09/07/2025
বিবিসির ‘ফরমায়েশি অনুসন্ধান’, অপসাংবাদিকতার নির্লজ্জ নজির!
ঢাকার যাত্রাবাড়িতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে খণ্ডিত একটি ‘অনুসন্ধান’ প্রকাশ করেছে বিবিসি। এতে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপের তথ্য রয়েছে। সেটিও প্রকাশ করা হয়েছে খণ্ডিতভাবে। নেই অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর। এমনকি ‘অনুসন্ধান’ দাবি করা হলেও বিবিসির রিপোর্টে সাংবাদিকতার সাধারণ মানদণ্ডও অনুসরণ করা হয়নি।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে তাদের কারো বক্তব্য নেয়া হয়নি। এমনকি বক্তব্য নেয়ার কোনো চেষ্টা করা হয়েছিল কিনা তেমন কোনো ইঙ্গিতও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে নেই। কোনো প্রক্ষাপটে কী ঘটেছিল তার উত্তর দেয়নি বিবিসি। শুধু একটি অডিওর খন্ডিত কয়েক সেকেন্ডের কথিত ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং সরকারি লোকজনের বক্তব্যের ভিত্তিতেও শেষ করা হয়েছে তথাকথিত ‘বিশাল অনুসন্ধান’।
প্রতিবেদনে মোটাদাগে দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ি থানার ‘পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ৫২ জন নিহত’ হয়েছেন। এই অভিযোগের পেছনে কয়েকটি বিষয় সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে বিবিসি। যে অসহায় প্রেক্ষাপটে গুলি চালানো হলো তাকে গুরুত্বহীনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেন হঠাৎ সেনাবাহিনী থানায় অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যদের রেখে ঘটনাস্থল থেকে চলে গেল তার উত্তর খোঁজা হয়নি।
বিবিসি থানার যে দুজন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা সবাই জানিয়েছেন সব দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখে ছিলেন সবাই। নিজেদের জীবন বাঁচাতে তাদের সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে কেউ কাউকে নির্দেশনা দেয়ার অবস্থাতেও ছিলেন না। এমনকি তখন কার্যত কোনো সরকারও ছিল না। বিবিসি সেদিন মোতায়েন থাকা সেনাদলের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। ফলে কেন সেনারা আকস্মিকভাবে সরে গিয়েছিল সেই রহস্যের কোনো সুরাহা তারা করতে পারেনি। শুধু কিছু আন্দোলনকারীর বক্তব্য এবং মোবাইল ও ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণ করেই ‘নির্বিচারে গুলি’ চালানোর সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে তাদের অনুসন্ধানী দল!
দায়সারা এই ‘অনুসন্ধানের’ মধ্যেও কিছু তথ্য বিবিসি আড়াল করতে পারেনি। এর একটি হলো ঘটনা ঘটার সময়। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গুলিবর্ষণের ঘটনাটি শুরু হয়েছিল দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে।’ এই সময়টি থেকে বোঝা যায়, শেখ হাসিনার গণভবন ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার বেশ খানিকটা পরে ঘটনাটি ঘটেছিল। ততক্ষণে ঢাকাসহ সারা দেশে থানায় পুলিশের ওপর বর্বরোচিত হামলা শুরু হয়ে গেছে। পুলিশের অসহায় সদস্যরা যে যেভাবে পারছিলেন নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। যাত্রাবাড়ীতেও ঘটেছিল একই ঘটনা। যাত্রাবাড়ীতে ওই দিনের আগেও পুলিশকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বিবিসি সেসব চেপে গিয়ে আন্দোলনকারীদের উপস্থাপন করেছে ‘নিষ্পাপ’ হিসেবে।
উন্মত্ত কয়েক হাজার মানুষ সেখানকার থানায় আক্রমণ শুরু করেছিল। সেনাবাহিনীর একটি দল মোতায়েন থাকলেও ‘রহস্যজনক কারণে’ হঠাৎ তারা সরে যায়। এরপরই থানায় ঢুকে চালানো হয় তাণ্ডব। আক্রমণকারীরা আগুনে পুড়িয়ে হ'ত্যা করে অনেক পুলিশ সদস্যকে। ওই দিনের ঘটনার অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ অনলাইনে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু, বিবিসি বাছাই করেছে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি মোবাইল ও ড্রোনের ভিডিও।
ধারণ করা ভিডিওর একটি মোবাইল ফোন কার ছিল সেটি বিবিসি উল্লেখ করেছে, কিন্তু সেদিন সেখানে ড্রোন উড়িয়েছিলেন কারা? কারা সেখানে বিশেষ প্রেক্ষাপট তৈরি করে ড্রোনের সাহায্যে দৃশ্য ধারণের আসায় ওঁৎ পেতে ছিলেন- তার কোনো উত্তর প্রতিবেদনে নেই। যাত্রাবাড়ীতে নিহতদের কেন ময়নাতদন্ত হলো না- সে প্রশ্নের তালাশও করেনি বিবিসি।
চরম পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া পুলিশের সামনে গুলি চালানো ছাড়া আর কোনো করণীয় ছিল কিনা- সেটাও উল্লেখ নেই বিবিসির অনুসন্ধানে। সেদিন ‘পুলিশের গুলিতে’ নিহতদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বের করার দাবি করেছে বিবিসি, কিন্তু কতজন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছিলেন তা ১১ মাসের অনুসন্ধানেও তারা জানতে পারেনি। এ কারণেই এত দিন পরের প্রতিবেদনেও বিবিসি বলছে ‘পুলিশের কমপক্ষে ছয়জন সদস্য নিহত হন।‘
ঘটনার ১১ মাস পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতজন সেদিন নিহত হয়েছিলেন সেটি সুনির্দিষ্টভাবে জানা সবচেয়ে সহজ কাজ হওয়ার কথা ছিল। অথচ এখনও তা ‘কমপক্ষে’ শব্দ দিয়ে চালাতে হচ্ছে বিবিসির তুখোড় অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের! এর আরেকটি অর্থ হলো, নিহতের সংখ্যা এখনও বের করা যায়নি। পুলিশের মতো একটি বাহিনীতে কেন এতদিনেও সেটি করা গেল না, বা করা হলো না বিবিসি তার কোনো অনুসন্ধান করেনি। কেন ঘটনার সময়কালে ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে 'ইনডেমনিটি' দেয়া হলো, তার বিষয়েও কোন বক্তব্য নেই।
প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশে আছে শেখ হাসিনার একটি কথিত ফোনালাপেরও খণ্ডিত অংশ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এই বক্তব্য থেকে আগে-পরের প্রেক্ষাপট বোঝা সম্ভব নয়। আদোতেও বলেছিলেন কিনা, কার সঙ্গে, কোন পরিস্থিতিতে, কেন শেখ হাসিনা কথাগুলো বলেছিলেন সেটা জানাতে বিবিসির অনীহা কেন? সাধারণ সাংবাদিকতাতেও প্রেক্ষাপটের উল্লেখ করা খুব সাধারণ একটি চর্চা। কিন্তু, বিবিসির প্রতিবেদনে তা নেই। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবিসি চাইলেই এ ব্যাপারে যেকোনো দেশে অবস্থান করা বাংলাদেশের আগের সরকারের ঊর্ধ্বতনদের বক্তব্য নিতে পারত। সেটা তারা না করে অনুসন্ধানের নামে শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের সরবরাহ করা তথ্য উপাত্ত প্রচার করেছে। আবার শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের ভেতরে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন কিছু দৃশ্যের সংযোজন করেছে, যেগুলো মূলত ঘটেছিল পুলিশকে সরাসরি আক্রমণ করার প্রেক্ষাপটে।
একইভাবে যে কাজটি করেছিল জাতিসংঘের কথিত অনুসন্ধানী দল। সরকারের সরবরাহ করা নিহতের সংখ্যার ভিত্তিতে তারা ১৪০০ জন নিহত ‘হতে পারে’ বলে আনুমানিক ধারণা হাজির করে প্রতিবেদন দিয়েছিল। আবার সেই তথ্যই পরে জোরেশোরে প্রচার করেছে সরকার, যদিও তাদের নিজেদের করা তালিকাতেই সংখ্যাটি এখনো অনেক কম। একই ঘটনা ঘটছে বিবিসির ‘অনুসন্ধান’ নিয়ে। সরকারের সরবরাহ করা তথ্য ‘অনুসন্ধানের নামে’ প্রকাশ করেছে বিবিসি। এরপর সেটি নিয়ে সমস্বরে মাঠ কাঁপাচ্ছেন সরকার সমর্থকরা!
বিবিসির প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার কথিত ফোনালাপটির তারিখ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। সেই তারিখটি হলো ১৮ জুলাই। অবশ্য এই তারিখটিও বিবিসি পেয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারের সেই সূত্র বিবিসির কাছে দাবি করেন, ১৮ জুলাই নিজের সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে শেখ হাসিনা ওই ফোনালাপটি করেন।
ধরা যাক, বিবিসির দাবিটি সত্যি। শেখ হাসিনা ১৮ জুলাইয়েই কথাগুলো বলেছিলেন। ৩-৪ সেকেন্ডে শুধু এই কথাটুকু বলেই ফোন রেখে দিয়েছিলেন। এরপরেও একটি আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বিবিসির বিশাল অনুসন্ধানী দলের কাজ কি শুধু কণ্ঠস্বরের ফরেনসিক পরীক্ষা করে সেটি ভেজাল, না খাঁটি সেই সনদ দেয়া? এমনকি সেই পরীক্ষা করার জন্যও ভাড়া করা হয়েছে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে!
শেখ হাসিনা যদি ১৮ জুলাই এই নির্দেশনা দিয়েও থাকেন, তাহলে সেদিন দেশের পরিস্থিতি কেমন ছিল তা কি তুলে ধরেছেন বিবিসির তুখোড় অনুসন্ধাকারীরা? অথচ, সাধারণ মানের সাংবাদিকতাতেও প্রেক্ষাপট তুলে ধরা একটি অতি স্বাভাবিক চর্চা।
বিবিসির দলটি কেবল বর্তমান সরকারের সরবরাহ করা তথ্যের ওপর নির্ভর না করলেই জানতে পারত ১৮ জুলাই বা তার আগে দেশে কী ঘটেছিল।
১৭ জুলাই ২০২৪, চট্টগ্রামে ১৫ জন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীকে কু'পিয়ে ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়। যাদের অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গিয়েছে।
সূত্র: https://bangla.bdnews24.com/ctg/47276915a1f9
আন্দোলনের নামে ১৬ জুলাই ২টি, ১৭ জুলাই ১০টি, ১৮ জুলাই ২৫টি পুলিশের স্থাপনা ঘিরে হামলা চালানো হয়। এছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে (কেপিআই) আন্দোলনকারীরা একের পর এক হামলা চালায়।
১৮ জুলাই সকালের পরপরই রামপুরায় টেলিভিশন কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের একটি দল সেখানে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। আগুন নেভাতে খিলগাঁও ফায়ার স্টেশন থেকে পানিবাহী গাড়ি বের হলে রাস্তায় গাড়িটি আটকে দেয় উত্তেজিত জনতা। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিদের মারধর করে গাড়িটিকে স্টেশনে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
আরেকটি দল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে দীর্ঘসময় অবরুদ্ধ ছিল। পরে পাশের একটি ভবনের ছাদ থেকে তাদের হেলিকপ্টারের সাহায্যে উদ্ধার করা হয়। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে হামলা চলছিল। উত্তরায়, ভাঙচুর করা হয় পুলিশ বক্স এবং দুটি যাত্রীবাহী বাস। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল উন্মত্ত সহিংসতা।
সূত্র: https://www.ajkerpatrika.com/bangladesh/dhaka/ajphkmday8d7b
১৮ জুলাই মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরেও আগুন দেয়া হয়। তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন থেকে একটি পানিবাহী গাড়ি, একটি ইঞ্জিনবাহী গাড়ি এবং একটি অ্যাম্বুলেন্সবাহী গাড়ি রওনা হয়। কথিত উত্তেজিত জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে গাড়িটি আটকে ভাঙচুর করে। অ্যাম্বুলেন্সটি ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হন।
একই দিন চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সে দেওয়া আগুন নেভাতে গেলে কালুরঘাট ফায়ার স্টেশনের পানিবাহী ও পাম্পটানা দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা।
সূত্র: https://www.prothomalo.com/bangladesh/crime/e6qrcfc8sz
আর এগুলো যারা করেছিলেন তারা এখন প্রকাশ্যেই সব কিছু স্বীকার করছেন। এমনকি তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সম্প্রতি বলেছেন, সেই ১৮ জুলাই ছিল তাদের মেটিকুলাস ডিজাইনের দেড় মাসের সময়সীমার শেষ তারিখ! মাহফুজের দাবি অনুযায়ী, এই মেটিকুলাস ডিজাইনের শুরু ৫ জুন, আর শেষ হয়েছিল ১৮ জুলাই। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে শুরু হয় প্রাণহানি, যেগুলো কেন বা কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে আছে গুরুতর অনেক প্রশ্ন। পুলিশের ওপর নৃশংস অনেক হামলা হয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্যও হয়েছিল। বিবিসির অনুসন্ধানীরা এসব প্রেক্ষাপটের ধারেকাছেও ঘেঁষতে চাননি।
ধরা যাক ঠিক এমন কিছু নাশকতা ও সহিংসতা চলছে লন্ডনের বুকে। বিবিসি কার্যালয়ে ঢুকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। একদল পুলিশ একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়ে প্রাণভয়ে কাঁপছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার সেক্ষেত্রে তার দেশের পুলিশকে কী নির্দেশনা দিতেন? বিবিসির অনুসন্ধান দল এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে কি রাজি?
20250718