15/09/2025
আসুন তেলাপিয়ার স্ট্রেপটোকক্কাস নিয়ে একটু ভালভাবে জানতে চেষ্টা করিঃ
তেলাপিয়ার অনেক ধরনের রুগের মধ্যে স্ট্রেপটোকক্কোসিস হচ্ছে সবচেয়ে বিদ্ধংসী ধরনের রোগ এবং এই রোগের কারনে সবচেয়ে বেশি মারা যায় বড় সাইজের(৫০-৩০০ গ্রাম) তেলাপিয়া এবং খামারিরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
☯️রোগ হওয়ার কারনঃ
চাষকৃত তেলাপিয়াতে স্ট্রেপটোকক্কাস এর প্রধান কারন Streptococcus agalactiae ব্যাকটেরিয়া, এর আরেকটা প্রজাতি হচ্ছে streptococcus iniae যা তুলনামূলক কম মৃতুহার ঘটায়।
☯️খালি চোখে/বাহ্যিক লক্ষন দেখে এ রোগ চেনার উপায়ঃ
১. স্নায়ুতন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারনে মাছগুলো ঘূর্ণয়মান আচরন করে, মাছের দেহ বাঁকা হয়ে যায় এবং মাছের মধ্যে অলসতার ভাব চলে আসে।
২. অসুস্থ মাছের চোখের মধ্যে ক্ষত দেখা যায় বা মাছের চোখ ভিতরের দিকে বা বাহিরের দিকে বের হয়ে আসার লক্ষন প্রকাশ পায়।
৩. তেলাপিয়ার মাছের শরিরে বা পাখনার গোড়ায় বা মলদ্বার/যৌনাঙ্গ এর মশার কামরের ন্যায় ছোট ছোট লাল দাগ বা রক্তক্ষরণ দেখা যায়।
৪. স্ট্রেপটোকক্কাস আক্রান্ত মাছের নিচের চোয়ালের দিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁড়া দেখা যায় এবং এ ফোঁড়াগুলো দ্রুত ফেটে রক্তক্ষরণজনিত আলসারে পরিনত হয় এবং যা সাধারণত ভাল হয় না। এ ধরনের কিছু ফোঁড়া মাছের লেজের গোড়ার দিকেও পাওয়া যায় যা রোগ ভাল হলেও কিছু কিছু থেকে যায়।
৫. তীব্র পাদুর্ভাবের সময় পেটে এক ধরনের তরল পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং চাপ দিলে মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসে।
☯️মাছের দেহের ভিতরকার লক্ষন দেখে এ রোগ চেনার উপায়ঃ
১.সাধারণত অসুস্থ মাছের পেটে বা অন্ত্রে কোন খাবার পরিলক্ষিত হয় না, রোগের শুরুর দিকে মাছ কিছু ফিড অন্ত্রে পাওয়া যায়। মাছের গল ব্লাডার/পিত্ত থলি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় দেখা যায় এবং এ কারনে মাছের হজম বা পাকস্থলীতে খাদ্য বিপাকে সমস্যা দেখা দেয়।
২. তীব্র সংক্রমণের সময় ব্যাকটেরিয়া দ্রুত রক্তের অভ্যন্তরীণ সিস্টেমে পৌঁছে যায় এবং সমস্থ অভ্যন্তরীণ অঙ্গে(লিভার,প্লীহা,কিডনি, হৃদপিন্ড,মস্তিষ্ক, চোখ এবং পাকস্থলী নালী) ছড়িয়ে পরে। পিত্ত থলি, প্লীহা এবং কিডনি স্বাভাবিক এর চেয়ে অনেক বড় হয়ে যায়।
৩. মাছেত অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলি একত্রে পেরিটোনিয়াল গহব্বরের দেয়ালের সাথে আঠালোভাব লেগে যায় এবং ফাইব্রিনাস উপাদানের উপস্থিতি দেখা যায়।
**** সংক্রমণের তীব্রতার সাথে অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া যেমন Aeromas spp. এর সাথে একত্রিত হয়ে দ্বৈত আক্রমণ ঘটায়।
☯️স্ট্রেপটোকক্কাস কিভাবে বিস্তার লাভ করে বা কেন এ রোগ হয়ে থাকেঃ
তেলাপিয়া চাষের জন্য আদর্শ পি এইচ হচ্ছে ৬-৯ পিপিএম(Popma & Masser, 1999), অক্সিজেনের মাত্রা ৫ পিপিএম(Swann,1992;El-Sayed, 2006), এমোনিয়ার মাত্রা ২ মি.গ্রাম/লিটার এবং আদর্শ তাপমাত্রা হচ্ছে ২৯-৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস(Popma & Masser, 1999)। যখম এ মাত্রাগুলো চাষের পুকুরে ঠিক থাকে না তখন স্ট্রেপটোকক্কাস বিস্তার লাভ করে।
অধিক ঘনত্বে তেলাপিয়া চাষ এ রোগের অন্যতম কারন এর সাথে মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি, এমোনিয়া গ্যাসের আধিক্যতা। স্ট্রেপটোকক্কাস মুলত মাছ থেকে মাছে এবং পরিবেশ থেকে মাছে ছড়ায়। সাধারণ স্ট্রেপটোকক্কাস সব ধরনের মাছেই হতে পারে তবে বড় আকারের মাছ(১৫০গ্রাম থেকে বিক্রি উপযোগী) এ রোগের জন্য সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল । অতিরিক্ত তাপমাত্রায় সময় এ রোগ তীব্রতর আকার ধারন করে এবং আর মৃত্যহার সাধারণত ২-৩ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। যখন পানির তাপমাত্রা কম থাকে তখন এর তীব্রতাও কমে আসে।
☯️রোগ নির্ণয়ের প্রক্রিয়াঃ
খামারে রোগ নির্ণয়ঃ
৫-১০ টি মাছে পর্যবেক্ষণ করে উপরে বর্নিত লক্ষণগুলোর সাথে মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে আমরা স্ট্রেপটোকক্কাস নির্ণয় করতে পারি। এখানে উল্লেখ্য যে একটি মাছে সকল ধরনের বাহ্যিক লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে।
☯️গবেষণাগারে রোগ নির্ণয়ঃ
মাছ মৃত্যুর জন্য কোন প্রজাতির Streptococcus spp. দায়ী তা জানার জন্য ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়াল আইসোলেশন টেস্ট করে ফলাফল জানা যায়।
👉এ রোগ প্রতিরোধের জন্য আমরা নিন্মলিখিত বিষয়গুলোতে মনোযোগী হতে পারিঃ
স্ট্রেপটোকক্কাস মুক্ত মা মাছ থেকে পোনা সংগ্রহ করা এবং চাষের পুকুর স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া মুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
প্রবাধে আছে “Prevention is better than cure-প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম”।
চাষের পুকুরের মাটি ও পানিতে যদি কার্যকরী স্ট্রেপটোকক্কাস এর জীবানু উপস্থিত থাকে তবে তা প্রতিরোধ বা ধমন করা খুব একটা সহজ নয়।
এপ্রিল-জুন/জুলাই তেলাপিয়া চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে বিবেচিত হয় আবার এ সময় উচ্চ তাপমাত্রা এবং অতিরিক্ত মজুদ ঘনত্বে(১৫০-৩০০ গ্রামের মাছে) এ রুগের বিস্তার সবচেয়ে বেশি ঘটে, এমতাবস্থায় অতিরিক্ত মজুদ ঘনত্বে পরিহার করা, অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানো বন্ধ রাখা এবং পানির সকল গুনাগুন ঠিক রাখার দিকে নজর বাড়ানো।
যে সকল পুকুরের মাছ বিক্রি উপযোগী সেই মাছগুলো ক্রমান্বয়ে বিক্রি এবং একই সাথে পানির তাপমাত্রা কমানোর জন্য এরেটর(প্যাডেল হুইল) এবং নতুন পানির যোজন- বিয়োজন করা খুবই জরুরী বিষয় বলে বিবেচিত।
নিয়মিত স্যানিটাইজেশন করে প্যাথোজেনগুলির সংক্রামন কমানোর জন্য পর্যায়ক্রমে উৎপাদনের প্রতিটি ইউনিট এবং সরঞ্জাম পরিষ্কার এবং জীবানুমুক্ত করে স্ট্রেপটোকক্কাস এর ঝুঁকি কমানো।
*****পানির প্যারামিটার ঠিকঠাক রাখা-খাদ্য খাওয়ানোর পরিমান কমিয়ে রাখা-এবং অধিক মজুদ ঘনত্ব পরিহার করে স্ট্রেপটোকক্কাস এর ঝুঁকি কমানো।
☯️চিকিৎসাঃ
যেহেতু ব্যাকটেরিয়া গুলো পানিতেও উপস্থিত থাকে এবং খাবারের সাথে মিশে মাছের দেহে আরো দ্রুত প্রবেশ করতে পারে তাই এমতাবস্থায় আংশিক খাবার দেওয়া বা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ রেখে মৃত্যুহার কমানোতে সাহায্য পাওয়া যায়।
তেলাপিয়া একটি উচ্চ ফলনশীল মাছ এবং এর বেঁচে থাকার হারও অন্যান্য মাছের তুলনায় তুলনামূলক বেশি তাই চাষিরা চাষকৃত পুকুরে অধিক ঘনত্বে চাষ করে থাকে, যখন মৃত্যুহারের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় তখন মজুদ ঘনত্ব কমিয়ে দিলে স্ট্রেস(চাপ) লেভেল ও প্যাথোজেন লোড উভয়ই কমতে সাহায্য পায়।
তাপমাত্রা বেশি থাকার কারনে মাছের খাদ্য হজম ক্রিয়াই অতিরিক্ত অক্সিজেন এবং শক্তির খরচ হয় এমতাবস্থায় পানির যোজন-বিয়োজন করা এবং এরেটর চালিয়ে অক্সিজেন এর মাত্রা ঠিক রাখার চেষ্টা করা জরুরি (এক্ষেত্রে প্যাডেল হুইল এরেটর কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারে)।
☯️এন্টিবায়োটিক ব্যবহারঃ
এন্টিবায়োটিক(ব্রোডস্পেকট্রাম) সাধারণত রোগের শুরুতে বা প্রাথমিক অবস্থায় খুব ভাল কাজ করে সেক্ষেত্রে যদি লক্ষন প্রকাশ পাওয়ার সাথে-সাথেই চিকিৎসায় যাওয়া যায় তাহলে কিছুটা উপকার পাওয়া যায় কিন্তু রোগ ব্যাপক আকার ধারন করলে ওরাল এন্টিবায়োটিক গুলা অকার্যকর হয়ে পরে কারন এ সময় মাছের খাবারের তেমন চাহিদা থাকে না বা ক্ষুধামন্দা ভাব চলে আসে।
বিভিন্ন খামারে এন্টিবায়োটিকগুলো প্রয়োগ করে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র প্রয়োগের সময় মৃতুহার নিয়ন্ত্রণ(আংশিকভাবে) করতে সক্ষম হয় কিন্তু কোর্স শেষ হয়ে গেলে মৃত্যুহার আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
*** ইরিথ্রোমাইসিন, সালফাডায়াজিন এবং ট্রাইমিথোপ্রিম এর কম্বিনেশন এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল বলে বিবেচিত হয়। লিভার এবং পাকস্থলী মারাত্মক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিধায় ভাল মানের লিভারটনিক এবং গাট প্রোবায়োটিক ব্যবহার করাও জরুরী।
*** এমোক্সিসিলিন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক দীর্ঘ স্থায়ী সমাধানের জন্য কার্যকরী বলে বিবেচিত হয়
⚠️ এন্টিবায়োটিক এর উইথড্রল পিরিয়ড শেষ করে মাছ বাজারজাত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
👉 বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণতায় মজুদ ঘনত্বের নিয়ন্ত্রণ,পানির পর্যাপ্ততা এবং পানির প্যারামিটার ঠিকঠাক না রাখতে পারলে যতকিছুই করেন তেলাপিয়ার স্ট্রেপটোকক্কাস নিয়ন্ত্রনে সফল হতে পারবেন না।
নোটঃ লেখাটি আমার খামারি সেবা দেওয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন জার্নাল এবং ইন্টারনেট থেকে থেকে সংগ্রহ করে সহজভাবে বোজানোর জন্য লেখে হয়েছে।
ধন্যবাদান্তে,
মৎস্যবিদ মাসুম বিল্লাহ (তমাল)
মৎস্য চাষ বিষয়ক পরামর্শক।