24/05/2025
ফিলিস্তিনের গল্প: ০১
সেই সন্ধ্যা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, থামার নাম নেই, মনে হচ্ছে এই বৃষ্টিতে মৃতপ্রায় গাযা পানির নিচে তলিয়ে যাবে, থেমে যাবে পৃথিবীর সকল কোলাহল। রাতের অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টির তীব্রতা, যেন এই রাত শেষ হবার নয়, এই বৃষ্টি থেমে যাবার নয়।
শরনার্থী শিবিরের তাঁবু গুলো এমনিতেই বোমার আঘাতে জর্জরিত, ছেঁড়াফাটা জরাজীর্ণ, একটু বৃষ্টি হলেই ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়, এই ছেঁড়াফাটা তাঁবু গুলো যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক।
এটি সেই যুদ্ধ, ইতিহাস যাকে কখনো যুদ্ধ হিশেবে স্বীকৃতি দেয় না, এটি হলো নিরাপরাধ মানুষের রক্তের খেলা, যেখানে বিস্ফোরিত প্রতিটি বোমা একটি শিশুর কান্না, আর ছিন্নভিন্ন মাংসপিণ্ড মানবতার অপমৃত্যুর অভিশাপ।
এই ছেঁড়াফাটা তাঁবু গুলোতে বসবাস করে নিপীড়িত গাযার কয়েক লক্ষ মজলুম বনী আদম। এখানে প্রতিনিয়তই নেমে আসে এক করুণ বাস্তবতার অন্ধকার ছায়া। ক্ষুধার্ত শিশুর কাঁপা কণ্ঠে ভেসে আসে খাদ্যের আকুতি, বাতাস বেদনাবিধুর করে তুলে আহতের আর্তচিৎকার, যন্ত্রণার শব্দ ঢেকে দেয় সবকিছু।
হাহাকার, ব্যথা, অশ্রু আর অপার নিরাশার ধোঁয়াশা। শরীরে ক্ষতের জ্বালা, মনে নির্বাক দহন। এ যেন এক চলমান দুঃস্বপ্ন, ক্ষুধা, ব্যথা, মৃত্যু আর অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্পে জড়িয়ে থাকা এক বেদনাহত জনপদ।
নিয়মিত এখানে ত্রাণ আসে, তবে সে ত্রাণ পৃথিবীর অন্য সকল ত্রাণ সামগ্রীর মতো নয়।
এ ত্রাণের নাম, ডাম্ব, বাংকার বাস্টার ও ব্যলিস্টিক মিসাইল, যা আসে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্যাসিফিষ্ট ও হিউম্যান রাইটস অ্যাডভোকেট আমেরিকার খরচে তার মিত্র ইজরায়েল থেকে। এ ত্রাণ আসে হিউম্যানিটেরিয়ানের মুখোশ পড়া পৃথিবীর মিলিয়ন মিলিয়ন ইসলামোফোবির পক্ষ থেকে।
যা মুহূর্তেই কেড়ে নেয় প্রলয়ংকারি এ যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া শত শত অবুঝ শিশু আর অবলা নারীর তাজা তাজা প্রাণ, ছাপ ফেলে যায় কিয়ামতের দুর্বিষহ বিভীষিকার।
.......
সন্ধ্যায় মাহমুদের তাঁবুতে যে প্রদীপটি মিটমিট করে জ্বলছিল, বৃষ্টির ফোঁটায় তা নিভে গেছে অনেক আগেই, অন্ধকার যেন গা ছমছমে কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। তীব্র বৃষ্টি আর রাত্রির ঘোর অন্ধকারে এক অদ্ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে তাঁবুর ভেতর, নেমে এসেছে কবরের অন্ধকার।
হঠাৎ বিষন্ন ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সে, সদ্য বোমার আঘাতে জর্জরিত পিঠ থেকে এ ব্যথার উৎপত্তি। সারাটা দিন এই ক্ষত থেকে চুপ চুপ করে রক্ত ঝরেছে, অল্প ব্যথাও হয়েছে কয়েকবার, তবে এবারের ব্যাথা টা একটু ভিন্ন রকম লাগছে তার নিজের কাছে।
বৃষ্টির সাথে এবার প্রচন্ড দমকা হাওয়া বইতে লাগলো। প্রকৃতির উন্মত্ত রুদ্ররূপ যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো পৃথিবীর বুকে, ঠান্ডায় কাঁপুনি উঠে গেল মাহমুদের গায়ে। যেন প্রকৃতির ক্রোধের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে মানবজীবনের অসহায়তা।
ক্রমেই ব্যাথা বাড়তে লাগলো, বাড়তে বাড়তে সহ্যের সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল তার, নিজেকে এ পর্যায়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মনে হল মাহমুদের, মনে হলো এ বিশাল পৃথিবীর এতো এতো মানুষের কেউ তার নয়, একাকিত্ব ভীষণভাবে পেয়ে বসলো তাকে।
ব্যাথার তীব্রতায় মৃত্যুর মতো ঠান্ডা শীতল হয়ে আসতে লাগল তার শরীর, নীরব ও নিথর হয়ে আসতে লাগলো তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। সংকুচিত হয়ে আসতে লাগল তার সময়, থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো তার শ্বাস প্রশ্বাস।
একটুখানি বেঁচে থাকার যে আশা আর প্রতিশোধের যে অগ্নি নিয়ে সে এ শরনার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল, এখন সে ততটুকুই হতাশা দেখতে পাচ্ছে দু চোখে, অনিবার্য মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সে তার পুরো জীবনটাকে আরেকবার দেখে নিতে চাইল। দেখে নিতে চাইল বোমার বিস্ফোরণে জর্জরিত হয়ে যাওয়া তার স্মৃতির আল্পনাগুলোকে।
.........
সে দেখতে পেল শৈশবের ছোট্ট নিষ্পাপ মাহমুদকে, যার উপস্থিতি আয যাহরার প্রতিটি পথের ধুলো-কণা, আর গাছের পাতায় পাতায় এক অদ্ভুত ছন্দ যোগায়, যা পড়তে গেলে মনে হয় প্রকৃতিই যেন তার ছোট্ট কণ্ঠস্বরের পেছনে নতজানু।
সে দেখতে পেল কৈশোরের প্রাণবন্ত, উদ্যমী আর আবেগপ্রবণ মাহমুদকে, যে দাপিয়ে বেড়ায় আয যাহরার মাঠ ঘাট আর বন বাদার, প্রতিটি পথ ও প্রান্তরকে মুখরিত করে রাখে সকাল-সন্ধ্যা।
সে দেখতে পেল কুঁড়ি বছরের মেধাবী, সচ্চরিত্র, সকলের আস্থাভাজন, পিতা মাতার নয়নের মনি মাহমুদকে, নির্দ্বিধায় যার উপর ভরসা করে সবাই, যার মোহাবিষ্ট আয যাহরার প্রতিটি প্রাণ।
এই কুঁড়ি বছরের সমষ্টিই হলো মাহমুদের জীবন। এই কুঁড়ি বছরের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ যেন আজ তাঁর স্মৃতির দেয়ালে ভেসে উঠছে, শরনার্থী শিবিরের নিঃসঙ্গ নির্জন এক রাতে—মৃত্যুর নিকটবর্তী সন্ধিক্ষণে।
ঠান্ডা বাতাসে কাঁপতে থাকা তাঁর ক্ষীণ শরীর আর দুর্বল শ্বাসের মাঝেও এই উপলব্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠে—এই জীবন আল্লাহ তাঁকে কতোটা মমতায়, কতোটা ভালোবাসায় গড়ে দিয়েছেন! তাঁর অন্তর কেঁপে ওঠে কৃতজ্ঞতায়।
তার মনে পড়ে প্রিয় গ্রামটির কথা, ধুলোর আস্তরন জমে থাকা স্মৃতির পাতা থেকে ভেসে ওঠে সেই চিরচেনা দৃশ্যপট—প্রিয় গ্রাম, আয যাহরা।
আহ! কী অপূর্ব ছিল সে বসতভূমি। সকালে সূর্য যখন পর্বতের কোল ছুঁয়ে ওঠতো, তখন সোনালী রশ্মি খেলা করত তাদের পাথুরে দেয়ালের উপর। বাতাসে ভেসে আসত পাকা জলপাইয়ের ঘ্রাণ, পাখির কলকাকলিতে জেগে উঠত গাঁয়ের প্রতিটি প্রাণ।
তাদের উঠোনে ছিল একটি পুরনো অলিভ গাছ, যার ছায়ায় বসে তার দাদি গল্প বলত—পৃথিবী, স্বাধীনতা আর স্বপ্নের। শুক্রবারে তার বাবার সঙ্গে মসজিদে যেতে যেতে পথের ধারে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকত তার ছোট্ট বোন আলেয়া। আলেয়ার হাতে থাকত বুনো ফুল—মাহমুদের জন্য।
.....
মৃত্যুদূতের আগমনী এই রাত যেন বেঁধে দিলো এক অনন্তীর বাঁধন, যে রাতের আঁধারে হারিয়ে যেতে চায় সব আলো আর আশা।
গগনবৃন্দে বাজছে মরণঘণ্টার করুণ গর্জন, আর বারিবর্ষণের প্রতিটা ফোঁটা যেন ইসরাফিলের শিংয়ে ফুৎকারের বিষণ্ণ সুর, যা মৃত্যুর ঘোষণাপত্র বয়ে নিয়ে এসেছে।
হৃদয় দুলছে এক অজানা বিষাদের ভারে, মনে হচ্ছে, এই রাত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ ও অশান্ত রাত, যেটি কখনো শেষ হবে না। সময় যেন থমকে গেছে, আর একাকীত্বের মধ্যে ডুবে থাকা ক্ষণগুলো চিরস্থায়ী হয়ে গেছে।
প্রলয়ংকারি সেই রাতেও তার চোখের পাতায় জেগে আছে আয যাহরার সূর্যহীন এক সকাল। চারপাশে ধ্বংস, বারুদের গন্ধে ভরা বাতাস—তবু হৃদয়ে বাজে একটিই নাম, একটিই সুর—লায়লা।
লায়লার স্পর্শ ছিল তার প্রথম বসন্ত। সে যখন তার হাতে হাত রেখেছিল, আয যাহরার সব অলিগলি যেন ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল। অলিভ গাছের ছায়া, কুয়াশায় ঢাকা সকালের মাঠ, ভূমধ্যসাগরের তীরে বসে থাকা কিশোর হৃদয়—সব কিছুতেই ছিল লায়লার কোমল উপস্থিতি।
তারা হেঁটেছিল, দু’জনে, নীরব গ্রামপথে, যেন পৃথিবী থেমে গিয়েছিল তাদের পদচিহ্ন শুনতে।
লায়লা ছিল তার জীবনের পবিত্রতম নাম। সে চোখ বুজলে হৃদয়ের আরশিতে লায়লা ভেসে উঠত, রাত্রি নামলে লায়লার কণ্ঠস্বর বাতাসে তরঙ্গ তুলতো। যুদ্ধের প্রতিটি গর্জনের ভেতর সে শুনত লায়লার ডাক।
আজ যখন রক্তে তার বুক ভেসে যাচ্ছে, হৃদপিণ্ড নিঃশব্দে থেমে আসছে, সে একবারও কান্না করছে না, কারণ তার সব কষ্ট ছাপিয়ে আছে ভালোবাসার অলংকৃত এক ছবি।
লায়লা..।
.......
এবার বৃষ্টির তীব্রতা আরো বেড়ে গেল, প্রতিটি ফোঁটা একেকটি শাণিত বর্শার মতো আঘাত হানছে, যেন এই ক্ষয়িষ্ণু তাঁবুটিকে ছিন্নভিন্ন করে তার নিথর দেহে বিদ্ধ হবে। যেন এই তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিবে।
তার নিথর দেহ পড়ে আছে তাঁবুর ভেতরের স্যাঁতস্যাঁতে কাঁদায়, তার শরীর ছিন্ন, শ্বাস টলে যাচ্ছে, কিন্তু হৃদয়… হৃদয় তখনও দুলছে এক অতীত বিকেলের স্মৃতিতে।
এটা সেই বিকেল, যে বিকেল তাকে ধরা দিয়েছিল পৃথিবীর অনন্ত অসীম সকল সুখকল্পের আল্পনা হয়ে, এটা সেই বিকেল, যে বিকেল তাকে ধরা দিয়েছিল একটি নতুন স্বপ্ন, একটি নতুন ভোর আর একটি নতুন দিনের মুর্ছনা হয়ে।
গাযার এই রক্তরাঙা মাটি যেন আজও সাক্ষ্য দেয় সেই বিকেলের, সাক্ষ্য দেয় এক প্রেমিক, এক সন্তান, এক ভাইয়ের করুণ আর্তনাদের।
সেদিন ছিল গাযার রক্তিম সন্ধ্যা, আকাশের ক্যানভাসে যেন কেউ রঙ তুলির শেষ আঁচড়ে এক পশলা রক্তিম আবেশ ঢেলে দিয়েছিল। সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছিল, আর তার শেষ কিরণগুলো ছড়িয়ে পড়ছিল মেঘের আঁচলে, আলো ও অন্ধকারের মাঝখানে সৃষ্টি হয়েছিল এক অলৌকিক রহস্য।
সেই সন্ধ্যায় সে ডুবে গিয়েছিল স্বপ্নের সুগভীর তানে, লায়লাকে চিরকালের জন্য আপন করে পাওয়ার আকুল প্রত্যাশায়। তার কল্পনার পর্দায় ভেসে উঠছিল লায়লার কোমল হাত ধরে সে পাড়ি দিচ্ছে দিগন্তজোড়া পৃথিবীর অনন্ত পথ, সে দেখছিল, লায়লাকে নিয়ে ভালোবাসার অদৃশ্য নৌকায় সে ভেসে যাচ্ছে কুহেকাফ আর কাফুরের রহস্যঘেরা বনাঞ্চলে। যেখানে শুধু প্রেম, আর লায়লা আর অনন্তকালের স্বপ্নবাস।
কারণ সেই দিনটি ছিল লায়লার সাথে তার বন্ধনের দিন।
সারা বাড়ি সাজানো, মা কাঁপা হাতে লাল শাড়ি ছুঁয়ে দিচ্ছেন, বাবা তাকিয়ে আছেন গর্বিত চোখে। আর ছোট বোন আলেয়া? সে হাসছিল কিশোরীর আনন্দে,এমন আনন্দ, যা পৃথিবীর সব বেদনা ভুলিয়ে দেয়।
সে নিজেকে দেখছিল আয়নায়,যেন পৃথিবীতে তার মতো সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই, সে এক সফল প্রেমিক, সে এক সফল বর।
লায়লার চোখে সে দেখেছিল আগামী দিনের স্বপ্ন, যেখানে রক্ত নেই, শুধু সবুজ…
শুধু ভালোবাসা।
কিন্তু গাযা তো কখনো শান্ত থাকতে জানে না।
একটা বিকট শব্দ, এক ঝলক আলো…
তার চোখের সামনে যেন পুরো আকাশ চুরমার হয়ে গেল।
বিস্ফোরণ...
ধোঁয়া...
আর তারপর নিস্তব্ধতা।
মা নেই।
বাবা নেই।
আলেয়ার রক্তমাখা চুড়ি পড়ে আছে মেঝেতে।
আর লায়লা…
তার মুখটা আজও সে স্পষ্ট দেখতে পায়—এক পলক তাকিয়ে ছিল, যেন জিজ্ঞেস করছিল, এটাই কি আমাদের স্বপ্নের পরিণতি? এটাই কি আমার নিয়তি?
সেই সন্ধ্যা আর আসেনি।
আলো নিভে গেছে গাযার সেই উঠোনে।
আর সে—সে তখন থেকেই কেবল বেঁচে ছিল প্রতিশোধের আগুনে, হৃদয়ে এক অনাদৃত কষ্ট বয়ে।
আজ, মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে, গাযার সেই ছেলেটি চোখ বন্ধ করে আবার দেখে লায়লার মুখ।
মনে পড়ে তার হাতে লাল চুড়ি, চোখে কাজল আর কপালে.....
তার বুক চিৎকার করে উঠে, দম বন্ধ হয়ে যায়, শ্বাস প্রশ্বাস থেমে যায়...
অনন্ত মহাকালের জন্য।