16/07/2025
পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমানই আহলে সুন্নাতুল জামাতের অনুসারী এবং তারপর শিয়া ফেরকার অনুসারী এবং তারপর ওহাবি ফেরকার অনুসারী।
সমগ্র সৌদি আরব ওহাবি ফেরকার অনুসারী এবং ইরান শিয়া ফেরকার অনুসারী এবং ইরাকের অধিকাংশ মুসলমান শিয়া ফেরকার অনুসারী। আমার জানা মতে, সুন্নি ফেরকার অনুসারীদের একটিমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল আছে এবং সেই চ্যানেলটির নাম কিউ টিভি। কিউ টিভি-তে কেবল সুন্নিদের আদর্শই প্রচার করে না, বরং অনেক ওলি-আল্লাহদের ফারসি ভাষায় রচিত দুষ্প্রাপ্য অমর গ্রন্থগুলো পুনরায় ছাপিয়ে প্রচার করার ব্যবস্থাটিও করেছে। শিয়া এবং ওহাবি উভয় ফেরকার মাথায় ইহা একটি প্রচন্ড আঘাত। যেহেতু ইরান শিয়া ফেরকার অনুসারী এবং যেহেতু শিয়ারা সুফিবাদ মানে না তাই তাদের নিজস্ব ভাষায় রচিত ওলি-আল্লাহদের মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো পুনরায় ছাপাবার প্রশ্নই ওঠে না। অপরদিকে ওহাবিদের বেলায় তো আরও ভয়ের ব্যাপার। ওহাবিরা আল্লাহর বড় বড় ওলিদেরকে মেনে নেবার প্রশ্ন তো দূরে থাক, বরং কাফের ফতোয়া দিয়েছে। সুতরাং সুফিবাদ ওহাবিদের কাছে একটি অসহ্য বিষয়।
ওহাবিদের গুরুঠাকুর আবদুল ওহাব নজদি সাহেব ওহাবি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে শলা-পরামর্শ করতো। এক ওহাবি ঝানু বুদ্ধিজীবী বলে ফেললো যে, পৃথিবীর সমস্ত মাদ্রাসাগুলো হতে ফারসি ভাষাটি উঠিয়ে দিলে সুফিবাদের মৃত্যুঘণ্টা আপনিই বেজে উঠবে। কারণ সুফিবাদের ভান্ডারটি ফারসি ভাষায় রচিত হয়েছে। চেয়ে দেখুন, আজ আর পৃথিবীর কোনো মাদ্রাসায় ফারসি ভাষায় রচিত ওলি-আল্লাহদের বইগুলো পড়ানো হয় না। যখন মাদ্রাসায় ফারসি ভাষাটি চালু ছিলো তখন অনেক অনেক আল্লাহর ওলি মাদ্রাসা হতে বেরোতো। এখন আর মাদ্রাসা হতে ওলি বের হয় না। বৈজ্ঞানিক নিউটনের সূত্রটির চমৎকার মিল পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক নিউটন বলেছেন যে, প্রত্যেকটি কাজের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এখন মাদ্রাসা হতে আল্লাহর ওলি বের না হয়ে বের হয় তালেবান আর জঙ্গি। সৌদি আরবের পেট্রোডলারের প্রচন্ড দাপটে বহু সুন্নি আলেম-উলামাকে বিক্রি হয়ে যেতে দেখি। এই বিক্রি হয়ে যাওয়া আলেমদেরকে বলা হয় 'বিকাহুয়া' আলেম। ওহাবিদের দর্শনের সঙ্গে খারেজিদের দর্শনের হুবহু মিল পাওয়া যায়। ওহাবিদের দর্শনটি মনে হয় চমৎকার। ইমিটেশনের অলঙ্কার যে রকম চকচক করে, আসল অলঙ্কার ইমিটেশনের ধারে কাছেও যেতে পারে না। তাই সরল-সহজ মানুষগুলো এদের ফাঁদে পড়ে যায়। আবার ইরানের শিয়াদের প্রচারটিও কম নয়। তারাও ব্যাপক প্রচার করে চলেছে। শিয়া ও ওহাবিদের প্রচারের চাপাচাপিতে আহলে সুন্নাতুল জামাতের অনুসারীরা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। কিন্তু সৌভাগ্য যে পাকিস্তানের কিউ টিভি চ্যানেলটি কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে পেরেছে। পৃথিবী বিখ্যাত এক আহলে সুন্নাতুল জামাতের আলেম, যিনি ডক্টর উপাধিতে ভূষিত, সেই ডক্টর মোহাম্মদ আল তিজানি আল সামাজি শিয়া ফেরকার অনুসারী হয়ে যান। তাঁর রচিত বিখ্যাত বই অবশেষে আমি সত্য পেলাম। বহু ভাষায় অনূদিত বইটির ১৭৩ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, 'অতঃপর আমি নিশ্চিত হই যে, "ইসনা আসারী" দলটাই সঠিক। অতএব আমি শিয়া হয়ে গেলাম।'
শিয়া ফেরকার অনুসারীরা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), ফারুকে আজম হজরত ওমর ফারুক (রা.), জুননুন নুরাইন হজরত ওসমান গনি (রা.) এবং আশারে-মোবাশশারা তথা দুনিয়াতে থেকেই যাঁরা জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন সেই দশজনের একজন হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)- এই চার সাহাবার নাম-গন্ধটিও সহ্য করতে পারে না।
ড. মো. আল তিজানি আল সামাভি এদের বিরুদ্ধে সুন্নিদের দলিল প্রমাণসহ এবং সিয়াহ সিত্তাহ হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, তাঁরা সাহাবা হবার মর্যাদাটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। আমি বলতে চাই না যে, অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। কিন্তু এটুকু বলতে চাই যে ড. মোহাম্মদ আল তিজানি যেহেতু সুফিবাদ অস্বীকারকারী তাই গাদিরে খুম-এ মহানবির একটি কথার ভুল ব্যাখ্যা করেন। মহানবি বলেছিলেন, 'আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা', এবং এই কথাটি বিনাবাক্যে সব সাহাবারা মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি হজরত ওমর (রা.), হজরত আবু বকর (রা.), এবং হজরত ওসমান (রা.)-ও মেনে নিয়েছিলেন। মহানবির পর্দাগ্রহণ করার পর মাওলা আলী (আ.)-কে কেন প্রথম খলিফা করা হলো না এটাই শিয়াদের বিরাট গোস্বা এবং শিয়ারা মনে করে যে হজরত ওমর (রা.), হজরত আবুবকর (রা.) ওয়াদা ভঙ্গকারী। যেহেতু শিয়ারা সুফিবাদ মানে না সেহেতু সুফিবাদের জ্বলন্ত দলিলটি পেশ করলেও তারা মানবে না। কারণ দলিলটি নির্ভর করে সুলতানুল হিন্দ খাজা বাবার কথাগুলোর উপর, যে কথাগুলো আজও স্বর্ণে ক্ষোদিত অক্ষরে সদর দরজার উপরে লিখিত আছে: "শাহ হাস্তে হোসাইন, বাদশা হাস্তে হোসাইন" অর্থাৎ "রাজা হোসাইন, রাজার রাজা হোসাইন।"
শিয়া এবং ওহাবিদের তো প্রশ্ন করাটি একটি মামুলি ব্যাপার, বরং আহলে সুন্নাতুল জামাতের অনুসারী অধম লেখকও যদি খাজা বাবাকে প্রশ্ন করি যে, ইমাম হোসাইন কেমন করে রাজা হলেন এবং ইমাম হোসাইন কেমন করে রাজার রাজা হলেন? ইসলামের ইতিহাস পড়লেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে রাজা হয়েছিল এজিদ, খলিফা নামধারণ করে সিংহাসনে বসেছিল এজিদ, মুমিনদের আমির বলে ঘোষণা করে এজিদ মুসলিম জাহানের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়েছিল। রাজ্যশাসন করেছিল এজিদ, সৈন্য-সামন্ত নিয়ে মদিনা আক্রমণ করে বহু সাহাবা এবং তাদের সন্তানদেরকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে শহিদ করেছিল এই এজিদ। অপরপক্ষে, ইমাম হোসাইন কারবালার রণপ্রান্তরে এজিদের সৈন্যবাহিনীর প্রধান ইবনে জিয়াদের হুকুমে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। এমনকি আওলাদে রসুল দশমাসের শিশু আলী আসগর (আ.)-ও ওই কারবালার মাঠে শহিদ হয়েছিলেন। এই শাহাদাত বরণ করার কলঙ্কময় দিবসটির নাম ১০ই মোহরম। অনাগত কালের মুসলমানগণের থুতু নিক্ষেপ করার, ধিক্কার, ঝাড়ু-জুতা-পচা স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারার অপবাদ হতে বাঁচবার জন্য ১০ই মোহরমের অনেক প্রকার ফজিলতের বয়ানটি আমরা দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই, এই কলঙ্কময় ১০ই মোহরম দিবসটিকে দুই হাজার পাঁচশত নবির জন্মদিবস হিশাবে তথা পঁচিশ শত নবি এই ১০ই মোহরম তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমরা দেখতে পাই, আদমের (আ.) তওবা কবুল হয়েছিল এই ১০ই মোহরমের দিনে। আমরা দেখতে পাই, নুহ নবির (আ.) নৌকাটি মহাপ্লাবনের সময় ১০ই মোহরমের দিন জুদি পর্বতে ভিড়েছে। আমরা দেখতে পাই, মুসা নবি (আ.) নীলনদের মাঝখানের রাস্তাটি তৈরি করেছিলেন ১০ই মোহরমের দিনে। আমরা দেখতে পাই, ১৮ বছর পোকায় খাওয়া শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আইউব নবি (আ.) ১০ই মোহরমের দিন সম্পূর্ণ সেরে উঠলেন। আমরা দেখতে পাই, ইউনুস নবি (আ.) রজব মাসে দুই মাছের পেটে অবস্থান করছেন কমপক্ষে এক মাইল পানির নিচে দীর্ঘ তিনমাস: অক্সিজেন নাই, খাদ্য-পানি নাই, মাছ দুটিও ইউনুস নবিকে গিলে ফেলে মহা মুশকিলে পড়ে গেল। তারপর এই ১০ মোহরমের দিনে বালুচড়ে ইউনুস নবিকে বমি করে ফেলে দিল। ইউনুস নবি (আ.) গা ঝাড়া দিয়ে বাড়িতে চলে গেলেন।
এই ১০ই মোহরমের ফজিলতের বয়ানটি আরও অনেক বড়। এখানে সামান্য কিছুটা তুলে ধরলাম। তুলে ধরলাম এ জন্য যে উমাইয়া রাজবংশ এবং আব্বাসীয়া রাজবংশ অনাগত কালের মুসলমানদের মগজ ধোলাই করবার চমৎকার ব্যবস্থাটি করে গেছে! সাবাস উমাইয়া রাজবংশ। রেভো আব্বাসীয়া রাজবংশ। কিন্তু শুভঙ্করীর বিরাট ফাঁকটুকু একটু গবেষণা করলে ধরা পড়ে যায়। এই সাবাস পাওয়া উমাইয়া রাজবংশটি শহিদে আজম ইমাম হোসাইনের শানমানটি মুছে ফেলার একটি পাকাপোক্ত সুচতুর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই বিরাট শুভঙ্করীর ফাঁকটুকু পাঠক বাবা-মায়েদেরকে একটু ধরিয়ে দিতে চাই।
আদমের (আ.) তওবা কবুল হয়েছিল এই ১০ই মোহরমের দিন। তওবা কবুল হবার সময়ে হাবিল-কাবিল এবং অন্য ভাইবোনদের একজনও জন্মগ্রহণ করেন নি। এই নির্দিষ্ট ১০ই মোহরমের দিনটিতে আদমের তওবা যে কবুল হয়েছিল উহা কে লিখে রেখেছিল? মানুষই নাই অথচ ১০ই মোহরমের দিনটি নির্ধারণ করা যে একটি বিরাট ধাপ্পাবাজি ইহা পরিষ্কার বোঝা যায়। আরও লক্ষ করার বিষয় যে, যতগুলি ঘটনা ১০ই মোহরমের দিন ঘটেছে সবগুলো সুখের ঘটনা, আনন্দের ঘটনা কেবলমাত্র মহানবির আওলাদ, শহিদে আজম ইমাম হোসাইনই এই ১০ই মোহরমের দিন শাহাদাত বরণ করেন। আড়াই হাজার নবির জন্মদিন এই ১০ই মোহরম। সুতরাং আড়াই হাজার নবির সামনে ইমাম হোসাইনকে অবহেলা করার একটি বিরাট ধাপ্পাবাজি। উমাইয়া রাজবংশ বুঝাতে চেয়েছিল যে আড়াই হাজার নবির শুভ জন্মদিনের সামনে ইমাম হোসাইনের শহিদ হবার ঘটনাটি তত গুরুত্ব বহন করে না। আচ্ছা, ধরে নিলাম, সমস্ত ঘটনাগুলো ১০ই মোহরমের দিনই ঘটেছিল। আমরা যদি উমাইয়া রাজবংশকে সামান্য একটি প্রশ্ন করি যে, সবচেয়ে লেটেস্ট নবি-এখনও দেড় হাজার বছর পূর্ণ হয় নি, সেই লেটেস্ট নবির জন্মদিন কেন অনেকগুলো? ওহাবি ফেরকার মুসলমানেরা ৯ই রবিউল আউয়াল, আহলে সুন্নাতুল জামাতের অনুসারীরা ১২ই রবিউল আউয়াল- এভাবে একেক ফেরকার অনুসারীরা মহানবীর জন্য দিবসটি একেক দিন পালন করে। লেটেস্ট নবির উম্মত বলে যারা দাবি করে তাঁদের এই সেদিনের জন্মদিবসের ঘটনাটি কেন অনেক রকম হয়?
এই রকমভাবে ইসলামের কত বিষয়ে যে কত রকম গাজাখুরি গোঁজামিল দিয়ে রাখা হয়েছে, সেই গোঁজামিল হতে সত্য বিষয়টি তুলে ধরা চাট্টিখানি কথা নয়। মনেপ্রাণে সত্য উদ্ধার করার পথে অগ্রসর হতে গেলে পদে পদে আপনাকে হোঁচট খেতে হবে। আজ ইসলামের অনেক বিষয় গোঁজামিলের আবরণে ঢেকে আছে।
আমি দেখেছি, মুসলিম সমাজে যারা জাঁদরেল ইসলাম-গবেষক বলে পরিচিত তারাও এই ১০ই মোহরমের ফজিলতটি বর্ণনা করেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে থাকি আর হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ড. গোয়েবলসের কথা বার বার মনে করি।
উমাইয়া রাজবংশ কি ইমাম হোসাইনের স্মৃতি মুছে ফেলতে পেরেছে?
এজিদ রাজ্যশাসন করেছে সত্য, সিংহাসনে বসেছে সত্য, খলিফা নামধারণ করেছে সত্য, নিজেকে মুমিনদের আমির বলে ঘোষণা করেছে সত্য, কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান হৃদয় হতে এজিদের নামটি চিরতরে মুছে ফেলে দিয়েছে। পক্ষান্তরে ইমাম হোসাইন মুসলিম জাহানের খলিফা হতে পারেন নি সত্য, কিন্তু দুনিয়ার অধিকাংশ মুসলমান তাঁকে হৃদয়ের রাজা এবং রাজার রাজা রূপে বুকে ধারণ করে রেখেছে। কোনো মুসলমানই নিজের এবং আত্মীয়-পরিজনের নামটির শেষে এজিদ শব্দটি ব্যবহার করে না। যেমন জাহাঙ্গীর এজিদ, নাহিদ এজিদ, বেদম এজিদ, তারিক এজিদ, মহসিন এজিদ এইভাবে ব্যবহার করে না, বরং এজিদ শব্দটিকে একটি অপমানজনক গালি মনে করে। অথচ ইমাম হোসাইন এবং আওলাদে রসুলদের নামগুলো আজও মুসলমানেরা বুকে ধারণ করে রেখেছে। যেমন জাহাঙ্গীর হোসাইন, নাহিদ হাসান, বেদম হোসাইন, তারিক হাসান, মহসিন আলী ইত্যাদি। ইমাম হোসাইনের নাম মুসলমানের হৃদয়ে চির অমর হয়ে আছে, আর এজিদের নাম ইতিহাসের ড্রেনে স্থান পেয়েছে। তাই খাজা বাবা বলেছেন: রাজা হোসাইন, রাজার রাজা হোসাইন। এই রাজা, এই রাজার রাজা বিত্ত-বৈভব আর দুনিয়ার সিংহাসনে বসা রাজা নয়, বরং হৃদয় জয় করার অমর রাজা, অমর রাজার রাজা।
📚গ্রন্থ: আলে বায়েত এবং কারবালার করুণ দৃশ্য (পৃষ্ঠা: ৬৫-৬৯)
✍🏻চেরাগে জানশরীফ বিনয়ের সম্রাট ডা. কালান্দার বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান সুরেশ্বরী