22/07/2025
১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচলের ইতিহাসে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, যা আজও অনেকের মনে বেদনার ছাপ রেখে গেছে। সেদিন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে ঢাকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফকার এফ২৭-৬০০ বিমান, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল S2-ABJ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই বিমানটি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। ঢাকার আকাশে খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমানটি রানওয়েতে অবতরণের আগেই একটি জলাভূমিতে বিধ্বস্ত হয়, আর তাতেই প্রাণ হারান বিমানে থাকা সকল যাত্রী ও ক্রু সদস্য—মোট ৪৯ জন।
বিমানটি ছিল একটি ফকার এফ২৭ ফ্রেন্ডশিপ মডেলের টার্বোপ্রপ যাত্রীবাহী বিমান, যা প্রথম তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এটি মূলত ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বহরে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ভারত সরকার এটি উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেয় এবং এরপর থেকে এটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে যোগ দেয়। ১৯৮৪ সালের দুর্ঘটনার সময় এটি ২৪,০০০ ঘন্টার বেশি উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছিল, এবং তা নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় ছিল বলে জানা যায়।
উক্ত ফ্লাইটে পাইলট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন কায়েস আহমেদ মজুমদার, যিনি প্রায় ৫,০০০ ঘন্টার বেশি উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ পাইলট। প্রথম অফিসার হিসেবে সঙ্গে ছিলেন কানিজ ফাতেমা রোকসানা, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী বাণিজ্যিক পাইলট। এই দুর্ঘটনায় তিনিও প্রাণ হারান, এবং এই দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়েই তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে।
দুর্ঘটনার দিন ঢাকার আকাশে ছিল প্রবল বৃষ্টি, বজ্রপাত ও ঝড়ো হাওয়া। সেই সঙ্গে দৃশ্যমানতাও ছিল অত্যন্ত খারাপ, যা বিমান অবতরণের জন্য একেবারে অনুপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রথমে পাইলটরা ঢাকার রানওয়ে ৩২-এ VOR (VHF Omnidirectional Range) নেভিগেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে অবতরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু রানওয়ে স্পষ্টভাবে দেখতে না পাওয়ায় তারা অবতরণ বাতিল করে আবারও উড্ডয়ন করেন। এরপর দ্বিতীয়বারে তারা রানওয়ে ১৪-এ ILS (Instrument Landing System) ব্যবহার করে অবতরণের চেষ্টা করেন, কিন্তু সেবারও সফল হননি। তৃতীয়বারের চেষ্টায়, যখন তারা আবার রানওয়ে ১৪-এ অবতরণ করতে যাচ্ছিলেন, তখন দৃষ্টিসীমা এতটাই খারাপ ছিল যে বিমানটি ভুল করে রানওয়ের ৫৫০ মিটার আগেই একটি জলাভূমিতে আছড়ে পড়ে। এতে বিমানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ভেতরে থাকা কেউই বেঁচে যাননি।
বিমানে মোট ৪৫ জন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু সদস্য ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক এবং আরেকজন ছিলেন জাপানি নাগরিক, বাকি সবাই ছিলেন বাংলাদেশি। জানা যায়, যাত্রীদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে সংযোগকারী আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ধরার উদ্দেশ্যে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন প্রবাসী কর্মী, যারা কাজ শেষে দেশে ফিরে আবার বিদেশে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেদিনের সেই অন্ধকার বিকেলে সেই প্রত্যেকটি যাত্রা থেমে যায় চিরতরে।
এই দুর্ঘটনার পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে। তদন্তে জানা যায়, খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণের চেষ্টা এবং সেই সময়কার প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল। পাইলটদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আবহাওয়ার বাস্তব অবস্থা এবং ILS গাইডেন্স অনুযায়ী বিমান কতটা নিচে নেমে এসেছে, তা যথাযথভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। বিমানের উচ্চতা নির্দেশক এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ করলেও, অতিমাত্রায় নির্ভরতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তহীনতাই ছিল বিপর্যয়ের মূলে।
এই দুর্ঘটনার পর বিমান চলাচলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব বাড়ে এবং নতুন করে প্রশিক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ এবং জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে নিয়ম-কানুন আরও কঠোর করা হয়। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা অনুসরণ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংস্কারে উদ্যোগ নেয়। যদিও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আজ অনেক দূর এগিয়েছে, তখনকার প্রেক্ষাপটে সীমিত প্রযুক্তি ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে পাইলটদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপরই নির্ভর করত একটি সফল অবতরণ।
এই দুর্ঘটনায় সবচেয়ে দুঃখজনক ও ঐতিহাসিক দিক ছিল কানিজ ফাতেমা রোকসানার মৃত্যু। তিনি শুধু বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলটই নন, বরং নারী সমাজের জন্য এক অনুপ্রেরণা ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল আকাশে নিজের জায়গা তৈরি করার, আর সেই স্বপ্ন নিয়েই তিনি আকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আকাশই তাকে চিরতরে নিয়ে নেয়।
১৯৮৪ সালের এই বিমান দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি উড্ডয়ন শুধু প্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণের উপর নির্ভর করে না—এটি একটি মানুষের জীবন-মরণ সংলগ্ন দায়িত্ব। সে কারণে প্রতিটি যাত্রা শুরু হওয়ার আগে প্রয়োজন সর্বোচ্চ সতর্কতা, সর্বোচ্চ প্রস্তুতি এবং প্রকৃতির প্রতিকূলতা মোকাবিলায় বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত। আর সেই শিক্ষাই, দুঃখজনক হলেও, রেখে গেছে ফকার এফ২৭ বিমানের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
©