26/11/2025
#অন্ধকারের প্রতিদান
লেখক: সাজিদ আহমেদ
রাত যখন গভীর হয়, তখন শহরের পরিচিত রাস্তাগুলোও অচেনা হয়ে ওঠে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো আর অন্ধকারের লুকোচুরিতে এমন কিছু ছায়া জন্ম নেয়, যা মানুষের যুক্তির বাইরে। আমরা ভাবি, ভাগ্য বুঝি পরিশ্রমের ফল, কিংবা ঈশ্বরের দান। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন কিছু দান আমাদের হাতে আসে, যা আলো থেকে নয়, বরং ঘন অন্ধকার থেকে উঠে আসা কোনো সত্তার খেয়ালি উপহার। সেই উপহারের ভার মানুষ সইতে পারে না, সেই উপহারের স্পর্শে বাস্তব আর অবাস্তবের দেয়ালটা কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। লোভ যখন মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তখন সে ভুলে যায়—বিনিময় ছাড়া এই পৃথিবীতে, কিংবা এই পৃথিবীর বাইরের জগত থেকে কিছুই পাওয়া যায় না।
কার্তিক মাসের শেষ দিক। ঢাকার বুকে শীত নামতে শুরু করেছে। দিনের বেলা ধুলো আর ধোঁয়ায় জঞ্জাল হয়ে থাকা শহরটা রাত গভীর হতেই এক অদ্ভুত চাদর মুড়ি দেয়। কুয়াশা। আজ কুয়াশাটা একটু বেশিই। রাত দুইটা বাজে। মিরপুর বেড়িবাঁধের দিকের রাস্তাটা এখন প্রায় জনশূন্য। দু-একটা লরি বা ট্রাক গর্জন করে চলে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে, তারপর আবার সেই নিস্তব্ধতা। রাস্তার ধারের সোডিয়াম বাতিগুলোর কয়েকটা জ্বলছে, কয়েকটা নিভে আছে, যেন অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও ক্লান্ত।
কালাম মিয়ার রিক্সার চেইনটা ক’দিন ধরেই ঝামেলা করছে। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটা এই নিস্তব্ধ রাতে বড় বেমানান লাগছে তার কাছে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, শরীরে আগের মতো জোর নেই। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে এখন পিঠের হাড়গুলো যেন চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গামছা দিয়ে মুখের ঘাম আর কুয়াশার জল মুছল সে। পকেটে হাত দিয়ে দেখল, সারাদিনে যা কামাই হয়েছে, তাতে চাল-ডাল কেনা যাবে, কিন্তু ঘরভাড়ার বাকি টাকাটা হবে না। মহাজন আজ সকালেই হুমকি দিয়ে গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালাম রিক্সাটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করাল। গাবতলীর দিকে যাবে, নাকি সোজা গ্যারেজে চলে যাবে—এই দোটানায় ভুগছিল সে। শরীর বলছে, ‘বাড়ি চল’, কিন্তু পকেট বলছে, ‘আর একটা খ্যাপ’।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মানুষটা এল।
কোত্থেকে এল, কালাম খেয়াল করেনি। মনে হলো যেন কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে হঠাৎই উদয় হলো। রাস্তার উল্টোপাশের একটা বড় কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা, কাঁধের ওপর একটা ছাই রঙের চাদর জড়ানো। এই শীতেও লোকটার পায়ে চটি নেই, খালি পা। রাস্তার ওপাশ থেকে আবছা আলোয় মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে লোকটা বেশ লম্বা। সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু বেশিই লম্বা যেন।
কালামের বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছাঁত করে উঠল। এত রাতে, এমন নির্জন রাস্তায় এমন পরিপাটি পোশাকের মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। সে রিক্সার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরল। ভাবল চলে যাবে। কিন্তু অভাব বড় খারাপ জিনিস, ভয়কে সে পেটে খিদে দিয়ে চাপা দেয়।
লোকটা রাস্তা পার হয়ে ধীর পায়ে রিক্সার কাছে এগিয়ে এল। হাঁটার ভঙ্গিটা অদ্ভুত, যেন মাটির সাথে পায়ের কোনো শব্দ হচ্ছে না। কালামের রিক্সার হুডটা নামানো ছিল। লোকটা কাছে এসে দাঁড়াতেই একটা তীব্র সুগন্ধ কালামের নাকে লাগল। আতর। খুব কড়া, পুরনো আমলের আতর, আর তার সাথে মেশানো কেয়া ফুলের গন্ধ। গন্ধে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল কালামের।
"যাবেন?"
গলাটা খুব ভরাট, কিন্তু কেমন যেন যান্ত্রিক। যেন কোনো গভীর কুয়োর ভেতর থেকে আওয়াজটা উঠে আসছে।
কালাম একটু নড়েচড়ে বসল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, "কই যাইবেন সাব?"
"নবাবগঞ্জ। পুরোনো কেল্লার মোড়।"
কালাম চমকে উঠল। নবাবগঞ্জ এখান থেকে অনেক দূর। আর পুরোনো কেল্লার ওই দিকটা তো এখন প্রায় পরিত্যক্ত। দিনের বেলাতেই মানুষ ওদিকে যেতে ভয় পায়, আর এই রাত দুপুরে!
"সাব, ওইদিকে তো রাস্তাঘাট ভালা না। আর অনেক দূর। আইজকা থাক, আমি গ্যারেজে যামু।" কালাম বিনয়ের সাথেই না করার চেষ্টা করল।
লোকটা কোনো কথা বলল না। চাদরের নিচ থেকে একটা হাত বের করল। রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোয় কালাম দেখল, হাতটা ফ্যাকাশে সাদা, আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা। লোকটা পকেট থেকে এক দলা টাকা বের করল না, বরং তর্জনী উঁচিয়ে ইশারা করল।
"ডাবল ভাড়া দেব। যাবে?"
লোভ। মানুষের আদিমতম রিপু। কালামের চোখের সামনে মহাজনের মুখটা ভেসে উঠল। ডাবল ভাড়া পেলে কালকের দিনটা নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে। সে ঢোক গিলল। আতরের গন্ধে তার বিচারবুদ্ধি যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল।
"উঠেন তাইলে," কালামের গলাটা একটু কেঁপে গেল।
লোকটা রিক্সায় উঠল। উঠার সময় রিক্সাটা এমনভাবে দুলে উঠল যেন মনে হলো বিশাল কোনো পাথরের চাই চাপানো হয়েছে সিটে। কালাম অবাক হলো। লোকটাকে দেখে তো এত ভারী মনে হয়নি! চিকন স্বাঁস্থ্য, অথচ ওজনে রিক্সার টায়ার যেন মাটিতে দেবে গেল।
রিক্সা চলতে শুরু করল। বেড়িবাঁধের রাস্তা ধরে সোজা দক্ষিণে।
প্রথম পনেরো মিনিট কোনো কথা হলো না। শুধু রিক্সার চেইনের সেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আর কালামের ভারী নিঃশ্বাস। পেছনের যাত্রী একদম মূর্তির মতো বসে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না। কালামের পিঠের ওপর একটা শীতল দৃষ্টির ভার সে অনুভব করতে পারছিল। সাধারণত যাত্রীরা রিক্সায় উঠলে নড়াচড়া করে, মোবাইল টেপে, কিংবা বিড়ি ধরায়। কিন্তু এই লোকটা একদম স্থির।
রাস্তাটা ক্রমশ নির্জন থেকে নির্জনতর হতে লাগল। কুয়াশা যেন আরও ঘন হয়ে চেপে ধরছে চারপাশ। রাস্তার দুপাশের গাছগুলো অদ্ভুত সব আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালামের মনে হলো, আজ রাতটা যেন শেষই হচ্ছে না।
"সাব, আপনে কি ওইহানে থাকেন?" নীরবতা ভাঙার জন্যই জিজ্ঞেস করল কালাম। নিজের গলার আওয়াজ নিজের কাছেই অচেনা লাগল।
পেছন থেকে কোনো উত্তর এল না। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ।
কালাম আবার বলল, "ওই দিকের রাস্তা তো ভাইঙ্গা গেছে শুনছি। রিক্সা কতদূর যাইবো জানি না।"
এবারও কোনো উত্তর নেই। কালাম ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর সাহস পেল না। তার মনে হলো, ঘাড় ঘোরালেই সে এমন কিছু দেখবে যা সে দেখতে চায় না। কিন্তু আতরের গন্ধটা আরও তীব্র হয়েছে। গন্ধটা এখন আর সুবাস মনে হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে বাসি ফুলের পচা গন্ধের সাথে মেশানো কোনো রাসায়নিক। বমি বমি ভাব হতে লাগল তার।
হঠাৎ করেই একটা কুকুর রাস্তার বাম পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল। সাধারণ ঘেউ ঘেউ নয়, কলিজা ছেঁড়া আর্তনাদ। কালাম দেখল, রাস্তার ধারের জঞ্জালের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে একটা কালো কুকুর তার রিক্সার দিকে তাকিয়ে হিংস্রভাবে গোঙাচ্ছে। কিন্তু কুকুরটা এগোচ্ছে না, বরং পেছনের পায়ে ভর দিয়ে ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।
কালামের শরীরটা হিম হয়ে এল। মুরুব্বিরা বলে, কুকুর আর বিড়াল নাকি এমন জিনিস দেখে যা মানুষ দেখে না। সে জোরে প্যাডেল মারতে চাইল, কিন্তু পারল না। রিক্সাটা মনে হচ্ছে ক্রমশ আরও ভারী হয়ে যাচ্ছে। যেন পেছনের যাত্রী একা নয়, তার সাথে আরও কেউ চেপে বসেছে।
"আর কত দূর?" পেছন থেকে সেই ভরাট গলা ভেসে এল। কিন্তু এবার গলাটা যেন কানের একদম কাছে। কালাম শিউরে উঠল। যাত্রী তো সিটে বসে আছে, তাহলে আওয়াজটা ঘাড়ের কাছে এল কীভাবে?
"জি... জি সাব, আর একটু। সামনেই তো শ্মশান ঘাট, ওটা পার হইলেই কেল্লার মোড়।" কালামের জিব আড়ষ্ট হয়ে আসছে।
শ্মশান ঘাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কালামের মনে হলো বাতাসটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। এত শীতের রাতেও গরম বাতাস! রাস্তার দুপাশে বড় বড় বটগাছ। তাদের ঝুড়িগুলো নিচে নেমে এসেছে ফাঁসির দড়ির মতো। কালাম বিড়বিড় করে সুরা ফাতিহা পড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মনে করতে পারল না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে পুরোনো কেল্লার মোড় দেখা গেল। একসময় এখানে জাঁকজমক ছিল, এখন শুধু ভাঙাচোরা কিছু ইটের দেয়াল আর জঙ্গল। রাস্তার বাতি এখানে নেই বললেই চলে। চাঁদের আলো কুয়াশায় আটকে গিয়ে এক ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে।
"থামাও।"
আদেশটা এল খুব শান্তভাবে। কালাম ব্রেক কষল। রিক্সাটা থামতেই তার মনে হলো কাঁধ থেকে হাজার মণের বোঝা নেমে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে সে শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছল।
লোকটা রিক্সা থেকে নামল। সেই একই রকম ধীরস্থির ভঙ্গি। কিন্তু এবার কালাম একটা জিনিস খেয়াল করল। লোকটা যখন মাটিতে পা রাখল, মাটির ধুলো উড়ল না। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে গেল, কিন্তু মড়মড় শব্দ হলো না।
কালাম ভয়ে কথা বলতে ভুলে গেল। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। লোকটা রিক্সার সামনে এসে দাঁড়াল। চাদরের আড়াল থেকে হাত বের করল।
"আজকের রাতটা তোমার জন্য মনে থাকবে, কালাম।"
কালাম চমকে উঠল। সে তো নিজের নাম বলেনি! এই লোক তার নাম জানল কী করে?
"সাব... আপনে আমার নাম..."
"চুপ!" লোকটা ধমক দিল না, কিন্তু সেই এক শব্দেই কালামের কথা বন্ধ হয়ে গেল। "তোমার মেয়েটার জ্বর, তাই না? টাকার জন্য ওষুধ কিনতে পারোনি।"
কালামের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। এই লোক কে? মানুষ নাকি অন্য কিছু? সে কি পীর-ফকির? নাকি...
লোকটা তার দিকে এক তাড়া নোট বাড়িয়ে দিল। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে, ওগুলো সব বড় নোট। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটের একটা আস্ত বান্ডিল।
"নাও। এটা তোমার ভাড়া, আর তোমার মেয়ের ওষুধের খরচ।"
কালাম কাঁপাকাঁপা হাতে টাকাটা নিল। টাকার নোটগুলো অস্বাভাবিক ঠান্ডা। যেন ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে। টাকা হাতে নিতেই শরীরে একটা বিদ্যুতিক শকের মতো শিহরণ খেলে গেল।
"সাব, এত টাকা! ভাড়া তো মাত্র..."
"বেশি কথা বলো না। যা দিয়েছি, রাখো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।" লোকটা ঝুঁকে এল কালামের মুখের কাছে। আবছা আলোয় এবার কালাম লোকটার চোখ দুটো দেখল। ওগুলো মানুষের চোখ নয়। চোখের মণি নেই, পুরোটাই আগুনের মতো জ্বলজ্বলে হলদেটে।
কালাম চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না।
"বাড়ি যাওয়ার আগে এই টাকা গুনবে না। কাউকে দেখাবে না। সোজা বাড়ি যাবে, বাক্সে রেখে দেবে। সকাল হওয়ার আগে এই টাকার দিকে তাকাবে না। মনে থাকবে?"
কালাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়ল।
"যাও এখন। পেছনে তাকাবে না।"
কালাম আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। রিক্সা ঘুরিয়ে সে প্যাডেল মারল প্রাণপণে। তার মনে হচ্ছিল, সে যদি এখন না পালায়, তবে এই অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নেবে। সে রিক্সা চালাচ্ছে ঝড়ের বেগে। অথচ একটু আগেই তার শরীরে শক্তি ছিল না। এখন অজানা এক ভয়ে তার পায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে।
কিছুদূর যাওয়ার পর তার খুব ইচ্ছে হলো পেছনে ফিরে তাকানোর। লোকটা কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? নাকি মিলিয়ে গেছে? কিন্তু লোকটার সেই সাবধানবাণী—"পেছনে তাকাবে না"—তাকে থামিয়ে রাখল।
রাস্তা যেন শেষ হতে চায় না। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে তার মনে হতে লাগল, কেউ একজন তার কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলছে। কিন্তু সে কান দিল না। তার পকেটে টাকার বান্ডিলটা আগুনের মতো গরম মনে হচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই বরফের মতো ঠান্ডা।
মিরপুরের চেনা রাস্তায় যখন সে পৌঁছাল, তখন রাত সাড়ে তিনটা। শহরের কুকুরগুলো এখন শান্ত হয়ে গেছে। কালামের বুকের ধড়ফড়ানি একটু কমল। সে বেঁচে ফিরেছে। এবং তার পকেটে এখন অনেক টাকা। হয়তো পঞ্চাশ হাজার, হয়তো তারও বেশি। তার সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে। মেয়েটার চিকিৎসা হবে। একটা নতুন রিক্সা কেনা যাবে।
আনন্দে আর উত্তেজনায় কালামের কান্না পাচ্ছিল। সে রিক্সাটা গ্যারেজে জমা না দিয়েই সোজা নিজের বস্তির দিকে রওনা দিল। গ্যারেজের মালিককে কাল সকালে বুঝিয়ে বলা যাবে। এখন তার প্রথম কাজ টাকাটা নিরাপদে ঘরে তোলা।
বস্তির সরু গলি দিয়ে রিক্সা নিয়ে ঢোকার সময় তার মনে হলো, কেউ যেন তাকে নজরে রাখছে। কিন্তু সে পাত্তা দিল না। তার টিনের চালের ঘরটার সামনে এসে রিক্সা রাখল। তালা খুলল খুব সাবধানে, যেন আওয়াজ না হয়।
ঘরে ঢুকে সে দেখল, তার স্ত্রী আমেনা আর ছোট মেয়েটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটার গায়ে হাত দিয়ে দেখল, জ্বরটা একটু কমেছে। কালামের মনটা শান্তিতে ভরে গেল। সে সাবধানে ঘরের কোণে রাখা পুরনো টিনের ট্রাঙ্কটা খুলল। আমেনার পুরনো শাড়ি আর কাঁথার নিচে সে টাকার বান্ডিলটা রেখে দিল।
লোকটা বলেছিল, সকাল হওয়ার আগে না দেখতে। কালাম কথা রাখবে। সে জানে, বুজুর্গ বা পীর-ফকিরদের কথা অমান্য করলে ক্ষতি হয়। সে ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে দিল।
বিছানায় শুয়ে তার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। চোখের সামনে ভাসছে সেই হলুদ চোখ, নাকে সেই তীব্র পচা ফুলের গন্ধ। আর মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। কাল সকালে উঠেই সে বাজার করবে। মেয়েকে ডাক্তার দেখাবে। আমেনার জন্য একটা ভালো শাড়ি কিনবে।
শুয়ে শুয়ে কখন যে তার চোখ লেগে এল, সে টেরই পেল না।
ঘুম ভাঙল যখন, তখন সকাল আটটা বাজে। রোদের আলো টিনের ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকেছে। বাইরে বস্তির কোলাহল শুরু হয়ে গেছে। কালাম ধড়মড় করে উঠে বসল। তার শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে, যেন গত রাতে কেউ তাকে পিটিয়েছে। কিন্তু মনে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটল। টাকা!
আমেনা তখনো উঠানে বাসন মাজছে। কালাম কাউকে কিছু না বলে সোজা ট্রাঙ্কের কাছে গেল। হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। আজ থেকে তাদের আর কোনো অভাব থাকবে না।
সে ট্রাঙ্কের ডালাটা খুলল। কাঁথা আর কাপড়গুলো সরাল। তার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করেছে। ওই তো, কাপড়ের নিচে উঁচু হয়ে আছে জায়গাটা।
কালাম হাত ঢোকাল। স্পর্শ করতেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল। টাকার নোট তো এমন খসখসে আর শক্ত হওয়ার কথা নয়! এত ঠান্ডা কেন?
সে এক টানে জিনিসটা বের করে আনল।
এবং পরমুহূর্তেই তার গলার ভেতর থেকে এক অমানবিক চিৎকার বেরিয়ে এল। তার হাত থেকে জিনিসগুলো ঝনঝন করে মেঝতে পড়ে গেল।
ওগুলো কোনো টাকা নয়।
মেঝের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে একগাদা পোড়া মাটির ভাঙা খাপরা (টালি) আর কিছু পুরোনো হাড়ের টুকরো। মাটির খাপরাগুলোর ওপর কয়লা দিয়ে কিছু অদ্ভুত নকশা আঁকা, যা দেখতে টাকার নোটের মতো মনে হয়েছিল অন্ধকারে। আর তার সাথে, একটা মরা মানুষের হাতের আঙুলের হাড়।
ঘরের বাতাসে ভুরভুর করে ছড়িয়ে পড়ল সেই তীব্র আতর আর পচা লাশের গন্ধ।
আমেনা দৌড়ে ঘরে ঢুকল, "কী হইছে? ও মাগো! তুমি চিল্লাও ক্যান?"
কালাম কোনো উত্তর দিতে পারল না। সে শুধু মেঝের দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার মনে পড়ে গেল গত রাতের সেই যাত্রীর কথা। সেই হলুদ চোখ।
"টাকা... আমার টাকা..." কালাম বিড়বিড় করে বলতে লাগল, "ওরা আমারে ঠকাইছে... শয়তান... জ্বিন..."
আমেনা অবাক হয়ে মেঝের দিকে তাকাল। "কি হাবি-জাবি বকো? এইগুলা তো মরা মাইনষের হাড় আর ভাঙা হাড়ি! তুমি রাইতে কই গেছিলা?"
কালামের তখনো ঘোর কাটেনি। সে বুঝতে পারছিল না এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি। কিন্তু ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে তখনো একটা ধোঁয়া বেরোচ্ছিল, আর সেই ধোঁয়ায় লেখা ছিল তার সর্বনাশের ইঙ্গিত। সে বুঝতে পারল, সে মানুষের যাত্রী বহন করেনি। সে বহন করেছিল অন্য জগতের কাউকে। আর তাদের প্রতিদান মানুষের জন্য আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ।
হঠাৎ কালামের চোখ পড়ল হাড়ের টুকরোটার পাশে পড়ে থাকা একটা ছোট কাগজের টুকরোর দিকে। ওটা গতকালকের টাকার বান্ডিলের মতো দেখতে হলেও এখন সাধারণ একটা চিরকুট। সে ভয়ে ভয়ে সেটা তুলল।
কয়লা দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে সেখানে লেখা:
"লোভ করেছিস, তাই আসলটা নিলি না। ঋণ শোধ করতে চাস? আজ রাতে আবার আসব। তৈরি থাকিস।"
কালামের চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল। সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সেই ভাঙা খাপরা আর হাড়ের ওপর।
জ্ঞান ফেরার পর কালামের মনে হলো, সে যেন এক গভীর পানির নিচ থেকে ভেসে উঠল। কিন্তু ভেসে ওঠার পর যে আলো দেখার কথা, তা সে দেখল না। তার চোখের সামনে তখনো সেই ভাঙা খাপরা, পোড়া হাড় আর কয়লা দিয়ে লেখা চিরকুটটা ভাসছে। ঘরের ভেতর সেই পচা লাশের গন্ধটা এখন আর নেই, কিন্তু কালামের নাকে গন্ধটা আঠার মতো লেগে আছে। সে উঠে বসার চেষ্টা করল, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। টিনের চালের ফুটো দিয়ে আসা রোদের কোণটা এখন ঘরের পূর্ব কোণে হেলে পড়েছে। আমেনা চোকিতে বসে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। স্বামীকে নড়তে দেখে সে দ্রুত কাছে এল। তার চোখেমুখে আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি।
"ও কালামের বাপ, তোমার কী হইছে কও তো? রাইত থাইকা তুমি কেমন করতেছ! আর এইগুলা... এই হাড়-হাড্ডি ঘরে কেমনে আইল?" আমেনার গলা কাঁপছে। সে স্বামীর কপালে হাত রাখল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কিন্তু এই জ্বর সাধারণ জ্বর নয়, শরীরটা বরফের মতো ঠান্ডা, অথচ ভেতরটা পুড়ছে।
কালাম কোনো কথা বলল না। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে পড়ছে সেই চিরকুটের শেষ লাইনটা—"আজ রাতে আবার আসব।" সূর্য ডুবতে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। পশ্চিম আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। এই লাল রং কালামের কাছে সাধারণ গোধূলি মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পুরো আকাশটা রক্তে মেখে আছে। তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে। পালাতে হবে। কোথাও পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? যার ছায়া একবার গায়ে লেগেছে, দুনিয়ার কোনো কোণায় লুকিয়ে তাকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।
সে আমেনার হাতটা খপ করে ধরল। তার হাতের বাঁধন এত শক্ত যে আমেনা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল।
"আমেনা, ঘরের দোর দে। জানালা বন্ধ কর। কেউ ডাকলে সাড়া দিবি না। কেউ না... যদি আমার গলা ধইরাও ডাকে, তাও না।"
কালামের গলার স্বরে এমন এক পৈশাচিক ভীতি ছিল যে আমেনা আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। সে দ্রুত উঠে ঘরের নড়বড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল, দরজার খিলটা ঠিকমতো লাগে না বলে একটা ভারী কাঠের তক্তা আড়াআড়িভাবে ঠেস দিয়ে রাখল। জানালার ফাঁক-ফোকরগুলো পুরনো কাপড় দিয়ে গুঁজে দিল।
সন্ধ্যা নামল। বস্তির হইচই, পাশের ঘরের টিভি সিরিয়ালের শব্দ, রিক্সার টিংটিং আওয়াজ—সব যেন বহু দূর থেকে আসছে। কালামের ঘরের ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কুপি বাতিটা জ্বালানো হয়েছে, কিন্তু সেই বাতির আলো কাঁপছে। বাতাসের কোনো ঝাপ্টা নেই, অথচ শিখাটা স্থির থাকছে না। কালাম ঘরের কোণে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তার হাতে সেই চিরকুটটা। সে ওটা ফেলতে পারেনি। ওটা যেন তার হাতের তালুর সাথে সেলাই করা হয়ে গেছে।
রাত যত বাড়ছে, কালামের মানসিক অবস্থা তত খারাপ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, ঘরের চারপাশের দেওয়ালগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। সে বিড়বিড় করে বলছে, "আমি লোভ করি নাই... আমি শুধু আমার মাইয়ার ওষুধ... আমি লোভ করি নাই..."
হঠাৎ টিনের চালে একটা শব্দ হলো।
খুব জোরে নয়, যেন একটা কাক বা বিড়াল আলতো করে পা ফেলেছে। কিন্তু কালাম জানে, ওটা কাক বা বিড়াল নয়। শব্দটা ছাদের এক কোণা থেকে ধীরে ধীরে মাঝখানের দিকে আসছে। খসখস... খসখস...। যেন কেউ খুব সাবধানে, খুব ভারী শরীর নিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে।
আমেনা মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে চোকিতে বসে ছিল। সে ফিসফিস করে বলল, "কিসের শব্দ ওইটা?"
কালাম তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে ইশারা করল। তার চোখ ছাদের দিকে স্থির। শব্দটা ঠিক তাদের মাথার ওপর এসে থামল। তারপর দীর্ঘক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই। এই নীরবতা শব্দের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে ছাদের ওপরের ওই সত্তাটা কান পেতে আছে, ঘরের ভেতরের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনছে।
হঠাৎ ঘরের পেছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস সুড়সুড় করে ঢুকে পড়ল। সাথে সেই গন্ধ। আতর আর পচা মাংসের জঘন্য মিশ্রণ। কালামের বমি এল, কিন্তু সে বমি করতে পারল না। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
দরজার ওপাশ থেকে একটা আওয়াজ এল। কোনো টোকা নয়, কেউ যেন নখ দিয়ে দরজার কাঠে আঁচড় কাটছে। ক্যাঁ...চ... ক্যাঁ...চ...। শব্দটা মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামিয়ে দিল।
"কালাম..."
ডাকটা খুব নিচু, কিন্তু ঘরের প্রতিটি কোণায় সেটা প্রতিধ্বনিত হলো। সেই যান্ত্রিক, ভরাট গলা।
"কালাম, দরজা খোল। পাওনা নিতে এসেছি।"
আমেনা ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইল, কালাম লাফিয়ে গিয়ে তার মুখ চেপে ধরল। আমেনার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, সে স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে মানুষের দৃষ্টি নেই, আছে এক বন্য প্রাণীর বাঁচার আকুতি।
"চুপ... একদম চুপ," কালাম ফিসফিস করে বলল।
বাইরের সত্তাটা যেন তাদের এই ধস্তাধস্তি দেখতে পাচ্ছে। দরজার ওপাশ থেকে একটা নিচু হাসির শব্দ ভেসে এল। হাসিটা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সাপ চলে যাওয়ার মতো খসখসে।
"তুমি কি ভাবছ, এই কাঠের দরজা আমাকে আটকাতে পারবে? আমি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিলাম। তুমি লোভ সামলাতে পারোনি। তুমি সকালের আলোয় আমার দানকে অপমান করেছ।"
কালাম আর সহ্য করতে পারল না। সে চেঁচিয়ে উঠল, "আমি চাই না তোমার টাকা! আমি কিছু চাই না! আমারে মাফ কইরা দাও। তুমি চইলা যাও!"
বাইরের হাসিটা এবার থামল। মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা বদলে গেল। ঘরের কুপির আলোটা দপ করে নিভে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল ঘর। কিন্তু পরমুহূর্তেই ঘরের দেওয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরে থেকে একটা নীলাভ আলো চুঁইয়ে ভেতরে আসতে লাগল। সেই আলোতে কালাম দেখল, দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়া ঢুকছে। কুণ্ডলী পাকানো সাদা ধোঁয়া। ধোঁয়াগুলো সাপের মতো একেঁবেঁকে মেঝের ওপর দিয়ে কালামের দিকে এগিয়ে আসছে।
"বিনিময় ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না, কালাম," গলাটা এবার দরজার বাইরে থেকে নয়, মনে হলো ঘরের ভেতর থেকেই আসছে। একদম কালামের কানের কাছে। "তুমি আমার রিক্সায় উঠেছিলে, আমি তোমার রিক্সায় উঠিনি। তুমি আমাকে ডেকেছিলে, তোমার অভাব আমাকে ডেকেছিল। এখন সেই অভাব মেটানোর সময়।"
হঠাৎ ঘরের টিনের দরজাটা প্রচণ্ড এক শব্দে কেঁপে উঠল, যেন বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে। কিন্তু কালাম জানে বাইরে কোনো বাতাস নেই। দরজার কাঠের তক্তাটা মটমট করে ভাঙতে শুরু করল। আমেনা মেয়েকে নিয়ে চোকির নিচে সেঁধিয়ে গেল ভয়ে। কালাম দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির মতো। সে বুঝতে পারছে, পালানোর আর কোনো পথ নেই।
দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল।
বাইরে কুয়াশা ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু সেই কুয়াশার বুক চিরে এক বিশাল ছায়া ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। কালামের ছোট্ট ঘরটা নিমেষেই পূর্ণ হয়ে গেল সেই ছায়ায়। গতকালের সেই সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটা। কিন্তু আজ আর তাকে মানুষের মতো দেখাচ্ছে না। তার শরীরটা অদ্ভুতভাবে বেঁকে আছে, হাতগুলো হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলে আছে। আর মুখ... মুখের জায়গায় কোনো চামড়া নেই, আছে শুধু এক দলা মাংসপিণ্ড, আর তার মাঝে জ্বলছে সেই দুটো হলুদ আগুনের গোলা।
কালাম পিছিয়ে যেতে যেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিল। লোকটা—নাকি ছায়াটা—ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। তার হাঁটার কোনো শব্দ নেই, কিন্তু মেঝের ওপর যেখানে সে পা রাখছে, সেখানকার মাটি যেন দেবে যাচ্ছে।
"আমার টাকাগুলো তুমি মাটিতে পরিণত করেছ," ছায়াটা বলল। তার মুখ নড়ছে না, কিন্তু শব্দটা সরাসরি কালামের মগজে আঘাত করছে। "এখন তোমাকে মাটি হতে হবে।"
কালাম হাতজোড় করে কাঁদতে লাগল। "আমার মাইয়াটা ছোট... আমার বউ... ওদের ছাইড়া দেন। আমার জান নিয়া নেন, কিন্তু ওদের কিছু কইরেন না।"
ছায়াটা কালামের খুব কাছে এসে দাঁড়াল। আতরের গন্ধে কালামের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ছায়াটা তার লম্বা, হাড়সার হাতটা বাড়িয়ে দিল। সেই হাতে নখগুলো ছুরির মতো ধারালো।
"তোমার জান আমার দরকার নেই, কালাম। আমি আত্মা খাই না। আমি চাই দাসত্ব। আজ থেকে তুমি আর মানুষ নও। তুমি হবে আমার বাহন। যেমন তোমার রিক্সা তোমাকে টানে, তুমি আমাকে টানবে। অনন্তকাল।"
কালাম কিছু বোঝার আগেই ছায়াটার হাত তার কপালে স্পর্শ করল।
স্পর্শটা আগুনের মতো গরম নয়, বরং এতই ঠান্ডা যে মনে হলো কালামের মগজ জমে বরফ হয়ে গেল। তার চোখের সামনে আমেনা, তার মেয়ে, এই ঘর—সব ঝাপসা হয়ে এল। তার শরীরের হাড়গুলো যেন মড়মড় করে ভেঙে নতুন করে জোড়া লাগতে শুরু করল। এক অসহ্য যন্ত্রণায় সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো মানুষের স্বর বের হলো না। বের হলো এক জন্তুর গোঙানি।
ঘরের কোণে চোকির নিচ থেকে আমেনা দেখল এক হাড়হিম করা দৃশ্য। সে দেখল, তার স্বামী, তার কালাম ধীরে ধীরে কুঁকড়ে যাচ্ছে। তার হাত-পাগুলো অস্বাভাবিকভাবে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। গায়ের চামড়া ধূসর হয়ে ফেটে যাচ্ছে। কালামের চোখ দুটো উল্টে গিয়ে সাদা হয়ে গেল, তারপর ধীরে ধীরে সেখানে ফুটে উঠল সেই একই হলুদ আভা।
ছায়াটা হাসল। "চলো। রাত অনেক হয়েছে। যাত্রীরা অপেক্ষা করছে।"
রূপান্তরিত কালাম—যে এখন আর মানুষ নয়, বরং এক অদ্ভুত চারপেয়ে প্রাণী—ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার মানবসত্তা, তার স্মৃতি, তার ভালোবাসা সব মুছে গেছে। এখন তার শুধু একটাই কাজ—বহন করা।
সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছায়াটা তার পিছু নিল। তারা কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যেতেই ভাঙা দরজাটা নিজে থেকেই ধড়াস করে বন্ধ হয়ে গেল।
পরদিন সকালে যখন বস্তির লোকেরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল, তারা দেখল আমেনা চোকির নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার জ্ঞান ফেরার পর সে পাগলিনির মতো শুধু একটাই কথা বলতে লাগল—"ওরে নিয়া গেছে... ওরে রিক্সা বানাইয়া নিয়া গেছে..."
কালামের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। পুলিশ এল, তদন্ত হলো, কিন্তু কেউ কোনো হদিস পেল না। ঘরের মেঝেতে শুধু পড়ে ছিল কিছু ভাঙা মাটির খাপরা আর একদলা ছাই।
তবে মিরপুর বেড়িবাঁধের ওই পুরনো রাস্তায়, যেখানে সোডিয়াম লাইটগুলো প্রায়ই নিভে থাকে, সেখানে গভীর রাতে রিক্সাওয়ালারা মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা রিক্সা চলে যায়। কিন্তু সেই রিক্সায় কোনো চালক থাকে না। রিক্সাটা নিজে নিজেই চলে, আর তার হুডের ভেতর বসে থাকে সাদা পাঞ্জাবি পরা এক ছায়া। আর রিক্সাটা যখন পাশ দিয়ে যায়, তখন চাকার আওয়াজ হয় না, শোনা যায় মানুষের হাড় ভাঙার মড়মড় শব্দ আর ফিসফিসানি—"যাবেন? নবাবগঞ্জ... পুরনো কেল্লা..."
রিক্সাওয়ালারা চোখ বুজে ফেলে, সুরা পড়ে আর জোরে প্যাডেল মারে। তারা জানে, ওই রিক্সার দিকে তাকালে, কিংবা ওই ডাকে সাড়া দিলে, তাদের পরিণতিও হবে কালামের মতো। অনন্তকালের জন্য এক অদেখা যাত্রীর বাহন হয়ে অন্ধকারের পথে পাড়ি জমানো। আর বাতাসের সাথে ভেসে আসে এক তীব্র, পুরনো আতরের গন্ধ, যা মনে করিয়ে দেয়—লোভ আর ভুলের মাশুল মাঝে মাঝে জীবন দিয়েও শোধ করা যায় না, শোধ করতে হয় তার চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে।
(END)
Noted: This story is protected under copyright law and copyrighted by Bhoutik kotha. Unauthorized copying, posting, or sharing may result in DMCA takedown, legal action, and Facebook account penalties. Content is tracked digitally—violators will be reported and penalized.
#ভূতেরগল্প #ভৌতিক #ভুত