13/08/2025
ভুবনমোহন মুখার্জীর ছোট পুত্র নীলকণ্ঠ আজ দীর্ঘ পাঁচ বছর শেষে বিলেত থেকে ডাক্তারি পাস করিয়া বাড়ি ফিরিলেন।ভুবনের হাসি আর ধরিতেছে না। পুত্র বিলেত ফিরিয়া আসিয়াছে। এবার বুঝি ভাগ্যের চাকা ঘুরিবে। যেটুকু জমি থাকিবার কথা সেটুকু হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের কাছে বন্দক দেওয়া রহিয়াছে। দিবে না কেন! পুত্র বিলেত থাকার সময় তাহার জন্য অনেক টাকা খরচ হইয়াছিল। আর যেটুকু সম্বল থাকার কথা সেটুকু তাহার নিজের এই ভিটে। বৃদ্ধ মুখার্জী ভাবিয়াছিলেন ছেলে অনেক টাকা রোজগার করিবে, সকল অভাব ঘুচিবে। কিন্তু তা আর হইলো কোথায়?
নীলকন্ঠ তাহার পিতাকে সরাসরি বলিলেন, “পিতা,আমি ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখিয়াছি গ্রামের মানুষকে সাহায্য করিবো।তাই তিন রাস্তার মোড়ে একটা দোকান দেব। সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা করিব।”
ছোট মুখার্জী তার কথা মতোন কাজ করিলেন। চারিদিকে তাহার নাম ছড়িয়া পড়িল। দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসিলেন শত শত মানুষ। আর ওদিকে চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তলব দিয়া বারবার করিয়া লোক পাঠাইলেন।
একদিন বৃদ্ধ মুখার্জী গিয়াছিলেন চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ি।
চট্টোপাধ্যায় বলিলেন, "আমি আপনার জন্য কি করিতে পারি!”
“যদি আমার জমি ফেরত দিতেন, বৃদ্ধ বয়সে জমি চাষ করিয়া কিছু অর্থ উপার্জন করিতে পারিতাম। এজন্য আপনি যাহা চহিবেন আমি দিতে রাজি আছি।"
চট্টোপাধ্যায় বলিলেন, “যদি আমার মেয়ে মাধবীলতার সঙ্গে আপনার ছোট পুত্রের বিবাহ দিতে রাজি হতেন, তাহলে হয়তো চিন্তা করিয়া দেখিতাম।”
“এটা ছাড়া কি আর কোনো উপায় নেই! গিন্নির সাথে কথা বলিয়া দেখি কি মতামত দেন।”
“গিন্নি, জানো আজ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। উনি তার একমাত্র মেয়ে মাধবীলতার সাথে নীলকন্ঠের বিবাহ দিতে চাচ্ছেন।”
"কি বলিতেছো? ও মেয়ে যে মুখপুরি! বিবাহ হতে না হতেই দুইদিনের ব্যবধানে তার স্বামীর মরা মুখ দেখিয়াছে। এমন মেয়েকে আমি পুত্রবধূ করিয়া আনিব না।”
“গিন্নি, না বলিয়ো না। এছাড়া যে আর আমাদের অন্য কোনো উপায় নেই।”
সানাই-ঢোলের শব্দে মুখরিত হলো গ্রাম। চারিদিকে আলোকিত, এ যেন এক এলাহি কাণ্ড। গ্রামের কিছু লোক চুপিসারে বলিতেছে, "এমন মুখপোড়া মেয়েকে ওই মুখার্জী নিজের পুত্রবধূ করিবেন! করিতে পারেন, ছেলে বিলেত থেকে এসেছে গ্রামের সংস্কারের আদব কায়দা কিভাবে জানিবে।"
কেউ সামনে থেকে বলিবার সাহস পেলেন না। যথা নিয়মে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে সাক্ষী রেখে বিবাহ সম্পন্ন হইল।
মুখার্জী স্ত্রী বললো, "আজ থেকে মাধবীলতা চিলেকোঠার ঘরে থাকবে।”
নীলকণ্ঠ বলিলো, " মা, ওখানে কোন মানুষের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়।"
মায়ের মুখের ওপর আর বলিবার সাহস হইল না যে, "ও আমার বিবাহিত স্ত্রী। ও আমার সঙ্গেই থাকিবে।"
মুখার্জী গিন্নির কথামতো মাধবীলতার ঠাঁই হইলো ঐ ছোট চিলেকোঠার ঘরে।
এভাবে দুমাস কাটিয়া গেল। এলো মাঘ মাস। এর ভিতর একটা অঘটন হলো। মাধবীলতার শরীরে ভীষন জ্বর।দুদিন ধরিয়া খাবার মুখে তুলিতে পারিল না। কিছুই জানা হলো না ডাক্তার মুখার্জীর।জানিবেই বা কেমনে বৃদ্ধা স্ত্রী মুখার্জী বলিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। ঠিক তিনদিনের ব্যবধানে অবস্থা যখন খুব খারাপ তখন ডাক পরিলো ডাক্তার মুখার্জীর।
“মা, তুমি আগে কেন বলোনি! ওর অবস্থা এখন আমি ভালো দেখিতেছি না। ওকে এখনি কলকাতার বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হইবে।না হয়! না হয় ও আর বাঁচবে না।”
ছোট মুখার্জী গাড়ি ডাকিতে গিয়াছিল।যখন সে গাড়ি নিয়া এলো। তখন দেখিলেন মাধবীলতা আর তার ডাকে সাড়া দেয় না।বিবাহের পরে এই প্রথম মাধবীলতাকে এতো নিকট থেকে দেখিলেন।কি অপরুপা নারী,শরীরের বর্ণ কাঁচা হলুদের ন্যায়, মাথায় এক ঝাঁক কৃষ্ণ বর্ণের কেশ ,চোখ দেখিয়া মনে হইল চোখে কে যেন কাজল পড়িয়া দিয়াছিল। কল্পনাতেই হারিয়ে গিয়াছে ডাক্তার মুখার্জী। ডাক্তার মুখার্জীর চোখের পলক আর পড়িল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়া রহিলেন মাধবীলতা দিকে।চারিদিকে নীরব পরিবেশ। নীলকন্ঠের চোখের বাধঁ ভেঙ্গে অশ্রু গড়িয়া পড়িতে লাগিল।