13/06/2025
ইউটিউবার বনাম সাংবাদিক: পেশাদার সাংবাদিকতায় নতুন সংকট
বর্তমান যুগে সাংবাদিকতা পেশা চরম এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি এবং স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার ফলে যে কেউ এখন হাতে মোবাইল নিয়ে হয়ে উঠছে "সংবাদকর্মী"। তবে এই সুযোগ যেমন কিছু ভালো উদ্যোগের জন্ম দিয়েছে, তেমনি সাংবাদিকতার মতো একটি পেশাদার ক্ষেত্রকে টেনে নামিয়েছে অনিশ্চয়তা, অজ্ঞতা ও অশোভন প্রতিযোগিতার গহ্বরে।
কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের ছায়ায় সাংবাদিকতার পরিচয় সংকট
আজ মাঠে যেকোনো ঘটনার কভারেজ করতে গেলে পেশাদার সাংবাদিককে প্রথমেই শুনতে হয়—"ভাই, ইউটিউবার না তো?" কিংবা, ফেসবুকে কন্টেন্ট বানান? "দেখেন কিন্তু উল্টাপাল্টা কিছু ভিডিও দিয়েন না!" সাংবাদিক নাম শুনেই লোকজন যেন এখন সন্দেহের চোখে তাকায়। অথচ এই পেশাটি একসময় ছিল বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতীক। এখন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ছায়ায় প্রকৃত সাংবাদিকরাও গুলিয়ে যাচ্ছেন সাধারণের দৃষ্টিতে। এ যেন পরিচয়ের এক ভয়ংকর সংকট।
সবাই এখন ‘লাইভে’
ঘটনার স্থলে পৌঁছানোর আগেই দেখা যায়, অনেকেই ফেসবুক লাইভে ব্যস্ত। মোবাইল ধরে রাখার ভঙ্গিমা দেখে বোঝার উপায় নেই, কে কনটেন্ট ক্রিয়েটর, কে উৎসাহী দর্শক, আর কে পেশাদার সাংবাদিক। এই ‘সবাই সাংবাদিক’ ভাবনা মিডিয়া ডিসিপ্লিনকে ভেঙে দিয়েছে। অনেকে তো ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদেরকে ঢুকতে না দিয়ে নিজের মোবাইল দিয়ে ভিডিও করতে ব্যস্ত। এতে অনেক সময় প্রকৃত সাংবাদিকরা ছবি বা ভিডিও নিতেই পারেন না। এটা শুধু বিঘ্ন নয়, সাংবাদিকতার কাজকে অসম্ভব করে তোলে।
কনটেন্টের নামে অপসংস্কৃতি
শিক্ষনীয় বা ইতিবাচক কনটেন্ট এখন ব্যতিক্রম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইউটিউব বা সামাজিক মাধ্যমে যেসব ভিডিও ছড়ায়, তাতে থাকে অসুস্থ রসিকতা, গুজব, নাটকীয়তা বা হিংসাত্মক উস্কানি। কেবলমাত্র ‘ভিউস’ পাওয়ার লোভে তথ্য বিকৃত করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা একদিকে সমাজে ভুল বার্তা দেয়, অন্যদিকে সাংবাদিকতার ওপর আস্থা নষ্ট করে।
মাঠে নেই, তবু নাম সাংবাদিক
আরেক ভয়ংকর প্রবণতা হলো, তথাকথিত ‘ সাংবাদিকদের’ আগমন। এদেরকে সাংবাদিকতার মাঠে সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোনো দিন, বিশেষ অনুষ্ঠান বা ভিআইপি উপস্থিতিতে হঠাৎ করে তারা আবির্ভূত হন। নামের পাশে থাকে চটকদার মিডিয়ার পরিচয়—দৈনিক জনতার কার্টুন, আগুনের শিখা২৪ডটকম, কিংবা ন্যাশনাল এক্সপ্রেস টাইমস অনলাইন। কেউ নিজেকে ব্যুরো চিফ বলে, কেউ স্পেশাল প্রতিনিধি। অথচ সংবাদ কাঠামো, ফ্রেমিং, তথ্য যাচাইয়ের বালাই নেই। নেই শিক্ষাগত যোগ্যতা, মাঠে এসে প্রকৃত সাংবাদিকদের জায়গা দখল করে, আবার অদ্ভুত প্রশ্ন করে বিব্রত করে।
আইন ও নীতির জ্ঞানহীনতা
সাংবাদিকতা শুধু ছবি তোলা বা ভিডিও করার বিষয় নয়—এটি নৈতিকতা, নিয়মনীতি, তথ্য যাচাই ও আইনি বোধসম্পন্ন একটি পেশা। কিন্তু বর্তমানে যারা সাংবাদিকতার নাম নিচ্ছেন, তাদের অনেকেই আইন-আদালত, ব্যক্তি অধিকার, রাষ্ট্রের নীতিমালা এসব সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। ফলে ভুল তথ্য, অসংলগ্ন ভাষা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের মতো বিষয় অনায়াসে ছড়িয়ে পড়ছে মিডিয়ার মোড়কে।
গ্যাজেট হাতে, দায়িত্বহীনতা মগজে
স্মার্টফোন হাতে থাকলেই এখন নিজেকে সাংবাদিক মনে করে বসে অনেকেই। তথ্যের সত্যতা যাচাই, দুই পক্ষের বক্তব্য নেওয়া, প্রাসঙ্গিকতা বোঝা—এসবের ধার ধারছে না কেউ। ফলে সাংবাদিকতার নামে ছড়াচ্ছে অবহেলা, দায়িত্বহীনতা এবং তথ্য দূষণ।
আশরাফ আলী ফারুকী
সহ-বার্তা সম্পাদক, জাতীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা অগ্রযাত্রা থেকে সংগৃহীত