
26/07/2025
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ২৯
নিধিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে পাঁচ দিন হলো। মেয়েটা একেবারে ঘরকোনো হয়ে আছে। কারো সাথে তেমন কোনো কথাই তার বলা হয় না। একেবারে চুপচাপ থাকে। খাবার বেলায় সোহানা বা নিপা কে জোর করে খাওয়াতে হয়। মির্জা বাড়ির লোকেরা অনেকটাই চুপসে রয়েছে। অন্যদিকে নাভানেরও একই হাল। দিনরাত আল্লাহর কাছে দোয়া চায় নিজের কৃতকর্মের জন্য। তবু সোহানা নাভানকে নিয়ে অতোটাও চিন্তিত নয়। সে এডাল্ট, নিজেকে সামলাতে শিখে নেবে নিশ্চয়ই। নিধি ঘরের সাথে লাগোয়া বেলকনিতে বসেছিলো। শিউলি ফুলের গাছের দিকে নজর তার। ফুল নেই তবুও এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলো। আজকাল নিজের শরীর টাকেও তার প্রচুর ঘিন্না লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় শরীরটা কে কেটেকুটে ছিড়ে ফেলতে। এক বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি। রুম থেকে অনবরত ফোনের আওয়াজ ভেসে আসছে। কিন্তু ফোনটা রিসিভ করতে মনে চায়না নিধির। আনুমানিক পনেরো টা কল তো হবেই। বিরক্ত হয়ে নিধি গিয়ে এবার ফোনটা রিসিভ করে।
-'' বলুন, এতোবার কল কেনো দিচ্ছেন? "
কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠেই প্রশ্ন করে নিধি। ফোনের ওপাশ থেকে ফাহাদ তেমন কোনো রিয়াকশন দেখায় না। শুধু শান্ত গলায় বলে ওঠে,
-" কখন থেকে ফোন করছি নিধি। দরকারী ফোনও তো হতে পারে? "
নিধি কোনো উত্তর দেয় না চুপ করে রইল। ফাহাদ ফোনের ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব'লে,
-" দরজা টা খুলো। "
-" মানে? "
-" আমি সেই কখন তোমাদের বাড়িতে এসেছি। নিপা আন্টি তোমাকে দরজা খোলার জন্য এতোবার করে ডাকছে। কিন্তু তুমি? ট্রাস্ট মি, এখন দরজা না খুললে ভেঙে ফেলবো আমি। "
নিধি ফোন রেখে দরজা টা খুলে ককন থেকেই নিপা ডাকছিলো। দরজা খুলতেই ফাহাদ কে দেখে নিধি। শান্ত অবিচল মুখ। নিধি সড়ে গিয়ে কাউচে পা উঠিয়ে বসে থাকে। ফাহাদ ধীর পায়ে হেটে নিধির পাশে বসে।
-" নিধি সেদিনের বিষয়ে কথা ব... "
-" ওইদিনের বিষয়ে কিছু বলবেন না। আমার ভালো লাগে না জবাব দিতে। "
ফাহাদের মুখের কথা থাকতেই নিধি কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়। ফাহাদ হতাশ হয়ে নিধির দিকে তাকায়। বড়ো মুশকিলে পড়া গেছে যেনো। নিধি কিছু না বললে বুঝবে কিভাবে? এদিকে নাভানেরও কোনো হদিস নেই। ফাহাদ যথাযথ নিজেকে শান্ত রেখে ঠান্ডা গলায় ব'লে,
-" আই নো নিধি, ঘটনাটা তুমি ভুলে যেতে চাও। বাট নিধি তুমি কি জানো? তোমার ঘটনাটা কোনো স্বাভাবিক নয়। এরা আগে থেকেই প্লেন করে সবটা করেছে। "
নিধি এবার চোখ তুলে ফাহাদের দিকে তাকালো। কালো মনির চোখগুলো যে কতোটা রাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে তা জানান দিচ্ছে যেন। ফাহাদ এবার নরম হয়ে বলে ওঠে,
-" প্লিজ নিধি বলো সবটা। তুমি কি চাওনা তাদের শাস্তি হোক? "
নিধি চুপসে থাকে অনেক্ক্ষণ। কোনো কথা বলতে পারেনা সে। ফাহাদ নিধির হাতে ধরে রিকোয়েস্ট করে। নিধি চোরা চোখে একবার ফাহাদের দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বলে ওঠে,
-" বিকালের পরপরই সেদিন আশাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে সিএনজি করে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম। আর মাঝ রাস্তায় আসতেই লোকটার গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। আমি বাইরে দাড়িয়ে ড্রাইভার আংকেল কে অনেক্ক্ষণ কল করি। উনি ফোন তুলেন না। হঠাৎ কেউ পিছন থেকে আমার নাকে রুমাল চেপে ধরে। তারপর আর আমার কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরতেই আমি ওই বাড়িতে নিজেকে আবিষ্কার করি। আর......
নিধির গলা কেঁপে যায় আর কোনো বলার মতো সাহস পায় না সে। ফাহাদ আর জোর করে না। নিধি দু'হাতে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকে। ফাহাদ নিধির পিঠে হাত বুলিয়ে কাঁদতে নিষেধ করে।
-" ওদের কাছে আমি কতো আকুতি মিনতি করেছি আমাকে ছেড়ে দিতে। জানেন? শেষ মুহূর্তে জ্ঞান হারাবার আগে আমি আমার মৃত্যু কামনা করেছি পর্যন্ত। ''
ফাহাদ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিধির কান্না কিছুটা থেমেছে। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ করে কাটিয়ে দিলো। নিধি এবার গা এলিয়ে দিলো। ফাহাদ শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো নিধির দিকে। কিছুক্ষণ পরে কিছুটা মনে করার মতো ভয়ার্ত মুখে নিধি বলে ওঠে,
-" ওরা আমার ভিডিও করেছিলো ফাহাদ। আমার মনে আছে কিছুটা। "
কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটি কুচকে গেলো ফাহাদের। নিধির তাকিয়ে তাকে ধাতস্থ করলো। সে সবটা সামলে নিবে।
,
,
,
,
,
,
দুপুর তিনটে, ইনায়া ভার্সিটির রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। হোস্টেলে এখন যাবে না সে। ভেবেছে বাইরে থেকেই কিছু খেয়ে নিবে। তারপর যাওয়া যাবে। আজকে টিউশনিও নেই৷ ইনায়ার ভাবনার মাঝেই সামনে গাড়ি রাখে জায়ান। ইনায়া চোখ ঘুরিয়ে দেখে সেটা। ইনায়া একটু অবাক হয় জায়ানের চোখে আজ পাওয়ারের চশমা। ইনায়া কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জায়ান মৃদু গলায় বলতে শুরু করে,
-" আর বলো না। গতকয়েক দিনের মাথা ব্যাথায়, ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি আমাকে চশমা ধরিয়ে এই হাল করে দিয়েছেন। "
-" গুন্ডামী পনা অব্যাহত থাকলে কয়দিন পরে জানটাই হারাবেন। ''
জায়ান হাসলো সেটা শুনে। সে ইনায়ার কাছে এসে শান্ত গলায় বলে ওঠে,
-" গাড়িতে উঠো, আজকে একটা স্পেশাল জায়গায় যাওয়া হোক। "
-" আমি লাঞ্চ করিনি এখনো, অতএব যাওয়া যাবে না। "
জায়ান ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। করুন গলায় ব'লে,
-" আমারো না লাঞ্চ করা হয়নি। চলো আমার সাথে এখুনি। ''
লাস্টের কথাটা শক্ত গলায় বলে জায়ান। ইনায়ার কিছু না বলে জায়ানের সাথে গাড়িতে উঠে বসে। চলতে চলতে প্রায় সময়ের ঘর এক ঘন্টা পেরিয়েছে। কিন্তু এখনো জায়ানের নিদিষ্ট জায়গা আসে নি। ইনায়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে জায়ানের দিকে তাকালো। কিন্তু তার কোনো হুঁশ জ্ঞান নেই। সে এক ধ্যানে গাড়ি চালাতে মগ্ন। শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টের দিকে গাড়ি থামায় জায়ান। ইনায়া কে হাতে ইশারা করে নামতে। ইনায়া গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে রেস্টুরেন্টে দিকে তাকায়। নেম প্লেটে জলজল করছে 'গ্রাম পাহাড়ি' নামটি। সম্পূর্ণ টাই বাঁশের বেত দিয়ে তৈরির। শুধু উপরে রঙিন টিনের ছাউনি। ইনায়া জায়ানের পিছন কাঠের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে। রেস্টুরেন্টের ভিতরের দিকটা খুব আধুনিক। আলাদা আলাদা কেবিন করা এখানে। ইনায়া কিছুটা অবাক হলো ভেতরের পরিবেশ দেখে। বাইরের দিকে বাঁশের বেত হলেও ভিতর দিয়ে তার উপর মাটির প্রলেপ দেওয়া। তার উপর বিভিন্ন রঙের নকশা আঁকা।একদম মাটির ঘরের মতো। জায়ান ইনায়া কে একটা কেবিনে বসিয়ে দিয়ে খাবার অর্ডার করতে যায়। ইনায়া কেবিনটা দেখে পুলকিত হলো অনেক। মেঝেতে মাদুর পাতা। মাঝখানে গোল আকৃতির কাঠের খোদাই করা নিচু সাইজের টেবিল সেট করা। এখানে আসন পেতে বসে সাচ্ছন্দ্যে খেতে পারবে। ইনায়া হাসিমুখে সেখানে বসে পরে। কেবিনে লাগোয়া ছোট্ট বেতের জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। এদিকটা অনেক নিরিবিলি। ইনায়া বাইরে এক ধ্যানে
দিকে তাকিয়ে থাকে। তন্মধ্যে জায়ান কেবিনে ঢোকে ইনায়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে, তড়িঘড়ি করে বসতে বসতে বলে ওঠে,
-" আর দশ মিনিট ওয়েট করতে হবে হরিণী। ওফ্ফ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। "
জায়ানের হঠাৎ কথায় ইনায়ার ধ্যান ভাঙ্গে। শান্ত দৃষ্টি স্থির করে জায়ানের পানে। অতঃপর মৃদু হেঁসে প্রশ্নের স্বরে বলে,
-" মন শান্ত হয়ে গেলো, জানেন? শহরের কোলাহল যানবাহনের হন সব থেকে মুক্ত এই জায়গাটা। আসলেই গ্রামের ফিলিংস আসছে। কোথায় পেলেন এর খোঁজ? "
জায়ান ইনায়ার হাস্যজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এমন কম সময় হয়েছে, ইনায়া তার সাথে হাসিমুখে কোনো কথা বলেছে। জায়ান আলতো হেঁসে জবাব দেয়,
-" দাদু থাকতে এই রেস্টুরেন্টে করেছিলাম। আইডিয়া টা তাঁরই ছিলো। উনার সাথেই এখানে আসতাম গ্রামীণ খাবারের স্বাদ নিতে। তিরি মারা যাওয়ার পর আজ তোমার সাথে আবার। "
ইনায়া অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-" এখানে সত্যিই গ্রামের ও পাহাড়ি আইটেম পাওয়া যাবে? "
-" হুম, কিন্তু এখন আমি বনমোরগ ছাড়া পাহাড়ি আইটেম আর কোনো অর্ডার করিনি। কারণ আমি তাদের খাবার দাবার বেশি একটা পছন্দ করিনা। কয়েক পদের ভর্তা আরো কিছু পদের খাবার। এতেই চলবে। দাদুর কারনে এটা ধরে রাখা। "
ইনায়া ভ্রু কুচকালো,
-'' কিন্তু আমার তাদের খাবার খুব পছন্দ। "
-" তাই? বলো কি খাবে?"
জায়ান ঝটপট জিজ্ঞেস করলো। ইনায়া কিছুক্ষণ ভেবে ঝটপট উত্তর দিলো,
-" ব্যাঙের স্যুপ। "
জায়ান বড়সড় চোখে ইনায়ার পানে তাকায়। ইনায়ার মুখে দুষ্টু হাসি। জায়ান হালকা হেসে বলে ওঠে,
-'' স্যরি মেম, আমাদের রেস্টুরেন্টে এমন ডিস বানানো হয়না। "
-'' তাহলে, শামুক সেদ্ধ? হবে তো স্যার? আমার ইচ্ছে জীবনে একবার হলেও এইসব ট্রাই করবো। "
বলেই উচ্চ স্বরে হেসে উঠে ইনায়া। জায়ান মৃদু হেঁসে তাকিয়ে থাকে ইনায়া দিকে। এই প্রানবন্ত ইনায়া কে তার প্রচন্ড ভালো লাগছে। আচমকা জয়ান ইনায়ার দিকে তাকিয়ে আলতোভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে স্ফুট কন্ঠে বলে ওঠে,
-" চলো না হরিণী, দুজনে বিয়ে করে ফেলি। ''
জায়ানের আচমকা এমন কথায় হাসি থেমে গেলো ইনায়ার। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে জায়ান তার দিকে তাকিয়ে। ইনায়া হকচকালো না। সেও শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল জায়ানের পানে।
,
,
,
,
,
সোহানা মির্জা আজকে না পারতেই অফিসে এসেছেন। নিধি কে ফেলে আসতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না। নিপার ভরসায় এসেছেন অনেকটা। দ্রুত কাজ সেড়ে জলদিই বাড়ি ফেরার তাড়া তার। তার আগেও এক জায়গায় যেতে হবে সোহানার।
এদিকে নাভানের স্তব্ধতা তাকে আরও পোড়াচ্ছে। টেবিলের এক কোনো কতো গুলো ফাইল পড়ে রয়েছে। সোহানা হাতে কলম ধরে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার ধ্যান ভাঙ্গে নাহিদ মির্জার হঠাৎ আগমনে। তিনি সোহানার সামনের চেয়ারে বসে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠে,
-" ফাইল গুলো এখনো সিগনেচার করোনি? বাড়ি ফিরতে হবে তো। "
সোহানা তার এই কথায় কোনো জবাব দেয় না। শুধু মলিন মুখে বলে ওঠে,
-'' মিজানুল করিম ফোন করে বলেছেন, একবার তাদের বাড়িতে যেতে। হয়তো কোনো জরুরি কথা আছে। "
-" আমাদের সাথে কি কথা থাকতে পারে?
চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে নাহিদ মির্জা। সোহানা চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে শান্ত গলায় বলে,
-'' হয়তো ইশান আর তিথির বিষয়ে। "
চলবে..…......…..……
( আলহামদুলিল্লাহ এখন সুস্থ আছি। এখন থেকে রেগুলার গল্প দেবো।)