18/10/2025
কাজের বুয়াটা প্রেগন্যান্ট তাই ছুটিতে আছে এজন্য বাসার কাজ গুলো আমাকেই করতে হচ্ছে,
হাতের কাজ গুলো শেষে মনে পড়লো ছাদে কাপড় রয়ে গেছে সেগুলো আনতে ছাদে উঠে দেখি পাশের ফ্ল্যাটে আন্টি ছাদের একপাশে পায়চারি করছে,।উনাকে দেখে সামনে গিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলাম,
টুকটাক কথার মধ্যে তিনি বললেন উনার নাতীর সাথে এসেছে আর নাতী বাসায় একটু দরকারে গেছে ফিরলেই নাতীর সাথে ঘরে যাবে,
তো আমি উনাকে একা রেখে আসতে কেমন যেনো লাগছিল তাই গল্প করতে লাগলাম,
উনি নিজেই বলছেন উনার ছেলের বউ অনেক ভালো তার অনেক যত্ন করে খেয়াল রাখে,
তার একটাই ছেলে স্বামী নেই তাই ছেলের কাছেই থাকেন,
বাড়ি যেতে চাইলে ছেলে ছেলের বউ কেউ যেতে দেয়না,
তারা বলে কি করবা বাড়ি গিয়ে কে আছে তোমার বাড়িতে এখানে আমাদের সাথেই থাকো,
তাই ওদের মন রাখতে তিনি তাদের সাথে থাকেন।
উনি আমতা আমতা করে আরো বলেন...
আসোলে মা এই ছেলেটা ছাড়া আমার তেমন কাছের কেউ নেই,
একমাত্র ছেলে আমার অনেক আদরের অনেক যত্নের অনেক মায়ার!
তোমার আঙ্কেল মারা যাবার পর ছেলেটাকে আগলেই আমার জীবন কেটেছে তাই ওর মায়া কাটাতে পারিনা,
ছেলের বউটাও মাশাআল্লাহ অনেক ভালো পেয়েছি,
আজকাল এমন ছেলের বউ কোথায় কে পায়?
আমার তো ভাগ্য নিজের মায়ের মত রাখে আমাকে।
"আমি উনার মুখে কথা গুলো শুনে খুবই অবাক হলাম এইজন্য যে...
উনার ছেলের বউয়ের সাথে আমার যতটুকু কথা হয়েছে তিনি তার শাশুড়ী কে নিয়ে খুবই বিরক্ত,
আমি পোশায় একজন গাইনি ডাক্তার,
আমার কাজের পারপাসে বাইরে যেতে হয় তাই উনি কয়েকবার আমাকে আমার জানাশোনা কোনো বিদ্যাশ্রম আছে কিনা জিজ্ঞেস ও করেছিলো,
কিন্তু কাজের চাপে আমি আর তেমন খোঁজ দিতে পারিনি,
আমি খেয়াল করলাম উনি কথা বলছে ঠিকই কিন্তু উনার চোখে মুখে প্রচন্ড দীর্ঘশ্বাস।
যাই হোক আমরা অনেক সময় পর্যন্ত কথা বলার পরও দেখি উনাকে নিতে কেউ আসেনি,
এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো তাই আমি বললাম...
আন্টি কেউ তো আসছে না চলুন আমি আপনাকে ধরে নামিয়ে নিয়ে যাই,
উনি বললেন ছোট বাচ্চা তো হয়তো বাসায় গিয়ে ভুলে গেছে,
তুমি আবার কষ্ট করবা মা?
আমি বললাম সমস্যা নেই আমি ও তো সেইম ফ্লোরেই নামব আসুন আমার সাথে,
মনে মনে ভাবলাম এত অমায়িক একজন ভদ্রমহিলা, আর সবচাইতে বড় কথা উনার মধ্যে কাউকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই,
কত সুন্দর করে ছেলের বউ নাতীকে সেভ করলো,
অথচ এটা যে কারো বুঝার কথা এত সময় বৃদ্ধ মানুষটা বাসায় নেই,
বাচ্চা ছেলেটা না হয় ভুলে গেছে হয়ত কিন্তু ছেলের বউয়ের ও কি মনে নেই তিনি যে ছাদে একা!
যাই হোক আন্টিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকব তখনই ভিতর থেকে চ্যাঁচামেচি শুনতে পেয়ে ইচ্ছে না থাকার স্বত্বেও দাঁড়াই,
কারণ উনার ছেলের বউয়ের কথা গুলো এতোটাই স্পষ্ট যে না শুনে পারলাম না,
তিনি চিৎকার করে বলছেন,
কি দরকার ছিলো উনার সাথে আসার?
একটু সহ্য হলো চলে আসছে আরেকজনের সাথে,
না জানি কি কি বলেছেন আমাদের সম্পর্কে,
আমি তার প্রতিত্তোরে আন্টির একটা কথা ও শুনলাম না,
মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলো।
বাসায় হেল্পিং হ্যান্ড না থাকায় কিছুদিন ক্লিনিকে যাওয়া অফ করে দেই,
বাসার সব কাজ করে বাচ্চা সামলে ক্লিনিকে যাওয়া হয়ে উঠে না,
হবে ইমারজেন্সি হলে তখন যেতেই হয়,
সেইদিন কার পর থেকে ছাদে গেলে আন্টি আমাকে কেমন জানি এড়িয়ে চলে,
আনমনে হাঁটতে থাকে,
উনার ডায়বেটিস লেভেল টা অনেক হাই তাই সকাল বিকাল ডাক্তার উনাকে হাঁটতে বলেছেন,
কিন্তু উনাকে এমন উদাস দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়,
বেচারি ছেলের বউয়ের ভয়ে কারো সাথে কথা ও বলেনা।
এর মধ্যে একদিন আমাকে ডেকে তিনি দুটো কথা বলেন আর কথা গুলো এখন কারো কাছে শেয়ার করতে ও বারণ করেন,
সেইদিন আমি তার চোখে মুখে অনেক বিষন্নতা আর একাকীত্বের ছাপ দেখতে পাই,
মনে হচ্ছিল তিনি সবার সাথে থেকে ও অনেক একা,
মনে মনে ভাবি হায়রে সন্তান!
তারপর আমি কাজে রেগুলার হয়ে পরি,
আমার মাথায় সেই আন্টির খেয়াল আসেনা আর কাজের চাপে ও বুয়া আসায় ছাদে উঠা ও হয়ে উঠেনা।
তারপর কেটে যায় আরো কিছু দিন,
একদিন বাসায় ফেরার সময় দেখি বাসার গেটের সামনে একটা এ্যাম্বুলেন্স দাড়িয়ে আছে,
দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে,
দারোয়ান বলল আপনার পাশের ফ্ল্যাটে যে বয়স্ক মহিলা ছিলো তিনি মারা গেছেন তাকে গোরস্থানে গ্নিতেই এই এম্বুলেন্স,
জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিলো?
দারোয়ান বলল তারা কিছু জানেনা,
রাতে ঘুমিয়ে ছিলো দুপুর পর্যন্ত উঠেনি দেখে উনার রুমে গিয়ে দেখেন উনি আর নেই,
কথা গুলো শুনে ভিতরটা কেমন করে উঠলো,
আহ্ কি করুন মৃত্যু!
আহারে মুখটা চোখের সামনে ভাসছে,
এমন অমায়িক মানুষ খুব কম দেখা যায়।
হঠাৎ আমার তার সাথে বলা শেষ কথা গুলোর কথা মনে পরে যায়,
আমি লিফ্ট দিয়ে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে তাদের ঘরে যাই,
গিয়ে দেখি উনাকে বিদায়ের কাজ পুরোপুরি শেষ,
আমি আন্টির ছেলে কে ডেকে বলি...
ভাইয়া যদি কিছু মনে না করতেন দুটো কথা বলার ছিলো,
তিনি আমাকে বললেন বলুন কি বলবেন,
আমি বললাম আন্টি ছাদে আমাকে কিছুদিন আগে কয়টা কথা বলেছিলেন যাতে আপনাকে বলি,
উনি বললেন বলেন বলেন কি বলেছিলো আমার মা,
আমি তাকে বলি,
উনি বলেছিলে উনি মারা গেলে উনাকে যাতে উনার গ্রামের বাড়ি উনার স্বামীর কবরের পাশে মাটি দেন,
উনি বলেন ও আচ্ছা ঠিক আছে।
আর আরো একটা কথা বলেছিলেন যেটা শুনে হয়ত আপনাদের ভালো লাগবেনা,
উনি বলেন জ্বি আপনি বলুন,
আমি বললাম উনার শেষ ইচ্ছে হলো যদি আপনি মারা যান আপনাকে তার পাশে যেনো কবর দেওয়া হয়,
উনি অনেক আক্ষেপ নিয়ে বলেন,
বুকে পিঠে করে যে ছেলেকে মানুষ করেছি বড় হয়ে ছেলেটা কেমন জানি আমার বুক খালি করে আলগা হয়ে গেলো তাই বেঁচে থাকতে তো ওর ব্যস্ততার কারণে কাছে পাইনি মৃত্যুর পর আমার পাশেই যেনো ওর কবর হয়,
আমার একপাশে স্বামী আরেক পাশে সন্তান,
কথা গুলো বলতেই নিজের অজান্তেই আমি ইমোশনাল হয়ে পরি এবং আমার চোখ থেকে পানি পরতে থাকে,
খেয়াল করলাম ভাইয়ার চোখেও পানি,
কিন্তু আজ কেঁদে আর কি হবে?
মানুষ টা একবুক অভিমান নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো।
তারপর কেটে গেলো কিছুদিন,
একদিন সন্ধ্যায় আন্টির ছেলের বউ তার একমাত্র ছেলেকে খুজতে আমার বাসায় এলো,
আমার ছেলেটা উনার ছেলের দুই বছর বড়,
মাঝে মাঝেই আসে বাচ্চাটা আমার ছেলের সাথে একসাথে বসে গেমস গেলে,
কিন্তু সেইদিন আসেনি আমি তাকে জানালাম,
তিনি পাগলের মত ছেলেকে খুঁজতে থাকে,
উনি উনার বরকে কল করে আর তখন জানতে পারে অফিস থেকে ফেরার পথে গেটের সামনে ছেলে বাবাকে ধরে মার্কেটে নিয়ে যায় আইসক্রিম খাবে আর কিছু খেলনা কিনবে তাই,
উনার চোখে মুখে স্বস্তি দেখলাম যা কিছু সময় আগে ও ছিলোনা,
আমি উনাকে বসতে বলি,
উনি বসলে আমি এক গ্লাস পানি এনে দেই।
পানি খেতে বলেন,
আর একটু হলে আমার জান-ই বের হয়ে যেতো,
কি একটা অবস্থা বলুন!
এই ছেলেটা ছাড়া আমার আছে কে?
কত কষ্ট আর কত সাধনার ফল এই ছেলে,
ওর কিছু হলে আমি তো পাগল-ই হয়ে যেতাম,
আমি তার দিকো তাকিয়ে বলি একটা কথা বলি ভাবি?
উনি বলেন জ্বি বলুন,
আমি বলি সব সন্তানই মায়ের চোখের মনি বুকের মানিক হয়ে থাকে,
তবে একটা এডভাইজ দিব আপনাকে,
উনি বলেন জ্বি বলুন,
আমি তার দুটো হাত ধরে বলি...
ছেলের প্রতি আস্তে আস্তে মায়া কমিয়ে ফেলুন নয়তো পরে বেশি কষ্ট পাবেন,
উনি উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন কেনো এমন বলছেন?
আমি একটু হেসে বলি,
ছেলে বড় হবে একটা সময় বিরাট চাকরি করবে বিয়ে করবে তার নিজের সংসার হবে তখন যদি এমন মায়া বহাল রাখেন তাহলে হয়ত আপনার শাশুড়ির মত বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে একটা সময় নিরবে নিভৃতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে।
উনি আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না,
শুধু উনার চোখ থেকে টপটপ করে গাল বেয়ে পানি পরতে থাকলো।
আমি জানি এই পানি উনার অনুশোচনার পানি,
উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন,
হয়তো দেরিতে বুঝতে পেরেছেন কিন্তু বুঝেছেন এটাই সত্য।
আমরা বুঝি তবে হারিয়ে বুঝি,
এমন সময় বুঝি যখন নিজেকে শোধরানো বা যাদের সাথে অন্যায় করি তাদের কাছে ক্ষমা চাইবার রাস্তাটুকু ও ওপেন থাকেনা।
মা আসোলে মা-ই হয়,
মায়ের তুলনা কেবল মা।