26/12/2023
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন-এর মধ্যকার সমস্যাটার শুরু কবে থেকে, কিভাবে ও কেন- আমি ঘেঁটে ঘেঁটে যা জানলাম, জানাচ্ছি। বিশাল ইতিহাস। এমন একশো একটা দিক থেকে একশো একটা চোখ দিয়ে একই ঘটনা দেখা, দেখে নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প বলা প্রায় অসম্ভব। ভুলচুক হতে পারে। শুরুটা করছি যিশু দিয়ে।
ইসলাম ধর্মে যিশুকে ডাকা হয় ঈসা নামে। মুসলিম বিশ্বাস করে, ঈসা আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী ও রাসুল, যার উপর আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছে, ওই কিতাবের নাম ইনজিল। এবং তার এখনও মৃত্যু হয়নি, তাকে আল্লাহ চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। কেয়ামতের আগে তিনি আবার পৃথিবীতে আসবেন। আর খ্রিস্টান বিশ্বাস করে, যিশু হচ্ছেন ঈশ্বরের পুত্র, তিনি মসীহ। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম বাইবেল। যেটা দুইভাগে বিভক্ত। একটা ওল্ড টেস্টামেন্ট আরেকটা নিউ টেস্টামেন্ট। অন্যদিকে ইহুদিরা বিশ্বাস করে, যিশু নয়, ঈশ্বরের সর্বশেষ বাণীবাহক হলেন মোযেশ। ইহুদি ও খ্রিস্টান দুই ধর্মের অনুসারীরাই ঈশ্বরকে ডাকে জেহোবা। ওদের ধর্মগ্রন্থ-এর নাম তোরাহ, যেটা খ্রিস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্টের অংশ। ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটা বইয়ের নাম যথাক্রমে- জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিটিকাস, নামারস এবং ডিউটেরোনোমি। এই পাঁচটি বইকে একসাথে ডাকা হয় তোরাহ।
ইসলাম, ক্রিশ্চান আর ইহুদি- তিন ধর্মই লতায় পাতায় একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। তিনটাই একেশ্বরবাদী আব্রাহামিক ধর্ম। ইহুদিদের মোযেশই হলেন মুসা, যিনি ইসলাম ধর্মে আল্লাহর প্রেরিত চারজন নবী ও রাসুলের মধ্যে একজন।
ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম- তিন ধর্মেরই পবিত্র ও আবেগের জায়গা হলো জেরুজালেম। মুসলিমদের প্রথম কেবলা আল-আকসা, যেটা জেরুজালেম-এ অবস্থিত। ইহুদিদের পবিত্র ওয়েস্টার্ন ওয়াল, যেটাকে তারা পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর বলে- ওটাও জেরুজালেম। আর খ্রিস্টান বিশ্বাস করে, জেরুজালেমই ওই জায়গা, যেখানে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। একই জায়গায় তিন ধর্মের মানুষ মাথা ঠুকতে গেলে মাথা ঠোকাঠুকি হবে। ওটাই হলো। ইতিহাস অনুযায়ী ওই ঠোকাঠুকির নাম ক্রুসেড। শত শত বৎসর ধরে চলা ধর্মযুদ্ধ। প্রথম ক্রুসেডের ঘটনাটি বলি।
বাইবেল অনুযায়ী, ইহুদিদের রাজা ডেভিড যাকে মুসলিমরা চেনে দাউদ নামে, উনি জেরুজালেম দখল করেন, ওখানে গোড়াপত্তন করেন আর ইসরায়েল-এর রাজধানী স্থাপন করেন। তার পুত্র সলোমন যাকে মুসলিমরা চেনে সুলায়মান নামে, উনি ওখানে টেম্পল মাউন্টে ইহুদিদের প্রথম প্রার্থনালয় বানান। ওরা ওখানে বসবাস শুরু করে। পাঁচশ আশি খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। কেননা তারপর ব্যাবিলনীয়রা এসে জেরুজালেম দখল করে নেয়। ওরা ইহুদিদের প্রার্থনালয় গুড়িয়ে দেয়। ওদের নির্বাসনে পাঠায়। তার প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর পারস্যের রাজা সাইরাস ইহুদিদের ওই প্রার্থনালয় পুনঃনির্মাণ করে দেন, ইহুদিদের বন্দীদশা থেকে ফেরত আসতে দেন নিজেদের জায়গায়। তিনশ বত্রিশ খিস্টাব্দে এসে জেরুজালেম দখল করে নেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। এবং পরবর্তী কয়েকশ বৎসর আরও কয়েকবার দখল-বেদখল হয় এই জায়গা। তখনও ক্রুসেড আরম্ভ হয়নি। এটি আরম্ভ হলো, যখন আরবরা দখল নিলো জেরুজালেম। সাল ছয়শ আটত্রিশ।
মুসলিম শাসন চলছিল যখন, তখনও খ্রিস্টানরা জেরুজালেম আসতে পারতো, তাদের প্রার্থনালয় দর্শন করতে পারত, কিন্তু এক হাজার সাতাত্তর সাল, যখন শাসন চলছিল সেলযুকদের, ওরা খ্রিস্টানদের জেরুজালেম আসার উপর কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করল। তখন পার্শ্ববর্তী কনস্টান্টিনোপোলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটা সাম্রাজ্য, যা রোমান দ্বারা পরিচালিত, সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন এর মৃত্যুর পর দু্ই ভাগ হয়ে যাওয়া রোমান সাম্রাজ্যের এক ভাগ, নাম- বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য; এই সাম্রাজ্যের ওই সময়কালীন সম্রাট অ্যালেক্সিক কমনেনুস আশংকা করেন, সেলযুক সাম্রাজ্যের এই কড়াকড়ি তার সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি স্বরুপ। তিনি তখন পোপের সহায়তা চান। পোপ ঘোষণা দেন, খ্রিস্টান ধর্ম বিপদে রয়েছে, যিশুর সৈনিক হিসেবে ইউরোপকে জেগে উঠার এখনই সময়। এই আহ্বানে ইউরোপের সাধারণ মানুষও সাড়া দেন কেননা তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ওরা যদি জেরুজালেম উদ্ধার করতে পারে, তবে তাদের জীবনের সকল অপরাধ ক্ষমা পেয়ে যাবে।
এক হাজার ছিয়ানব্বই সালে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি থেকে পবিত্র ভূমি উদ্ধারের জন্য প্রায় ষাট হাজার যোদ্ধা কনস্টান্টিনোপোলে উপস্থিত হয়। এদেরকে ডাকা হয় পিওপলস ক্রুসেড। ওরা ওদের যাত্রা আরম্ভ করে এবং সেলযুকদের হাতে পরাজিত হয়। তারপর প্রায় পঁচাত্তর হাজার যোদ্ধা নিয়ে দ্বিতীয় যাত্রা আরম্ভ হয় জেরুজালেম উদ্দেশ্যে তাদের। পিওপোলস ক্রুসেড ছিল সাধারণ মানুষদের নিয়ে গঠিত, অনভিজ্ঞ যোদ্ধা, কিন্তু এরা ছিল অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। ফলাফল সেলযুকদের রাজধানী দখল করে নেয় এরা আর জেরুজালেম অবরোধ করে রাখে। দীর্ঘ অবরোধ শেষে জেরুজালেম দখলে আসে ক্রুসেডারদের। পরাজিত হয় সেলযুক। জেরুজালেমে প্রবেশ করে ক্রুসেডাররা বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায়। খোদ খ্রিস্টান থেকে ইহুদি ধর্মাবলম্বী, কেউ বাদ পড়েনি এই হত্যাযজ্ঞ থেকে। ধারণা করা হয়, প্রায় সত্তর হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাযজ্ঞ আর বিজয়ের পর ক্রুসেডারদের হাতে আসে বর্তমান ফিলিস্তিনের বড়ো একটা অংশ।
দ্বিতীয় ক্রুসেড সংঘটিত হয় এগারশো চুয়াল্লিশ সালে। ওই ক্রুসেডে মুসলমান বিজয় লাভ করে। ফিলিস্তিন আসে মুসলিমদের দখলে। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ সহ বেশ কিছু ক্রুসেড সংঘটিত হয়। তবে ফিলিস্তিন থেকে যায় মুসলিমদের হাতে। আর খ্রিস্টান ও মুসলিমদের ধর্মযুদ্ধের মাঝখানে পড়ে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইহুদি। যিশুর হত্যার সঙ্গে ইহুদি জড়িত বিশ্বাস করে খ্রিস্টানদের একাংশ ইহুদি ঘৃণা করে। আর মুসলিমদের সঙ্গে তাদের কোনোদিন যাবে না। যদিও ইতিহাসের অনেক জায়গায় এই সময়কালে ইহুদিদের প্রতি মুসলিমদের আন্তরিকতার উল্লেখ রয়েছে। এগারশ সাল থেকে ষোলশ সাল অবধি ইহুদিরা এদিক-ওদিক থেকে বন্দী, হত্যা ও বিতাড়িত হয়ে অনুধাবন করতে শুরু করে, তাদের একটা প্রকৃত জায়গা দরকার, প্রকৃত দেশ। আর এই ভাবনার বাস্তবিক একটা রুপ দান করেন থিওডর হার্জল। আঠারশ ছিয়ানব্বই সালে তিনি একটি পলিটিক্যাল মুভমেন্ট-এর সূচনা করেন। যাকে ডাকা হয়, জায়োনিজম। বাংলায়, ইহুদিবাদ। ইহুদি ধর্ম ও ইহুদিবাদ এক নয়। এই মতবাদ অনুযায়ী, ইহুদিদের জন্য একটা আলাদা দেশ গঠন করা জরুরি। দেশটা কোথায় হবে? অবশ্যই জেরুজালেম। ওটা পবিত্র ভূমি, প্রমিসড ল্যান্ড, ওখানে ওদের ধর্মের প্রথম প্রার্থনালয় অবস্থিত।
ঠিক একই সময় শুধু জেরুজালেম নয়, ওটা কেন্দ্র করে বৃহৎ একটা এলাকা পুরোটাই পরিচিত ছিল একটা নামে, প্যালেস্টাইন। যেটাকে আমরা বলি ফিলিস্তিন। এটি শাসন করছিল অটোমান সাম্রাজ্য। সুলতান সুলেমান সিরিজের কল্যাণে এই সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা সবার আছে বলে মনে হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে ফিলিস্তিনে ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলিম মিলেমিশেই ছিল মোটামুটি। হানাহানি রক্তপাত খুব একটা হয়নি। সুলতান সুলেমান সিরিজে খুব সম্ভবত এই বিষয়টিকেই তুলে ধরা হয়েছিল একটা বাগানের তুলনা দিয়ে। রাজ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাস করা নিয়ে কিছু একটা অসন্তোষজনক কথা বলায় একজনকে সুলতান বলেছিলেন, একটা বাগান তখনই সুন্দর, যখন ওখানে নানান প্রজাতির ফুল থাকে।
দেশ গঠন করার তাগিদে এদিক-ওদিক থেকে ইহুদিরা এসে ফিলিস্তিনের জমি কিনতে শুরু করে, বসবাস করতে শুরু করে অটোমান সময় থেকেই। তারপর আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। উনিশশো চৌদ্দ সাল। একপক্ষে আছে অটোমান, জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি। অন্যপক্ষে আছে, সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধে পতন হয় জার্মানির, অটোমান সাম্রাজ্যেরও পতন হয়, আর ওই পুরো এলাকা দখলে আসে ব্রিটেনের। জার্মানির এই পতনের পেছনেও ইহুদিরা আছে বলে অনুমান করা হয়। প্রথমত, জার্মান বিশ্বাস করে, জার্মানির পরাজয় স্বীকার করার পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে খোদ জার্মানেরই উচ্চপদস্থ জায়গায় থাকা কমিউটিস্ট ইহুদিরা। দ্বিতীয়ত, আমেরিকাকে যুদ্ধে ব্রিটেনের পক্ষে নিয়ে আসা এবং আসার পেছনে লবিং করাটাও ইহুদিদের কাজ। জার্মানের ভেতর যে চরম ইহুদি-বিদ্বেষ, তার সূত্রপাত খুব সম্ভবত এটা। আপাতত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের বুদ্ধি ও সাহায্য পাওয়ায় এবং জয়লাভ করার বিনিময়ে ওদের জন্য একটা দেশ গঠন করার প্রতিশ্রুতি দেয় ব্রিটেন। ওই দেশটার নাম হবে, ইসরায়েল। জায়গাটা হবে ফিলিস্তিনের ভেতর। এই সমর্থন, ঘোষণা কিংবা প্রতিশ্রুতিকে বেলফোর ডিক্লারেশন বলা হয়। তখন সাল, উনিশশো সতের।
তারপর, তার পনের বৎসর পর জার্মানির ক্ষমতায় আসে এডলফ হিটলার। শুরু হয় ইহুদি নিধন। সংঘটিত হয় বর্বর হত্যাকাণ্ড। মারা হয় প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদি। যেটা হলোকাস্ট নামে পরিচিত। এটি ইহুদিদের উপর চলা দ্বিতীয় বর্বর গণহত্যা। প্রথম বর্বর গণহত্যাটা ছিল সেলযুক শাসনামল পতনের পর। ওটা সংঘটিত হয়েছিল খ্রিস্টান দ্বারা। যাই হোক, শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের বর্বরতায় টিকতে না পেরে জার্মান থেকে ইহুদিরা এদিক-ওদিক চলে যায়, আর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদি চলে আসে ফিলিস্তিন। ওখানে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়।
সাল উনিশশো সাতচল্লিশ। জাতিসংঘে একটা প্রস্তাব উত্থাপন হয়। ওটি হলো, ইসরায়েল নামে স্বাধীন একটা রাষ্ট্র হবে, ফিলিস্তিন নামে স্বাধীন একটা রাষ্ট্র হবে, আর জেরুজালেমটা দুই দেশের কারোরই ব্যক্তিগত এখতিয়ারে থাকবে না। ওটা থাকবে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির নিয়ন্ত্রণে। এই প্রস্তাবটা ইহুদিদের জন্য সন্তোষজনক হলেও ফিলিস্তিনীদের জন্য সন্তোষজনক ছিল না। তাদের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘের এই প্রস্তাবটিতে নারাজ হন বাকি আরব দেশগুলোও। ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের ভেতর ইহুদিদের শক্ত একটা কমিউনিটি গড়ে ওঠে, পাশাপাশি জেগে ওঠে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনীও। আর এইরকম অস্থির রাজনৈতিক অবস্থায় সাল উনিশশো আটচল্লিশ-এ ব্রিটেন নিজেদের সাম্রাজ্য গুটিয়ে নিয়ে ভেগে যায় ফিলিস্তিন হতে। আর দেশের কতটুকু অংশ ফিলিস্তিন পাবে আর কতটুকু অংশ ইহুদিরা পাবে- সেটা ভাগ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউনাইটেড ন্যাশনকে।
ইউনাইটেড ন্যাশন সাতচল্লিশ সালের ওই প্রস্তাব মোতাবেক পুরো ফিলিস্তিনের প্রায় পঞ্চান্ন পার-সেন্ট ইহুদিকে আর প্রায় পঁয়তাল্লিশ পার-সেন্ট ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দেয়। জেরুজালেম অংশটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। ইহুদিরা তাদের ওই অংশটাকেই তাদের রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। এবং জন্ম হয় ইহুদিদের একমাত্র রাষ্ট্র, ইসরায়েল। যেটাকে তার আশপাশের আরবদেশগুলো সমর্থন করে না। ফলাফল, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। যেখানে একপক্ষ লড়ছিল একটা দেশের ভাগ হয়ে যাওয়া রোধ করতে, আরেকপক্ষ লড়ছিল সদ্য সদ্য পাওয়া ছোট্ট একটা রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে। যারা ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছে পুরো বিশ্ব তাদের কেমন ঘৃণ্য নজরে দেখে। যারা ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছে, এই যুদ্ধে হেরে গেলে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে প্রায়। ফলে অস্তিত্ব রক্ষার প্রাণপণ এক যুদ্ধে নামে তারা। তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইরাক, সিরিয়া, মিশর ও জর্ডান। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ইসরায়েল এই যুদ্ধে জয়লাভ করে।
আরব-ইসরায়েল প্রথম যুদ্ধের পর- ইহুদিরা, জাতিসংঘের হিসাবমতে পাওয়া তাদের পঞ্চান্ন পার-সেন্ট জমিন নিজেদের দখলে রাখার পাশাপাশি ফিলিস্তিনেরও অনেকটুকুন অংশ জমিন দখল করে নেয়। পাশাপাশি ফিলিস্তিনের মানচিত্রে ছোট্ট ছোট্ট কামড় বসায় আরবদেশগুলোও। ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাংক নামক একটা জায়গা, যেটা জাতিসংঘের করে দেওয়া পার্টিশনে ফিলিস্তিনের ভাগে পড়েছিল, ওটা পুরোপুরি জর্ডান দখলে নেয়। আর আরেকদিকে কোণায় আরেকটা অংশ নিয়ে নেয় মিশর। ওই ছোট্ট অংশটার নাম গাজা। সবাই যে যার মতো জমিন নিয়ে নেয়, মাঝখানে পড়ে যায় ফিলিস্তিনিরা। এরা নিজেদের জায়গা হারায়, নিজেরাই নিজেদের দেশের মাটিতে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে, অনেকেই আশ্রয় নেয় আরবদেশগুলোর ভেতর।
আরব-ইসরায়েল দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় উনিশশো সাতষট্টি সালে। ওই যুদ্ধেও ইসরায়েল জয়ী হয়। আর এইবার ইসরায়েল গাজা, ওয়েস্ট ব্যাংক সহ মিসরের অনেক বড়ো একটা অংশ দখল নিয়ে নেয় পুনরায়। ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামীরা গঠন করেছে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। যেটার উদ্দেশ্য নিজেদের দেশ ফিলিস্তিন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
উনিশশো ঊনআশি সালে মিশর ও ইসরায়েল আলোচনায় বসে। মিশর স্বীকৃতি প্রদান করে ইসরায়েলকে। মিশরের যে বড়ো অংশ ইসরায়েল দখলে নিয়েছিল, সেটা তারা ফেরত দেয়। মাঝখানের সময়টায় ইহুদিরা জাতিসংঘের ভাগ করে দেওয়া নিয়ম টপকে নিজেদের দখলকৃত ওই ওয়েস্ট ব্যাংক এলাকায় বসতি স্থাপন শুরু করে। তারা জেরুজালেম কেন্দ্র করে চারপাশ বিস্তৃত ওয়েস্ট ব্যাংক পুরোটাটা নিজেদের বলে দাবী করে, যেটা জাতিসংঘ দিয়েছিল ফিলিস্তিনকে। আর ওই সময়েই তৈরী হয় একটা গ্রুপ, যেটা এক্সট্রিম, যারা পিএলও’র নমঃ নমঃ কাজকর্ম পছন্দ করে না, তারা বিশ্বাস করে, পুরো ফিলিস্তিনই তাদের, তারা জাতিসংঘের ভাগাভাগি মানে না, তাদের প্রধান লক্ষ্যই হলো ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া, ফিলিস্তিনে এই রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্বই তারা স্বীকার করে না। এই গ্রুপটার নাম হলো হা/ মাস।
উনিশশো নব্বই-এর পর ফিলিস্তিন এলাকায় প্রথমবার শান্তির হাওয়া ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। কারণ, অসলো চুক্তি। চুক্তির পেছনে কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। এই চুক্তি অনুসারে উনিশশো তিরানব্বই সালে ইসরায়েল পিএলও’কে অফিশিয়াল স্বীকৃতি দেয়, আর পিএলও ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় প্রথমবার। আর ওয়েস্ট ব্যাংক-এ প্রথমবার ফিলিস্তিনের সরকার গঠন হয়। নাম, প্যালেস্টেনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি বা পিএনএ। কিন্তু এই সরকার কাজ করবে কোথায়? ওয়েস্ট ব্যাংকের অনেক জায়গা ইতোমধ্যে ইহুদিদের দখলে। তখন ইসরায়েল ওই ওয়েস্ট ব্যাংককেই তিন টুকরো করে আবার।
লক্ষ করুন, পুরো ফিলিস্তিন একটা ছিল। ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ বলে ওখানে আসলো ইসরায়েল। দুই ভাগ হলো ফিলিস্তিন। জাতিসংঘ আসলো, তিন ভাগ হলো। ফিলিস্তিনিরা পেল ছোট্ট একটা অংশ, ওয়েস্ট ব্যাংক। এখন ওই ওয়েস্ট ব্যাংককেই তিন ভাগ করা হবে- এরিয়া এ, এরিয়া বি এবং এরিয়া সি। এরিয়া এ ভাগে থাকবে শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের নতুন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, এরিয়া বি থাকবে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয়ের সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং এরিয়া সি থাকবে শুধুমাত্র ইসরায়েল সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যদিও ওটা শান্তি চুক্তি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওই শান্তির জন্য ফিলিস্তিনিদের ত্যাগ করতে হয় নিজেদের ভুমির অনেক বড়ো অংশ। তারা মূলত ওয়েস্ট ব্যাংকের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটো ছোটো টুকরো।
স্বাভাবিকতই পিএলও’র করা অসলো চুক্তি হা/ মাসের পছন্দ হয়নি। চুক্তি পছন্দ হয়নি খোদ কট্টরপন্থী ইহুদিদেরও। এই জায়গায় তিনটি পক্ষ। কট্টর ইহুদিপন্থী, হা/ মাস ও পিএনএ। এরমধ্যে হা/ মাস ও কট্টর ইহুদিপন্থী দুইপক্ষের কোনোপক্ষই একে অপরকে মেনে নিতে রাজি নয়। আর পিএনএ চায় সমঝোতা। প্রতিবাদের উদ্দেশ্য ফিলিস্তিন হলেও হা/ মাস ও পিএনএ এক নয়। দুই পক্ষই ফিলিস্তিন চায়, তবে পিএনএ চায় সমঝোতার মাধ্যমে, অর্ধেক। আর হা/ মাস চায় যুদ্ধের মাধ্যমে, পুরোটা।
অসলো চুক্তি সফলতার মুখ দেখেনি তাই। ইসরায়েলের যে প্রধানমন্ত্রী ওই চুক্তি করেছিলেন, তাকে মেরে ফেলা হয় চুক্তির পর। ফিলিস্তিনের ভেতর হা/ মাস আত্মঘাতী হামলা করে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়, একই অঞ্চলে থাকা ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার সম্পর্ক চূড়ান্ত খারাপ হয়। এরমধ্যে নির্বাচন আসে। হা/ মাস ওই নির্বাচনে পিএনএ-কে হারিয়ে জিতে যায়। আর এই হা/ মাস ও পিএনএ- তাদের নিজেদের মধ্যে একটা গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় নির্বাচনের পরের বৎসর। দুই হাজার সাত সাল। ওই গৃহযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন হয়ে যায় দুই ভাগ। এক ভাগ, যেটা ওয়েস্ট ব্যাংক, ওটা পিএনএ নিয়ন্ত্রণ করে, দ্বিতীয় ভাগ গাজা, যেটা নিয়ন্ত্রণ করে হা/ মাস।
এই হলো যুদ্ধ ও উৎস। একপক্ষ, ইসরায়েল- যারা বহু বৎসর ধরে অত্যাচার সহ্য করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকে নিজেদের এমন এক ক্ষমতাধর জায়গায় নিয়ে গেছে, যাদের বিরুদ্ধে টু শব্দ করতেও অন্যান্য রাষ্ট্র ভয় পায়। আরেকপক্ষ, হা/ মাস- যাদের প্রধান লক্ষ্য ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি হতে ধুলিস্মাৎ করা। আর তার জন্য যদি হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারা যায়, আফসোস নেই। তৃতীয়পক্ষ, পিএনএ- যারা চায় একটা সমঝোতা।
তিনপক্ষের বাইরে আরেকটা পক্ষ আছে। যাদের ইতিহাস চিনবে সংখ্যা দিয়ে। কোল্যাটেরল ড্যামেজ। এই পক্ষ কোনোদিন যুদ্ধ চায়নি, ভাগ-বাটোয়ারা চায়নি, রক্ত চায়নি, পূন্য চায়নি, স্বর্গ চায়নি। ওদের মৃত্যু হয়েছে হঠাৎ, বোমার আঘাতে, রাইফেলের গর্জনে কিংবা আশ্চর্য ঘুমের ভেতর।
নয় মাসে প্রায় ত্রিশ লক্ষ শহীদের লাশের স্তুপে দাঁড়িয়ে, একগলা রক্তের সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া একটা জাতি কীভাবে হা/ মাসের ছোঁড়া বিষ্ফোরক আর ইসরায়েলের ছোঁড়া বিষ্ফোরকে মরে যাওয়া মৃতদের হিসাব কষে আনন্দ-উল্লাস করতে পারে- মাথায় ধরে না আমার। হিরোশিমা আর নাগাসাকি জাপানকে দিয়েছিল এমন ক্ষত, আজ অবধি ওটা সারাতে পারেনি ওরা। কোথাও যুদ্ধ হলে এখনও আঁতকে ওঠে। আর আমাদের এত বড়ো একটা ক্ষত কিভাবে সেরে গেল কে জানে। কোন আজগুবি ঔষধে সারালাম ওই ক্ষত? আমাদের তো প্রার্থনা করা উচিত ছিল, এমন হাল যেন আমাদের শত্রুরও না হয়। প্রার্থনা করা উচিত ছিল, মেঘদলের ওই গানটার মতোন। সুখী হোক সব ফুল, সব পায়ের নুপুর। সুখী হোক সব।
© Shakhawat Hossen ভাইয়ের পোস্ট থেকে অনুমতি ছাড়া কপি পেস্ট।