27/02/2024
                                            আপা আমার ডানগালে থাপ্পড় লাগিয়ে রাগে লাল হয়ে বললো, ‘ঘরে বৌ রেখে অন্য মেয়ের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা গিলিস৷৷ শরম করেনা?’
আপার রাগগুলো পানি হয়ে চোখ দিয়ে ঝরছে৷ আমি 'থ' হয়ে দাঁড়িয়ে দেখি৷ আপার চিৎকারে টিভির রুম থেকে ছুটে এসেছে মিতু৷
আমি তখনো দাঁড়িয়ে দেখছি আপাকে৷ আপার চোখে জল৷ ছোটবেলা থেকেই টানাটানির সংসারে বড় হয়েছি ভাই বোন৷ টানাটানির সংসার বলে আমার দুঃখ হতো ছোটবেলায়৷ বন্ধুরা টিফিনে ১০-২০ টাকা পকেটে করে স্কুলে যায়৷ আর আমি স্কুলে যাওয়ার আগে পান্তাভাত গিলি৷ ঐটাই সকালের নাস্তা, ঐটাই দুপুরের টিফিন৷
মাঝেমধ্যে আম্মার আঁচল ধরে ঘুরঘুর করে দু''এক টাকা পেতাম৷ আপার উপবৃত্তির টাকা পেলে আমাকে এককালিন ৫০টাকা দিতো৷ আমি আপাকে জমা দিতাম আবার৷ ২টাকার বেশি স্কুলে নিতাম না৷ ২টাকা দিয়ে একটা আইসক্রিম চুষে মন ফূর্তিতে ভরে যেতো৷
আরেকটু বড় হলাম৷ এখন টিফিনের জন্য মন খারাপ হয় না৷ কিন্তু মন খারাপের শেষ নেই৷ এবার উদয় হলো, ‘বন্ধুদের সাইকেল আছে আমার নেই৷ বন্ধুরা বেড়াতে যায়৷ আমি যেতে পারিনা৷ আমার দু'টো সুন্দর কাপড় নেই কেন? আব্বা কিনে দিতে পারে না কেন?’
মাঝেমধ্যে আব্বার উপর রাগ হতো৷ আব্বাকে উল্টা পাল্টা বলে দৌঁড়ে পালাতাম৷ ভয়ে আর ঘরে ঢুকতাম না৷ বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতো৷ আব্বার ভয়ে আমি ঘরে ঢুকিনা৷
আব্বা জানে আমি ঢুকবোনা৷ তাই সন্ধ্যা হতেই ঘুমের ভান ধরে থাকতেন৷ ঐ ঘুমের ভান যে চাপা কান্না ছিল৷ সেটা আমি একটু বড় হতেই অনুভব করি৷
আপা আমাকে বুঝাতো৷ দুনিয়াধারীর সংজ্ঞা শেখানোর চেষ্টা করতো৷ আমি এই কানে ঢুকিয়ে অন্য কানে বের করে দিতাম৷ পাড়ার কেউ নতুন ব্যাট বা সাইকেল কিনলে আমি ঘরে ফিরে আপাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম৷
তারপর বড় হলাম৷ স্কুল, কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটি৷ প্রাথমিক পেরিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে উঠেই বড় হওয়া শুরু আমার৷ স্কুলের শার্টটা টেনেটুনে পড়তাম৷ জাতীয় সংগীত গাইতে মাঠে লাইনের পেছনটাতে দাঁড়াতাম৷ আমার শার্ট টানা যেন কারো চোখে না পরে৷ স্কুল ছুটি হওয়া মাত্রই বাড়িতে দৌঁড়৷ যেদিন ভুলক্রমে বেরোতে দেরী হয়েছে৷ সেদিন পিচঢালা রাস্তার ছোট পাথর গোণার ভান ধরে বাড়ি ফিরতাম৷
আপার স্কুল ড্রেসটার রং ছিল আকাশি৷ তার বান্ধবীদের ছিল গাঢ়ো নীল৷
আমি আপাকে বলতাম,
: 'তোরটা রং ভিন্ন কেন?"
আপা বলতো,
: 'আমারটা স্পেশাল৷ আমি ফাষ্ট গার্ল ক্লাসের তাই৷'
---
-------
--------------
আমি যে স্কুলটাতে পড়তাম৷ সেই স্কুলেই শিক্ষকতা করি৷ ৮,৯,১০৷ টানা তিনবছর ফাষ্ট বয় ছিলাম৷ আমার আপা ছিল ৬-১০ফাষ্ট গার্ল৷
শিক্ষকতার দু'বছরের মাথায় একবার হেড স্যারের রুমে ডাক পড়লো৷ হেডস্যার ভালো মানুষ৷ আমাকে হাসি মুখে অভিবাদন জানালেন৷
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
: 'এত কিছু থাকতে শিক্ষকতা করছো কেন ছেলে?'
আমি মুচকি হেসে বলেছিলাম,
: 'ভালো থাকতে৷ সুখী থাকাটায় আসল দুনিয়াতে৷ আমরা যখন কোনো পেশায় যোগ দেই৷ তখনই কিন্তু আমাদের জীবনের বয়সটা অর্ধেকের কাছাকাছি পেরিয়ে যায়৷
আমরা অর্থের পেছনে ছুটি৷ সারাদিন ছুটোছুটি করে নীড়ে ফিরে মনে মনে বলি, ‘জীবনটা কেন?’ তাই এই পেশায় আসা৷ সারাদিন মনে হয় স্কুলের ছাত্র নই৷ নিজের সন্তান নিয়ে পড়ে আছি৷
ছোটবেলায় বাচ্চারা যখন তার মা-বাবাকে এটা ঐটা দেখিয়ে বলে, ‘এটা কি? ঐটা কী?’ তেমনি আমার ছাত্ররাও বলে, ‘স্যার এটা কিভাবে হলো? ঐটা কিভাবে হলো?’ এই উত্তর দিতে দিতেই আমার একাকিত্ব, মন খারাপীগুলো বিলিন হয়৷'
হাতের কাপটা টেবিলে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,
: 'তোমার কাছে ভালো থাকাটা কী?'
: 'দু'টো কাপড়, দু'মুঠো ভাত, ভালো একটা ঘুম৷ প্রিয়জনদের হাসিমুখ৷'
তার দু'দিন পরেই হেডস্যারকে আমি আমার ঘরে আবিষ্কার করলাম৷ আম্মার হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিতে দিতে আম্মাকে বলছিলেন,
: 'আমার মেয়েটাকে রাখতে চাচ্ছিলাম৷ আপনি রাজি আপা?'
তার সপ্তাহ খানেক পরেই মিতুর সাথে আমার জীবন চলা শুরু৷ আমি মিতুর মাষ্টার সাহেব৷ ক'দিন যেতেই স্কুলের মাষ্টার দাদা থেকে সবারই মাষ্টার দাদা হয়ে গেলাম৷ এতে মিতুর কারসাজি আমি খুব বুঝতে পারি৷ মিতুর জন্য শাড়ি, গহনা কিংবা সিনেমা হল এ গিয়ে মুভি বরাদ্দ ছিল না৷ এতে মিতুর দুঃখ নেই৷
মিতুকে হুটহাট বলতাম,
: 'তোমার খারাপ লাগে না?'
: 'কেন?' ভ্রু কুচকে বলতো মিতু৷
আমি মাথার নিচে দু'হাত ঠেকিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বলতাম,
: 'এই যে তোমার জন্য আমার বেশি কিছু বরাদ্দ নেই৷ ধরো, প্রতিমাসে নতুন শাড়ি, হুটহাট কানের দুল এনে তোমাকে চমকে দিতে পারিনা?'
মিতু আমার নাক টিপে দিয়ে বলতো,
: 'কে বলেছে বরাদ্দ নেই? প্রতিমাসে ২৬টা সুন্দর ভালোবাসায় মাখানো সন্ধ্যা৷ ৩০টা সুন্দর সকাল৷ মাসে ৯৬টা শ্রেষ্ঠ ঘন্টার ভালোবাসাতো আমার জন্য বরাদ্দ৷
ছুটির দিনের বিকেলে বিটিভিতে বাংলা ছায়াছবির সাথে সন্ধ্যা বেলার রাস্তার মাঝে ফুচকা গেলা৷ সোডিয়ামের আলোতে হাত জড়িয়ে ঘোরা৷ আমার আবদারটাও খুব ভীষণ না৷ আবার ভীষণও৷ আমি চেয়েছিলাম, কেউ একজন আমাকে ভীষণ ভালোবাসুক৷ আমি পেয়েছি! আর বকবক করো না তো৷ জড়িয়ে ধরো৷'
আমি ম্মিত হেসে জড়িয়ে ধরি৷
আপা আর মিতু পাশের রুমে৷ আমি আপার চড় খেয়ে এখনো সোফায় বসা৷ মিতুর সাথে আমার কথা হয়না সপ্তাহ খানেকের মতো, অজানা কারণে৷ আমার ভালোবাসা ভরা পৃথিবীটাতে হুট করে অন্ধকার নামে৷ 
ভালোবাসার শরতের আকাশে বর্ষার মেঘ জমে৷ আমি আঁচ করতে পারিনা৷ শিক্ষক না হয়ে আবহাওয়াবিদ হওয়া উচিত ছিল বোধহয়৷ পরক্ষণেই ভাবি, ‘যা তা ভাবছি৷ আবহাওয়াবিদ হলেতো ভালোবাসার শরৎটায় আসতোনা আমার৷’
আমি রুমের কাছে কান পাতি৷ মিতুর কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ আপা ধমক দিচ্ছে দু'একটা৷ আমি আরেকটু কান পাততেই শুনলাম আপা বলছে,
: 'চড় দিয়েছি বলে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিস৷ খানিকক্ষণ বাদেতো ফ্যানের সাথে বেঁধে পেটাবো৷ তখন কী করবি?'
মিতুর কান্নার আওয়াজ আরেকটু ঘন হয়৷ আপার হুমকি শুনে এই সময়ই আমার হাসি পায়৷ তবু চেপে রাখি৷
কান্নার আওয়াজ শুনছিনা আর৷ রুমে আমার ডাক পরেছে৷ রুমে ঢুকতেই দেখলাম আপার হাতে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু৷ রুমের কোণে বসে আছে মিতু৷ মুখটা হালকা পাকা টমেটোর মতো হয়ে আছে৷ দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে৷ একটু আলগা করলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিবে অবস্থা৷
আপা মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
: 'তুই এই কাজ কেমনে করলি?'
: 'কী কাজ?'
আপা একবার তেড়ে আসতে চাইলো৷ আবার মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
: 'তোরে ধরলেই এই মেয়ে কেঁদে মরে যাবে৷ সোজা বল, সেদিন ফুচকা খেয়েছিলি সাথে মেয়েটা কে?'
আমি লম্বা শ্বাস ফেলি৷
: 'আপা তোর মনে আছে, তোর আকাশী কালারের স্পেশাল ড্রেসের কথা শুনে আমি পরের বছরই ক্লাসের ফাষ্ট বয় হয়ে গিয়েছিলাম? তারপর স্কুলের সেই টেনেটুনে পরা শার্টটা পরে স্কুলে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতাম, ফাষ্ট বয়ের স্পেশার ড্রেস! পোলাপান হাসতো৷ আমার এতটুকু খারাপ লাগতোনা৷ তারপরের বার আবার প্রথম হলাম৷ আতিক স্যার নতুন স্কুলের শার্ট হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘তুই আমার মেয়েকে পড়াবি৷ তোর ছোটবোন বুঝলি৷ দুষ্টুমি করলে পেটাবি৷ দুষ্টুমি না করলে কাঁধে নিয়ে ঘুরবি৷ ঘোড়া চড়াবি৷ পারবি?’
আমার প্রথম টিউশন৷ প্রথম বেতন দিয়ে তোর বান্ধবী শিউলি আপাকে সাথে নিয়ে তোর জন্য গাঢ়ো নীল স্কুল ড্রেস কিনে এনেছিলাম! মনে আছে? তুই খুশিতে কেঁদেছিলি৷ তারপর আতিক স্যার! ভালোমানুষটা হারিয়ে গেল৷
টুম্পার আম্মা একদিন গম্ভীর মুখ নিয়ে বললেন, ‘আর পড়াতে এসো না বাবা৷’ আমি মন খারাপ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম৷ তোর কোলে মাথা রেখে কেঁদেছিলাম৷ তুই তারপরের বিকেলে আমার হাত ধরে স্যারের বাসায় নিয়ে গেলি৷ আন্টির সামনে বসিয়ে বলেছিলি, ‘আমার ভাই টুম্পাকে পড়াবে আন্টি৷ যতদিন প্রয়োজন৷’
আন্টির সেকি কান্না৷ আন্টির হাতে রান্না করা বিরিয়ানী স্বাদটা ভুলেছিস? টুম্পা ততদিনে একটু বড়৷ স্যারের সংসারের টানাপোঁড়েন৷ এরপর আমি ডজনখানেক টিউশন করিয়েছি৷ কিন্তু টুম্পাকে পড়ানো ছাড়িনি৷"
স্যারের কথাটা মনে পড়তো - 'তোর ছোটবোন!' সেদিন থেকেই আমার দু'টো বোন হয়ে গেল৷ তুই আর টুম্পা৷ টিউশনের বেতন পেলেই, তোকে যেমন চুড়ি দিয়েছি৷ টুম্পাকেও দিয়েছি৷ তুই বাইরে যাওয়ার পক্ষে ছিলি না৷ আমি টুম্পাকে নিয়ে ঘুরেছি কত বিকেল৷
জানিস! পিচ্চিটা বড় হয়েছে! সেদিন হুট করে উদয় হলো তার৷ আমাকে দেখলেই তার বাচ্চামো জাগে৷ সেদিন আমার ক্লাসের ফাঁকে এসে হুট করে বলে বসলো, ‘ভাইয়া আমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরবা?’
আমি মেকি রাজি হলাম৷ তারপর বাচ্চা বুড়ি মেয়েটার খিলখিল হাসি৷ হাসি শেষে বললো, ‘তুমি এত ভালো কেন?’ আমি লজ্জা পেলাম একটু৷ আবার বললো, ‘পাম দিলাম৷ ফুচকা গেলানোর জন্য৷’
আপা আমার কী কোনো দোষ আছে?'
কথা শেষ হতেই বাম গালে চড় বসালো আপা৷ এবারও চোখে পানির আনাগোণা৷ চড়ের শব্দে মিতুকে দেখলাম কেঁপে উঠলো৷ আর চেপে রাখতে পারেনি৷ হাউমাউ কান্নার রোল পড়লো৷
আমি মিনমিন করে আপাকে বলি,
: 'কাকে শান্তনা দিবো? তোরে না বৌ কে?'
আপা মিতুকে ধমক দিয়ে বললো,
: 'এই মেয়ে! তুই কান্দস ক্যান?'
মিতু কান্নামুখে বললো,
: 'আপা আপনার সাথে চুক্তি ছিলো, এক চড়ের৷ দু'টো দিলেন কেন? আমার মাষ্টার সাহেব নির্দোষ'
আপা মুচকি হেসে বললো,
: 'ওরে বোকা! এক গালে চড় খেলে এক গালের বাচ্চা হবে৷ তখন কী হবে?'
মিতু ফিক করে হেসে উঠে৷ আমার শান্তি লাগে৷ মনের আকাশের মেঘগুলো হুট করে গায়েব হয়৷ আমার পৃথিবীটা আবার ভালো লাগায় ভরে উঠে৷
(সমাপ্ত)...
ছোটগল্প || আরিফুর রহমান (রাজন)
------
গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন। আর কমেন্টে আপনার মূল্যবান মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না।🥰