07/12/2024
আগামীকাল সকালবেলা যদি বাংলাদেশের সরকার ঘোষণা দেয়- 'প্রচলিত সব ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট আগামীকাল মধ্যরাত থেকেই অচল বলে গণ্য হবে এবং ৩০ শে জুন, ২০২৫ এর মধ্যে সবাইকে সব ৫০০/১০০০ টাকার নোট ব্যাংকে জমা দিয়ে নতুন ৫০০/১০০০/২০০০ টাকার নোট নিতে হবে', তাহলে কেমন হবে?
আমি একটা সম্ভাবনার কথা বলছি। অতীতে অনেক দেশের সরকার এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।
২০১৬ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখ এমন ঘোষণা দিয়েছিলো ভারতের সরকার। ঘোষণায় বলা হয়, ওই দিন মধ্যরাত থেকে মহাত্মা গান্ধী সিরিজের সব ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল বলে গণ্য হবে। জনগণ ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৬ এর মধ্যে ব্যাংকে ওইসব নোট জমা দিয়ে নতুন ৫০০ ও ২০০০ রুপির নোট নিতে পারবে।
ভারতীয় জনগণের জন্য এই ঘোষণা বয়ে নিয়ে এসেছিলো সীমাহীন ভোগান্তি। মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাংকে দাঁড়িয়ে টাকা বদলাতে বাধ্য হয়েছিলো। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্যমতে, ওই ৫০ দিনে ব্যাংকে জমা পড়েছিলো ১৫.৪১ লক্ষ কোটি রুপি!
এমনটা কেনো করা হয়েছিলো?
প্রথমত: কালো টাকার বিস্তার রোধ করার জন্য। দ্বিতীয়ত: দুর্নীতি রুখবার জন্য। তৃতীয়ত: ডিজিটাল লেনদেনের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য। চতুর্থত: মানি ইন সার্কুলেশন হিসেবের মধ্যে আনার জন্য।
এই প্রসেসকে ইংরেজিতে বলা হয় ডিমনিটাইজেশন। এর বাংলা অর্থ হতে পারে 'মুদ্রারহিতকরণ'।
এই পদক্ষেপের ফলে সাময়িকভাবে দেশের শিল্পোৎপাদন এবং জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো, শেয়ারবাজারে ধ্বস নেমেছিলো এবং জনগণ প্রতিরোধ-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো।
সাময়িক কষ্ট হলেও ভারতীয়রা কিন্তু এই পদক্ষেপ থেকে লাভবানই হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর ভয়ডরহীন নেতৃত্বের ফলে এমন কঠোর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছিলো বলে মনে করা হয়, যার সুফল ভারতের জনগণ বহু বছর ধরে পাবে।
ক্যাশ টাকার একটা বড় অসুবিধা আছে। ক্যাশ টাকার লেনদেন ট্রেস করা যায়না। যার ফলে, ক্যাশ টাকার লেনদেন এর মাধ্যমে নানাবিধ অপরাধ ঘটানো সম্ভব।
সব টাকা যদি ট্রেসেবল করে ফেলা যায়, তাহলে অনেক অপরাধ রুখে দেয়া সম্ভব।
যেমন ধরেন, ঘুষ। যিনি ঘুষ দেবেন, তাঁর হাতে যদি ক্যাশ টাকা না থাকে, তাহলে তাকে এমনভাবে টাকাটা দিতে হবে, যাতে ট্রেস থেকে যায়। আবার যিনি ঘুষ নেবেন, তিনি যদি ক্যাশ টাকা না নিতে পারেন, তাহলে কিন্তু তাঁর লেনদেনেরও ট্রেস থেকে যাবে। ব্যাংক একাউন্ট কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ঘুষের লেনদেন হলে ঘুষ দাতা এবং গ্রহীতা - উভয়েই ধরা পড়ে যাবেন।
ক্যাশ টাকা না থাকলে মানুষ নিজেদের আয় লুকাতে পারবেন না। ফলে, রাষ্ট্রের কোষাগারে অনেক বেশি ট্যাক্স জমা পড়বে।
ক্যাশ টাকা না থাকলে মাদকের কারবারিরা সুবিধা করে উঠতে পারবে না।
ক্যাশ টাকা না থাকলে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দ্রব্যমূল্য বাড়াতে পারবে না।
ক্যাশ টাকা না থাকলে চাঁদাবাজি কমে যাবে।
ক্যাশ টাকা না থাকলে সবার সব গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।
ক্যাশ টাকা না থাকলে বিদেশে ডলার পাচার করা সুকঠিন হয়ে যাবে। বেগমপাড়ার বেগমদের ঠাটবাট থাকবেনা।
সব টাকা যদি ব্যাংক একাউন্টে, মোবাইল ওয়ালেটে কিংবা কোনো পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়, সব লেনদেন তখন ভিজিবল হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রের অধিকাংশ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ কিন্তু এখন 'লেস ক্যাশ সোসাইটি' কিংবা 'লেস ক্যাশ কান্ট্রি' হবার জন্য প্রস্তুত। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ইএফটিএন, এনপিএসবি, আরটিজিএস এর মাধ্যমে ক্যাশ লেনদেনের পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ২০২১ সালে উদ্বোধন হওয়া 'বাংলা কিউআর' (স্ক্যান টু পে) এর যথাযথ বিস্তার হলে সর্বত্র ক্যাশলেস লেনদেন চালু হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমার খুব লোভ হয়, এমন একটা বাংলাদেশ পাবো, যেখানে চুরি করার সুযোগই থাকবেনা। সুযোগের অভাবে এই দেশের সব মানুষ সৎ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের কোনো শাসক যদি নরেন্দ্র মোদীর মতো জিদ করে একবার ডিমনিটাইজেশন করে ফেলতে পারেন- দেশ এগিয়ে যাবে অন্তত ৫০ বছর।
টুলস আমাদের হাতেই আছে, দরকার একটা সাহসী উদ্যোগের। কেউ কি নিতে পারবেন, এমন সাহসী, একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত?
পুনশ্চঃ অনেকে বলেন, ভারতে ডিমনিটাইজেশন একটা ডিজাস্টার ছিলো। আমি অবশ্য তেমনটা মনে করিনা। বাংলাদেশে ৫৩ বছরের জঞ্জাল সরাতে এই মহৌষধ এর বিকল্প দেখিনা।