25/05/2025
ভ্যানঘাটের রাত
রাত ২টা ১০ বাজে। ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই চোখে। বিছানায় পড়ে আছি অথচ মনে হচ্ছে আমি শরীর ছেড়ে অন্য কোথাও ভেসে যাচ্ছি। মাথার ভিতরে অচেনা সব ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
যেন অজানা কেউ আমার মগজের ভিতর ফিসফিস করছে, কিছু বলছে... আবার থেমে যাচ্ছে। নিজেকে অস্থির লাগছে। ঘরে অক্সিজেন কম বলে মনে হচ্ছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পেটে ক্ষুধা বোধ হচ্ছে অথচ খাবারের কথা মনে হলেই গা গুলিয়ে উঠে।
ছটফট করছি বিছানায়, কোনোভাবেই স্থির থাকতে পারছি না।
হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম, অদ্ভুত রকমের হালকা লাগছে শরীরটা, যেন ভেতরটা ফাঁকা। টিশার্টটা গায়ে পরে মোবাইলটা হাতে নিলাম। কোনোকিছু না ভেবেই বেরিয়ে পড়লাম।
গেটে এসে থমকে গেলাম, সেখানে কেউ নেই। সাধারণত একজন পাহারাদার থাকেই কিন্তু আজ যেন সময় থেমে গেছে। বাতাস নেই, কুকুরের ঘেউ-ঘেউ নেই, এমনকি নিজের পায়ের শব্দটাও যেন শোষে নিচ্ছে অন্ধকার।
ঠিক তখনই ছায়ার মতো ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো একটা পুরনো ভ্যানগাড়ি। শব্দহীন। ভ্যানে কোনো হেডলাইট নেই। চালকের মুখে রহস্যময় হাসি, কুচকুচে কালো চামড়া যেন মাটির মতো শুকনো, চোখ জ্বলছে মরা আগুনের মতো।
আমি হাত উঁচু করা মাত্রই চালক জিজ্ঞেস করলেন — মামা যাবেন? (গলা যেন শোনা গেল বুকের ভেতর থেকে)
আমি কিছু বললাম না, শুধু মাথা নাড়লাম। ভ্যানে উঠে পা ঝুলিয়ে বসলাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি—তা যেন প্রশ্ন করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি।
কিছুক্ষণ পর শরীরটা কেমন জানি অবশ লাগতে শুরু করলো। আমি ধীরে ধীরে ভ্যানের মধ্যে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আকাশের দিকে তাকালাম—তারা নেই, চাঁদ নেই, শুধু গাঢ় নীল অন্ধকার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে পৃথিবীর উপর।
ঘুমিয়ে পড়লাম...
ঘুম ভাঙলো হঠাৎ এক অদ্ভুত গন্ধে। উঠে দেখি, ভ্যানটা থেমে আছে একটা ভাঙাচোরা পুরাতন বাড়ির উঠোনে। বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে বহু বছর ধরে কেউ এর ধারে কাছেও আসেনি। আশপাশে কুয়াশা, ঠান্ডা বাতাস, আর নিঃস্তব্ধতা। কোনো শব্দ নেই, তবু মনে হচ্ছে কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে আমার ঘাড়ের কাছেই।
মোবাইল বের করলাম। ফ্ল্যাশ অন করার চেষ্টা করলাম, অন করতে পারলাম না। চার্জ মাত্র ১৩%। লোকেশন চালু করতে গেলাম কিন্তু নেটওয়ার্ক নেই। সময় দেখলাম, ৩টা ৩৭ বাজে। বুক ধকধক করছে।
হঠাৎ কাশি দিয়ে ভ্যানচালক এসে হাজির হল। এই প্রথম মনে হলো সে যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়েছে। কোনো আলো ছাড়াই দিব্যি হাঁটছে লোকটা। তার গলার স্বরে এবার গা আরো শিউরে উঠলো। ঠোঁটের কোণে একটা বিকট বাঁকা হাসি। আমাকে জিজ্ঞেস করলো — মামা ভয় পেয়েছেন?
আমি — না মামা, ভয় পাইনি। কিন্তু কণ্ঠটা আমার নিজের বলে মনে হলো না।
সে হাসতে হাসতে বলল — ভয় পাওয়ার কিছু নেই মামা। এই জায়গাটাই এরকম, অন্ধকার অন্ধকার লাগে সবসময়।
আমি — আমরা এখানে কেন এসেছি?
সে আরেকটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো — আমার হাগু চেপেছিল মামা, খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত মাঠে হাগু করার যে শান্তি মামা! তাই এখানে চলে আসলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম — আমরা কোথায় এখন?
সে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল — এটা গোয়ালনগর মাঝিপাড়া শ্মশানঘাট। ভোরের আগে এখান থেকে কেউ ফিরতে পারে না, মামা।
চারপাশ ঘূর্ণায়মান হতে লাগল। দূর থেকে কারা যেন হেসে উঠল, আবার কেঁদে উঠল শিশুর মতো। বাতাসে পচা ধূপের গন্ধ। আমি দৌড়াতে চাইলাম, কিন্তু পা যেন মাটিতে আটকে গেছে।
ভ্যানচালক এগিয়ে এল আমার দিকে। তার মুখটা এখন আর মানুষের মতো নেই—চোখ নেই, চামড়া কুঁচকে গেছে, আর মুখের ভেতর শুধু অন্ধকার... যেন গহ্বর। তার গলা থেকে ভেসে এলো এক ফিসফিসে স্বর— যারা ঘুম ভেঙে রাতের ডাকে সাড়া দেয়, তাদের জন্যই আমরা অপেক্ষা করি মামা...
তারপর কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বিছানায়।
ডাক্তার বললেন — আমি অজ্ঞান অবস্থায় একটা জঙ্গলাকীর্ণ শ্মশানের সামনে পড়ে ছিলাম। কিছু লোক আমাকে খুঁজে পেয়েছে। তারা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে আবার চলে গেছে।
এই ঘটনার অনেক বছর হয়ে গেল। এখনো মাঝেমধ্যে রাতে ঘুম ভেঙে দেখি, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ কাশছে।
আর তখন আমার কানে আবার বাজে সেই ভয়ানক স্বর— মামা, যাবেন?
২৪/০৫/২৫
০১.৪৭ এএম
(Picture from AI)