
06/08/2025
পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম : মৃত্যুর আয়নায় রাষ্ট্রচিন্তার পাঠ এবং বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয়
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের মিডটাউনে গত ২৮ জুলাই ঘটে গেল মর্মান্তিক এক ঘটনা। আধা-স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে এক উন্মাদ বন্দুকধারীর গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (NYPD) কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম (৩৬) এবং আরও তিনজন। দিদারুলের মৃত্যু শুধু একটি কর্মজীবনের অবসান নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সেই কর্তব্যের প্রতিদান কী হওয়া উচিত, তার একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে একজন বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে দিদারুল নিজের জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করে গেছেন, অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে জননিরাপত্তা রক্ষায় কতটা আত্মনিবেদিত হতে পারেন।
দিদারুল ইসলামের মৃত্যুতে আমেরিকান রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তা বিশ্বজনীন মূল্যবোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সিনেটর চাক শ্যুমার, গভর্নর ক্যাথি হোকুল, মেয়র এরিক অ্যাডামস, মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানি, অ্যান্ড্রু ক্যুমোসহ অন্যান্য সিটি, স্টেট অফিসিয়ালরা তার মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সশরীরে উপস্থিত হয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগসহ সিটির অন্যান্য ইউনিফর্মধারী সংস্থার সদস্যরা তাকে যেভাবে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা ও বীরোচিত বিদায় জানিয়েছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি অভিবাসী কমিউনিটির গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ ছাড়া নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের প্রায় ২০ হাজার সদস্যের অংশগ্রহণে তার জানাজা ও শেষ বিদায় অনুষ্ঠানে তাকে যেভাবে সম্মাননা জানানো হয়েছে, তা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং পেশাদারিত্ব, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও সহমর্মিতা-সহানুভূতির স্পষ্ট বার্তা।
আমার নিজ জন্মস্থান মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা প্রতিবেশী দিদারুল ইসলাম রতন প্রায় দেড় দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে পা রাখেন। কঠোর পরিশ্রম, পেশাগত নিষ্ঠা ও সাহসিকতায় তিনি NYPD-তে নিজেকে মাত্র সাড়ে তিন বছরে প্রতিষ্ঠিত করেন। সহকর্মীদের কাছে ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক, নিউইয়র্ক কমিউনিটির কাছে মানবিক পুলিশের প্রতিচ্ছবি। শুধু পেশাগত ক্ষেত্রেই নয়, নিজ কমিউনিটির প্রতিও তিনি ছিলেন অন্তঃপ্রাণ।
দিদারুলের মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জাতিগত পরিচয় নয়, পেশাদারত্বই রাষ্ট্রীয় মর্যাদার নির্ধারক হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র সেই নীতি অনুসরণ করে দেখাল।
সভ্যতার একটি সূচক হলো—তাদের মৃতদের প্রতি আচরণ। যারা রাষ্ট্রের জন্য জীবন দেয়, তাদের প্রতি কীভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়, সেটাই বলে দেয় সেই রাষ্ট্র কতটা মানবিক, কতটা প্রজ্ঞাসম্পন্ন। মানবিকতার সেই মানদণ্ডেও যুক্তরাষ্ট্র অতুলনীয়।
সরকারি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করার পর একজন অভিবাসী হয়েও দিদারুল যে বীরের মর্যাদা পেলেন, সেই প্রেক্ষাপটে মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশে কর্তব্যরত অবস্থায় পুলিশ সদস্যসহ ইউনিফর্মধারী কোনো সদস্য, চিকিৎসক, শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীরা মারা গেলে আমরা তাদের কতটুকুই-বা সম্মান জানাই? রাষ্ট্র কি তাদের ত্যাগ ও অবদানকে স্মরণ রাখে? নিহত নাগরিকের পরিবারকে যথাযথ সুরক্ষা ও মর্যাদা দেয়? প্রায়ই দেখা যায়, শহীদদের আত্মত্যাগ রাজনৈতিক বিতর্ক বা প্রশাসনিক অবহেলার মধ্যে হারিয়ে যায়। এর অন্যতম কারণ হলো, আমরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন না করে দলীয় পরিচয় বহন করে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ি। রাজনৈতিক ইশারায় প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও প্রশাসনের উচিত, নিউইয়র্কের বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুলের মৃত্যু-পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা থেকে শিক্ষা নেওয়া—কীভাবে একজন পেশাদার মানুষের শেষ বিদায়কেও রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ করে তোলা যায়।
আমেরিকাকে কেন ‘গ্রেট কান্ট্রি’ বলা হয়, তার একটি পরিশীলিত উত্তর পাওয়া যায় এই একটি ঘটনায়। উন্নত অবকাঠামো নয়, বরং নীতিগত অঙ্গীকার, মানবিক মর্যাদা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাই একটি রাষ্ট্রকে মহান করে তোলে।
দিদারুল ইসলাম আজ নেই, কিন্তু তাঁর মৃত্যু রাষ্ট্রচিন্তার দর্পণে আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।
আমাদের উচিত এই আয়নায় তাকানো, আত্মসমালোচনা করা এবং শিখে নেওয়া, কীভাবে একজন নাগরিককে সম্মান জানাতে হয়।
লেখা :- এস এম শাহিন।
Copy From Facebook