Bhoutik Kotha

  • Home
  • Bhoutik Kotha

Bhoutik Kotha ভৌতিক কথার ইউটিউব চ্যানেল - https://www.youtube.com/
ফেইসবুক গ্রুপে জয়েন করুন - https://www.facebook.com/groups/bhoutikkothaofficial/

PlayList
https://www.youtube.com/playlist?list=PLvrcsbnfeOyU-_OkMbBB7TAXusNM92ZNp
BHOUTIK KOTHA is a Bengali weekly horror storytelling show which is brought to you by it's own Youtube channel, hosted by Jeffrey Khan horror storyteller of Bangladesh. In this show, Jeffrey Khan and many other guests share thier supernatural experiences & stories for their listeners. If u want to share your own story with us then email us here - [email protected]

 #অন্ধকারের প্রতিদানলেখক: সাজিদ আহমেদরাত যখন গভীর হয়, তখন শহরের পরিচিত রাস্তাগুলোও অচেনা হয়ে ওঠে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আল...
26/11/2025

#অন্ধকারের প্রতিদান
লেখক: সাজিদ আহমেদ

রাত যখন গভীর হয়, তখন শহরের পরিচিত রাস্তাগুলোও অচেনা হয়ে ওঠে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো আর অন্ধকারের লুকোচুরিতে এমন কিছু ছায়া জন্ম নেয়, যা মানুষের যুক্তির বাইরে। আমরা ভাবি, ভাগ্য বুঝি পরিশ্রমের ফল, কিংবা ঈশ্বরের দান। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন কিছু দান আমাদের হাতে আসে, যা আলো থেকে নয়, বরং ঘন অন্ধকার থেকে উঠে আসা কোনো সত্তার খেয়ালি উপহার। সেই উপহারের ভার মানুষ সইতে পারে না, সেই উপহারের স্পর্শে বাস্তব আর অবাস্তবের দেয়ালটা কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। লোভ যখন মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তখন সে ভুলে যায়—বিনিময় ছাড়া এই পৃথিবীতে, কিংবা এই পৃথিবীর বাইরের জগত থেকে কিছুই পাওয়া যায় না।
কার্তিক মাসের শেষ দিক। ঢাকার বুকে শীত নামতে শুরু করেছে। দিনের বেলা ধুলো আর ধোঁয়ায় জঞ্জাল হয়ে থাকা শহরটা রাত গভীর হতেই এক অদ্ভুত চাদর মুড়ি দেয়। কুয়াশা। আজ কুয়াশাটা একটু বেশিই। রাত দুইটা বাজে। মিরপুর বেড়িবাঁধের দিকের রাস্তাটা এখন প্রায় জনশূন্য। দু-একটা লরি বা ট্রাক গর্জন করে চলে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে, তারপর আবার সেই নিস্তব্ধতা। রাস্তার ধারের সোডিয়াম বাতিগুলোর কয়েকটা জ্বলছে, কয়েকটা নিভে আছে, যেন অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও ক্লান্ত।
কালাম মিয়ার রিক্সার চেইনটা ক’দিন ধরেই ঝামেলা করছে। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটা এই নিস্তব্ধ রাতে বড় বেমানান লাগছে তার কাছে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, শরীরে আগের মতো জোর নেই। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে এখন পিঠের হাড়গুলো যেন চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গামছা দিয়ে মুখের ঘাম আর কুয়াশার জল মুছল সে। পকেটে হাত দিয়ে দেখল, সারাদিনে যা কামাই হয়েছে, তাতে চাল-ডাল কেনা যাবে, কিন্তু ঘরভাড়ার বাকি টাকাটা হবে না। মহাজন আজ সকালেই হুমকি দিয়ে গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালাম রিক্সাটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করাল। গাবতলীর দিকে যাবে, নাকি সোজা গ্যারেজে চলে যাবে—এই দোটানায় ভুগছিল সে। শরীর বলছে, ‘বাড়ি চল’, কিন্তু পকেট বলছে, ‘আর একটা খ্যাপ’।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মানুষটা এল।
কোত্থেকে এল, কালাম খেয়াল করেনি। মনে হলো যেন কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে হঠাৎই উদয় হলো। রাস্তার উল্টোপাশের একটা বড় কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা, কাঁধের ওপর একটা ছাই রঙের চাদর জড়ানো। এই শীতেও লোকটার পায়ে চটি নেই, খালি পা। রাস্তার ওপাশ থেকে আবছা আলোয় মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে লোকটা বেশ লম্বা। সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু বেশিই লম্বা যেন।
কালামের বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছাঁত করে উঠল। এত রাতে, এমন নির্জন রাস্তায় এমন পরিপাটি পোশাকের মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। সে রিক্সার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরল। ভাবল চলে যাবে। কিন্তু অভাব বড় খারাপ জিনিস, ভয়কে সে পেটে খিদে দিয়ে চাপা দেয়।
লোকটা রাস্তা পার হয়ে ধীর পায়ে রিক্সার কাছে এগিয়ে এল। হাঁটার ভঙ্গিটা অদ্ভুত, যেন মাটির সাথে পায়ের কোনো শব্দ হচ্ছে না। কালামের রিক্সার হুডটা নামানো ছিল। লোকটা কাছে এসে দাঁড়াতেই একটা তীব্র সুগন্ধ কালামের নাকে লাগল। আতর। খুব কড়া, পুরনো আমলের আতর, আর তার সাথে মেশানো কেয়া ফুলের গন্ধ। গন্ধে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল কালামের।
"যাবেন?"
গলাটা খুব ভরাট, কিন্তু কেমন যেন যান্ত্রিক। যেন কোনো গভীর কুয়োর ভেতর থেকে আওয়াজটা উঠে আসছে।
কালাম একটু নড়েচড়ে বসল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, "কই যাইবেন সাব?"
"নবাবগঞ্জ। পুরোনো কেল্লার মোড়।"
কালাম চমকে উঠল। নবাবগঞ্জ এখান থেকে অনেক দূর। আর পুরোনো কেল্লার ওই দিকটা তো এখন প্রায় পরিত্যক্ত। দিনের বেলাতেই মানুষ ওদিকে যেতে ভয় পায়, আর এই রাত দুপুরে!
"সাব, ওইদিকে তো রাস্তাঘাট ভালা না। আর অনেক দূর। আইজকা থাক, আমি গ্যারেজে যামু।" কালাম বিনয়ের সাথেই না করার চেষ্টা করল।
লোকটা কোনো কথা বলল না। চাদরের নিচ থেকে একটা হাত বের করল। রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোয় কালাম দেখল, হাতটা ফ্যাকাশে সাদা, আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা। লোকটা পকেট থেকে এক দলা টাকা বের করল না, বরং তর্জনী উঁচিয়ে ইশারা করল।
"ডাবল ভাড়া দেব। যাবে?"
লোভ। মানুষের আদিমতম রিপু। কালামের চোখের সামনে মহাজনের মুখটা ভেসে উঠল। ডাবল ভাড়া পেলে কালকের দিনটা নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে। সে ঢোক গিলল। আতরের গন্ধে তার বিচারবুদ্ধি যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল।
"উঠেন তাইলে," কালামের গলাটা একটু কেঁপে গেল।
লোকটা রিক্সায় উঠল। উঠার সময় রিক্সাটা এমনভাবে দুলে উঠল যেন মনে হলো বিশাল কোনো পাথরের চাই চাপানো হয়েছে সিটে। কালাম অবাক হলো। লোকটাকে দেখে তো এত ভারী মনে হয়নি! চিকন স্বাঁস্থ্য, অথচ ওজনে রিক্সার টায়ার যেন মাটিতে দেবে গেল।
রিক্সা চলতে শুরু করল। বেড়িবাঁধের রাস্তা ধরে সোজা দক্ষিণে।
প্রথম পনেরো মিনিট কোনো কথা হলো না। শুধু রিক্সার চেইনের সেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আর কালামের ভারী নিঃশ্বাস। পেছনের যাত্রী একদম মূর্তির মতো বসে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না। কালামের পিঠের ওপর একটা শীতল দৃষ্টির ভার সে অনুভব করতে পারছিল। সাধারণত যাত্রীরা রিক্সায় উঠলে নড়াচড়া করে, মোবাইল টেপে, কিংবা বিড়ি ধরায়। কিন্তু এই লোকটা একদম স্থির।
রাস্তাটা ক্রমশ নির্জন থেকে নির্জনতর হতে লাগল। কুয়াশা যেন আরও ঘন হয়ে চেপে ধরছে চারপাশ। রাস্তার দুপাশের গাছগুলো অদ্ভুত সব আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালামের মনে হলো, আজ রাতটা যেন শেষই হচ্ছে না।
"সাব, আপনে কি ওইহানে থাকেন?" নীরবতা ভাঙার জন্যই জিজ্ঞেস করল কালাম। নিজের গলার আওয়াজ নিজের কাছেই অচেনা লাগল।
পেছন থেকে কোনো উত্তর এল না। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ।
কালাম আবার বলল, "ওই দিকের রাস্তা তো ভাইঙ্গা গেছে শুনছি। রিক্সা কতদূর যাইবো জানি না।"
এবারও কোনো উত্তর নেই। কালাম ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর সাহস পেল না। তার মনে হলো, ঘাড় ঘোরালেই সে এমন কিছু দেখবে যা সে দেখতে চায় না। কিন্তু আতরের গন্ধটা আরও তীব্র হয়েছে। গন্ধটা এখন আর সুবাস মনে হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে বাসি ফুলের পচা গন্ধের সাথে মেশানো কোনো রাসায়নিক। বমি বমি ভাব হতে লাগল তার।
হঠাৎ করেই একটা কুকুর রাস্তার বাম পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল। সাধারণ ঘেউ ঘেউ নয়, কলিজা ছেঁড়া আর্তনাদ। কালাম দেখল, রাস্তার ধারের জঞ্জালের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে একটা কালো কুকুর তার রিক্সার দিকে তাকিয়ে হিংস্রভাবে গোঙাচ্ছে। কিন্তু কুকুরটা এগোচ্ছে না, বরং পেছনের পায়ে ভর দিয়ে ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।
কালামের শরীরটা হিম হয়ে এল। মুরুব্বিরা বলে, কুকুর আর বিড়াল নাকি এমন জিনিস দেখে যা মানুষ দেখে না। সে জোরে প্যাডেল মারতে চাইল, কিন্তু পারল না। রিক্সাটা মনে হচ্ছে ক্রমশ আরও ভারী হয়ে যাচ্ছে। যেন পেছনের যাত্রী একা নয়, তার সাথে আরও কেউ চেপে বসেছে।
"আর কত দূর?" পেছন থেকে সেই ভরাট গলা ভেসে এল। কিন্তু এবার গলাটা যেন কানের একদম কাছে। কালাম শিউরে উঠল। যাত্রী তো সিটে বসে আছে, তাহলে আওয়াজটা ঘাড়ের কাছে এল কীভাবে?
"জি... জি সাব, আর একটু। সামনেই তো শ্মশান ঘাট, ওটা পার হইলেই কেল্লার মোড়।" কালামের জিব আড়ষ্ট হয়ে আসছে।
শ্মশান ঘাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কালামের মনে হলো বাতাসটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। এত শীতের রাতেও গরম বাতাস! রাস্তার দুপাশে বড় বড় বটগাছ। তাদের ঝুড়িগুলো নিচে নেমে এসেছে ফাঁসির দড়ির মতো। কালাম বিড়বিড় করে সুরা ফাতিহা পড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মনে করতে পারল না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে পুরোনো কেল্লার মোড় দেখা গেল। একসময় এখানে জাঁকজমক ছিল, এখন শুধু ভাঙাচোরা কিছু ইটের দেয়াল আর জঙ্গল। রাস্তার বাতি এখানে নেই বললেই চলে। চাঁদের আলো কুয়াশায় আটকে গিয়ে এক ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে।
"থামাও।"
আদেশটা এল খুব শান্তভাবে। কালাম ব্রেক কষল। রিক্সাটা থামতেই তার মনে হলো কাঁধ থেকে হাজার মণের বোঝা নেমে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে সে শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছল।
লোকটা রিক্সা থেকে নামল। সেই একই রকম ধীরস্থির ভঙ্গি। কিন্তু এবার কালাম একটা জিনিস খেয়াল করল। লোকটা যখন মাটিতে পা রাখল, মাটির ধুলো উড়ল না। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে গেল, কিন্তু মড়মড় শব্দ হলো না।
কালাম ভয়ে কথা বলতে ভুলে গেল। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। লোকটা রিক্সার সামনে এসে দাঁড়াল। চাদরের আড়াল থেকে হাত বের করল।
"আজকের রাতটা তোমার জন্য মনে থাকবে, কালাম।"
কালাম চমকে উঠল। সে তো নিজের নাম বলেনি! এই লোক তার নাম জানল কী করে?
"সাব... আপনে আমার নাম..."
"চুপ!" লোকটা ধমক দিল না, কিন্তু সেই এক শব্দেই কালামের কথা বন্ধ হয়ে গেল। "তোমার মেয়েটার জ্বর, তাই না? টাকার জন্য ওষুধ কিনতে পারোনি।"
কালামের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। এই লোক কে? মানুষ নাকি অন্য কিছু? সে কি পীর-ফকির? নাকি...
লোকটা তার দিকে এক তাড়া নোট বাড়িয়ে দিল। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে, ওগুলো সব বড় নোট। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটের একটা আস্ত বান্ডিল।
"নাও। এটা তোমার ভাড়া, আর তোমার মেয়ের ওষুধের খরচ।"
কালাম কাঁপাকাঁপা হাতে টাকাটা নিল। টাকার নোটগুলো অস্বাভাবিক ঠান্ডা। যেন ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে। টাকা হাতে নিতেই শরীরে একটা বিদ্যুতিক শকের মতো শিহরণ খেলে গেল।
"সাব, এত টাকা! ভাড়া তো মাত্র..."
"বেশি কথা বলো না। যা দিয়েছি, রাখো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।" লোকটা ঝুঁকে এল কালামের মুখের কাছে। আবছা আলোয় এবার কালাম লোকটার চোখ দুটো দেখল। ওগুলো মানুষের চোখ নয়। চোখের মণি নেই, পুরোটাই আগুনের মতো জ্বলজ্বলে হলদেটে।
কালাম চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না।
"বাড়ি যাওয়ার আগে এই টাকা গুনবে না। কাউকে দেখাবে না। সোজা বাড়ি যাবে, বাক্সে রেখে দেবে। সকাল হওয়ার আগে এই টাকার দিকে তাকাবে না। মনে থাকবে?"
কালাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়ল।
"যাও এখন। পেছনে তাকাবে না।"
কালাম আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। রিক্সা ঘুরিয়ে সে প্যাডেল মারল প্রাণপণে। তার মনে হচ্ছিল, সে যদি এখন না পালায়, তবে এই অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নেবে। সে রিক্সা চালাচ্ছে ঝড়ের বেগে। অথচ একটু আগেই তার শরীরে শক্তি ছিল না। এখন অজানা এক ভয়ে তার পায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে।
কিছুদূর যাওয়ার পর তার খুব ইচ্ছে হলো পেছনে ফিরে তাকানোর। লোকটা কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? নাকি মিলিয়ে গেছে? কিন্তু লোকটার সেই সাবধানবাণী—"পেছনে তাকাবে না"—তাকে থামিয়ে রাখল।
রাস্তা যেন শেষ হতে চায় না। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে তার মনে হতে লাগল, কেউ একজন তার কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলছে। কিন্তু সে কান দিল না। তার পকেটে টাকার বান্ডিলটা আগুনের মতো গরম মনে হচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই বরফের মতো ঠান্ডা।
মিরপুরের চেনা রাস্তায় যখন সে পৌঁছাল, তখন রাত সাড়ে তিনটা। শহরের কুকুরগুলো এখন শান্ত হয়ে গেছে। কালামের বুকের ধড়ফড়ানি একটু কমল। সে বেঁচে ফিরেছে। এবং তার পকেটে এখন অনেক টাকা। হয়তো পঞ্চাশ হাজার, হয়তো তারও বেশি। তার সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে। মেয়েটার চিকিৎসা হবে। একটা নতুন রিক্সা কেনা যাবে।
আনন্দে আর উত্তেজনায় কালামের কান্না পাচ্ছিল। সে রিক্সাটা গ্যারেজে জমা না দিয়েই সোজা নিজের বস্তির দিকে রওনা দিল। গ্যারেজের মালিককে কাল সকালে বুঝিয়ে বলা যাবে। এখন তার প্রথম কাজ টাকাটা নিরাপদে ঘরে তোলা।
বস্তির সরু গলি দিয়ে রিক্সা নিয়ে ঢোকার সময় তার মনে হলো, কেউ যেন তাকে নজরে রাখছে। কিন্তু সে পাত্তা দিল না। তার টিনের চালের ঘরটার সামনে এসে রিক্সা রাখল। তালা খুলল খুব সাবধানে, যেন আওয়াজ না হয়।
ঘরে ঢুকে সে দেখল, তার স্ত্রী আমেনা আর ছোট মেয়েটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটার গায়ে হাত দিয়ে দেখল, জ্বরটা একটু কমেছে। কালামের মনটা শান্তিতে ভরে গেল। সে সাবধানে ঘরের কোণে রাখা পুরনো টিনের ট্রাঙ্কটা খুলল। আমেনার পুরনো শাড়ি আর কাঁথার নিচে সে টাকার বান্ডিলটা রেখে দিল।
লোকটা বলেছিল, সকাল হওয়ার আগে না দেখতে। কালাম কথা রাখবে। সে জানে, বুজুর্গ বা পীর-ফকিরদের কথা অমান্য করলে ক্ষতি হয়। সে ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে দিল।
বিছানায় শুয়ে তার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। চোখের সামনে ভাসছে সেই হলুদ চোখ, নাকে সেই তীব্র পচা ফুলের গন্ধ। আর মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। কাল সকালে উঠেই সে বাজার করবে। মেয়েকে ডাক্তার দেখাবে। আমেনার জন্য একটা ভালো শাড়ি কিনবে।
শুয়ে শুয়ে কখন যে তার চোখ লেগে এল, সে টেরই পেল না।
ঘুম ভাঙল যখন, তখন সকাল আটটা বাজে। রোদের আলো টিনের ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকেছে। বাইরে বস্তির কোলাহল শুরু হয়ে গেছে। কালাম ধড়মড় করে উঠে বসল। তার শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে, যেন গত রাতে কেউ তাকে পিটিয়েছে। কিন্তু মনে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটল। টাকা!
আমেনা তখনো উঠানে বাসন মাজছে। কালাম কাউকে কিছু না বলে সোজা ট্রাঙ্কের কাছে গেল। হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। আজ থেকে তাদের আর কোনো অভাব থাকবে না।
সে ট্রাঙ্কের ডালাটা খুলল। কাঁথা আর কাপড়গুলো সরাল। তার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করেছে। ওই তো, কাপড়ের নিচে উঁচু হয়ে আছে জায়গাটা।
কালাম হাত ঢোকাল। স্পর্শ করতেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল। টাকার নোট তো এমন খসখসে আর শক্ত হওয়ার কথা নয়! এত ঠান্ডা কেন?
সে এক টানে জিনিসটা বের করে আনল।
এবং পরমুহূর্তেই তার গলার ভেতর থেকে এক অমানবিক চিৎকার বেরিয়ে এল। তার হাত থেকে জিনিসগুলো ঝনঝন করে মেঝতে পড়ে গেল।
ওগুলো কোনো টাকা নয়।
মেঝের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে একগাদা পোড়া মাটির ভাঙা খাপরা (টালি) আর কিছু পুরোনো হাড়ের টুকরো। মাটির খাপরাগুলোর ওপর কয়লা দিয়ে কিছু অদ্ভুত নকশা আঁকা, যা দেখতে টাকার নোটের মতো মনে হয়েছিল অন্ধকারে। আর তার সাথে, একটা মরা মানুষের হাতের আঙুলের হাড়।
ঘরের বাতাসে ভুরভুর করে ছড়িয়ে পড়ল সেই তীব্র আতর আর পচা লাশের গন্ধ।
আমেনা দৌড়ে ঘরে ঢুকল, "কী হইছে? ও মাগো! তুমি চিল্লাও ক্যান?"
কালাম কোনো উত্তর দিতে পারল না। সে শুধু মেঝের দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার মনে পড়ে গেল গত রাতের সেই যাত্রীর কথা। সেই হলুদ চোখ।
"টাকা... আমার টাকা..." কালাম বিড়বিড় করে বলতে লাগল, "ওরা আমারে ঠকাইছে... শয়তান... জ্বিন..."
আমেনা অবাক হয়ে মেঝের দিকে তাকাল। "কি হাবি-জাবি বকো? এইগুলা তো মরা মাইনষের হাড় আর ভাঙা হাড়ি! তুমি রাইতে কই গেছিলা?"
কালামের তখনো ঘোর কাটেনি। সে বুঝতে পারছিল না এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি। কিন্তু ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে তখনো একটা ধোঁয়া বেরোচ্ছিল, আর সেই ধোঁয়ায় লেখা ছিল তার সর্বনাশের ইঙ্গিত। সে বুঝতে পারল, সে মানুষের যাত্রী বহন করেনি। সে বহন করেছিল অন্য জগতের কাউকে। আর তাদের প্রতিদান মানুষের জন্য আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ।
হঠাৎ কালামের চোখ পড়ল হাড়ের টুকরোটার পাশে পড়ে থাকা একটা ছোট কাগজের টুকরোর দিকে। ওটা গতকালকের টাকার বান্ডিলের মতো দেখতে হলেও এখন সাধারণ একটা চিরকুট। সে ভয়ে ভয়ে সেটা তুলল।
কয়লা দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে সেখানে লেখা:
"লোভ করেছিস, তাই আসলটা নিলি না। ঋণ শোধ করতে চাস? আজ রাতে আবার আসব। তৈরি থাকিস।"
কালামের চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল। সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সেই ভাঙা খাপরা আর হাড়ের ওপর।

জ্ঞান ফেরার পর কালামের মনে হলো, সে যেন এক গভীর পানির নিচ থেকে ভেসে উঠল। কিন্তু ভেসে ওঠার পর যে আলো দেখার কথা, তা সে দেখল না। তার চোখের সামনে তখনো সেই ভাঙা খাপরা, পোড়া হাড় আর কয়লা দিয়ে লেখা চিরকুটটা ভাসছে। ঘরের ভেতর সেই পচা লাশের গন্ধটা এখন আর নেই, কিন্তু কালামের নাকে গন্ধটা আঠার মতো লেগে আছে। সে উঠে বসার চেষ্টা করল, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। টিনের চালের ফুটো দিয়ে আসা রোদের কোণটা এখন ঘরের পূর্ব কোণে হেলে পড়েছে। আমেনা চোকিতে বসে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। স্বামীকে নড়তে দেখে সে দ্রুত কাছে এল। তার চোখেমুখে আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি।
"ও কালামের বাপ, তোমার কী হইছে কও তো? রাইত থাইকা তুমি কেমন করতেছ! আর এইগুলা... এই হাড়-হাড্ডি ঘরে কেমনে আইল?" আমেনার গলা কাঁপছে। সে স্বামীর কপালে হাত রাখল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কিন্তু এই জ্বর সাধারণ জ্বর নয়, শরীরটা বরফের মতো ঠান্ডা, অথচ ভেতরটা পুড়ছে।
কালাম কোনো কথা বলল না। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে পড়ছে সেই চিরকুটের শেষ লাইনটা—"আজ রাতে আবার আসব।" সূর্য ডুবতে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। পশ্চিম আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। এই লাল রং কালামের কাছে সাধারণ গোধূলি মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পুরো আকাশটা রক্তে মেখে আছে। তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে। পালাতে হবে। কোথাও পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? যার ছায়া একবার গায়ে লেগেছে, দুনিয়ার কোনো কোণায় লুকিয়ে তাকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।
সে আমেনার হাতটা খপ করে ধরল। তার হাতের বাঁধন এত শক্ত যে আমেনা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল।
"আমেনা, ঘরের দোর দে। জানালা বন্ধ কর। কেউ ডাকলে সাড়া দিবি না। কেউ না... যদি আমার গলা ধইরাও ডাকে, তাও না।"
কালামের গলার স্বরে এমন এক পৈশাচিক ভীতি ছিল যে আমেনা আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। সে দ্রুত উঠে ঘরের নড়বড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল, দরজার খিলটা ঠিকমতো লাগে না বলে একটা ভারী কাঠের তক্তা আড়াআড়িভাবে ঠেস দিয়ে রাখল। জানালার ফাঁক-ফোকরগুলো পুরনো কাপড় দিয়ে গুঁজে দিল।
সন্ধ্যা নামল। বস্তির হইচই, পাশের ঘরের টিভি সিরিয়ালের শব্দ, রিক্সার টিংটিং আওয়াজ—সব যেন বহু দূর থেকে আসছে। কালামের ঘরের ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কুপি বাতিটা জ্বালানো হয়েছে, কিন্তু সেই বাতির আলো কাঁপছে। বাতাসের কোনো ঝাপ্টা নেই, অথচ শিখাটা স্থির থাকছে না। কালাম ঘরের কোণে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তার হাতে সেই চিরকুটটা। সে ওটা ফেলতে পারেনি। ওটা যেন তার হাতের তালুর সাথে সেলাই করা হয়ে গেছে।
রাত যত বাড়ছে, কালামের মানসিক অবস্থা তত খারাপ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, ঘরের চারপাশের দেওয়ালগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। সে বিড়বিড় করে বলছে, "আমি লোভ করি নাই... আমি শুধু আমার মাইয়ার ওষুধ... আমি লোভ করি নাই..."
হঠাৎ টিনের চালে একটা শব্দ হলো।
খুব জোরে নয়, যেন একটা কাক বা বিড়াল আলতো করে পা ফেলেছে। কিন্তু কালাম জানে, ওটা কাক বা বিড়াল নয়। শব্দটা ছাদের এক কোণা থেকে ধীরে ধীরে মাঝখানের দিকে আসছে। খসখস... খসখস...। যেন কেউ খুব সাবধানে, খুব ভারী শরীর নিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে।
আমেনা মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে চোকিতে বসে ছিল। সে ফিসফিস করে বলল, "কিসের শব্দ ওইটা?"
কালাম তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে ইশারা করল। তার চোখ ছাদের দিকে স্থির। শব্দটা ঠিক তাদের মাথার ওপর এসে থামল। তারপর দীর্ঘক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই। এই নীরবতা শব্দের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে ছাদের ওপরের ওই সত্তাটা কান পেতে আছে, ঘরের ভেতরের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনছে।
হঠাৎ ঘরের পেছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস সুড়সুড় করে ঢুকে পড়ল। সাথে সেই গন্ধ। আতর আর পচা মাংসের জঘন্য মিশ্রণ। কালামের বমি এল, কিন্তু সে বমি করতে পারল না। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
দরজার ওপাশ থেকে একটা আওয়াজ এল। কোনো টোকা নয়, কেউ যেন নখ দিয়ে দরজার কাঠে আঁচড় কাটছে। ক্যাঁ...চ... ক্যাঁ...চ...। শব্দটা মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামিয়ে দিল।
"কালাম..."
ডাকটা খুব নিচু, কিন্তু ঘরের প্রতিটি কোণায় সেটা প্রতিধ্বনিত হলো। সেই যান্ত্রিক, ভরাট গলা।
"কালাম, দরজা খোল। পাওনা নিতে এসেছি।"
আমেনা ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইল, কালাম লাফিয়ে গিয়ে তার মুখ চেপে ধরল। আমেনার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, সে স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে মানুষের দৃষ্টি নেই, আছে এক বন্য প্রাণীর বাঁচার আকুতি।
"চুপ... একদম চুপ," কালাম ফিসফিস করে বলল।
বাইরের সত্তাটা যেন তাদের এই ধস্তাধস্তি দেখতে পাচ্ছে। দরজার ওপাশ থেকে একটা নিচু হাসির শব্দ ভেসে এল। হাসিটা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সাপ চলে যাওয়ার মতো খসখসে।
"তুমি কি ভাবছ, এই কাঠের দরজা আমাকে আটকাতে পারবে? আমি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিলাম। তুমি লোভ সামলাতে পারোনি। তুমি সকালের আলোয় আমার দানকে অপমান করেছ।"
কালাম আর সহ্য করতে পারল না। সে চেঁচিয়ে উঠল, "আমি চাই না তোমার টাকা! আমি কিছু চাই না! আমারে মাফ কইরা দাও। তুমি চইলা যাও!"
বাইরের হাসিটা এবার থামল। মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা বদলে গেল। ঘরের কুপির আলোটা দপ করে নিভে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল ঘর। কিন্তু পরমুহূর্তেই ঘরের দেওয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরে থেকে একটা নীলাভ আলো চুঁইয়ে ভেতরে আসতে লাগল। সেই আলোতে কালাম দেখল, দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়া ঢুকছে। কুণ্ডলী পাকানো সাদা ধোঁয়া। ধোঁয়াগুলো সাপের মতো একেঁবেঁকে মেঝের ওপর দিয়ে কালামের দিকে এগিয়ে আসছে।
"বিনিময় ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না, কালাম," গলাটা এবার দরজার বাইরে থেকে নয়, মনে হলো ঘরের ভেতর থেকেই আসছে। একদম কালামের কানের কাছে। "তুমি আমার রিক্সায় উঠেছিলে, আমি তোমার রিক্সায় উঠিনি। তুমি আমাকে ডেকেছিলে, তোমার অভাব আমাকে ডেকেছিল। এখন সেই অভাব মেটানোর সময়।"
হঠাৎ ঘরের টিনের দরজাটা প্রচণ্ড এক শব্দে কেঁপে উঠল, যেন বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে। কিন্তু কালাম জানে বাইরে কোনো বাতাস নেই। দরজার কাঠের তক্তাটা মটমট করে ভাঙতে শুরু করল। আমেনা মেয়েকে নিয়ে চোকির নিচে সেঁধিয়ে গেল ভয়ে। কালাম দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির মতো। সে বুঝতে পারছে, পালানোর আর কোনো পথ নেই।
দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল।
বাইরে কুয়াশা ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু সেই কুয়াশার বুক চিরে এক বিশাল ছায়া ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। কালামের ছোট্ট ঘরটা নিমেষেই পূর্ণ হয়ে গেল সেই ছায়ায়। গতকালের সেই সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটা। কিন্তু আজ আর তাকে মানুষের মতো দেখাচ্ছে না। তার শরীরটা অদ্ভুতভাবে বেঁকে আছে, হাতগুলো হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলে আছে। আর মুখ... মুখের জায়গায় কোনো চামড়া নেই, আছে শুধু এক দলা মাংসপিণ্ড, আর তার মাঝে জ্বলছে সেই দুটো হলুদ আগুনের গোলা।
কালাম পিছিয়ে যেতে যেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিল। লোকটা—নাকি ছায়াটা—ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। তার হাঁটার কোনো শব্দ নেই, কিন্তু মেঝের ওপর যেখানে সে পা রাখছে, সেখানকার মাটি যেন দেবে যাচ্ছে।
"আমার টাকাগুলো তুমি মাটিতে পরিণত করেছ," ছায়াটা বলল। তার মুখ নড়ছে না, কিন্তু শব্দটা সরাসরি কালামের মগজে আঘাত করছে। "এখন তোমাকে মাটি হতে হবে।"
কালাম হাতজোড় করে কাঁদতে লাগল। "আমার মাইয়াটা ছোট... আমার বউ... ওদের ছাইড়া দেন। আমার জান নিয়া নেন, কিন্তু ওদের কিছু কইরেন না।"
ছায়াটা কালামের খুব কাছে এসে দাঁড়াল। আতরের গন্ধে কালামের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ছায়াটা তার লম্বা, হাড়সার হাতটা বাড়িয়ে দিল। সেই হাতে নখগুলো ছুরির মতো ধারালো।
"তোমার জান আমার দরকার নেই, কালাম। আমি আত্মা খাই না। আমি চাই দাসত্ব। আজ থেকে তুমি আর মানুষ নও। তুমি হবে আমার বাহন। যেমন তোমার রিক্সা তোমাকে টানে, তুমি আমাকে টানবে। অনন্তকাল।"
কালাম কিছু বোঝার আগেই ছায়াটার হাত তার কপালে স্পর্শ করল।
স্পর্শটা আগুনের মতো গরম নয়, বরং এতই ঠান্ডা যে মনে হলো কালামের মগজ জমে বরফ হয়ে গেল। তার চোখের সামনে আমেনা, তার মেয়ে, এই ঘর—সব ঝাপসা হয়ে এল। তার শরীরের হাড়গুলো যেন মড়মড় করে ভেঙে নতুন করে জোড়া লাগতে শুরু করল। এক অসহ্য যন্ত্রণায় সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো মানুষের স্বর বের হলো না। বের হলো এক জন্তুর গোঙানি।
ঘরের কোণে চোকির নিচ থেকে আমেনা দেখল এক হাড়হিম করা দৃশ্য। সে দেখল, তার স্বামী, তার কালাম ধীরে ধীরে কুঁকড়ে যাচ্ছে। তার হাত-পাগুলো অস্বাভাবিকভাবে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। গায়ের চামড়া ধূসর হয়ে ফেটে যাচ্ছে। কালামের চোখ দুটো উল্টে গিয়ে সাদা হয়ে গেল, তারপর ধীরে ধীরে সেখানে ফুটে উঠল সেই একই হলুদ আভা।
ছায়াটা হাসল। "চলো। রাত অনেক হয়েছে। যাত্রীরা অপেক্ষা করছে।"
রূপান্তরিত কালাম—যে এখন আর মানুষ নয়, বরং এক অদ্ভুত চারপেয়ে প্রাণী—ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার মানবসত্তা, তার স্মৃতি, তার ভালোবাসা সব মুছে গেছে। এখন তার শুধু একটাই কাজ—বহন করা।
সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছায়াটা তার পিছু নিল। তারা কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যেতেই ভাঙা দরজাটা নিজে থেকেই ধড়াস করে বন্ধ হয়ে গেল।
পরদিন সকালে যখন বস্তির লোকেরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল, তারা দেখল আমেনা চোকির নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার জ্ঞান ফেরার পর সে পাগলিনির মতো শুধু একটাই কথা বলতে লাগল—"ওরে নিয়া গেছে... ওরে রিক্সা বানাইয়া নিয়া গেছে..."
কালামের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। পুলিশ এল, তদন্ত হলো, কিন্তু কেউ কোনো হদিস পেল না। ঘরের মেঝেতে শুধু পড়ে ছিল কিছু ভাঙা মাটির খাপরা আর একদলা ছাই।
তবে মিরপুর বেড়িবাঁধের ওই পুরনো রাস্তায়, যেখানে সোডিয়াম লাইটগুলো প্রায়ই নিভে থাকে, সেখানে গভীর রাতে রিক্সাওয়ালারা মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা রিক্সা চলে যায়। কিন্তু সেই রিক্সায় কোনো চালক থাকে না। রিক্সাটা নিজে নিজেই চলে, আর তার হুডের ভেতর বসে থাকে সাদা পাঞ্জাবি পরা এক ছায়া। আর রিক্সাটা যখন পাশ দিয়ে যায়, তখন চাকার আওয়াজ হয় না, শোনা যায় মানুষের হাড় ভাঙার মড়মড় শব্দ আর ফিসফিসানি—"যাবেন? নবাবগঞ্জ... পুরনো কেল্লা..."
রিক্সাওয়ালারা চোখ বুজে ফেলে, সুরা পড়ে আর জোরে প্যাডেল মারে। তারা জানে, ওই রিক্সার দিকে তাকালে, কিংবা ওই ডাকে সাড়া দিলে, তাদের পরিণতিও হবে কালামের মতো। অনন্তকালের জন্য এক অদেখা যাত্রীর বাহন হয়ে অন্ধকারের পথে পাড়ি জমানো। আর বাতাসের সাথে ভেসে আসে এক তীব্র, পুরনো আতরের গন্ধ, যা মনে করিয়ে দেয়—লোভ আর ভুলের মাশুল মাঝে মাঝে জীবন দিয়েও শোধ করা যায় না, শোধ করতে হয় তার চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে।

(END)
Noted: This story is protected under copyright law and copyrighted by Bhoutik kotha. Unauthorized copying, posting, or sharing may result in DMCA takedown, legal action, and Facebook account penalties. Content is tracked digitally—violators will be reported and penalized.
#ভূতেরগল্প #ভৌতিক #ভুত

 #মধ্যরাতের গোলপোস্টলেখক: আবির হাসানঅন্ধকার যখন ঘন হয়, তখন পরিচিত পৃথিবীটাও অচেনা ঠেকতে শুরু করে। ভয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট...
26/11/2025

#মধ্যরাতের গোলপোস্ট
লেখক: আবির হাসান

অন্ধকার যখন ঘন হয়, তখন পরিচিত পৃথিবীটাও অচেনা ঠেকতে শুরু করে। ভয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এর কোনো আকার নেই, আকৃতি নেই; এটি কেবল অস্তিত্বের গভীরে ঠান্ডা স্রোতের মতো বয়ে যায়। গ্রামের মানুষ বলে, রাতের আঁধার কেবল বিশ্রামের জন্য নয়, বরং এমন কিছু সত্তার বিচরণের সময়, যাদের নাম মুখে আনলেও বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এই গল্পটি কোনো রূপকথা নয়, বরং হাড়হিম করা এক অভিজ্ঞতার দলিল, যা যুক্তি আর কুসংস্কারের মাঝখানের দেয়ালটা নিমিষেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
গ্রামের নাম রসুলপুর। শীতের রাত। কুয়াশা এমনভাবে জেঁকে বসেছে যেন পুরো গ্রামটাকে সাদা কাফনে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত এগারোটা পার হয়েছে, কিন্তু গ্রামের হিসেবে এটা গভীর রাত। রাস্তাঘাট জনশূন্য, কুকুর ডাকার শব্দও শোনা যাচ্ছে না। কেবল মাঝে মাঝে উত্তুরে হাওয়ায় বাঁশঝাড়ের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ একঘেয়ে নিস্তব্ধতা ভাঙছে।
রসুলপুর গ্রামের ঠিক শেষ মাথায়, যেখানে পুরনো শ্মশানটা গিয়ে নদীর সাথে মিশেছে, তার ঠিক পাশেই একটা বিশাল খেলার মাঠ। নাম ‘দিঘির পাড়’। দিনের বেলা সেখানে ছেলেদের হইহুল্লোড় লেগেই থাকে, কিন্তু সূর্য ডোবার পর সেই মাঠের রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, দিঘির পাড়ের মাটি অভিশপ্ত। বহুকাল আগে নাকি এক ভয়াবহ মহামারিতে গ্রামের অর্ধেক মানুষ মারা গিয়েছিল, আর জায়গা অভাবে অনেককেই এই মাঠের নিচে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই এই মাঠ নিয়ে নানা কথা চালু আছে। বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে নাকি সেখানে এমন কিছু ছায়া দেখা যায়, যা মানুষের নয়।
রাকিব এসব গল্পকে বরাবরই ‘গাঁজাখুরি’ বলে উড়িয়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়া ছেলে সে। চশমার মোটা ফ্রেমের আড়ালে তার চোখ দুটো সব সময় যুক্তির সন্ধানে থাকে। কুসংস্কার তার কাছে আদিম মানুষের অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছে সে। গ্রামের বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়ার সময় প্রসঙ্গটা উঠল।
চায়ের দোকানদার মজিদ চাচা কেটলিতে গরম পানি ঢালতে ঢালতে নিচু স্বরে বললেন, “বাজান, তোমরা জোয়ান পোলাপান, রক্ত গরম। কিন্তু আমার কথা হোনো, আইজ কাইল ওই দিঘির পাড়ে যাইও না। দিনকাল ভালো না।”
রাকিব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। “কেন চাচা? দিনকাল তো ক্যালেন্ডারেই আছে। দিঘির পাড়ে আবার কী হলো? নতুন কোনো পেত্নী আমদানি হয়েছে নাকি?”
রাকিবের বন্ধু সাজিদ কনুই দিয়ে তাকে গুঁতো দিল। সাজিদ গ্রামের স্কুলেই মাস্টারি করে, গ্রামের মিথ আর সংস্কারগুলো সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস না করলেও ভয় পায়। সে ফিসফিস করে বলল, “চুপ কর রাকিব। মজিদ চাচা যা বলছে, তা বানিয়ে বলছে না। গত সপ্তাহে করিমের বাপ ওই পথ দিয়ে ফিরছিল। সে নিজের চোখে দেখেছে মাঠে কারা যেন ফুটবল খেলছে। কিন্তু তাদের শরীর...”
রাকিব কথার মাঝখানের থামিয়ে দিয়ে বলল, “শরীর কী? হাওয়ায় ভাসছিল? নাকি তাদের পা উল্টো ছিল? এসব আজগুবি গল্প বাদ দে তো। ফুটবল খেলছে, তার মানে গ্রামেরই কোনো পোলাপান হয়তো খেলছিল। করিমের বাপ হয়তো তালের রস খেয়ে মাতাল হয়ে ছিল, তাই উল্টাপাল্টা দেখেছে।”
“না রে রাকিব,” আরেক বন্ধু তুহিন গম্ভীর মুখে বলল। তুহিন একটু ভীতু প্রকৃতির। সে ঢোক গিলে বলল, “করিমের বাপ মদ খায় না। আর সে বলেছে, যারা খেলছিল, তারা মানুষ না। তাদের উচ্চতা নাকি তালগাছের সমান। আর তারা যেটা দিয়ে খেলছিল, সেটা ফুটবল না...”
“কী তবে?” রাকিব ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“মানুষের মাথা।” তুহিনের গলাটা কেঁপে উঠল।
রাকিব শব্দ করে হেসে উঠল। সেই হাসিতে চায়ের দোকানের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল। মজিদ চাচা বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। রাকিব চশমাটা খুলে শার্টের কোণায় মুছতে মুছতে বলল, “তোরা একশ বছর আগের গাঁজাখুরি গল্প নিয়ে এখনো পড়ে আছিস! একুশ শতকে মানুষ মঙ্গলে বসতি গড়ার প্ল্যান করছে, আর তোরা আছিস ভূত আর জ্বিনের ফুটবল খেলা নিয়ে। শোন, ভয় মানুষের মনের সৃষ্টি। হ্যালুসিনেশন। যখন তুই বিশ্বাস করবি যে ওখানে ভূত আছে, তখন বাতাসের শব্দকেও তোর ভূত মনে হবে।”
সাজিদ কিছুটা অপমানিত বোধ করল। সে বলল, “তোর এতই যখন সাহস, আজ রাতে গিয়ে দেখ না। বাজি ধরলাম।”
রাকিব চশমাটা চোখে পরে সোজা হয়ে বসল। তার চোখে এক ধরনের জেদ। “কত টাকা বাজি?”
“টাকা না। যদি তুই আজ রাত বারোটার পর দিঘির পাড়ে একা এক ঘণ্টা কাটাতে পারিস, আর ফিরে এসে বলিস কিছুই দেখিসনি, তাহলে আমি কাল পুরো গ্রামের মানুষকে খাসি খাওয়াব। আর যদি ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাবি, তাহলে তুই সবার সামনে স্বীকার করবি যে বিজ্ঞান সব কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না।”
“মঞ্জুর,” রাকিবের গলায় দৃঢ়তা। “আজ রাতেই যাব। তোরা শুধু দেখিস।”
রাত বারোটা বাজার পনেরো মিনিট আগে রাকিব বাড়ি থেকে বের হলো। তার পরনে একটা জ্যাকেট, হাতে একটা শক্তিশালী টর্চলাইট, আর পকেটে মোবাইল ফোন। শীতের প্রকোপ বেড়েছে। কুয়াশা এতটাই ঘন যে হাত দেড়েক দূরের জিনিসও ঝাপসা দেখাচ্ছে। গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাকিবের মনে হলো, সে যেন এক অনন্ত শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
রাস্তার দুপাশে বাঁশঝাড়গুলো ঝুঁকে আছে, যেন তারা একে অপরের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। রাকিবের জুতোর নিচে শুকনো পাতা মচমচ করে উঠছে। এই শব্দটা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। সাধারণত গ্রামে শেয়ালের ডাক শোনা যায়, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়, কিন্তু আজ যেন প্রকৃতি তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে।
হাঁটতে হাঁটতে রাকিব ভাবছিল তার বন্ধুদের কথা। ওরা বোকা। গ্রামের মানুষ অশিক্ষিত হতে পারে, কিন্তু সাজিদ তো শিক্ষিত। সে কেন এসব বিশ্বাস করে? বিজ্ঞান বলে, শক্তি কখনো ধ্বংস হয় না, কেবল রূপান্তর হয়। কিন্তু তাই বলে সেই শক্তি ফুটবল খেলবে? তাও আবার মানুষের মাথা দিয়ে? এসব ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
দিঘির পাড়ের কাছাকাছি আসতেই বাতাসটা যেন একটু ভারী হয়ে উঠল। একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল। অনেকটা পচা ডোবা বা পুরনো ভেজা কাঠের গন্ধের মতো। রাকিব নাকে রুমাল দিল। টর্চের আলো ফেলে সামনে তাকাতেই দিঘির পাড়ের বিশাল মাঠটা চোখে পড়ল।
মাঠটা লম্বায় প্রায় দুই ফুটবল মাঠের সমান। একপাশে বিশাল দিঘি, যার পানি এখন কুয়াশায় ঢাকা। অন্য তিন পাশ ঘিরে আছে প্রাচীন সব রেইনট্রি আর কড়ই গাছ। গাছগুলো এতই পুরনো যে তাদের শিকড়গুলো মাটির ওপর সাপের মতো কিলবিল করে ছড়িয়ে আছে। মাঠের মাঝখানটা ধূলিময়, ঘাস নেই বললেই চলে।
রাকিব মাঠের ঠিক মাঝখানের দিকে এগিয়ে গেল। তার বুকের ভেতরটা কি একটু কেঁপে উঠল? না, এটা শীতের কারণে। সে নিজেকে বোঝাল। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে মোবাইলের সময় দেখল। বারোটা বেজে পাঁচ। তাকে ঠিক এক ঘণ্টা এখানে থাকতে হবে।
সে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। সিগারেটের আগুনের লাল আভাটা কুয়াশার মধ্যে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে চারপাশে তাকাল। কোথাও কেউ নেই। দিঘির পানি স্থির। কোনো তরঙ্গ নেই। গাছগুলো স্থির। কোনো বাতাস নেই। সব কিছুই যেন একটা ছবির মতো স্থবির হয়ে আছে।
দশ মিনিট পার হলো। রাকিবের বিরক্তি লাগতে শুরু করল। মশা কামড়াচ্ছে। সে ভাবল, এক ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বোকামি আর কিছু হতে পারে না। সাজিদদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। সে পকেট থেকে ফোন বের করে গেম খেলার কথা ভাবল। ঠিক তখনই—
ধপ...
শব্দটা খুব কাছে নয়, আবার খুব দূরেও নয়। মাঠের পশ্চিম কোণ থেকে এল শব্দটা। রাকিব চমকে উঠল। শব্দটা ভারী কিছু মাটিতে পড়ার মতো। সে টর্চটা সেদিকে ঘোরাল। টর্চের আলো কুয়াশা ভেদ করে খুব বেশি দূর যেতে পারল না। কেবল সাদা ধোঁয়ার দেয়াল দেখা গেল।
“কে? কে ওখানে?” রাকিব চেঁচিয়ে উঠল। তার নিজের গলার আওয়াজটা নিজের কানেই অচেনা লাগল।
কোনো উত্তর নেই। আবার সেই নিস্তব্ধতা।
রাকিব হাসল। “শেয়াল হবে হয়তো। অথবা কোনো নারকেল পড়ল গাছ থেকে।” সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু তার যুক্তি তাকে মনে করিয়ে দিল, আশেপাশে কোনো নারকেল গাছ নেই। আর শেয়াল এত ভারী শব্দ করে হাঁটে না।
ধপ... ধপ...
এবার শব্দটা জোড়া। এবং আগের চেয়ে কাছে। যেন কেউ ভারী পায়ে এগিয়ে আসছে। রাকিবের হাতের সিগারেটটা নিভে গেছে কখন সে খেয়াল করেনি। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সে টর্চটা এদিক-ওদিক ঘোরাতে লাগল।
হঠাৎ মাঠের বাতাসটা বদলে গেল। এতক্ষণ বাতাস ছিল না, কিন্তু এখন হঠাৎ করে এক দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল। সেই হাওয়ায় কনকনে ঠান্ডা। আর সেই ভ্যাপসা গন্ধটা—এখন সেটা আরও তীব্র, অনেকটা বাসি রক্তের গন্ধের মতো।
রাকিবের চশমাটা কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। সে চশমা খুলে মুছতে যাবে, ঠিক তখন তার নজরে পড়ল মাঠের উত্তর দিকের গোলপোস্টের কাছে কিছু একটা নড়ছে। প্রথমে মনে হলো কুয়াশার কুণ্ডলী। কিন্তু ভালো করে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেল।
ছায়াগুলো স্বাভাবিক মানুষের উচ্চতার নয়। একেকটা ছায়া লম্বায় অন্তত আট থেকে দশ ফুট হবে। তাদের হাত-পাগুলো অস্বাভাবিকভাবে সরু এবং লম্বা। তারা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন মাটির সাথে তাদের কোনো সংযোগ নেই। রাকিব চশমাটা দ্রুত চোখে পরল। তার হাত কাঁপছে।
“কে আপনারা? এটা প্রাইভেট প্রপার্টি না হলেও এত রাতে এখানে কী করছেন?” রাকিব গলার জোর বাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু স্বর বের হলো ফিসফিসানির মতো।
ছায়াগুলো কোনো উত্তর দিল না। তারা ধীরে ধীরে মাঠের মাঝখানের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। তাদের হাঁটার ভঙ্গিটা বড়ই অদ্ভুত। হাঁটু ভাঁজ না করেই যেন তারা সামনে এগিয়ে আসছে। তাদের শরীরের রঙ মিশমিশে কালো, যেন অন্ধকারেরই তৈরি।
রাকিবের মনে হলো তার এখান থেকে দৌড় দেওয়া উচিত। তার মস্তিষ্ক তাকে বারবার সংকেত দিচ্ছে—পালাও, রাকিব, পালাও। কিন্তু তার পা দুটো যেন মাটির সাথে গেঁথে গেছে। সে নড়তে পারছে না। বিজ্ঞানের ছাত্র রাকিব আজ প্রথমবারের মতো এমন কিছুর মুখোমুখি হয়েছে যা তার কোনো বইয়ে লেখা নেই।
ছায়াগুলো এবার আরও স্পষ্ট হলো। সংখ্যায় তারা এগারো জন নয়, সাত-আট জন হবে। তাদের সবার মাঝখানে একজন দাঁড়িয়ে আছে, যার হাতে গোলাকার কিছু একটা।
রাকিব টর্চের আলোটা সরাসরি সেই বস্তুটার ওপর ফেলল। আলো পড়তেই সে যেটা দেখল, তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
ওটা কোনো ফুটবল নয়। ওটা একটা মানুষের মাথা।
মাথাটার চুলগুলো খামচে ধরে আছে সেই দীর্ঘকায় ছায়াটি। টর্চের আলোয় দেখা গেল মাথাটার চোখগুলো এখনো খোলা, আর তাতে আটকে আছে মৃত্যু যন্ত্রণার এক ভয়াবহ অভিব্যক্তি। গাল বেয়ে চাপ চাপ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চামড়া ফ্যাকাশে, অনেকটা সাদা কাগজের মতো।
রাকিবের গলা দিয়ে একটা গোঙানির মতো শব্দ বের হলো। সে পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু পারল না। তার হাত থেকে টর্চলাইটটা পড়ে গেল। আলোটা গিয়ে পড়ল ঘাসের ওপর, একটা অদ্ভুত অ্যাঙ্গেল থেকে আলো ছড়িয়ে দিল।
সেই ছায়ামূর্তিটি, যার হাতে মাথাটি ছিল, সে হঠাৎ হাতটা একটু উঁচুতে তুলল। তারপর এক ঝটকায় মাথাটা মাটিতে ফেলে দিল।
ধপাস!
মাটিতে পড়ার শব্দটা কোনো রাবারের বলের মতো হলো না, হলো মাংস আর হাড়ের মাটিতে আছড়ে পড়ার মতো বীভৎস এক শব্দ। এরপর যেটা ঘটল, তা দেখার জন্য রাকিবের হৃদপিণ্ড প্রস্তুত ছিল না।
অন্য একটা ছায়ামূর্তি, যে এতক্ষণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এল। তার পা-টা উঠল অনেক উঁচুতে। এবং সজোরে লাথি মারল সেই মাথাটিতে।
মাথাটা গড়িয়ে গড়িয়ে রাকিবের দিকে আসতে লাগল। ঘাসের ওপর দিয়ে গড়ানোর সময় একটা ‘খস খস’ শব্দ হচ্ছে। রাকিব দেখল, মাথাটা ঘুরতে ঘুরতে তার পায়ের কাছে এসে থামল।
মাথাটা কার, সেটা চেনার চেষ্টা করতেই রাকিবের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। এটা তো মজিদ চাচা! সেই চায়ের দোকানদার মজিদ চাচা, যার সাথে এক ঘণ্টা আগেই সে কথা বলে এসেছে! মজিদ চাচার খোলা চোখ দুটো সরাসরি রাকিবের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের মণি স্থির, কিন্তু তাতে এক গভীর অভিযোগ—‘কেন এলি এখানে?’
রাকিব চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। সে অনুভব করল তার প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ভয়ে তার শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে।
মাঠের মাঝখান থেকে সেই লম্বা ছায়াগুলো এবার তার দিকে ঘুরল। তাদের কোনো মুখ নেই, কেবল অন্ধকারের তৈরি এক একটা অবয়ব। কিন্তু রাকিব বুঝতে পারল, তারা হাসছে। নিঃশব্দ, নির্মম এক হাসি। তাদের একজন ধীরে ধীরে রাকিবের দিকে হাত বাড়াল। সেই হাতটা লম্বা হতে হতে রাকিবের খুব কাছে চলে এল। আঙুলগুলো শুকনো গাছের ডালের মতো খসখসে।
“আমাদের... খেলোয়াড়... কম...”
বাতাসে ভেসে এল একটা যান্ত্রিক, ভারী কণ্ঠস্বর। এটা কোনো মানুষের গলা নয়। এটা যেন মাটির নিচ থেকে উঠে আসা কোনো শব্দ।
“তুই... খেলবি...?”
রাকিবের চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। তার জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তে সে দেখল, মজিদ চাচার কাটা মাথাটা যেন নড়ে উঠল। তার ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে ফিসফিস করে বলল, “পালা...”
কিন্তু পালানোর পথ কি আর আছে? চারপাশের কুয়াশা এখন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। গাছগুলো যেন আরও কাছে এগিয়ে এসেছে, একটা জ্যান্ত খাঁচার মতো তাকে ঘিরে ফেলছে। রাকিবের মনে হলো, তার বিজ্ঞান, তার যুক্তি, তার অহংকার—সব কিছু এই মধ্যরাতের মাঠে এক তুচ্ছ ধূলিকণায় পরিণত হয়েছে।
সে পড়ে গেল মাটির ওপর। টর্চলাইটটা তখনো জ্বলছে, তার আলোয় দেখা যাচ্ছে একজোড়া কঙ্কালসার পা তার দিকে এগিয়ে আসছে। পরবর্তী শটের জন্য তারা প্রস্তুত। আর এবার বল হিসেবে তারা নতুন কিছু খুঁজছে।

রাকিবের মনে হলো তার শরীরটা অবশ হয়ে আসছে, যেন শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে রক্তের বদলে বরফগলা পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তের সেই ঝাপসা ঘোরটা কাটতে শুরু করেছে, কিন্তু চোখের পাতা খোলার সাহস সে সঞ্চয় করতে পারছে না। তার ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হতে শুরু করল তীব্র এক দুর্গন্ধে। সেই পচা ডোবা আর বাসি রক্তের গন্ধটা এখন এতটাই প্রকট যে মনে হচ্ছে সে কোনো কসাইখানার ড্রেনের ভেতরে শুয়ে আছে। তার গালটা মাটির সাথে লেগে আছে, কিন্তু মাটিটা অদ্ভুত রকম নরম আর চটচটে। এটা কি দিঘির পাড়? নাকি অন্য কোথাও?
রাকিব খুব সাবধানে চোখের পাতা সামান্য ফাঁক করল। কুয়াশা এখন আর সাদা নেই, ঘোলাটে হলদে এক বর্ণ ধারণ করেছে। টর্চলাইটটা এখনো জ্বলছে, কিন্তু সেটা তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ে আছে। সেই আলোর রেখা ভেদ করে সে যা দেখল, তাতে তার হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এল। তার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই কদাকার ছায়ামূর্তিগুলো। তাদের উচ্চতা এখন আরও বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে, যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। তাদের শরীর থেকে কালো ধোঁয়ার মতো বাষ্প বের হচ্ছে।
হঠাৎ রাকিব অনুভব করল, তার পায়ে শক্ত ও ঠান্ডা কিছু একটা স্পর্শ করছে। কোনো মানুষের হাতের স্পর্শ এত শীতল হতে পারে না। সেই স্পর্শে চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো। তাকে টেনেহিঁচড়ে সোজা করা হচ্ছে। রাকিবের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত নেমে গেল। সে নড়তে চাইল, চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার শরীর যেন তার মস্তিষ্কের কোনো নির্দেশই মানছে না। ‘স্লিপ প্যারালাইসিস’-এর মতো এক অসহায় অবস্থায় সে আটকে আছে।
“বল... বল প্রস্তুত...”
আবার সেই যান্ত্রিক, হাড়হিম করা কণ্ঠস্বর। এবার শব্দটা কোনো নির্দিষ্ট দিক থেকে এল না, মনে হলো বাতাস নিজেই কথা বলছে। রাকিবকে যারা ধরে দাঁড় করিয়েছিল, তাদের হাতের নখগুলো তার জ্যাকেট ভেদ করে চামড়ায় বসে যাচ্ছে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল সে।
তার ঠিক সামনেই সেই ছায়ামূর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে, যার হাতে একটু আগেও মজিদ চাচার কাটা মাথাটা ছিল। সে এখন রাকিবের মুখের দিকে ঝুঁকে এল। তার কোনো মুখমণ্ডল নেই, শুধুই অন্ধকারের এক গভীর গহ্বর। কিন্তু সেই গহ্বরের ভেতর থেকে দুটো লাল বিন্দুর মতো চোখ জ্বলে উঠল। রাকিবের মনে হলো সে সরাসরি নরকের দিকে তাকিয়ে আছে।
“তুই... গোলকিপার...”
ছায়ামূর্তিটি হিসহিস করে বলল। এইটুকু বলেই সে এক ধাক্কা দিল রাকিবকে। রাকিব তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গোলপোস্টের ঠিক মাঝখানে। কিন্তু মাটিতে পড়ার বদলে সে অনুভব করল সে হাড়গোড়ের স্তূপের ওপর পড়েছে। হাতের নিচে শক্ত হাড়ের টুকরো আর নরম পচা মাংসের অনুভূতি। সে আতঙ্কে ছিটকে সরে আসতে চাইল, কিন্তু দেখল গোলপোস্টের দুই খাম্বার মাঝখানে সে আটকা পড়েছে। কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে সেখানে আটকে রেখেছে।
খেলা শুরু হলো।
রাকিব দেখল, মাঠের মাঝখান থেকে একজন লম্বা খেলোয়াড় দৌড়ে আসছে। তার পায়ে সেই বল—মজিদ চাচার মাথা। মাথাটা মাটিতে গড়ানোর সময় এক বীভৎস আর্তনাদ করছে, যেন মজিদ চাচা এখনো প্রতিটি আঘাতে নতুন করে মারা যাচ্ছেন। “বাঁচাও... রাকিব... বাঁচাও...” মজিদ চাচার গলাটা কি শোনা গেল? নাকি এটা রাকিবের মনের ভুল?
খেলোয়াড়টি সজোরে লাথি মারল। মাথাটা বুলেট গতিতে ছুটে এল রাকিবের দিকে। রাকিবের ফিজিক্সের জ্ঞান তাকে বলছিল, এই গতিতে কোনো বস্তু আঘাত করলে তার বুকের পাঁজর গুঁড়ো হয়ে যাবে। সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
থপাস!
মাথাটা রাকিবের বুকে এসে লাগল না। ঠিক তার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পেছনের জালে আটকা পড়ল। কিন্তু বাতাসের যে ঝাপটা তার গালে লাগল, তাতে মনে হলো কেউ ধারালো ব্লেড দিয়ে তার গাল চিরে দিয়েছে। সে পেছনে তাকাল। মজিদ চাচার মাথাটা জালের সাথে আটকে আছে, আর তার জিবটা বের হয়ে ঝুলছে। সেই মৃত চোখ দুটো এখনো রাকিবের দিকে তাকিয়ে হাসছে। এক বিকৃত, শয়তানি হাসি।
“গোল...”
সমস্বরে চিৎকার করে উঠল ছায়ামূর্তিগুলো। সেই চিৎকারে দিঘির পানি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। গাছে বসে থাকা কোনো নিশাচর পাখি ভয়ে ডেকে উঠল না, কারণ তারাও জানে আজ রাতে এই মাঠ কাদের দখলে।
রাকিব বুঝতে পারল, এরা তাকে মারবে না। এরা তার সাথে খেলবে। তাকে মানসিকভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করে, তার সত্তাকে গ্রাস করে তবেই ছাড়বে।恐惧 (ভয়) যখন সীমানার বাইরে চলে যায়, তখন মানুষ পাগল হয়ে যায় অথবা তার ভেতরে আদিম এক জিঘাংসা জেগে ওঠে। রাকিবের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টা ঘটল। তার মনে হলো, এভাবে মরার চেয়ে লড়াই করে মরা ভালো। তার শরীরের অবশ ভাবটা কাটতে শুরু করেছে। অ্যাড্রেনালিন রাশ তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
সে আচমকা উঠে দাঁড়াল। তার হাতে উঠে এল একটা বড় হাড়ের টুকরো—সম্ভবত কোনো পশুর, অথবা... মানুষের উরুর হাড়। সে সেটা শক্ত করে ধরল।
“আমি খেলব না!” রাকিব চিৎকার করে উঠল। তার গলার স্বর ফেটে চৌচির হয়ে গেল। “তোরা কে? কি চাস তোরা?”
ছায়ামূর্তিগুলো তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তারা ধীরে ধীরে বৃত্তটা ছোট করে আনছে। তাদের হাঁটার ভঙ্গি এখন বদলে গেছে। তারা আর সোজা হয়ে হাঁটছে না, বরং পশুর মতো চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে ক্রলিং করে এগিয়ে আসছে। তাদের মেরুদণ্ডগুলো অদ্ভুতভাবে বাঁকানো।
“আমাদের... নিয়ম... ভঙ্গ... করেছিস...” একজন ছায়া ফিসফিস করে বলল। “শাস্তি... মৃত্যু... নয়... অনন্ত... খেলা...”
ঠিক সেই মুহূর্তে রাকিবের পকেটের ফোনটা বেজে উঠল। এই নারকীয় পরিবেশে ফোনের রিংটোনটা অদ্ভুত এবং হাস্যকর শোনাল। ফোনের আলো পকেটের ভেতর থেকে জ্বলে উঠল। এই সামান্য শব্দটুকু যেন ছায়াদের মনোযোগ একটু বিগ্নিত করল। তারা থমকে দাঁড়াল।
এই সুযোগ। এই এক সেকেন্ডের সুযোগ।
রাকিব জানে, সোজা পথে দৌড়ে সে পালাতে পারবে না। মাঠের গেটের দিকে তাকাতেই দেখল তিনজন ছায়া সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একমাত্র পথ—দিঘি। দিঘির পানি বরফশীতল হতে পারে, কিন্তু এই নরকের চেয়ে সেটা নিরাপদ।
রাকিব উল্টো ঘুরে দৌড় দিল। তার জীবনের সমস্ত শক্তি পায়ের পেশিতে এনে সে দৌড়াতে লাগল। পেছনে শোনা গেল ক্রুদ্ধ গর্জন। যেন একপাল হিংস্র নেকড়ে তাদের শিকার হাতছাড়া হতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।
“ধর... ধর ওকে...”
রাকিব দিঘির পাড়ের দিকে ছুটল। মাটি উঁচুনীচু, কাঁটাঝোপে তার প্যান্ট ছিঁড়ে গেল, চামড়া ছড়ে গেল, কিন্তু সে থামল না। তার পেছনে ভারী পায়ের ধপধপ শব্দ। তারা কাছে চলে এসেছে। ঘাড়ের ওপর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করছে সে।
দিঘির কালো পানি সামনে। রাকিব কোনো চিন্তাভাবনা না করেই ঝাঁপ দিল।
ঝপাস!
কনকনে ঠান্ডা পানি তাকে গ্রাস করল। পানির নিচে ডুব দিতেই বাইরের জগতের শব্দগুলো চাপা পড়ে গেল। কিন্তু পানির নিচেও শান্তি নেই। রাকিব অনুভব করল, পানির নিচ থেকেও লম্বা লম্বা হাত তার পা খামচে ধরার চেষ্টা করছে। দিঘির তলায় থাকা শ্যাওলাগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে তার শরীর পেঁচিয়ে ধরছে। সে হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটতে লাগল। তার ফুসফুস ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
কোনো রকমে দিঘির অন্য পাড়ে ভেসে উঠল সে। এই পাড়টা গ্রামের দিকে। সে হামাগুড়ি দিয়ে ডাঙ্গায় উঠল। শীতে আর ভয়ে তার দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে। সে পেছনে তাকানোর সাহস পেল না। শুধু উঠে দৌড়াতে লাগল।
গ্রামের সরু রাস্তা ধরে সে ছুটছে। কুয়াশা এখনো ঘন, কিন্তু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো তাকে কিছুটা ভরসা দিল। তার মনে হলো সে অন্য এক ডাইমেনশন থেকে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছে।
রাকিব সোজা গিয়ে ধাক্কা খেল চায়ের দোকানের বন্ধ শাটারে।
“মজিদ চাচা! মজিদ চাচা!” সে পাগলের মতো শাটারে কিল ঘুষি মারতে লাগল। “দরজা খোলেন! ওরা আসছে! ওরা আসছে!”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এল না।
রাকিবের মাথা ঘুরছে। মজিদ চাচার মাথা সে মাঠে দেখে এসেছে। তাহলে এখানে কে দরজা খুলবে? তার মনে পড়ে গেল বাজি ধরার কথা। সাজিদ! তুহিন! ওরা কোথায়? ওরা কি এখনো ওখানেই অপেক্ষা করছে? নাকি ওরাও...
সে আবার দৌড়াতে শুরু করল। এবার সাজিদের বাড়ির দিকে। গ্রামের কুকুরগুলো এবার ডাকতে শুরু করেছে। তাদের কান্নাজড়িত ডাক শুনে মনে হচ্ছে তারাও আজ রাতে অশুভ কিছুর উপস্থিতি টের পেয়েছে।
সাজিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে রাকিব আছড়ে পড়ল। “সাজিদ! দরজা খোল! বাঁচাও আমাকে!”
অনেকক্ষণ পর ঘরের বাতি জ্বলল। সাজিদ চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলল। রাকিবকে দেখে সে আঁতকে উঠল। রাকিবের সারা শরীর কাদামাখা, জামাকাপড় ছেঁড়া, শরীরে রক্তের দাগ (কার রক্ত?), আর চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা।
“রাকিব! তুই! তোর এই অবস্থা কেন?” সাজিদ তাকে ধরে ভেতরে নিয়ে এল।
রাকিব সাজিদের কলার চেপে ধরল। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। “ওরা... ওরা ফুটবল খেলছে... মজিদ চাচার মাথা দিয়ে... আমি দেখেছি সাজিদ... আমি দেখেছি... ওরা আমাকেও গোলকিপার বানাতে চেয়েছিল...”
সাজিদ রাকিবকে শান্ত করার চেষ্টা করল। “কী বলছিস উল্টাপাল্টা? মজিদ চাচা তো সন্ধ্যাবেলায় দোকান বন্ধ করে বাড়ি গেল। তুই স্বপ্ন দেখেছিস রাকিব। শান্ত হ।”
“না! স্বপ্ন না!” রাকিব চিৎকার করে উঠল। “আমার জ্যাকেট দেখ! এই দেখ নখের দাগ! ওরা মানুষ না সাজিদ, ওরা মানুষ না। ওই মাঠ... ওই মাঠ একটা কবরস্থান না, ওটা নরক!”
রাকিবের চিৎকারে সাজিদের বাড়ির সবাই উঠে এল। রাকিবকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। সে বিড়বিড় করছে, “মাথাটা... গোলপোস্ট... মজিদ চাচা হাসছিল...”
সকালে গ্রামের আকাশ পরিষ্কার হলো। রোদ উঠল, কিন্তু সেই রোদে কোনো উত্তাপ ছিল না। পুরো গ্রামে একটা শোকের ছায়া নেমে এল। খবরটা বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ল।
দিঘির পাড়ের মাঠের ঠিক মাঝখানে মজিদ চাচার লাশ পাওয়া গেছে। তার শরীরটা অক্ষত, কিন্তু মাথাটা ধড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মাথাটা পাওয়া গেছে গোলপোস্টের নেটের ভেতর আটকানো অবস্থায়। আর তার চোখ দুটো... সেই চোখ দুটো খোলা, আর মুখে লেগে আছে এক অদ্ভুত ভয়ের ছাপ। ডাক্তাররা বলছেন, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হলো কীভাবে, তার কোনো ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারছে না। যেন কেউ বা কারা প্রচণ্ড শক্তিতে মাথাটা শরীর থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিল।
পুলিশ এল। তদন্ত হলো। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা পাওয়া গেল না। গ্রামের মানুষ বলাবলি করতে লাগল, জ্বিনেরা তাদের খেলা শেষ করেছে।
রাকিবকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে এখন আর ফিজিক্স পড়ে না। সে এখন আর কোনো কিছু নিয়েই প্রশ্ন করে না। তাকে একটা মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সে সারাদিন ঘরের কোণায় বসে থাকে। তার হাতে সবসময় একটা কাল্পনিক বল থাকে। সে বাতাসের সাথে কথা বলে।
মাঝে মাঝে নার্সরা শুনতে পায়, সে ফিসফিস করে বলছে, “আমার টার্ন এখনো শেষ হয়নি... হাফ টাইম চলছে... ওরা আবার আসবে... সেকেন্ড হাফ খেলতে...”
রাতে যখন হাসপাতালের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়, রাকিব তখন বিছানার নিচে লুকিয়ে পড়ে। সে জানে, অন্ধকার নামলেই ওরা ছায়া হয়ে আসে। আর তাদের দলের একজন খেলোয়াড় এখনো কম আছে। রাকিব জানে, সেই শূন্যস্থানটা তাকে দিয়েই পূরণ করা হবে। কারণ, সে বাজিটা হেরে গেছে। আর বাজির শর্ত ছিল—তার যুক্তি, তার বিশ্বাস, আর তার মস্তিষ্ক।
বিজ্ঞান বলে শক্তি ধ্বংস হয় না, কেবল রূপান্তর হয়। রাকিবের যুক্তি আর সাহসের শক্তি এখন রূপান্তরিত হয়েছে অনন্ত এক ভয়ে, যা তাকে তিলে তিলে গ্রাস করছে। দিঘির পাড়ের সেই রেফারি এখনো তার বাঁশি বাজায়নি। খেলা এখনো বাকি।

(END)
Noted: This story is protected under copyright law and copyrighted by Bhoutik kotha. Unauthorized copying, posting, or sharing may result in DMCA takedown, legal action, and Facebook account penalties. Content is tracked digitally—violators will be reported and penalized.
#ভূতেরগল্প #ভৌতিক #ভুত

Address


Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Bhoutik Kotha posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Bhoutik Kotha:

  • Want your business to be the top-listed Media Company?

Share

ভৌতিক কথার জানা অজানা ইতিহাস ।

ভুত এফ এম বন্ধ হয়ে যায় ১৩ই ডিসেম্বর ২০১৯ সালে। এর পর থেকেই আমাদের ইচ্ছাছিল একটা ভৌতিক ঘটনা নিয়ে ভুত এফ এম এর মতই একটা ভৌতিক সিরিজ করবো। ঠিক এমনটা ভাবতে ভাবতেই অনেক গুলো ভৌতিক ঘটনা শেয়ার করার মত একজন মানুশ মনির ভাইকে আমরা পেয়ে যাই আর সাথে সাথে প্ল্যানিংটা কে বাস্তবায়ন করে ফেলি। ঠিক এভাবেই গড়ে উঠেছে ভৌতিক কথা। আমাদের প্রথম এপিসড এ আল্লাহর রহমতে বেশ সারা পেয়েছি । তাই আমাদের ইচ্ছা এই প্রোগ্রামটাকে সাম্নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আপনাদের ভালোবাসা এবং অনুপ্রেরণবা আমাদের কাম্য। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সপ্তাহে দুইদিন এপইসড করা । এবং আপনাদের ভালোবাসা আছে বলেই হয়ত আমাদের পক্ষে প্রতি সপ্তাহে দুদিন করে টেলিকাস্ট করতে পারছি । আমাদের ইউটিউব চ্যানেল লিঙ্ক - https://www.youtube.com/channel/UCrZ2O60RhGy9tDk3iC6Xi9w

সাবক্স্রাইব করে সাথে থাকবেন এবং ৬ টা এপিসড দেখে আসুন আপনাদের মতামত জানাবেন ।

প্রতি শুক্র এবং শনিবার রাত ১১-১৫ মিনিটে চোখ রাখুন ভৌতিক কথা এর ইউটিউব চ্যানেল এ । BHOUTIK KOTHA is a Bengali weekly horror storytelling show which is brought to you by it's own Youtube channel, hosted by Jeffrey Khan horror storyteller of Bangladesh. In this show, Jeffrey Khan and many other guests share thier supernatural experiences & stories for their listeners. If u want to share your own story with us then email us here - [email protected]