
01/05/2025
ময়মনসিংহের আজ জন্মদিন 💚
এটি অবিভক্ত ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ জেলা এবং বঙ্গদেশের প্রথম এবং উপমহাদেশের দ্বিতীয় পৌরসভা ✌️
ময়মনসিংহ জেলার ভৌগোলিক পরিবেশ বিচিত্র হওয়ায় বলা হয়-‘হাওর, জঙ্গল, মইষের শিং-এ নিয়ে ময়মনসিং।৪,৭৮৭ বর্গমাইলের রত্নগর্ভা এ জেলার প্রাণবন্ত মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় এর নামের মাঝেই- My-men-sing অর্থাৎ আমার লোকেরা গান গায়।
ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক জনপদ ময়মনসিংহ। এক সময়কার উপমহাদেশের বৃহত্তর এ জেলাটি আজ বিভাগে রূপান্তরিত হয়েছে।শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সূতিকাগার বৃহত্তর ময়মনসিংহ। উত্তরে গারো পাহাড় ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে গাজীপুর জেলা, পূর্বে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলা বেষ্টিত ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে রাজস্ব আদায়, প্রশাসনিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে স্থানীয় বিদ্রোহ দমনের জন্য ১৭৮৭ সালের পহেলা মে ময়মনসিংহকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করে বৃটিশ সরকার।
ময়মনসিংহ জেলার নামকরণের ইতিহাস রয়েছে। মোঘল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন, তার নামেই মধ্যযুগে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি।
নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন হয়ে ময়মনসিংহ হয় একটি ভুলের কারণে। বিশ টিন কেরোসিন বুক করা হয়েছিল বর্জনলাল এন্ড কোম্পানির পক্ষ থেকে নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এই মাল চলে যায় রাজপুতনার নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এ নিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পরবর্তীতে আরো কিছু বিভ্রান্তি ঘটায় রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ময়মনসিংহ রাখা হয়। সেই থেকে নাসিরাবাদের পরিবর্তে ময়মনসিংহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
১ মে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা গঠিত হয় যার প্রথম কালেক্টর ছিলেন মিঃ এফ লি গ্রোস। এর আগে খাগডহর ইউনিয়নের বেগুনবাড়ীর কোম্পানির কুঠিসহ বিভিন্ন জায়গায় কাচারী বসত। কুঠি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হলে শহরের উত্তর অংশে খাগডহরে কাচারী স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনের কারণে সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরের দক্ষিণে কাওনা নদীর তীরে ‘দগদগা’ নামক প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্রে জেলা শহর স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঐ অঞ্চলের জমিদাররা এই সিন্ধান্তের বিরোধিতা করে। কর্তৃপক্ষ তাই ১৭৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেহড়া মৌজায় নাসিরাবাদ নাম দিয়ে জেলা শহরের পত্তন হয় । শহর স্থাপিত হওয়ার পর ৮ই এপ্রিল ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পৌরসভা গঠিত হয় নাসিরবাদ মিউনিসিপ্যালিটি। বঙ্গদেশে এটি প্রথম এবং উপমহাদেশে এটি ছিল দ্বিতীয় পৌরসভা। মি. আরপর্চা ছিলেন পৌরসভার প্রথম অফিসিয়াল চেয়ারম্যান। প্রথম নন অফিশিয়াল চেয়ারম্যান ছিলেন চন্দ্রকান্ত ঘোষ।কালেক্টরেট ভবন ছিল ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রবিন্দু। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারী ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। প্রথম সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করা হয় ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রথম মুদ্রিত পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ইংরেজি স্কুল। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। জেলার প্রথম আদম শুমারী পরিচালিত হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। টেলিগ্রাফ অফিস স্থাপন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। । ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ চালু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে, এবং ময়মনসিংহ-জগন্নাথগঞ্জ রেলপথ চালু হয় ১৮৬৫ সনে। ১৯০৫ সালে নাসিরবাদ নাম বদলে ময়মনসিংহ পৌরসভা নামকরণ হয়। ১৯১০ সালে পৌরসভার একতলা পাকা ভবন নির্মাণ হয় যেটি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।[
১৯৭১-এর ২৫ মার্চে ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরুর অব্যবহিত পরে ময়মনসিংহের সংগ্রামী জনতা খাগডহর তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প ঘেরাও করে এবং বাঙ্গালী ইপিআর সদস্যদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এ যুদ্ধে ইপিআর সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের ড্রাইভার পুত্র আবু তাহের মুকুল শাহাদাৎ বরণ করেন। মূলতঃ এই যুদ্ধের পর পরই ময়মনসিংহের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত সীমান্ত ফাঁড়িগুলি বাঙ্গালী বিডিআর-দের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। নিহত পাক সেনাদের লাশ নিয়ে ময়মনসিংহবাসী বিজয় মিছিল করতে থাকে ও ধৃত অন্যান্য পাকসেনাদের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ময়মনসিংহ জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এক সকালে পুরাতন বিডিআর ভবনের ৩য় তলার শীর্ষে হাজার হাজার লোকের জয় বাংলা ধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশের নকশা খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।
ময়মনসিংহ জেলা ভেঙ্গে পরবর্তীতে ১৮৪৫ সালে জামালপুর, ১৮৬০ সালে কিশোরগঞ্জ, ১৮৬৯ সালে টাঙ্গাইল ও ১৮৮২ সালে নেত্রকোনা মহকুমা গঠন করা হয়। পরে সবকটি মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়েছে। ১৮৮৬ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ ও ১৮৮৭ সালে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। এই ভাবে ময়মনসিংহ জেলা যা কিনা ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ জেলা ছিল তার আকার ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসে।
বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে গাজীপুর জেলা, পূর্বে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলা অবস্থিত।
সব মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করলেও এই অঞ্চল এখনো বৃহত্তর ময়মনসিংহ নামে পরিচিত। ২০১৫ সালে ঢাকা বিভাগ ভেঙ্গে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা নিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগ গঠিত হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের অংশ হলেও কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলা ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
প্রাচীন এ জনপদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য গৌরিপুরের রাজবাড়ি, মুক্তাগাছার রাজবাড়ী, ময়মনসিংহ শহরের শশীলজ, রাজ রাজেস্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস, আঠারোবাড়ী জমিদার বাড়ি তারই প্রমাণ এখনো বহন করছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুথান, ৯০-দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সহ বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রেই ময়মনসিংহ ছিল অগ্রগণ্য তালিকায়।
ময়মনসিংহে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়), দুটি মেডিকেল কলেজ (ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ ), একটি প্রকৌশল কলেজ (ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ), একটি ক্যাডেট কলেজ (ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ), একটি শারীরিক শিক্ষা কলেজ(ময়মনসিংহ সরকারী শারীরিক শিক্ষা কলেজ ) এবং বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আনন্দমোহন কলেজ ছাড়াও আরো অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক মনীষী, রাজনৈতিক, বিখ্যাত সাহিত্যিক। যারা দেশের ভাণ্ডারকে করে গেছেন।
শুভ জন্মদিন প্রাণের শহর ময়মনসিংহ 💚