05/04/2022
রোজা ও চিকিৎসা: জেনে রাখা ভালো
হাফেয মাওলানা ডাক্তার আব্দুল বারী
অনেক ডাক্তারের ওয়ালে রোজার মাসআলা সম্পর্কিত নিম্ন লিখিত পোস্ট টি দেখে দুয়েকটি কথা বলা দরকার মনে করলাম। আমার এই লেখাটি বিশেষ ভাবে আমার ডাক্তার ভাইদের জন্য।
আসুন, আমরা দেখে নিই সূরা বাকারায় রোজার নির্দেশ সম্পর্কিত ১৮৩ ও১৮৪ নাম্বার আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কি বলেছেন?
"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।
গণনা করে কয়েকটি দিনের জন্য। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার জন্য অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর রোজা রাখা যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে।
যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণ কর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার।" ..সূরা বাকারাহ, আয়াত, ১৮৩-১৮৪।
উক্ত আয়াতে রোজা রাখার নির্দেশের বাইরে তিন ক্যাটাগরির মানুষের কথা বলা হয়েছেঃ
১। অসুস্থ
২। সফর বা ভ্রমণঃ (৪৮ মাইলের বেশি দূরত্ব।)
এই দুই প্রকারের মানুষ জন্য পরে রোজা কাজা করে নেবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
৩। বার্ধক্য বা অন্য কোনো কারণে শরীর এতো দুর্বল যে, রোজা রাখা তাদের জন্য কষ্টকর এবং পরবর্তীতেও রোজা রাখার মত শারীরিক অবস্থা হবে না, তারা ফকির মিসকিন খাইয়ে দিবেন।
অসুস্থতার বিষয়ে সব চেয়ে ভাল বুঝবেন চিকিৎসকগন।
সাধারণভাবে অসুস্থতার মাত্রা ৩ প্রকারঃ
১। মাইল্ড বা মৃদু
২। মডারেট বা মধ্যম
৩। সিভিয়ার বা তীব্র
সিভিয়ার বা তীব্র যে কোনো রোগের ক্ষেত্রে রোজা না রাখার জন্য অনুমতি দেয়া আছে।
সাধারণভাবে মাইল্ড থেকে মডারেট রোগ নিয়ে রোজা রাখা যেতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারগণ রোজা রাখার পরামর্শও দিয়ে থাকেন।
তবে মেডিকেল ইমার্জেন্সি রোগে রোজা রাখতে গেলে তা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে রোজা না রেখে পরে কাজা করে নেয়ার অনুমতি আছে।
মেডিকেল ইমার্জেন্সি রোগগুলো সাধারণত সিভিয়ার হয়ে থাকে।
যে কোনো মেডিকেল প্রসেডিওর ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন তৈরি করতে পারে।
যে অ্যানজাইনাল পেইনে নাইট্রেট ব্যবহার করতে হয় বা যে অ্যাজমায় ইনহেলার প্রয়োজন পরে, তা সিভিয়ার ডিজিজের মধ্যে পরে।
নিচের মাসআলাগুলোর কোনটি ব্যক্তি পর্যায়ে প্রযোজ্য হলেও সব তথ্য সঠিক নয় ও জেনারেলি প্রযোজ্য নয় বলে মনে হয়। আল্লাহু আ'লাম।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমাদের সঠিক বিষয় বোঝার তৌফিক দিন।
"রোজায় চিকিৎসা:
১. রোজা অবস্থায় ইনহেলার, নাকের স্প্রে ব্যবহার করা যাবে।
২. রোজা অবস্থায় চোখ, ও কানের ড্রপ ব্যবহার করা যাবে।
৩. হার্টের এনজাইনার সমস্যার জন্যে বুকে ব্যথা উঠলে ব্যবহৃত নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট বা স্প্রে জিহবার নিচে ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হবে না।
৪. রোজা রেখে শিরাপথে খাদ্য-উপাদান ছাড়া কোনো ওষুধ ত্বক, মাংসপেশি বা হাড়ের জোড়ায় ইনজেকশান হিসেবে প্রয়োগ করলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
৫. রোজা রাখা অবস্থায় স্যালাইন বা গ্লুকোজ জাতীয় কোনো তরল শিরাপথে গ্রহণ করা যাবে না।
৬. চিকিৎসার প্রয়োজনে রোজা রেখে অক্সিজেন কিংবা চেতনা নাশক গ্যাস গ্রহণে রোজা নষ্ট হবে না।
৭. চিকিৎসার প্রয়োজনে ক্রিম, অয়েনমেণ্ট, ব্যাণ্ডেজ, প্লাস্টার ইত্যাদি ব্যবহার করলে এবং এসব উপাদান ত্বকের গভীরে প্রবেশ করলেও রোজার কোনো সমস্যা হবে না।
৮. রোজা রেখে দাঁত তোলা যাবে। দাঁতের ফিলিং করা যাবে এবং ড্রিল ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া দাঁত পরিষ্কার করার সময় অসাবধানতাবশত কিছু গিলে ফেললে রোজা নষ্ট হবে না।
৯. রোজা রেখে রক্ত পরীক্ষার জন্যে রক্ত দিতে বাধা নেই।
১০. কাউকে রক্তদানে এবং রক্তগ্রহণেও বাধা নেই।
১১. চিকিৎসার জন্যে যোনিপথে ট্যাবলেট কিংবা পায়ুপথে সাপোজিটোরি ব্যবহার করলে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।
১২. পরীক্ষার জন্যে যোনিপথ কিংবা পায়ুপথে চিকিৎসক বা ধাত্রী আঙুল প্রবেশ করালেও রোজার সমস্যা হবে না।
১৩. রোজা রেখে জরায়ু পরীক্ষার জন্যে হিস্টেরোস্কপি এবং আই.ইউ.সি.ডি ব্যবহার করা যাবে।
১৪. হার্ট কিংবা অন্য কোনো অঙ্গের এনজিওগ্রাফি করার জন্যে কোনো রোগ নির্ণয়কারক দ্রবণ শরীরে প্রবেশ করানো হলে রোজার ক্ষতি হবে না।
১৫. কোনো অঙ্গের আভ্যন্তরীণ চিত্রধারণের জন্যে সেই অঙ্গের প্রবেশপথে কোনো ক্যাথেটার বা নালীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তরল রঞ্জক প্রবেশ করালে রোজা নষ্ট হবে না।
১৬. রোগ নির্ণয়ের জন্যে এণ্ডোস্কোপি বা গ্যাস্ট্রোস্কোপি করলেও রোজা নষ্ট হয় না। তবে এণ্ডোস্কোপি বা গ্যাস্ট্রোস্কোপি করার সময় ভেতরে তরল কিংবা অন্য কোনো কিছু প্রবেশ করানো যাবে না যার খাদ্যগুণ রয়েছে।
১৭. রোজা রাখা অবস্থায় না গিলে মাউথওয়াশ, মুখের স্প্রে ব্যবহার করা যাবে এবং গড়গড়া করা যাবে।
১৮. রোজা রাখা অবস্থায় লিভারসহ অন্য কোনো অঙ্গের বায়োপসি করা যাবে।
১৯. রোজা রাখা অবস্থায় পেরিটোনিয়াল কিংবা মেশিনে কিডনি ডায়ালাইসিস করা যাবে।
রোজা রাখা অবস্থায় চিকিৎসা সংক্রান্ত কী কী করা যাবে আবার কী কী করা যাবে না তা নিয়ে যেমন সাধারণ রোগীদের মধ্যে জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব রয়েছে, তেমনি নানা সংশয় ও বিভ্রান্তি রয়েছে চিকিৎসকদের মাঝেও। এ সমস্ত বিভ্রান্তি দূর করার জন্যে ১৯৯৭ সালের জুন মাসে মরক্কোতে অনুষ্ঠিত নবম ফিক্বহ-চিকিৎসা সম্মেলন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ সম্মেলনে জেদ্দা ইসলামিক ফিকহ একাডেমি, আল আজহার ইউনিভার্সিটি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আলেকজান্দ্রিয়া, মিশর এবং ইসলামিক শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (আইএসইএসসিও) প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞ প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনের মূল আলোচনার বিষয় ছিল--রোজা অবস্থায় যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধ প্রয়োগে রোজা নষ্ট হবে না সে বিষয়ে একটা সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। এ লক্ষ্যে ইসলামিক চিন্তাবিদগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা ও গবেষণা করে রোজা অবস্থায় ওষুধ প্রয়োগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে সুচিন্তিত তথ্য উপস্থাপন করেন যা ২০০৪ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজে) বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়।
(তবে নাকের ড্রপের ব্যাপারে অনেক স্কলার আপত্তি করেন। অনেকসময় এসব ফিক্বহী বিষয়ে বিভিন্ন স্কলারদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে। সব স্কলারের মতামতের প্রতিই আমাদের শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন।)