকে সংযত রাখ। এটাই সতীত্ব অধ্যায়ের সারমর্ম। এ সূরায় সতীত্বকে গুরুত্বদানের জন্যে এতদসম্পর্কিত বিধানাবলী আলোচিত হয়েছে। এ কারণেই নারীদেরকে এই সূরা শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশেষ নির্দেশ রয়েছে। হযরত উমর ফারূক (রা) কুফাবাসীদের নামে এক ফরমানে লিখেছেন :علموا نسائكم سورة النور অর্থাৎ তোমাদের নারীদেরকে সূরা আন-নূর শিক্ষা দাও। এ সূরার ভূমিকা যে ভাষায় রাখা হয়েছে; سُورَةٌ أَنْزَلْنَاهَا وَفَرَضْنَاهَا অর্থাৎ এটাও এ সূরার বিশেষ গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
এটা একটা সূরা, যা (অর্থাৎ যার ভাষাও) আমি (ই) অবতীর্ণ করেছি, যা (অর্থাৎ যার অর্থসম্ভার তথা বিধানাবলীও) আমি (ই) নির্ধারিত করেছি (ফরয হোক কিংবা ওয়াজিব, মনদূব হোক কিংবা মুস্তাহাব) এবং আমি (এসব বিধান বুঝানোর জন্য) এতে (অর্থাৎ এই সূরায়) সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝ এবং আমল কর)। ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ উভয়ের বিধান এই যে,) তাদের প্রত্যেককে একশ দুররা মার এবং তাদের ব্যাপারে তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয় (যেমন দয়ার বশবর্তী হয়ে ছেড়ে দাও কিংবা শাস্তি হ্রাস করে দাও), যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। তাদের শাস্তির সময় মুসলমানদের একটি দল যেন উপস্থিত থাকে (যাতে তাদের লাঞ্ছনা হয় এবং দর্শক ও শ্রোতারা শিক্ষা গ্রহণ করে)।
এ সূরার প্রথম আয়াত ভূমিকাস্বরূপ, যদ্দ্বারা এর বিধানাবলীর বিশেষ গুরুত্ব বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। বিধানাবলীর মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যভিচারের শাস্তি—যা সূরার উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সতীত্ব ও তজ্জন্যে দৃষ্টির হিফাযত, অনুমতি ব্যতিরেকে কারও গৃহে যাওয়া ও দৃষ্টিপাত করার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত বিধানাবলী পরে বর্ণিত হবে। ব্যভিচার সতর্কতার এমন বাধা ডিঙ্গিয়ে সতীত্বের বিপক্ষে চরম সীমায় উপনীত হওয়া এবং আল্লাহর বিধানাবলীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করার নামান্তর। এ কারণেই ইসলামে মানবিক অপরাধসমূহের যেসব শাস্তি কোরআনে নির্ধারিত রয়েছে, তন্মধ্যে ব্যভিচারের শাস্তি সবচাইতে কঠোর ও অধিক। ব্যতিচার স্বয়ং বৃহৎ অপরাধ; তদুপরি সে নিজের সাথে আরও শত শত অপরাধ নিয়ে আসে এবং সমগ্র মানবতার ধ্বংসের আকারে এর ফলাফল প্রকাশ পায়। পৃথিবীতে যত হত্যা ও লুণ্ঠনের ঘটনাবলী সংঘটিত হয়; অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ ঘটনার কারণ কোন নারী ও তার সাথে অবৈধ সম্পর্ক। তাই সবার প্রথমে এই চরম অপরাধ ও নির্লজ্জতার মূলোৎপাটনের জন্য এর শরীয়তানুগ শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।
ব্যতিচার একটি মহা অপরাধ এবং অনেক অপরাধের সমষ্টি; তাই শরীয়তে এর শাস্তিও সর্ববৃহৎ রাখা হয়েছেঃ কোরআন পাক ও মৃতাওয়াতির হাদীস চারটি অপরাধের শাস্তি ও তার পন্থা স্বয়ং নির্ধারিত করেছে এবং কোন বিচারক ও শাসনকর্তার মতামতের পর ন্যস্ত করেনি। এসব নির্দিষ্ট শাস্তিকে শরীয়তের পরিভাষায় ’হুদূদ’ বলা হয়। এগুলো ছাড়া অবশিষ্ট অপরাধের শাস্তি এভাবে নির্ধারিত করা হয়নি; বরং শাসনকর্তা অথবা বিচারক অপরাধীর অবস্থা; অপরাধের গুণাগুণ, পরিবেশ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে যে পরিমাণ শাস্তিকে অপরাধ দমনের জন্য যথেষ্ট মনে করে, সেই পরিমাণ শাস্তি দিতে পারে । এ ধরনের শাস্তিকে শরীয়তের পরিভাষায় ’তা’যীরাত’ (দণ্ড) বলা হয়। হুদূদ চারটিঃ চুরি, কোন সতীসাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ, মদ্যপান করা এবং ব্যভিচার করা। এগুলোর মধ্যে প্রত্যেক অপরাধই স্বস্থলে গুরুতর জগতের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক এবং অনেক অপরাধের সমষ্টি: কিন্তু সবগুলোর মধ্যেও ব্যভিচারের অশুভ পরিণতি মানবিক সমাজ ব্যবস্থাকে যেমন মারাত্মক আঘাত হানে, তেমনি বোধ হয় অন্য কোন অপরাধে নেই।
(১) কোন ব্যক্তির কন্যা, ভগিনী ও স্ত্রীর উপর হাত রাখা তাকে ধ্বংস করার নামান্তর। সম্ভ্রান্ত মানুষের কাছে ধন-সম্পদ, সহায়-সম্পত্তি ও নিজের সর্বস্ব কোরবানী করা যতটুকু কঠিন নয়, যতটুকু তার অন্দরমহলের উপর হাত রাখা কঠিন। এ কারণেই দুনিয়াতে রোজই এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয় যে, যাদের অন্দরমহলের উপর হাত রাখা হয়, তারা জীবন পণ করে ব্যভিচারীর প্রাণ সংহার করতে উদ্যত হয় এবং এই প্রতিশোধস্পৃহা বংশের পর বংশকে বরবাদ করে দেয়।
(২) যে সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যভিচার ব্যাপক আকার ধারণ করে, সেখানে কারও বংশই সংরক্ষিত থাকে না; জননী, ভগিনী, কন্যা ইত্যাদির সাথে বিবাহ হারাম যখন এসব সম্পর্কও বিলীন হয়ে যায়, তখন আপন কন্যা ও ভগিনীকেও বিবাহে আনার সম্ভাবনা আছে, যা ব্যভিচারের চাইতেও কঠোরতম অপরাধ।
(৩) চিন্তা করলে দেখা যায় যে, জগতের যেখানেই অশান্তি ও অনর্থ দেখা দেয়, তার অধিকাংশ কারণই নারী এবং তার চাইতে কম কারণ অর্থসম্পদ। যে আইন নারী ও ধন-সম্পদের সংরক্ষণ সঠিকভাবে করতে পারে এবং তাদেরকে নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেতে না দেয়, সেই আইনই বিশ্বশান্তির রক্ষাকবচ হতে পারে। এটা ব্যভিচারের যাবতীয় অনিষ্ট ও অপকারিতা সন্নিবেশিত করা ও বিস্তারিত বর্ণনা করার স্থান নয়। মানব সমাজের জন্য এর ধ্বংসকারিতা জানার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। এ কারণেই ইসলাম ব্যভিচারের শাস্তিকে অন্যান্য অপরাদের শাস্তির চাইতে কঠোরতর করেছে। আলোচ্য আয়াতে এই শাস্তি এভাবে বর্ণিত হয়েছে । الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ এতে ব্যভিচারিণী নারীকে আর এবং ব্যভিচারী পুরুষকে পরে উল্লেখ করা হয়েছে। শাস্তি উভয়ের একই। বিধানাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে সাধারণ রীতি এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু পুরুষদেরকে সম্বোধন করে আদেশ দান করা হয়, নারীরাও এতে প্রসঙ্গত অন্তর্ভুক্ত থাকে তাদেরকে পৃথকভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজনই মনে করা হয় না। সমগ্র কোরআনে يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا পুংলিঙ্গ পদবাচ্য ব্যবহার করে যেসব বিধান বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোতে নারীরাও উল্লেখ ছাড়াই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সম্ভবত এর রহস্য এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা নারী জাতিকে সংগোপনে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনিভাবে তাদের আলোচনাকেও পুরুষদের আলোচনার আবরণে ঢেকে রাখা হয়েছে। তবে এই পদ্ধতিদৃষ্টে কেউ এরূপ সন্দেহ করতে পারত যে, এসব বিধান পুরুষদের জন্যই নির্দিষ্ট, নারীরা এগুলো থেকে মুক্ত। তাই বিশেষ বিশেষ আয়াতসমূহে স্বতন্ত্রভাবে নারীদের উল্লেখও করে দেওয়া হয়; যেমন وأقمن الصلوة وآتين الزكوة যে ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের উল্লেখ উদ্দেশ্য থাকে, সেখানে স্বাভাবিক ক্রম এরূপ হয় যে, অগ্রে পুরুষ ও পশ্চাতে নারীর উল্লেখ থাকে। চুরির শাস্তি বর্ণনা প্রসঙ্গে এই স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا বলা হয়েছে। এতে চোর পুরুষকে চোর নারীর অগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যভিচারের শাস্তি বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রথমত: নারীর উল্লেখ প্রসঙ্গত রাখাকে যথেষ্ট মনে করা হয়নি; বরং স্পষ্টত উল্লেখকেই উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয় নারীকে পুরুষের অগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এতে অনেক রহস্য নিহিত আছে। নারী অবলা এবং তাকে স্বভাবতই দয়ার পাত্রী করা হয়। তাকে স্পষ্টত উল্লেখ করা না হলে কেউ সন্দেহ করতে পারত যে, সম্ভবত নারী এই শাস্তির আওতাধীন নয়। নারীকে অগ্রে উল্লেখ করার কারণ এই যে, ব্যভিচার একটি নির্লজ্জ কাজ। নারী দ্বারা এটা সংঘটিত হওয়া চরম নিৰ্ভীকতা ও ঔদাসীন্যের ফলেই সম্ভবপর। কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা তার স্বভাবে মজ্জাগতভাবে লজ্জা ও সতীত্ব সংরক্ষণের শক্তিশালী প্রেরণা গচ্ছিত রেখেছেন এবং তার হিফাযতের অনেক ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন। কাজেই তার পক্ষ থেকে এ কাজ ঘটা -পুরুষের তুলনায় অধিকতর অন্যায়। চোরের অবস্থা এর বিপরীত। পুরুষকে আল্লাহ তায়ালা উপার্জনের শক্তি দিয়েছেন। তাকে গায়ে খেটে নিজের প্রয়োজনাদি মিটানোর সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। এগুলো বাদ দিয়ে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করা পুরুষের জন্য খুবই ও দোষের কথা। নারীর অবস্থা তদ্রূপ নয়। সে চুরি করলে পুরুষের তুলনায় তা লঘু স্বল্পস্তরের অপরাধ হবে।
جلد — فَاجْلِدُوا
শব্দের অর্থ চাবুক মারা। শব্দটি جلد (চামড়া) থেকে উদ্ভূত। কারণ, চাবুক সাধারণত চামড়া দ্বারা তৈরি করা হয়। কোন কোন তফসীরকার বলেনঃ جلد শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, এই কশাঘাতের প্রতিক্রিয়া চামড়া পর্যন্তই সীমিত থাকা চাই এবং মাংস পর্যন্ত না পৌঁছা চাই। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) কশাঘাতের শাস্তিতে কার্যের মাধ্যমে এই মিতাচার শিক্ষা দিয়েছেন যে, চাবুক যেন এত শক্ত না হয়, মাংস পর্যন্ত উপড়ে যায় এবং এমন নরমও যেন না হয় যে, বিশেষ কোন কষ্টই অনুভূত না হয়। এস্থলে অধিকাংশ তফসীরবিদ এই হাদীসটি সনদ ও ভাষাসহ উল্লেখ করেছেন।
একশ কশাঘাতের উল্লিখিত শাস্তি শুধু অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট, বিবাহিতদের শাস্তি প্রস্তরাঘাতে হত্যা করাঃ স্মর্তব্য যে, ব্যভিচারের শাস্তি সংক্রান্ত বিধি-বিধান পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ হয়েছে এবং লঘু থেকে গুরুতরের দিকে উন্নীত হয়েছে : যেমন মদের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কেও এমনি ধরনের পর্যায়ক্রমিক বিধান স্বয়ং কোরআনে বর্ণিত আছে। এর বিস্তারিত বিবরণ পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কিত সর্বপ্রথম বিধান সূরা নিসার ১৫ ও ১৬ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আয়াতদ্বয় এই
وَاللَّاتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِنْ نِسَائِكُمْ فَاسْتَشْهِدُوا عَلَيْهِنَّ أَرْبَعَةً مِنْكُمْ فَإِنْ شَهِدُوا فَأَمْسِكُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ حَتَّى يَتَوَفَّاهُنَّ الْمَوْتُ أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا - وَاللَّذَانِ يَأْتِيَانِهَا مِنْكُمْ فَآذُوهُمَا فَإِنْ تَابَا وَأَصْلَحَا فَأَعْرِضُوا عَنْهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ تَوَّابًا رَحِيمًا
তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচার করে, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের চারজন পুরুষকে সাক্ষী আন। যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তবে নারীদেরকে গৃহে আবদ্ধ রাখ যে পর্যন্ত তাদের মৃত্যু ঘটে অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন পথ করে দেন এবং তোমাদের মধ্যে যে পুরুষ এই অপকর্ম করে তাকে শাস্তি দাও। অতঃপর সে যদি তওবা করে সংশোধিত হয়ে যায়, তবে তাদের চিন্তা পরিত্যাগ কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তওবা কবূলকারী, দয়ালু।" এই আয়াতদ্বয়ের পূর্ণ তফসীর সূরা নিসায় বর্ণিত হয়েছে। ব্যভিচারের শাস্তির প্রাথমিক যুগ সম্মুখে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে এখানে আয়াতদ্বয়ের পুনরুল্লেখ করা হলো। আয়াতদ্বয়ে প্রথমত ব্যভিচার প্রমাণের বিশেষ পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। যে, চারজন পুরুষের সাক্ষ্য দরকার হবে। দ্বিতীয়ত ব্যভিচারের শাস্তি নারীর জন্য গৃহে আবদ্ধ রাখা এবং উভয়ের জন্য কষ্ট প্রদান করা উল্লিখিত হয়েছে। এতদসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, ব্যভিচারের শাস্তি সংক্রান্ত এই বিধান সর্বশেষ নয় ভবিষ্যতে অন্য বিধান আসবে। আয়াতের أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا অংশের মর্ম তাই।
উল্লিখিত শাস্তিতে নারীদেরকে গৃহে অন্তরীণ রাখাকে তখনকার মত যথেষ্ট মনে করা হয়েছে এবং উভয়কে শাস্তি প্রদানের শাস্তিও যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এই শাস্তি ও কষ্ট প্রদানের কোন বিশেষ আকার পরিমাণ ও সীমা বর্ণনা হয়নি। বরং কোরআনের ভাষা থেকে জানা যায় যে, ব্যভিচারের প্রাথমিক শাস্তি শুধু ’তা’যীর’ তথা দণ্ডবিধির আওতাধীন ছিল, যার পরিমাণ শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়নি; বরং বিচারক ও শাসনকর্তার বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই আয়াতে ’কষ্ট প্রদানের’ অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সাথে সাথেই أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে এসব অপরাধীর জন্য অন্য ধরনের শাস্তি প্রবর্তিত হওয়া অসম্ভব নয়। সূরা নূরের উল্লিখিত আয়াত অবতীর্ণ হলে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস মন্তব্য করলেন: সূরা নিসায় أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا বলে যে ওয়াদা করা হয়েছিল যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্য অন্য কোন পথ করবেন, সূরা নূরের এই আয়াত সেই পথ ব্যক্ত করে দিয়েছে ; অর্থাৎ পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য একশ কশাঘাত করার শাস্তি নির্ধারিত করে দিয়েছে। এতদসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস একশ কশাঘাতের শাস্তিকে অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট করে বললেন :يعنى الرجم للثيب والجلد للبكر অর্থাৎ সেই পথ ও ব্যভিচারের শাস্তি নির্ধারণ এই যে, বিবাহিত পুরুষ ও নারী এ অপরাধ করলে তাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে এবং অবিবাহিত পুরুষ ও নারী করলে একশ কশাঘাত করা হবে।
বলা বাহুল্য, সূরা নূরের আলোচ্য আয়াতে কোনরূপ বিবরণ ছাড়াই ব্যভিচারের শাস্তি একশ কশাঘাত বর্ণিত হয়েছে। এই বিধান যে অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট এবং বিবাহিত পুরুষ ও নারীর শাস্তি প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা-একথা হযরত ইবনে আব্বাস কোন হাদীসের প্রমাণ থেকে জেনে থাকবেন। সেই হাদীসটি সহীহ মুসলিম মুসনাদে আহমদ, সুনানে নাসায়ী, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজায় ওবাদা ইবনে সামিতের রেওয়ায়েতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে :
خُذُوا عَنِّي، خُذُوا عَنِّي، قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا، الْبِكْرُ بِالْبِكْرِ جَلْدُ مِائَةٍ وَتَغْرِيبُ عَامٍ، وَالثَّيِّبُ بِالثَّيِّبِ جَلْدُ مِائَةٍ وَالرَّجْمُ
রাসুল্লাহ (সা) বলেনঃ আমার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন কর, আল্লাহ্ তা’আলা ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীর জন্য সূরা নিসায় প্রতিশ্রুত পথ সূরা নূরে বাৎলে দিয়েছেন। তা এই যে, অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য একশ কশাঘাত ও এক বছরের নির্বাসন এবং বিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য একশ কশাঘাত ও প্রস্তরাঘাতে হত্যা। (ইবনে কাসীর)
সূরা নূরে উল্লিখিত অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর শান্তি একশ কশাঘাতের সাথে এই হাদীসে একটি বাড়তি সাজা উল্লেখ করা হয়েছে। তা এই যে, পুরুষকে এক বছরের জন্য দেশান্তরিত করতে হবে। দেশান্তরিত করার এই শাস্তি পুরুষের জন্য একশ কশাঘাতের ন্যায় অপরিহার্য, না বিচারকের বিবেচনার উপর নির্ভরশীল যে, তিনি প্রয়োজনবোধ করলে এক বছরের জন্য দেশান্তরিতও করে দেবেন-এ ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমাম আযমের মতে শেষোক্ত মতই নির্ভুল; অর্থাৎ বিচারকের বিবেচনার উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত এই হাদীসে বিবাহিত পুরুষ ও নারীর শাস্তি প্রস্তরাঘাতে হত্যা-এর আগে একশ’ কশাঘাতের শাস্তিও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য হাদীস এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও সাহাবায়ে কিরামের কার্যপ্রণালী থেকে প্রমাণিত রয়েছে যে, উভয় প্রকার শাস্তি একত্রিত হবে না। বিবাহিতকে শুধু প্রস্তরাঘাতে হত্যাই করা হবে। এই হাদীসে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এতে أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا আয়াতের তফসীর করেছেন। তফসীরে সূরা নূরের আয়াতে বিধৃত একশ কশাঘাতের উপর কতিপয় অতিরিক্ত বিষয়ও সংযুক্ত হয়েছে। প্রথম, একশ কশাঘাতের শাস্তি অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট হওয়া; দ্বিতীয়, এক বছরের জন্য দেশান্তরিত করা এবং তৃতীয়, বিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য প্রস্তরাঘাতে হত্যা করার বিধান। বলা বাহুল্য, সূরা নূরের আয়াতের উপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যেসব বিষয়ের বাড়তি সংযোজন করেছেন, এগুলোও আল্লাহর ওহী ও আল্লাহর আদেশ বলেই ছিল। إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى পয়গম্বর ও তাঁর কাছ থেকে যারা সরাসরি শোনে, তাদের পক্ষে পঠিত ওহী অর্থাৎ কোরআন ও অপঠিত ওহী উভয়ই সমান। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবায়ে কিরামের বিপুল সমাবেশের সামনে এই বিধান কার্যে পরিণত করেছেন। মা’এয ও গামেদিয়ার উপর তিনি প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান জারি করেছেন, যা সব হাদীসগ্রন্থে সহীহ সনদসহ বর্ণিত আছে। বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হযরত আবূ হুরায়রা ও যায়দ ইবনে খালেদ জোহানীর রেওয়ায়েতে আছে, জনৈকা বিবাহিতা মহিলার সাথে তার অবিবাহিত চাকর ব্যভিচার করে। ব্যভিচারীর পিতা তাকে নিয়ে রাসূলূল্লাহ (সা)ম -এর কাছে উপস্থিত হয়। স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ঘটনা প্রমাণিত হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ لاقضين بينكما بكتاب الله অর্থাৎ আমি তোমাদের ব্যাপারে ফয়সালা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী করব। অতঃপর তিনি আদেশ দিলেন যে, ব্যভিচারী অবিবাহিত ছেলেকে একশ কশাঘাত কর। তিনি বিবাহিতা মহিলাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করার জন্য হযরত উনায়সকে আদেশ দিলেন। উনায়স নিজে মহিলার জবানবন্দি নিলে সেও স্বীকারোক্তি করল। তখন তার উপর প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান প্রয়োগ করা হলো।-(ইবনে কাসীর) এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) একজনকে একশ কশাঘাত এবং অপরজনকে প্রস্তরাঘাতে হত্যার শাস্তি দিয়েছেন। তিনি উভয় শাস্তিকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা বলেছেন; অথচ নূরের আয়াতে শুধু একশ কশাঘাতের শাস্তি উল্লিখিত হয়েছে—প্রস্তরাঘাতে হত্যার শাস্তি উল্লিখিত নেই। কারণ এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ওহীর মাধ্যমে এই আয়াতের তফসীর ও ব্যাখ্যা পুরোপুরি বলে দিয়েছিলেন। কাজেই এই তফসীর আল্লাহর কিতাবেরই অনুরূপ, যদিও তার কিছু অংশ আল্লাহর কিতাবে উল্লিখিত ও পঠিত নেই। বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর ভাষণ হযরত ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে। মুসলিমের ভাষায় :
قال عمر بن الخطاب وهو جالس على منبر رسول الله صلى الله عليه وسلم إن الله بعث محمدا صلعم بالحق وأنزل عليه الكتاب فكان مما أنزل الله عليه اية الرجـم قـرأنـاهـا ووعـيـنـاهـا وعـقـلنـاهـا فـرجـم رسول الله ﷺ ورجمنا بعده فاخشى ان طـال بـالـنـاس زمـان ان يـقـول قـائـل مـا نـجـد الرجم في كتاب الله تعالى فيـضـلـوا بـتـركـه فـريـضـة انزلها الله وإن الرجم في كتاب الله حق على من زنا إذا حصن من الرجال والنساء إذا قامت البينة او كان الحبل أو الاعتراف
হযরত উমর ফারুক (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মিম্বরে উপবিষ্ট অবস্থায় বললেন : আল্লাহ্ তা’আলা মুহাম্মদ (সা)-কে সত্যসহ প্রেরণ করেন এবং তাঁর প্রতি কিতাব নাযিল করেন। কিতাবে যেসব বিষয় অবতীর্ণ হয়, তন্মধ্যে প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধানও ছিল, যা আমরা পাঠ করেছি, স্মরণ রেখেছি এবং হৃদয়ঙ্গম করেছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা)-ও প্রস্তরাঘাতে হত্যা করেছেন এবং তাঁর পরে আমরাও করেছি। এখন আমি আশংকা করছি যে, সময়ের চাকা আবর্তিত হওয়ার পর কেউ একথা বলতে না শুরু করে যে, আমরা প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে পাই না। ফলে সে একটি ধর্মীয় কর্তব্য পরিত্যাগ করার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন। মনে রেখ, প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে সত্য এবং বিবাহিত পুরুষ ও নারীর প্রতি প্রযোজ্য—যদি ব্যভিচারের শরীয়ত সম্মত সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত হয় অথবা গর্ভ ও স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। (মুসলিম ২য় খণ্ড, ৬৫ পৃঃ)।
এই রেওয়ায়েত সহীহ্ বুখারীতে আরও বিস্তারিত বর্ণিত আছে। (বুখারী, ২য় খণ্ড ১০০৯ পৃঃ) নাসায়ীতে এই রেওয়ায়েতের ভাষা এরূপ :
أنا لا نجد من الرجـم بـدا فـانـه حد من حدود الله ألا وإن رسول قد رجم ورجمنا بعده ولولا أن يقول قائلون ان عمر زاد في كتاب الله ما ليس فيه لكتبت في ناحية الـمـصـحـف وشهد عمر بن الخطاب وعبد الرحمن بن عوف وفلان وفلان ان رسول الله ﷺ رجم ورجمنا بعده
“শরীয়তের দিক দিয়ে আমরা ব্যভিচারের শান্তিতে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে বাধ্য। কেননা, এটা আল্লাহর অন্যতম হদ। মনে রেখ, রাসূলুল্লাহ্ (সা) রজম করেছেন এবং আমরা তার পরেও রজম করেছি। যদি এরূপ আশংকা না থাকত যে, লোকে বলবে উমর আল্লাহর কিভাবে নিজের পক্ষ থেকে সংযোজন করেছেন, তবে আমি কোরআনের এক প্রান্তে এটা লিখে দিতাম। উমর ইবনে খাত্তাব, আবদুর রহমান ইবনে আউফ এবং অমুক অমুক সাক্ষী যে, রাসূলুল্লাহ (সা) রজম করেছেন এবং তাঁর পরে আমরা রজম করেছি।—(ইবনে কাসীর)
হযরত উমর ফারূক (রা)-এর এই ভাষণ থেকে বাহ্যত প্রমাণিত হয় যে, সুরা নূরের আয়াত ছাড়া রজম সম্পর্কিত একটি স্বতন্ত্র আয়াত আছে। কিন্তু হযরত উমর সেই আয়াতের ভাষা প্রকাশ করেননি। তিনি একথাও বলেননি যে, সেই স্বতন্ত্র আয়াতটি কোরআনে কেন নেই এবং তা পঠিত হয় না কেন? তিনি শুধু বলেছেন, আমি আল্লাহর কিতাবে সংযোজন করেছি এই মর্মে দোষারোপের আশংকা না থাকলে আমি আয়াতটি কোরআনের প্রান্তে লিখে দিতাম। – (নাসায়ী)
এই রেওয়ায়েতে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, সেটা যদি বাস্তবিকই কোরআনের আয়াত হয় এবং পাঠ করা ওয়াজিব হয়, তবে হযরত উমর মানুষের নিন্দাবাদের ভয়ে একে কিরূপে ছেড়ে দিলেন, অথচ ধর্মের ব্যাপারে তাঁর কঠোরতা প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত। এখানে আরও প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, হযরত উমর একথা বলেননি আমি এই আয়াতকে কোরআনে দাখিল করে দিতাম; বরং বলেছেন, আমি একে কোরআনের প্রান্তে লিখে দিতাম।
এসব বিষয় ইঙ্গিত বহন করে যে, হযরত উমর (রা) সূরা নূরের উল্লিখিত আয়াতের যে তফসীর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে শুনেছিলেন, যাতে তিনি একশ কশাঘাত করার বিধান অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন এবং বিবাহিতের জন্য রজমের বিধান দিয়েছিলেন, সেই তফসীরকে এবং তদনুযায়ী রাসূল (সা)-এর কার্যপ্রণালীকে তিনি আল্লাহর কিতাব ও কিতাবের আয়াত শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। এর মর্ম এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এই তফসীর ও বিবরণ কিতাবের হুকুম রাখে, স্বতন্ত্র আয়াত নয়। নতুবা এই পরিত্যক্ত আয়াতকে কোরআনের অন্তর্ভুক্ত করে দিতে কোন শক্তিই তাঁকে বাধা দিতে পারত না। প্রান্তে লিখে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশও এ বিষয়ের প্রমাণ যে, সেটা স্বতন্ত্র কোন আয়াত নয়; বরং সূরা নূরের আয়াতের কিছু ব্যাখ্যা ও বিবরণ। কোন কোন রেওয়ায়েতে এস্থলে স্বতন্ত্র আয়াত বলা হয়েছে। এসব রেওয়ায়েতে সনদ ও প্রমাণের দিক দিয়ে এরূপ নয় যে, এগুলোর ভিত্তিতে কোরআনে একে সংযুক্ত করা যায়। ফিকহবিদগণ একে “তিলাওয়াত মনসুখ, বিধান মনসূখ নয়" এর দৃষ্টান্তে পেশ করেছেন। এটা নিছক দৃষ্টান্তই মাত্র। এতে প্রকৃতপক্ষে এর কোরআনী আয়াত হওয়া প্রমাণিত হয় না।
সারকথা এই যে, সূরা নূরের উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষের একশ কশাঘাতের শান্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ব্যাখ্যা ও তফসীরের ভিত্তিতে অবিবাহিতদের জন্য নির্দিষ্ট এবং বিবাহিতদের শাস্তি রজম। এই বিবরণ আয়াতে উল্লিখিত না থাকলেও যে পবিত্র সত্তার প্রতি আয়াত নাযিল হয়েছিল, তার পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন:ভাষায় বর্ণিত আছে। শুধু মৌখিক শিক্ষাই নয়; বরং সাহাবায়ে কিরামের সামনে একাধিকবার বাস্তবায়ন ও প্রমাণিত রয়েছে। এই প্রমাণ আমাদের নিকট পর্যন্ত ’তাওয়াতুর’ তথা সন্দেহাতীত বর্ণনা পরস্পরার মাধ্যমে পৌঁছেছে। তাই বিবাহিত পুরুষ ও নারীর এই বিধানে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কিতাবের বিধান। একথাও বলা যায় যে, রজমের শাস্তি মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা অকাট্যরূপে প্রমাণিত। হযরত আলী (রা) থেকে একথাই বর্ণিত আছে। উভয় বক্তব্যের সারমর্মই একরূপ।
জরুরী জ্ঞাতব্যঃ এ স্থলে বিবাহিত ও অবিবাহিত শব্দগুলো শুধু সহজভাবে ব্যক্তকরণের উদ্দেশ্যে লিখিত হয়েছে। আসলে ’মুহসিন’ ও ‘গায়র মুহসিন’ অথবা ’সাইয়েব’ ও ‘বিকর’ শব্দই হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে। শরীয়তের পরিভাষায় মুহসিন এমন জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে শুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীর সাথে সহবাস করেছে। বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সর্বত্রই এই অর্থ বুঝানো হয়। তবে সহজভাবে ব্যক্তকরণের উদ্দেশ্যে অনুবাদ শুধু বিবাহিত বলা হয়।
ব্যভিচারের শাস্তির পর্যায়ক্রমিক তিন স্তরঃ উপরোক্ত রেওয়ায়েত ও কোরআনী আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করলে বুঝা যায় প্রথমে ব্যভিচারের শাস্তি লঘু রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ বিচারক অথবা শাসনকর্তা নিজ বিবেচনা অনুযায়ী অপরাধী পুরুষ ও নারীকে কষ্ট প্রদান করবে এবং নারীকে গৃহে অন্তরীণ রাখবে। এই বিধান সূরা নিসায় বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরের বিধান সূরা নূরে বিবৃত হয়েছে যে, উভয়কে একশ করে চাবুক মারতে হবে। তৃতীয় স্তরের বিধান রাসূলুল্লাহ্ (সা) উল্লিখিত আয়াত নাযিল হওয়ার পর বর্ণনা করেছেন। যে, অবিবাহিতদের বেলায় শুধু একশ’ কশাঘাত করতে হবে। কিন্তু বিবাহিতদের শাস্তি রজম তথা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা।
ইসলামী আইনে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ প্রমাণের জন্য শর্তাবলীও কড়া রাখা হয়েছেঃ উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি সর্বাধিক কঠোর। এতদসঙ্গে ইসলামী আইনে এই অপরাধ প্রমাণের জন্য শর্তাবলী ও অত্যন্ত কড়া আরোপ করা হয়েছে, যাতে সামান্যও ত্রুটি থাকলে অথবা সন্দেহ দেখা দিলে ব্যভিচারের চরম শাস্তি হদ মাফ হয়ে শুধু দণ্ডমূলক শাস্তি অপরাধ অনুযায়ী অবশিষ্ট থেকে যায়। অন্যান্য ব্যাপারাদিতে দুইজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুইজন নারীর সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়; কিন্তু ব্যভিচারের হদ জারি করার জন্য চারজন পুরুষ সাক্ষীর চাক্ষুষ ও দ্ব্যর্থহীন সাক্ষ্য জরুরী; যেমন সূরা নিসার আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এই সাক্ষ্য দ্বিতীয় সাবধানতা ও কঠোরতা এই যে, যদি সাক্ষ্যের জরুরী কোন শর্ত অনুপস্থিত থাকার কারণে সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে সাক্ষ্যদাতাদের নিস্তার নেই। ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপের অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাদের উপর হদ্দে কযফ’ জারি করা হবে ; অর্থাৎ আশিটি বেত্রাঘাত করা হবে। তাই সামান্য সন্দেহ থাকলে কোন ব্যক্তি এই সাক্ষ্য দানে অগ্রসর হবে না। যদি সুস্পষ্ট ব্যভিচারের প্রমাণ না থাকে, কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা দুইজন পুরুষ ও নারীর অবৈধ অবস্থায় পরিলক্ষিত হওয়া প্রমাণিত হয়, তবে বিচারক তাদের অপরাধের অনুপাতে দণ্ডমূলক শাস্তি বেত্রাঘাত ইত্যাদি জারি করতে পারেন। এর শর্তাবলী সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাবলী ফিকাহ গ্রন্থাদিতে দ্রষ্টব্য।
পুরুষ কোন পুরুষের সাথে অথবা জন্তুর সাথে অপকর্ম করলে তা ব্যভিচারের অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা এবং এর শাস্তিও ব্যভিচারের শাস্তি কিনা, এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সূরা নিসার তফসীরে করা হয়েছে। তা এই যে, অভিধানে ও পরিভাষায় যদিও একে ব্যভিচার বলা হয় না, তাই হদ প্রযোজ্য নয়; কিন্তু এর শাস্তিও কঠোরতায় ব্যভিচারের শাস্তির চাইতে কম নয়। সাহাবায়ে কিরাম এরূপ ব্যক্তিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার শাস্তি দিয়েছেন।
وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ
—ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর বিধায় শাস্তি প্রয়োগকারীদের তরফ থেকে দয়াপরবশ হয়ে শাস্তি ছেড়ে দেওয়ার কিংবা হ্রাস করার সম্ভাবনা আছে। তাই সাথে সাথে আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, ধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান কার্যকরকরণে অপরাধীদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়া বৈধ নয়। দয়া অনুকম্পা ও ক্ষমা সর্বত্র প্রশংসনীয়; কিন্তু অপরাধীদের প্রতি দয়া করার ফল সমগ্র মানব জাতির প্রতি নির্দয় হওয়া। তাই এটা নিষিদ্ধ ও অবৈধ।
وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
—অর্থাৎ ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগ করার সময় মুসলমানদের একটি দল উপস্থিত থাকা বাঞ্ছনীয়। ইসলামে সব শাস্তি বিশেষত হুদুদ প্রকাশ্য স্থানে প্রয়োগ করার পদ্ধতি প্রচলিত আছে, যাতে দর্শকরা শিক্ষালাভ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে একদল লোককে উপস্থিত থাকার আদেশ দান ব্যভিচারের শাস্তির বৈশিষ্ট্য।
ইসলামে প্রথম পর্যায়ে অপরাধ গোপন রাখার বিধান আছে; কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেলে অপরাধীদের পূর্ণ লাঞ্ছনাও সাক্ষাৎ প্রজ্ঞাঃ অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজকারবার দমনের জন্য ইসলামী শরীয়ত দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পাহারা বসিয়েছে। মেয়েদের জন্য পর্দা অপরিহার্য করা হয়েছে। পুরুষদেরকে দৃষ্টি নত রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছে। অলংকারের শব্দ ও নারী কণ্ঠের গানের শব্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ, এটা নির্লজ্জ কাজে উৎসাহ যোগায়। সাথে সাথে যার মধ্যে এসব ব্যাপারে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তাকে একান্তে বুঝাবার আদেশ আছে; কিন্তু লাঞ্ছিত করার অনুমতি নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি শরীয়ত আরোপিত সাবধানতাসমূহ ডিঙিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তার অপরাধ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়ে যায়, তদবস্থায় তার অপরাধ গোপন রাখা অন্যদের সাহস বাড়ানোর কারণ হতে পারে। তাই এ পর্যন্ত অপরাধ গোপন রাখার জন্য শরীয়ত যতটুকু যত্নবান ছিল, এমন অপরাধীকে জনসমক্ষে হেয় ও লাঞ্ছিত করার জন্যও ততটুকুই যত্নবান। এ কারণেই ব্যভিচারের শাস্তি শুধু প্রকাশ্য স্থানে প্রয়োগ করেই ইসলাম ক্ষান্ত হয়নি। বরং মুসলমানদের একটি দলকে তাতে উপস্থিত থাকার ও অংশগ্রহণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।