15/07/2025
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি জোরালো করছে বিএনপি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসনভিত্তিক জরিপ শুরু করেছে বিএনপি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে জরিপ কাজে যুক্ত রয়েছেন দলের তিনজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তাঁরা সরেজমিনে বিভিন্ন আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক শক্তি, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং মাঠপর্যায়ের অবস্থান মূল্যায়ন করছেন। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অপেক্ষাকৃত তরুণ, শিক্ষিত ও ইমেজসম্পন্ন নেতাদের ওপর।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে যারা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের অবস্থাও জরিপে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তবে ২০১৮ সালের মতো এবার এক আসনে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এবার দলের সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—এক আসনে একক প্রার্থী দেওয়া হবে। বিগত নির্বাচনের মতো একাধিক চিঠি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন আসনে বিএনপির একাধিক নেতার মাঠে সক্রিয় হয়ে পড়ায় কোথাও কোথাও নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এসব দ্বন্দ্ব এড়াতে কিছু আসনে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দিষ্ট কয়েকজন নেতাকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। তবুও অনেক আসনে একাধিক ব্যক্তি প্রচারে রয়েছেন।
দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। প্রত্যেক বিভাগের সাক্ষাৎকার শেষে বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গঠিত পার্লামেন্টারি বোর্ড একক প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। পার্লামেন্টারি বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য মনে করেন, আধুনিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে নেতৃত্বে তরুণ, আধুনিকমনস্ক এবং জনপ্রিয় নেতাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে কারণে অনেক সিনিয়র নেতা এবার মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। তাছাড়া মিত্র দলগুলোকেও কিছু আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। দলটির হাইকমান্ড ইতোমধ্যে কয়েকজন মিত্র দলের নেতাকে নির্বাচনী এলাকায় কাজ করার ইঙ্গিত দিয়েছে। ঢাকার দুই-তিনটি আসনেও ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
দল পুনর্গঠনের কাজও চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। বিএনপির সাংগঠনিক নেতাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে সকল পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছেন।
বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান জানান, “শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে নির্দেশনা পেয়েছি দ্রুত কাউন্সিলের মাধ্যমে সকল কমিটি গঠনের।” ভোলা জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ বলেন, “আমরা কয়েক দফা সভা করেছি। জুলাইয়ের মধ্যেই জেলা কমিটি গঠনের পরিকল্পনা আছে।” ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “কমিটি গঠনে আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করছি—তৃণমূল থেকে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন হচ্ছে।”
চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলেও কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তবে কোথাও কোথাও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে কেন্দ্রীয়ভাবে তা সমাধান করা হচ্ছে। ত্যাগীদের মূল্যায়ন ও নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে কমিটি গঠনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন নেতারা।
এদিকে, বিএনপি মনে করে, জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করতে দেশ-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরেই এসব চক্রান্তের কেন্দ্রে রয়েছে। বিএনপির নেতারা দাবি করছেন, “২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো বিএনপিকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।”
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে, তা কিছু অপশক্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা পরিকল্পিত অপপ্রচারের মাধ্যমে বিএনপিকে আক্রমণ করছে। কিন্তু আমরা জনগণের ম্যান্ডেট ও গণতন্ত্রের ওপর আস্থাশীল।”
দলীয় নেতারা আরও জানান, “যেখানেই অনিয়ম বা সন্ত্রাসের অভিযোগ এসেছে, বিএনপি সেখানে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। দলীয় নির্দেশ স্পষ্ট—যে কোনো অন্যায় বা বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করা হবে, সে যত বড় নেতা-ই হোক।”
একই সঙ্গে বিএনপি মনে করে, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪”-এর মাধ্যমে দেশের নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “জুলাইয়ের এই গণ-ঘোষণা অদূর ভবিষ্যতে সংবিধানে যুক্ত হবে। এটাই দেশের প্রকৃত পরিবর্তনের সূচনা।”
তিনি আরও বলেন, “ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক দলিল হিসেবে রাষ্ট্রীয় আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকবে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করা হতে পারে।” বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্রের খসড়ায় কিছু শব্দগত পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন ঘটিয়ে সরকারের কাছে মতামতও দেওয়া হয়েছে।
সবমিলিয়ে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির সাংগঠনিক তৎপরতা, নেতৃত্ব বাছাই, মিত্রদের সঙ্গে সমন্বয় এবং রাজনৈতিক ঘোষণার কৌশল—সবকিছুই দলটির জন্য এক কঠিন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে।