
12/08/2025
#খালি মাঠে মাঝরাতে ছায়ার সারি দাঁড়িয়ে থাকা।
**লেখক:** অনিমেষ রায়
সালটা সম্ভবত ২০০৮ কি ২০০৯ হবে। আমি তখন সবেমাত্র ঢাকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। থাকতাম ঢাকার অদূরে, সাভারের কাছাকাছি একটা এলাকায়। সেখান থেকে প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাতায়াত করাটা বেশ কষ্টকর ছিল, তাই কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি একটা বাসা ভাড়া নেব। তাতে যাতায়াতের সুবিধা হবে, আবার একসাথে পড়াশোনাটাও করা যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমরা চার বন্ধু—আমি, সুমন, রাশেদ আর নয়ন মিলে একটা দুই রুমের মোটামুটি মানের ফ্ল্যাট খুঁজে বের করলাম। বাড়িটা একদম নতুন না হলেও বেশ পরিচ্ছন্ন ছিল, আর সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, ছাদটা ব্যবহারের অনুমতি ছিল। আমাদের আনন্দের সীমা রইল না।
বাসা নেওয়ার পরের কয়েকটা দিন খুব আনন্দে কাটলো। নতুন পরিবেশ, নতুন স্বাধীনতা। ক্লাস শেষে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেওয়া, একসাথে খাওয়া-দাওয়া, গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে বসে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া—সব মিলিয়ে সময়টা স্বপ্নের মতো কাটছিল। আমাদের ফ্ল্যাটটা ছিল চারতলা বাড়ির তিনতলায়। বাড়ির মালিক দোতলায় থাকতেন, আর নিচতলা আর চারতলা অন্য ভাড়াটেদের দখলে ছিল। বাড়ির পাশেই ছিল একটা বিশাল ফাঁকা মাঠ। দিনের বেলায় সেখানে ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলত, বিকেলে এলাকার বয়স্করা হাঁটাহাঁটি করতেন। কিন্তু রাত নামলেই মাঠটা কেমন যেন নিস্তব্ধ, অন্ধকার হয়ে যেত। মাঠের এক কোণে কয়েকটা পুরনো তালগাছ এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন রাতের আঁধারে কোনো অশরীরী প্রহরী।
ঘটনার শুরুটা হয়েছিল খুব সাধারণভাবেই। তখন শীতকাল আসন্ন। সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নেমে আসে আর রাতগুলো হয় দীর্ঘ আর শীতল। আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল, তাই রাত জেগে পড়াশোনা করাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সারাদিন ক্লাস আর পরীক্ষার পর রাতে যখন পড়তে বসতাম, রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করত। তাই ক্লান্তি দূর করতে আমরা প্রায়ই ছাদে যেতাম, কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতাম।
একদিন রাতে, আনুমানিক দেড়টা কি দুটো বাজে, আমি আর সুমন বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। বাকি দুজন তখন ঘুমে অচেতন। হালকা কুয়াশা নামতে শুরু করেছে, চারপাশটা কেমন যেন থমথমে। রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলো কুয়াশার চাদর ভেদ করে একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে। হঠাৎ করেই সুমনের চোখে পড়ল মাঠটার দিকে।
ও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিচু গলায় বলল, “কিরে, মাঠের মধ্যে ওগুলো কীসের আলো?”
আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে মাঠের দিকে তাকালাম। সত্যিই তো! মাঠের ঠিক মাঝখানে, যেখানে দিনের বেলা ছেলেরা ক্রিকেট খেলে, সেখানে কয়েকটা আবছা আলোর বিন্দু দুলছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ হারিকেন বা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। আলোটা স্থির নয়, অল্প অল্প কাঁপছে।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “এত রাতে মাঠে কে থাকবে? হয়তো এলাকার কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছে।”
সুমন মাথা নেড়ে বলল, “আরে না। এত রাতে এই ঠান্ডার মধ্যে মাঠে বসে কে আড্ডা দেবে? আর মানুষ থাকলে তো কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যেত। দেখ, কী অদ্ভুত রকম চুপচাপ চারপাশটা।”
ওর কথাটা আমারও যৌক্তিক মনে হলো। সত্যিই, কোনো শব্দ নেই। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আমরা দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম সেদিকে তাকিয়ে। আলোটা তখনও দুলছে। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, আলোর বিন্দুগুলো যেন কয়েকটা ছায়ার মতো আকৃতির চারপাশে ঘুরছে। কুয়াশার কারণে অবয়বগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে ওখানে কিছু একটা আছে।
আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল। বললাম, “চল তো ভেতরে যাই। ঠান্ডা লাগছে।” আমার গলার স্বরে হয়তো ভয়টা স্পষ্ট ছিল।
সুমন আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, “ভয় পেলি নাকি? আরে ধুর, কিছু না। হয়তো সিকিউরিটি গার্ড বা অন্য কেউ হবে।”
কিন্তু ওর কথাতেও জোর ছিল না। আমরা আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে এলাম। সেই রাতে আমার ঘুমটা ভালো হলো না। বারবার চোখ বন্ধ করলেই মাঠের ওই দুলতে থাকা আলো আর আবছা ছায়ামূর্তিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘটনাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ভার্সিটির ব্যস্ততা, ক্লাস, পরীক্ষা—এসবের চাপে রাতের ওই অদ্ভুত দৃশ্যটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল কয়েকদিন পর। সেদিন ছিল শুক্রবার, ভার্সিটি বন্ধ। আমরা সারা দিন আড্ডা দিয়ে, সিনেমা দেখে কাটিয়েছি। রাতে খাওয়ার পর সবাই মিলে ছাদে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে তারপর ঘুমাতে যাওয়া।
ছাদে ওঠার পর হিমেল হাওয়ায় শরীরটা জুড়িয়ে গেল। আকাশটা ছিল বেশ পরিষ্কার, কয়েকটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। আমরা ছাদে পাতা একটা পুরনো মাদুরে গোল হয়ে বসলাম। রাশেদ ওর ভাঙা গলায় গান ধরার চেষ্টা করছিল, আর আমরা বাকিরা হাসাহাসি করছিলাম। সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল।
হঠাৎ নয়ন বলে উঠল, “আচ্ছা, ওই মাঠটা রাতের বেলা দেখতে এমন ভয়ংকর লাগে কেন রে?”
ওর কথায় আমাদের আড্ডাটা হঠাৎ থেমে গেল। সবাই মাঠটার দিকে তাকালাম। অন্ধকার মাঠটা যেন একটা বিশাল কালো চাদর বিছিয়ে রেখেছে। তালগাছগুলো রাতের আঁধারে আরও বেশি জীবন্ত আর রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
সুমন কয়েকদিন আগের রাতের ঘটনাটা ওদের বলল। রাশেদ বরাবরই একটু সাহসী আর যুক্তিবাদী। ও সব শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “আরে ধুর, তোরা সব ভীতুর ডিম। ও কিছু না। হয়তো শেয়াল বা কুকুর দৌড়াদৌড়ি করছিল, আর তোরা কুয়াশার মধ্যে ওটাকে ছায়ামূর্তি ভেবেছিস।”
আমি বললাম, “কিন্তু আলো জ্বলছিল যে! কুকুরের হাতে তো আর হারিকেন থাকে না।”
আমার কথায় সবাই চুপ হয়ে গেল। রাশেদও আর কিছু বলল না। আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। ছাদের নীরবতায় মাঠের দিক থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁর ডাক আরও প্রকট হয়ে কানে বাজছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে, আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে মাঠের ঠিক মাঝখানটায় আবার সেই আলোটা জ্বলে উঠল। একটা নয়, দুটো নয়, সারি দিয়ে প্রায় সাত-আটটা আলো। আবছা, হলদেটে আলো। সেগুলো স্থির নয়, আগের মতোই অল্প অল্প কাঁপছে। আর সেই আলোর চারপাশে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কয়েকটা দীর্ঘ, অস্পষ্ট ছায়ার সারি। ছায়াগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে, যেন কতগুলো মানুষ সারি বেঁধে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের চারজনের মুখেই কথা সরল না। শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। রাশেদের মতো সাহসী ছেলেও ফ্যাকাশে মুখে সেদিকে তাকিয়ে ছিল। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, ওগুলো কোনো কুকুর বা শেয়াল নয়। ওগুলো মানুষের মতোই ছায়া। কিন্তু এত রাতে কারা ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? আর কেনই বা থাকবে?
নয়ন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ও... ওগুলো কারা?”
কেউ কোনো উত্তর দিতে পারল না। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ছায়াগুলো এক চুলও নড়ছে না। শুধু আলোটা মৃদু কাঁপছে। আমার মনে হচ্ছিল, ছায়াগুলো যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। একটা তীব্র শীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। মনে হলো, এই মুহূর্তে যদি ছায়াগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে, তাহলে হয়তো ভয়েই আমরা জ্ঞান হারাব।
কতক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ করেই, যেমন হুট করে জ্বলে উঠেছিল, ঠিক তেমনই হুট করে আলোসহ ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল। মাঠটা আবার আগের মতোই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেল। যেন ওখানে কিছুই ছিল না, পুরোটাই আমাদের চোখের ভুল।
কিন্তু আমরা চারজনেই জানি, ওটা চোখের ভুল ছিল না। আমরা সবাই একই জিনিস দেখেছি। ছাদ থেকে নামার জন্য যখন উঠলাম, তখন দেখলাম আমাদের সবার হাত-পা কাঁপছে। সেই রাতে আমরা কেউ একা ঘুমাতে পারিনি। একটা রুমের মধ্যেই চারজন একসাথে শুয়েছিলাম, কিন্তু ঘুম কারো চোখেই আসেনি। সারারাত শুধু ওই একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল—খালি মাঠে মাঝরাতে কারা ওই ছায়ার সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে?
ছাদের সেই রাতের ঘটনার পর আমাদের চারজনের মধ্যেই একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করতে শুরু করল। দিনের বেলায় ভার্সিটির ব্যস্ততা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও, সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই একটা необъясনীয় অস্বস্তি আমাদের গ্রাস করত। যে বারান্দাটা একসময় আমাদের খুব প্রিয় ছিল, এখন সেদিকে যেতেও গা ছমছম করে। মাঠের দিকে তাকাতে কেমন যেন ভয় হয়। আমরা পারতপক্ষে সন্ধ্যার পর আর বারান্দায় যেতাম না, ছাদের দিকে তো পা-ই বাড়াতাম না।
কয়েকদিন পর, আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। হাতে বেশ কয়েকদিনের ছুটি। অন্য সময় হলে হয়তো আমরা খুশিতে হইচই করতাম, বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করতাম। কিন্তু এবার সবার মনই ভার। বাড়িওয়ালা, পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক, নাম আনোয়ার সাহেব। তিনি আমাদের সাথে বেশ ভালো ব্যবহারই করতেন। একদিন সকালে বাজারে যাওয়ার পথে সিঁড়িতে তার সাথে দেখা। তিনি আমাদের দেখে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী খবর বাবা, তোমাদের পরীক্ষা তো শেষ? চেহারা এমন শুকনো কেন? শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক আছে তো?”
আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। সুমনই প্রথম মুখ খুলল। ইতস্তত করে বলল, “না আঙ্কেল, শরীর ঠিক আছে। আসলে পরীক্ষার চাপে কয়েক রাত ভালো ঘুম হয়নি তো, তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।”
আনোয়ার সাহেব আমাদের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তার অভিজ্ঞ চোখ হয়তো আমাদের মনের ভেতরের ভয়টা পড়তে পেরেছিল। তিনি গলার স্বরটা একটু নামিয়ে এনে বললেন, “অন্য কোনো সমস্যা নেই তো? মানে, রাতে কোনো অসুবিধা হয়?”
তার প্রশ্নটা এত সরাসরি ছিল যে আমরা চমকে উঠলাম। রাশেদ, যে কিনা সবচেয়ে বেশি যুক্তিবাদী ছিল, সে-ই এবার থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসল, “আঙ্কেল, আপনি কিছু জানেন নাকি? মানে... ওই মাঠটা নিয়ে...”
আনোয়ার সাহেবের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি চারপাশে একবার দেখে নিয়ে আরও নিচু গলায় বললেন, “তোমরাও কিছু দেখেছ, তাই না?”
তার এই একটা প্রশ্নেই আমাদের সব দ্বিধা কেটে গেল। আমরা বুঝতে পারলাম, এই বাড়ির রহস্য বা মাঠের এই অস্বাভাবিকতার কথা তিনি জানেন। আমরা চারজনেই একসাথে মাথা নাড়লাম। আনোয়ার সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি তোমাদের বলেছিলাম, এই বাড়িটা নেওয়ার আগে। বলেছিলাম, এই এলাকায় কিছু ঝামেলা আছে। তোমরা তখন ছেলেমানুষি করে উড়িয়ে দিয়েছিলে।”
আমরা অবাক হলাম। তিনি কখন বলেছিলেন? পরে মনে পড়ল, বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় তিনি কথায় কথায় বলেছিলেন, “এলাকাটা ভালো, তবে রাত-বিরেতে বেশি বাইরে থেকো না। আর ছাদ বা বারান্দায় বেশি রাত পর্যন্ত থাকার দরকার নেই।” আমরা তখন তার কথাটাকে সাধারণ সতর্কবার্তা হিসেবেই ধরে নিয়েছিলাম। এর পেছনে যে এত গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে, তা কল্পনাও করিনি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কীসের ঝামেলা আঙ্কেল? ওই মাঠে রাতে কী হয়? আমরা যা দেখেছি, তা কি সত্যি?”
আনোয়ার সাহেব আমাদের নিয়ে তার ফ্ল্যাটের বসার ঘরে গেলেন। তার স্ত্রী আমাদের জন্য চা নিয়ে এলেন। পরিবেশটা থমথমে হয়ে উঠল। তিনি বলতে শুরু করলেন, “তোমরা যা দেখেছ, তা চোখের ভুল নয়। এই মাঠে ওসব দেখা যায়। বিশেষ করে শীতের রাতে, যখন কুয়াশা নামে। আমরা যারা পুরনো বাসিন্দা, তারা সবাই এটা জানি। इसीलिए কেউ রাত নামলে ও মাঠের দিকে ভুলেও তাকায় না।”
তিনি একটু থামলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো-বিশেক আগের কথা। এই মাঠটা তখন এত ফাঁকা ছিল না। এখানে একটা বিশাল বস্তি ছিল। অনেক গরিব, দিনমজুর মানুষ থাকত। একদিন শীতের এক রাতে, বস্তিতে আগুন লাগে। কীভাবে লেগেছিল, তা কেউ ঠিক করে বলতে পারে না। কেউ বলে রান্নার চুলা থেকে, কেউ বলে ষড়যন্ত্র করে কেউ লাগিয়ে দিয়েছিল। আগুনটা এত ভয়াবহ ছিল যে, কেউ বের হওয়ার সুযোগ পায়নি। ঘুমের মধ্যেই নারী-পুরুষ-শিশুসহ প্রায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়।”
ঘটনাটা শুনে আমাদের সবার শরীর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যে মাঠে দিনের বেলা ছেলেরা হাসিমুখে ক্রিকেট খেলে, তার মাটির নিচে এতগুলো মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ইতিহাস চাপা পড়ে আছে!
আনোয়ার সাহেব বলে চললেন, “তারপর থেকেই এই মাঠটা অভিশপ্ত হয়ে যায়। বস্তিটা পরিষ্কার করে ফেলা হলেও, এখানে আর কোনোদিন কোনো স্থাপনা তৈরি করা যায়নি। যে-ই চেষ্টা করেছে, কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাতের বেলা প্রায়ই ওখান থেকে কান্নার আওয়াজ, চিৎকার শোনা যেত। আর যা তোমরা দেখেছ—ওই ছায়ার সারি—ওগুলো আসলে ওই আগুনে পুড়ে মরা মানুষগুলোর আত্মা। ওরা প্রতি রাতে ওখানে জমায়েত হয়, নিজেদের পোড়া ঘরবাড়ি খুঁজে বেড়ায়।”
তার কথাগুলো আমাদের বুকের ভেতর হাতুড়ির মতো আঘাত করছিল। একটা বাস্তব ঘটনা কীভাবে এমন হাড়হীম করা ভৌতিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হতে পারে, তা ভেবেই শরীর শিউরে উঠছিল।
নয়ন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু... কিন্তু ওরা তো কারো কোনো ক্ষতি করে না, তাই না?”
আ আনোয়ার সাহেব বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়লেন। “না, সরাসরি ক্ষতি করে বলে শুনিনি। তবে যারা ওগুলো দেখে, তাদের ওপর একটা মানসিক চাপ পড়ে। অনেকেই ভয় পেয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। আর একটা কথা প্রচলিত আছে, যদি কেউ ওই ছায়ামূর্তিদের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে বা ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে, তাহলে নাকি ওরা তাকে নিজেদের সঙ্গী করে নিতে চায়। তাকেও ওই মাঠের দিকে টেনে নিয়ে যায়।”
এই কথাটা শোনার পর আমাদের মনে হলো যেন পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। আমরা তো শুধু দেখিনি, ছাদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম! আমাদের কি তাহলে কোনো বিপদ হতে পারে?
সেই দিন থেকে আমাদের ভয়টা সহস্রগুণ বেড়ে গেল। আমরা ঠিক করলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাসা ছেড়ে দেব। কিন্তু হাতে টাকা-পয়সারও টানাটানি ছিল। নতুন বাসা খুঁজতে আর অগ্রিম টাকা জোগাড় করতে অন্তত মাসখানেক সময় লাগবে। এই একটা মাস আমাদের এখানেই কাটাতে হবে। প্রতিটা রাত আমাদের জন্য যেন এক একটা বিভীষিকা হয়ে উঠল।
আমরা ঘরের সব জানালা-দরজা সন্ধ্যার আগেই বন্ধ করে দিতাম। বারান্দার দিকের দরজাটা তো প্রায় স্থায়ীভাবেই বন্ধ রাখা শুরু করলাম। রাতে বাথরুম যেতে হলেও আমরা একা যেতাম না, একজনকে সাথে করে নিয়ে যেতাম। চারজন মিলে এক ঘরে, আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু ঘুম আসত না। একটু শব্দ হলেই চমকে উঠতাম। মনে হতো, এই বুঝি কেউ দরজায় টোকা দিল। বাথরুমের কল থেকে টপটপ করে পানি পড়ার শব্দও বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিত। মনে হতো, ওই ছায়ারা কি আমাদের কথা জেনে গেছে? ওরা কি এখন বাড়ির ভেতরে আসার চেষ্টা করছে?
একদিন রাতে ঘটল সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটা। তখন রাত প্রায় তিনটে বাজে। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা। আমরা চারজনই জেগে ছিলাম, কিন্তু ভয়ে কেউ কোনো কথা বলছিলাম না। হঠাৎ আমাদের ফ্ল্যাটের কলিংবেলটা বেজে উঠল। তীক্ষ্ণ, একটানা শব্দে।
আমরা চারজনেই পাথরের মতো জমে গেলাম। এই মাঝরাতে কে আসবে? আমাদের তো কোনো বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনেরও আসার কথা নয়। সুমন সাহস করে দরজার ‘আই-হোল’ বা ‘চোখ’ দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু কুয়াশা আর অন্ধকারের কারণে সিঁড়ির আলোটা আবছা হয়ে আছে, কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা লম্বা, অস্পষ্ট ছায়ার মতো আকৃতি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হলো।
কলিংবেলটা আবার বেজে উঠল। এবার আরও জোরে, আরও একটানা। যেন কেউ মরিয়া হয়ে বেলটা চেপে ধরে আছে। রাশেদ ফিসফিস করে বলল, “কে হতে পারে? দারোয়ান চাচা?”
আমি বললাম, “দারোয়ান চাচা তো এত রাতে বেল বাজাবে না। তার কাছে তো চাবি আছে। আর তার তো আমাদের কাছে আসার কোনো কারণও নেই।”
আমাদের হৃৎপিণ্ড এমনভাবে ধুকপুক করছিল যে, মনে হচ্ছিল বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। আমরা ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। বেলটা বেজেই চলেছে। একটানা, কর্কশ শব্দটা যেন আমাদের মাথায় হাতুড়ি পেটা করছে।
হঠাৎ বেল বাজা থেমে গেল। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই দরজায় ধুম ধুম করে আঘাত করার শব্দ শুরু হলো। কেউ যেন দরজার ওপর তার সর্বশক্তি দিয়ে কিল-ঘুষি মারছে। সেই সাথে একটা চাপা, গোঙানির মতো আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। ওটা মানুষের গলার স্বর, নাকি অন্য কিছু, তা বোঝার উপায় ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, কেউ প্রচণ্ড কষ্টে কাতরাচ্ছে আর দরজাটা ভাঙার চেষ্টা করছে।
আমরা ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল, দরজা ভেঙে ওটা ভেতরে ঢুকে পড়বে। ওই ছায়ামূর্তিটা, যার কথা আনোয়ার সাহেব বলেছিলেন, সেই হয়তো আমাদের ডাকতে এসেছে। আমাদেরকেও ওর সঙ্গী বানাতে চায়। আমরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের কোণায় গিয়ে জড়ো হলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল, এটাই হয়তো আমাদের জীবনের শেষ রাত। দরজার ওপর আঘাতের শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলছিল, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল আমাদের আর্তনাদ।
দরজায় সেই ভয়াল, ритমহীন আঘাত আর চাপা গোঙানির শব্দে আমাদের চারজনের তখন প্রায় আধমরা অবস্থা। আমরা ঘরের এক কোণে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছিলাম। আমাদের সম্মিলিত ভয়ার্ত চিৎকার আর দরজার ওপর চলতে থাকা ধুমধাম শব্দ মিলেমিশে এক নারকীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। প্রতিটি মুহূর্ত মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। আমাদের মগজ তখন পুরোপুরি অসাড়, শুধু একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল—দরজাটা ভেঙে গেলেই সব শেষ। ওই ছায়ামূর্তিটা ভেতরে ঢুকে আমাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে ওই অভিশপ্ত মাঠে।
কতক্ষণ এভাবে চলেছিল জানি না। হয়তো কয়েক মিনিট, কিন্তু আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল কয়েক ঘণ্টা। হঠাৎ করেই দরজার ওপর আঘাতটা থেমে গেল। ঠিক যেমন আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছিল, তেমনই আকস্মিকভাবেই শেষ হলো। কিন্তু গোঙানির মতো চাপা আওয়াজটা তখনও শোনা যাচ্ছিল, তবে সেটা যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে বলে মনে হলো। কিছুক্ষণ পর সেটাও পুরোপুরি থেমে গেল। ফ্ল্যাটের ভেতর নেমে এলো কবরের নিস্তব্ধতা। এতটাই নিস্তব্ধ যে, আমরা আমাদের নিজেদের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ আর ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।
আমরা আরও কিছুক্ষণ ওভাবেই জড়সড় হয়ে বসে রইলাম। নড়াচড়া করার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভোরের আলো ফোটার আগে পর্যন্ত আমরা ওই কোণা থেকে এক পা-ও নড়িনি। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আবছা আলোটা যখন ঘরের ভেতর প্রবেশ করল, তখন আমাদের শরীরে যেন কিছুটা প্রাণ ফিরে এলো।
সকাল হতেই আমরা আর এক মুহূর্তও দেরি করিনি। রাতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আজ সকালেই এই বাসা ছাড়ব। জিনিসপত্র গোছানোর মতো মানসিক অবস্থা আমাদের ছিল না। আমরা শুধু আমাদের সার্টিফিকেট, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর মানিব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। যাওয়ার আগে আনোয়ার সাহেবকে একবার ঘটনাটা জানানো দরকার মনে করলাম।
আমরা চারজন কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। আনোয়ার সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজায় টোকা দিতেই তিনি বেরিয়ে এলেন। আমাদের ফ্যাকাশে, বিধ্বস্ত চেহারা দেখে তিনি হয়তো রাতেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। আমাদের কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “তোমরা ঠিক আছো তো? রাতে খুব চিৎকার চেঁচামেচি শুনলাম।”
সুমন কাঁপা কাঁপা গলায় রাতের পুরো ঘটনাটা তাকে খুলে বলল। দরজায় আঘাত করা, সেই গোঙানির শব্দ—সবকিছু। সব শুনে আনোয়ার সাহেবের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি ধারণা করেছিলাম এমন কিছুই হবে। তোমরা ওই ছায়াদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলেছ। ওরা এখন তোমাদের চিনে গেছে। এই বাসা তোমাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। তোমরা আজই চলে যাও। তোমাদের অগ্রিমের টাকা আমি ফেরত দিয়ে দেব। শুধু প্রাণ নিয়ে এখান থেকে যাও, বাবা।”
তার কথায় আমাদের ভয়টা আরও জাঁকিয়ে বসল। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রায় ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলাম। নিচতলায় নামার সময় সিঁড়ির কোণে একটা জিনিস দেখে আমার পা দুটো মাটিতে আটকে গেল। আমি বাকিদের থামালাম।
সিঁড়ির এক পাশে, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা একটা পুরনো, মরচে পড়া হারিকেন। যেটা আমরা মাঠের মধ্যে জ্বলতে দেখেছিলাম, ঠিক সেরকম। আর তার পাশেই পড়ে আছে একটা নোংরা, ছেঁড়া চাদর। চাদরটার কয়েক জায়গায় পোড়া দাগ স্পষ্ট।
আমাদের চারজনেরই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। তার মানে, রাতে যে এসেছিল, সে নিচতলাতেই থাকে? নাকি... সে এখনও এই বাড়িতেই আছে? আমরা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। প্রায় দৌড়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলাম। পেছনের দিকে একবারও তাকানোর সাহস হলো না।
আমরা সেদিনই এক বন্ধুর মেসে গিয়ে উঠলাম। কয়েকদিন পর নতুন বাসা খুঁজে সেখানে চলে যাই। কিন্তু সেই রাতের বিভীষিকা আমাদের পিছু ছাড়েনি। প্রথম কয়েক মাস আমরা কেউই একা ঘুমাতে পারতাম না। রাতের বেলা সামান্য শব্দ হলেই চমকে উঠতাম। দরজায় কেউ টোকা দিলে বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠত।
সময়ের সাথে সাথে সেই ভয়টা হয়তো কিছুটা কমে এসেছে, কিন্তু পুরোপুরি মুছে যায়নি। আমরা চার বন্ধু এখনও একসাথে আছি, কিন্তু আমাদের সেই আগের উচ্ছ্বাসটা আর নেই। আমাদের সবার মধ্যেই একটা স্থায়ী পরিবর্তন এসে গেছে। আমরা যেন এক রাতেই অনেকগুলো বছর বড় হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু গল্পের শেষটা এখানে নয়। আসল ভয়ংকর সত্যটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও কয়েক বছর পর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমরা সবাই তখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। একদিন পুরনো বন্ধুদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আমাদের চারজনের আবার দেখা হলো। অনেকদিন পর একসাথে বসে পুরনো দিনের কথা উঠতেই অবধারিতভাবে সেই অভিশপ্ত বাড়ির প্রসঙ্গ চলে এলো। আমরা তখন অনেকটাই পরিণত। ভয়টা কমে গিয়ে এখন কৌতুহলটা বেশি কাজ করে।
রাশেদ, যে বরাবরই যুক্তিবাদী, সে বলল, “আচ্ছা, আনোয়ার সাহেব যে গল্পটা বলেছিলেন, সেটা কি পুরোটাই সত্যি ছিল? মানে, বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনাটা?”
এই প্রশ্নটা আমাদের কাউকেই আগে ভাবায়নি। আমরা তখন এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, তার কথাগুলো যাচাই করার কথা মাথাতেই আসেনি। নয়ন ওর স্মার্টফোনটা বের করে গুগলে সার্চ করতে শুরু করল। “সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে বস্তিতে আগুন” – এই ধরনের বিভিন্ন কীওয়ার্ড দিয়ে অনেকক্ষণ খোঁজার পর ও যা পেল, তা আমাদের পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
হ্যাঁ, সেরকম একটা ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। প্রায় বছর পনেরো-বিশেক আগে, শীতের এক রাতে সাভারের ওই এলাকার এক বস্তিতে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল। কিন্তু... সেই আগুনে কেউ মারা যায়নি। বস্তির বাসিন্দারা সময়মতো বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছিল মাত্র, কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।
তাহলে? তাহলে আনোয়ার সাহেব আমাদের ওই গল্পটা কেন শুনিয়েছিলেন? কেন তিনি পঞ্চাশজন মানুষের পুড়ে মরার এক কাল্পনিক, বীভৎস কাহিনী তৈরি করেছিলেন?
আমাদের মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা ঠিক করলাম, একবার ওই এলাকায় গিয়ে খোঁজ নেব। আনোয়ার সাহেবের সাথে দেখা করব।
পরের সপ্তাহেই আমরা চারজন আবার গেলাম সেই পুরনো এলাকায়। বাড়িটা এখনও আগের মতোই আছে। কিন্তু এখন আর আগের মতো ভয় লাগছে না। আমরা সোজা আনোয়ার সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কলিংবেল চাপার পর যে দরজা খুলল, সে আনোয়ার সাহেব নন। বছর তিরিশের এক যুবক।
আমরা আনোয়ার সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতেই যুবকটি অবাক হয়ে বললেন, “আনোয়ার সাহেব তো বছর তিনেক আগেই বাড়িটা আমার কাছে বিক্রি করে দিয়ে পরিবার নিয়ে কানাডা চলে গেছেন। আপনারা কারা?”
আমরা পরিচয় দেওয়ার পর যুবকটি আমাদের ভেতরে আসতে বললেন। আমরা তাকে আমাদের পুরনো অভিজ্ঞতার কথা, মাঠের ছায়ামূর্তির কথা, আর আনোয়ার সাহেবের বলা সেই আগুনের গল্পের কথা—সব খুলে বললাম।
সব শুনে যুবকটি হাসলেন। এক অদ্ভুত, রহস্যময় হাসি। তিনি বললেন, “আনোয়ার সাহেব আপনাদের সাথে একটু মজা করেছেন। আসলে এই মাঠে ওসব ভৌতিক কিছু নেই।”
আমরা অবাক হয়ে বললাম, “তাহলে আমরা যা দেখেছি, সেগুলো কী ছিল?”
যুবকটি শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, “আপনারা যা দেখেছেন, তা বাস্তব। কিন্তু ভৌতিক নয়। এই মাঠটা রাতে মাদকসেবীদের আড্ডাখানা হয়ে ওঠে। ওরা এখানে হেরোইন, ইয়াবা এসব সেবন করে। ওরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য অদ্ভুত সব আলখাল্লা পরে থাকে আর যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন সাংকেতিক আলো ব্যবহার করে। হারিকেনের আলোটা তারই অংশ। ওরা এতটাই নেশাগ্রস্ত থাকে যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আপনারা আসলে একদল মাদকাসক্তকে দেখেই ভয় পেয়েছিলেন।”
কথাটা শুনে আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম। তাহলে এতদিনের বয়ে বেড়ানো ভয়, আতঙ্ক, বিনিদ্র রাত—সবকিছুর উৎস একদল নেশাখোর? আমাদের নিজেদের বোকামিতে হাসি পেল।
কিন্তু একটা প্রশ্ন তখনও আমার মাথায় ঘুরছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু সেই রাতে আমাদের দরজায় যে এসেছিল? যে ওভাবে দরজা পেটাচ্ছিল?”
যুবকটির মুখের হাসিটা এবার মিলিয়ে গেল। তার চোখে এক শীতল, অন্ধকার দৃষ্টি ফুটে উঠল। তিনি নিচু, প্রায় ফিসফিসে গলায় বললেন, “ওহ্, ওই রাতের কথা বলছেন? সেদিন আসলে আমিই এসেছিলাম।”
আমরা চারজনেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। “আপনি? কিন্তু কেন?”
যুবকটি তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের আবছা আলোয় তার লম্বা ছায়াটা দেয়ালে পড়ল, ঠিক যেন মাঠের সেই ছায়ামূর্তির মতো। তিনি আমাদের দিকে এক পা এগিয়ে এসে এক হাড়হীম করা হাসি দিয়ে বললেন,
“কারণ, মাঝে মাঝে নতুন প্রতিবেশীদের সাথে একটু পরিচিত হতে ভালো লাগে। বিশেষ করে যখন দেখি, তারা আমার রাতের কার্যকলাপ খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। ভয়টা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, তাই না? আপনারা ভয় পেয়েছিলেন বলেই তো এতদিন চুপ করে ছিলেন, এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আর আমিও নির্বিঘ্নে আমার কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছি।”
তার শেষ কথাটা আমাদের মগজে বজ্রপাতের মতো আঘাত করল। আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা কোনো ভূতের পাল্লায় পড়িনি, পড়েছিলাম তার চেয়েও ভয়ংকর কিছুর পাল্লায়। এক ঠান্ডা মাথার অপরাধীর পাল্লায়, যে নিজের মাদক ব্যবসা বা অন্য কোনো ভয়ংকর কার্যকলাপ আড়াল করার জন্য একটা ভৌতিক গল্পের বর্ম তৈরি করেছিল। আনোয়ার সাহেব হয়তো ভয়েই বাড়ি বিক্রি করে পালিয়েছিলেন। আর ওই রাতের আগমনটা ছিল আমাদের জন্য এক শীতল সতর্কবার্তা।
আমরা যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে সেই একই অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললেন, “আবার আসবেন। রাতের বেলা ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়ালে হয়তো আমার সাথে আবার দেখা হয়ে যেতে পারে।”
আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। দ্রুত পায়ে এলাকাটা পার হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেই যুবকের শীতল চাহনি আর তার বলা শেষ কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। মাঝে মাঝে নির্জন রাতে একা থাকলে এখনও মনে হয়, অন্ধকারের ওপার থেকে একজোড়া শীতল চোখ আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ভূতের ভয় হয়তো একসময় কেটে যায়, কিন্তু মানুষের তৈরি ভয়টা বোধহয় কোনোদিনও পুরোপুরি মন থেকে মোছে না। ওটা রক্তের সাথে মিশে থাকে, সারাজীবনের জন্য।
[END]
Noted: This story is protected under copyright law and copyrighted by Bhoutik Kotha. Unauthorized copying, posting, or sharing may result in DMCA takedown, legal action, and Facebook account penalties. Content is tracked digitally—violators will be reported and penalized.
#ভূতেরগল্প #ভৌতিক #ভুত