20/09/2024
পাহাড়ে হচ্ছেটা কী?
যারা সাজানো ভিডিও দেখে আবেগ মারাচ্ছেন, তাদের জন্য আমার পাহাড়ে বেড়ে উঠার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম৷
আমার জন্ম পার্বত্য অঞ্চলের রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলায়। সে সুবাদে আমি ছোট থেকে একটা শব্দের সাথে পরিচিত ছিলাম "শান্তিবাহিনী"। মা ছোট বেলায় দূরে কোথাও যেনো না যাই সেজন্য ভয় দেখাতো "ঐ খানে শান্তিবাহিনী আসছে, যাইস নাহ।" আরেকটা শব্দ শুনতাম "শান্তি চুক্তি!" কিন্তু এসবের কিছুই বুঝতাম নাহ।
ঘটনা-০১ঃ
আমার সম্ভবত বয়স খুব হলে ৬ কিংবা ৭ বছর চলে। রাত হলে হাতি এবং শান্তিবাহিনীর ভয় পেতাম আমরা। প্রবীণরা তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতো যা থেকে একটা ভীষণ ভয় ঢুকে গিয়েছিলো। পাশের বাড়ির লোকেরা ইয়া বড় ড্রেন খুঁড়তে লাগলো। জিজ্ঞেস করতাম- কেন? কেউ কিছু বলতো না। খুঁড়তো প্রতিদিনই।
একদিন হঠাৎ করে গুলাগুলির আওয়াজ। আব্বা-মা আমাকে আর ভাইকে নিয়ে দৌড়ে চলে যায় ঐ পাশের বাড়ির গর্ত করা ড্রেনে। এক পর্যায়ে মনে পড়ে আমার বোনকে ঘরে রেখে আসছে। আবার দৌড়ে যায় মা-বাবা। এরপর আমরা শুধু এলোপাতাড়ি গুলির আওয়াজ শুনি। একটু মাথা উঁচিয়ে সবাই দেখছিলো, আমিও দেখতে লাগলাম। গুলির আগুন এর ঝাটকা বুঝা যাচ্ছে, ব্রিজের ওপার থেকে গুলি ছুড়তে থাকে অনবরত। এরপর এক পর্যায়ে তারা চলে যায়। সেই যে ভয় পেয়েছিলাম৷ তারপর থেকে দূরে কোথাও যেতাম নাহ সচরাচর৷
ঘটনা-০২ঃ
স্কুল থেকে এসে দেখি আমাদের এলাকায় খুব হৈ-হুল্লোড়। যা আমি কখনোই দেখিনি৷ সবাই বলাবলি করছে, "সাবেদ আলী রে মারছে, কী নির্মম কইরা মারছে রে"। যেহেতু আমাদের বাড়ি হয়ে পাহাড়ে যায় মানুষ ঝাড়ুর ফুল, বাঁশ কাটতে এবং সাবেদ আলীকে পাহাড়ে হত্যা করা হয়েছে; সেহেতু লাশ বাড়ির সামনে দিয়েই যাবে৷
ঘন্টাখানেক পর দেখলাম একটা বাঁশে হাত পা বেঁধে ঝুলিয়ে আনা হচ্ছে লাশ। দৌড়ে গেলাম বাজারের মাঠে। চোখেমুখে জেদ আর আতঙ্ক আমার। এতোশত মানুষের ভীড়ে কোনরকম ভেতরে ঢুকতে পারলাম৷ দেখলাম জিহ্বাটা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ গুণ বাহিরে বের হয়ে আছে! সারা শরীর সিগারেটের আগুনে পোড়া হয়েছে, চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে৷ এই দৃশ্য দেখার পর ঘুমাইনি বহু রাত৷ ভাবতাম কিভাবে যে এলাকা ছেড়ে পালাতে পারি, কিভাবে! সে বিচার আজ পর্যন্ত নিহতের স্বজনরা পায়নি৷
ঘটনা-০৩ঃ
আমি তখন আলফেসানী স্কুলে পড়ি। পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ঘরগুলো সেদিকে কাছে হওয়ায় তারা সেখানে প্রভাব বিস্তার করে। স্কুলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তারা তুলকালাম মারামারি করতো। একবার বসে আছি টিফিন টাইমে। সবগুলো পাহাড়ি এক সাথে হলো আর কি যেনো বিড়বিড় করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর তারা এক বাঙ্গালী ছেলেকে ডিরেক্ট হুমকি দিল- "তুই আজকে গেট থেকে বের হ, তোরে আজকে লাশ করবো।"
এরপর আমি যেহেতু নিজ কানে শব্দটা শুনলাম; আমি একদম শুরুর দিকে বের হয়ে গেইটের সামনে একটা সিঙ্গারার দোকান ছিলো, সেখানে বসলাম। ছেলেটা বের হতেই তাকে ১৫-২০ জন মারতে লাগলো। ভাগ্যক্রমে সেদিন কাঁঠালতলির ছেলেরা এসে ঐ ছেলেকে বাঁচিয়ে নেয়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ছেলের নাক ফেটে যায় এবং সমস্ত শরীর রক্তে লাল হয়৷
পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কি পরিমাণ সাহস হলে এরা সরাসরি সেনাবাহিনী হত্যা করে? তাহলে আপনি আমি সাধারণ মানুষ নিরাপদ কোন চিন্তায় ভাবেন? আপনি তাদের সহজেই বন্ধু বানিয়ে ফেললেও তারা আপনাকে কখনো কোন ভাবেই বন্ধু বানাবে না মন থেকে৷ উপরে উপরে খুব খাতির রাখবে৷ আপনার খুব ভালো বন্ধু। বন্ডিং ভালো কিন্তু তাদের কথাকথিত আদিবাসী দিবস এলে দেখবেন তাদের আসল রূপ৷ তাদের প্লেকার্ডগুলোতে কি লিখা হয়।
তারা সরাসরি স্লোগান দেয়- "সেনাবাহিনীর চামড়া, তুলে নিবো আমরা!" ৩ পার্বত্য অঞ্চলকে (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরান) নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। সেটার নামকরণ তারা করেও রেখেছে- "জুম্মল্যান্ড।"
পাহাড়ে নব্য মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করা ওমর ফারুককে গুলি করে মসজিদে হত্যা, কিংবা ৩৫ কাঠুরিয়া হত্যা, কিংবা সেনাবাহিনী হত্যার বিচার কই? সে নিয়ে শহরের পাব্লিকগুলোর প্লেকার্ড কই? পোস্ট কই? কিচ্ছু নেই। কিন্তু তারা বানোয়াট ইমোশনাল ভিডিও দিতেই পাব্লিক হুমড়ি খেয়ে শেয়ার দিয়ে লিখছে, "পাহাড় ভালো নেই!"
আমি বলি- "আপনার মস্তিষ্ক ভালো নেই৷ এদের সংখ্যা এখন কম নয়৷ এরা সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায়৷ তাহলে ভাবুন কি পরিমাণ অস্ত্র থাকলে এমন চিন্তা ভাবনা সম্ভব? আবেগী না হয়ে আগে জানুন পাহাড়ে কি হয় সব সময়। কেন সেনাবাহিনীর মতো এতো শক্তিশালী বাহিনীর সদস্য নিহত হচ্ছে পাহাড়ে? এদের অপকর্ম সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আবেগ না মারিয়ে ঘুমান৷ কাজে দিবে৷"
প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্প পুনরায় বহাল চাই। পাহাড়ে নিয়মিত যৌথ বাহিনীর অভিযান চালনা করে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা প্রয়োজন। নয়তো অচিরেই ৩ পার্বত্য অঞ্চলকে বাংলাদেশ বলার আর কোন উপায় থাকবে না।
#®© Asif