30/07/2025
#ফের_বসন্ত
#ঐশী_রহমান
#পর্ব_|১২(খ)|
________________
ওয়াসিফ বেশ সময় ধরে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে, এই সময়টুকু তে আর অন্য কারো উপস্থিতি টেরই পেলোনা। ধারা পুরোই চুপচাপ। ফোনের ওপাশ থেকে ওয়াসিফ বলে।
' মুমতাহিনা! আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন'?
ধারা একটু নড়ে চড়ে বসে মাথায় গোমটা টানে, বলে।
' না, শুনছি। আপনি বলুন'
' কি শুনছেন'?
' এই যে আপনি ওয়াসিফার সঙ্গে যা যা বললেন'
' কি কি বললাম '
ধারা পড়লো মহা ঝামেলায়, সে তো বাপ মেয়েকে শুধু দেখেই চলেছিলো তাদের কথা কিছু ই মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। এখন কি বলবে সে? এ যেনো শিক্ষক বইয়ের কোনো একটা টপিক পড়িয়ে পিছনের সিটে বসে থাকা অমনোযোগী -ছাত্রীকে ভরা ক্লাসের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার মতোন পরিস্থিতি। ' নেও এবার বলো, এতোক্ষণ যা যা পড়িয়েছি, বোঝাও আমাকে'
ধারা মিনিট খানেক ভেবে জবাব দেয়, ' ঐতো, ঐ জিজ্ঞেস করলেন ও খেয়েছে কিনা? ও কেনো ঘুমোয়নি এখনো? ও কি আজ খুব বেশি দুষ্টুমি করেছে কিনা? এইতো এইসবই'
ওয়াসিফ এখনো দেখেনা ধারাকে, কারন ফোনের ক্যামেরা এখনো ওয়াসিফার দিকে ঘুরিয়ে রাখা। ওয়াসিফ ও আর বলেনা ' আপনি ওভাবে কেনো লুকিয়ে থেকে আমার কথার জবাব দিচ্ছেন, সামনে আসতে সমস্যা কোথায় মুমতাহিনা আপনার '?
' আচ্ছা তারপর বলুন, আপনারা বাড়ির সবাই কেমন আছেন'?
' জি আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই ভালো আছি'
' আংকেলের শরীরের কি অবস্থা এখন'?
' মামা এখন অনেকটাই সুস্থ, উনারা আজ চলে গেছেন'?
' কেনো? আপনি জোর করেননি আরো দুটোদিন থেকে যেতে'?
' করেছি, শুধু আমি না, মা, ভাবিরা সবাই মিলে করেছি '
' আচ্ছা '
' জি'
ওয়াসিফ সময় দেখে, অনেক রাত, বলে।
' আর কিছু বলবেন মুমতাহিনা'?
ধারার মনে মনে ইচ্ছে করছে লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে, ' আপনার ছুটি কবে হবে? আপনি কবে আসবেন'?
' হ্যালো'!
' জি'
' আমি কি তাহলে কল রাখবো এখন, আপনি কি আর কিছু বলতে চান'?
ধারা আস্তে করে বলে।
' জি, রাখুন। আল্লাহ হাফেজ '
' আল্লাহ হাফেজ। রাত অনেক হয়েছে আপনারা ও ঘুমিয়ে পড়ুন '
ওয়াসিফ কল কাটতেই ধারা ফোনটা বিছানা থেকে একটু দূরে রেখে ওঠে, ও একটু ওয়াশরুমে যাবে। বিছানা ছেড়ে দু'পা সামনে এগিয়ে থেমে আবার তাকায় ওয়াসিফার দিকে। সে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে ধারা দিকে। ধারা ফিরে এসে ওকে কোলে তুলে কাঠের দোলনায় শুইয়ে দিলো। মেয়েটার বয়স পাঁচ মাসে পড়তেই এখন একা একা শোয়া থেকে উপুর হয়ে যায়, এদিকে ওদিকে ঠেস দিয়ে পিপড়ার মতো চলে। একটু চোখ এদিক ওদিক করলেই বিপত্তি। পরিবারে এতোগুলো মানুষ, সবসময় কেউ না কেউ ওকে সঙ্গ দেয়, কিন্তু এই মাঝরাতে ধারা এখন কাকে ডাকবে। ও আজ নিরুপায় হয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে ওকে দোলনায় শোয়ালো। দোলনাটা মৃদু দোল দিয়ে ধারা গেলো ফ্রেশ হতে।
মিনিট তিনেক সময়ের ব্যবধানে যা ঘটার তা ঘটে গেলো। ধারা ওয়াশরুমে থাকলেও ওর কান ছিলো মেয়ের দিকে। সবে চোখ মুখে পানির ঝাঁপটা দিতেই কানে এলো ধুম করে কিছু একটা পড়ার শব্দ, তার ঠিক পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় ওয়াসিফার গলা উঁচিয়ে চিৎকার। ধারা একছুটে বেরিয়ে এসে দেখে হাত দুই উঁচু থেকে ওয়াসিফা মেঝেতে পড়ে আছে দোলনা সহ। দোলনার স্ট্যান্ড থেকে মাঝের টুকু কিভাবে যেনো খুলে পড়ে আছে। ধারার হাত কাপে, ও দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে তোলে। ওয়াসিফার কান্নার বেগ আরো বাড়ে। ধারা হতভম্ব হয়ে মেয়ের কপালে, গালে চুমু খায়, এদিকে ওদিকে ওর হাত, মাথা উল্টে পাল্টে দেখে কোথাও লেগেছে কিনা? কিন্তু আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। তবে মেয়ে ভয় পেয়েছে ভীষণ।
মিনিট খানেকের মধ্যে এঘর, ওঘর থেকে ছুটে আসে সবাই। এই মাঝরাতে ওয়াসিফার জোর গলায় কান্না এবাড়ির প্রতিটা রুমে পৌছেছে।
সাজু এসেই দেখে ঐ অবস্থা, ও হাত বাড়িয়ে ওয়াসিফা নিতে চেয়েও পারেনা। ধারার বুকের সঙ্গে মাথা মিশিয়ে শক্ত করে মুঠোয় শাড়ি চেপে ধরে কাঁদছে।
শাহেনূর এলো, ' কি হয়েছে বৌমা? ও কি পড়ে গেছে '?
ধারার চোখেও পানি জমলো, বললো ' জানি না আম্মা, ও পড়ে যেতে পারে বলে বিছানা থেকে দোলনায় শুইয়ে ওয়াশরুমে গিয়েছি, কিছুক্ষণ পর একটা শব্দ হলো, তারপর ওয়াসিফা.. '
নিধি দোলনার কাছে এগিয়ে, খুঁটিয়ে খাটিয়ে দেখে বললো।
' এইতো এখানের পিন ছুটেছে, আর ওটা খুলে গেছে '
আতিকা ভয়ে ভয়ে বললো। ' ভাইজান অনেক বার বারণ করেছিলো আম্মা কে, এই দোলনাটা ব্যবহার না করতে, এটা অনেক পুরাতন কাঠের দোলনা, আমার সময়ের। এখন ভাইয়া শুনলে তখন বুঝোও তোমরা।
শাহেনূর মেয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে সে নাতনিকে দেখতে থাকে। ' কোথায় লেগেছে দাদু তোমার? সাজুকে ডেকে বলে, ' একটু ভালো করে দেখোত তোমরা'?
সাজু, নিধি এগিয়ে আসে, নিধি বলে।
' আম্মা এখন কিছু বোঝা যাবে না, কোথাও যদি লেগে থাকে সেই জায়গাটা ফুলবে, আপাতত তো কোথাও ফোলেনি'
সাজু বলে।
' দোলনায় তো বেশ আরামদায়ক গদি, বালিশ এসব ছিলো, কোথাও হয়তো তেমন লাগেনি, ও ভয় পেয়েছে অনেক, তাই কাঁদছে '
_____
বেশ কিছু সময় ওয়াসিফার কান্না থামলো, মেয়েটার গায়ে কোথাও কোনো চোট লাগেনি, ফোলেনি কোথাও, এতেই সবাই যেনো একটু শান্তি পেলো। ওয়াসিফা যা কেঁদেছে ভয় থেকেই। মেয়েটা ওভাবে কাঁদতে কাঁদতেই বুকের সঙ্গে লেপ্টে থেকে ঘুমিয়ে গেলো। ধারা আলতো হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বিছানায় শোয়ালো ওকে। শাহেনূর চলে গেলেন, তাহাজ্জুদ নামাজ পরতে, নিধিও হাই তুলতে তুলতে শাশুড়ীর পেছন পেছন বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, এরপর যায় আতিকা। সাজু বসে থাকে কিছুসময়। ধারার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বলে।
' কয়েকটা প্রশ্ন করি তোমাকে'?
ধারা তাকায় সাজুর দিকে, এখানে আবার প্রশ্ন?
' জি ভাবি, করুন'
' আজকের এইটুকুর জন্য কি তোমার ভিতরে অপরাধবোধ হচ্ছে? আচ্ছাহ তোমার কি ভয় হচ্ছে, এই ঘটনা ভাইজান শোনার পর তোমাকে দুটো শক্ত করে কথা শুনিয়ে দেবে। বলবে ' তুমি তার মেয়েকে দেখে শুনে রাখতে পারোনা'? বা পাড়া প্রতিবেশী শুনলে বলবে ' আপন মা নয়তো, তাই ওতো আগলে রাখেনা' এসব মনে হচ্ছে? বলো বলো?'
ধারা আর কি জবাব দেবে, আসলেই হচ্ছে, তার মধ্যে এইসব ভয়ই কাজ করছে। তার ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল গুলো ধরে দুটো ঝাঁকি দিতে, ওর আগে কেনো চোখ পড়লোনা যে দোলনাটার ঐ জায়গায় সমস্যা রয়েছে।
ধারাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সাজু হেসে বলে।
' তুমি যদি সত্যি সত্যিই এসব ভেবে থাকো, তবে তুমি কিন্তু ওর আপন হয়ে উঠতে পারবেনা কখনো। কথাটা তেঁতো শোনালে এটাই সত্য। আরেহ ভাই! আমার ছেলের বয়স চার বছর, তুমি জানো? ও এই চার বছরে কতবার কতভাবে পড়েছে, ব্যথা পেয়েছে, কেটেছে? তাই বলে কি আমি তোমার মতো অপরাধ নিয়ে ভুগেছি? এটা ভোগা যাবেনা। বাচ্চারা পড়বে, ব্যথা পাবে, কাঁদবে, এভাবেই একটা বাচ্চা বড় হবে, কিন্তু আমাদের মায়েদের দু-চোখের জায়গায় চারচোখ লাগিয়ে ওদের খেয়াল রাখতে হবে। তবুও যদি অঘটন কিছু ঘটে যায় তাতে অপরাধবোধে ভোগার কোনো মানেই হয়না। আর বাকি রইলো ভাইজান, সে এতোটাও মুর্খ নয়, মেয়ে পড়ে গেছে ওমনি তোমাকে দুটো শক্ত কথা বলে দেবে। সো এসব চিন্তা ছাড়ো। আর যদি কিছু বলে, মানে যদি বলে, ধরো বললো, যদিও কখনো ই বলবে না, তবুও ধরো, যদি বলে তুমি ও দিগুণ তেজ নিয়ে বলে দেবে।
' মেয়ে শুধু আপনার? আমার না? ও ব্যথা পেলে, কাঁদলে, আমার বুঝি খারাপ লাগেনা'?
' একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবে, তুমি ওর মা হও, এই যে আমরা, যারা ওর পরিবার, এই সবার থেকে ওর উপর তোমার আর ভাইজানের অধিকার বেশি এবং সমান, কারণ তুমি ওর মা, আর ভাইজান বাবা'
ধারা শুনলো কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে, সাজু বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে।
' নেও এখন একটু ঘুমাও, মেয়ে তো তেমন ব্যথা পায়নি, তাই আর খুব বেশি চিন্তা ও করতে হবে না। ঘুমাওতো, ঘুমাও'
______
ফজরের ওয়াক্ত শেষ হতেই বিছানায় শাহেনূরের ফোন বাজে। ভদ্র মহিলা তখনও জায়নামাজে বসে আছেন। ফোন আসতেই বুঝলেন এই সময় ঠিক কার কল আসতে পারে। এটা ওয়াসিফে'র কল। এটা তার রেগুলার রুটিনের মধ্যেই একটি, রোজ ফজরের নামাজ শেষ হতেই প্রথম কলটি সে মা'কে করে। শাহেনূর জায়নামাজ গুছিয়ে ফোনের কাছে যেতে যেতে কলটি শেষ হতেই পুনরায় আবার কল এলো।রিসিভ করে কানে নিতেই সালাম দেয় ওয়াসিফ।
' আসসালামু আলাইকুম আম্মা '
' ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস বাবা?'
' আলহামদুলিল্লাহ আম্মা, তোমার শরীরের কি অবস্থা? হাঁটুর ব্যথা কমেছে'?
' অনেকটাই কম এখন, ঔষধ খাচ্ছি, নিয়মিত সেক ও নিচ্ছি'
' তোমার সব ঔষুধপত্র আছে তো যেগুলো রেখে এসেছিলাম? আর কিছু লাগবে আম্মা '?
' না, না, কিছুই লাগবেনা। সব আছে, তা বলছি কি বাবা'?
' হ্যা আম্মা বলো'?
' কাজের অনেক চাপ তাই না? ছুটি কবে পাবি বলতো?'
হাসে ওয়াসিফ, এই একটা কথা ' কবে ছুটি পাবি' এই কথাটাও রেগুলার মায়ের কথোপকথনের শীর্ষে থাকবেই।
' ছুটি পেলে তোমাকে ই সবার আগে জানাবো আম্মা '
' আচ্ছা '
ওয়াসিফ ভিডিও কলে মা'কে খুব খেয়াল করে দেখে বলে।
' রাতে ঘুমাও নাই আম্মা? চোখ মুখ এমন লাগছে কেনো?'
শাহেনূর একটু অন্যমনস্ক থাকায় চট করে বলে ফেললো ' ঐয়তো মেয়েটা যে পড়ে গিয়ে কান্নাকাটি করলো, তখনই ঘুম ভেঙে... '
এটুকু বলে থামে। আসলে সে বলতে চায়নি। এতটুকু কথা হজম করতে পারলোনা সে।
' কে পড়ে গেলো আম্মা '?
মুখ ফসকে কথা যখন একবার বেরিয়েই গেছে তখন আর এই ছেলের থেকে সে লুকাতে পারবেনা। তাই পুরোটা সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে বললো ওয়াসিফ কে। ওয়াসিফও শুনলো সবটা। এরপর তাড়াহুড়ো করে ই কল কাটে ওয়াসিফ। ছেলের এমন হুট করে কল কাটাতে শাহেনূর নিজেই এবার কল দেয়। ছেলের কল তখন এ্যানাদার কলে।
#চলবে