08/10/2025
সেক্যুলার ব্যবস্থা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মান ও মর্যাদার সুরক্ষা দিতে অক্ষম ও অনিচ্ছুক।
একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী বারবার আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ)-কে গালি দেবে, রাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় থাকবে, মুসলিমরা বিচার চাইলে তথাকথিত সুশীল সমাজ মুসলিমদের শান্ত থাকার উপদেশ দেবে, রাষ্ট্র গালিদাতাদের বিচার করার বদলে নিরাপত্তা দেবে, তারপর মুসলিমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালে তাদের মৌলবাদী, ধর্মান্ধ বলা হবে। একই চক্র।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা একই প্যাটার্ন দেখে আসছি। একশো বছরেও এ সমস্যার কোন সুরাহা হয়নি। চক্র বন্ধ হয়নি। মুখস্থ বয়ানও বদলায়নি।
সমাজ ও রাষ্ট্রে বারবার আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে আক্রমণ এবং এ নিয়ে ক্ষমতাকাঠামোর নিস্ক্রিয়তার বিষয়টি আসলে আমাদের সমাজের প্রধান দ্বন্দ্বের সাথে জড়িত। ইসলাম এবং সেক্যুলার ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব।
ব্রিটিশ রাজ থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশ আমল, আওয়ামী জাহেলিয়াত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান – সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা পরিবর্তনই তো এ লম্বা সময়ে এসেছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসেনি। কারণ ঐ দ্বন্দ্বের সুরাহা হয়নি। তাই সমাধান হয়নি এ সমস্যারও।
তাছাড়া সেক্যুলার রাষ্ট্রে মুসলিমদের আবেগ নিয়ে অস্বস্তি কাজ করে। নানা কারণে বাংলাদেশে এই অস্বস্তি আরও তীব্র। মুসলিমদের জমায়েত এখানে ভীতিকর কিছু একটা। আর জনপরিসরে ‘হুজুররা’ কোন দাবি নিয়ে আসা রাষ্ট্র এবং এলিটদের চোখে সবসময় ‘ঝুকিপূর্ণ ঘটনা’।
ওয়ার্ল্ডভিউয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও এখানে থাকে। সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিউয়ের সামগ্রিক বাস্তবায়ন ঘটে সেক্যূলার ব্যবস্থার মাধ্যমে। ইসলামের পবিত্রতার ধারনা, ইসলামের মানদণ্ডে প্রায়োরিটির হিসেব, মুসলিমদের কাছে আল্লাহ ও রাসূলুল্লাল্লাহ (ﷺ) এর অবস্থান এই ওয়ার্ল্ডভিউ বোঝে না।
এক ধরণের এপিস্টেমিক রেইসিসম কাজ করে। পশ্চিমে চিন্তা, দর্শন, মূল্যবোধ সঠিক। ইসলামেরটা ভুল। তাই মুসলিমের আবেগ, দাবি, এবং ইসলামআশ্রিত চিন্তা মানেই ভুল। কাজেই কোটি কোটি মুসলিমকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করা বাকস্বাধীনতা আর মুসলিমের কষ্ট, ক্ষোভ, প্রতিক্রিয়া মানে পশ্চাৎপদতা – এই মুখস্থ ফ্রেইমের বাইরে এধরনের রাষ্ট্র ও সমাজ যেতে পারে না।
তাই শেষ পর্যন্ত কোন সুরাহা হয় না। এধরণের সমস্যার ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক অ্যাপ্রোচে মোটা দাগে তিন ধরনের কর্মসূচী দেখা যায়।
- প্রতিবাদ, বিক্ষোভ
- বিচারের দাবি
- ব্লাসফেমি আইনের দাবি
কিন্তু দীর্ঘ প্রায় একশো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি শেষ পর্যন্ত বিচার হয় না। আইনও বানানো হয় না। আর যেসব ক্ষেত্রে আইন বানানো হয় (যেমন পাকিস্তান) সেখানে সমাধান আসে না। কারণ রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছা না থাকলে স্রেফ আইন দিয়ে কিছু হয় না।
সংস্কারের আরেকটা পথ আছে। নির্বাচনী রাজনীতি। এটা দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের পথ। আরগুমেন্ট আছে, নির্বাচন করে কিছু লোক সংসদে যাবে, সেখানে নিয়ে প্রতিবাদ করবে। অথবা কোন দল নির্বাচন করে সরকারে যাবে তারপর এই সমস্যার সমাধানে আইন বানাবে, ইত্যাদি।
বহু দশক যাবত মুসলিমদের এসব আশা আর বুলি দেখানো হয়েছে, শোনানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?
যারা নির্বাচনী রাজনীতি বাজারে ঢুকে দেখা যায় তারা এধরণের বিষয়গুলো নিয়ে পারতপক্ষে কথাই বলে না। রাজনৈতিক জোট, আসন ভাগাভাগি, নির্বাচনের প্রস্তুতি, সমালোচনা এড়িয়ে যাওয়ার মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয় নিয়ে ব্যস্ততার কারণে আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ)-এর ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত স্ট্যান্স নেয়ার সুযোগ তাদের হয় না। নিজেদের বুঝ দেয়ার নানা উপায় তারা শিখে ফেলে।
আস্তে আস্তে হবে। এক দিন ক্ষমতায় যাবো, তখন সমাধান করবো – এই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে অপেক্ষমান থাকে প্রচুর মানুষ। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়া হয় না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর পক্ষে অবস্থান নেয়ারও ফুরসত মেলে না।
কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু আজ নানা ঘরানা, নানা মাসলাকের বড় বড় দল আর বড় বড় ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে নীরবতা আর নিস্ক্রিয়তা আমরা দেখি, তার পেছনে যে এইসব হিসেবনিকেশ লুকিয়ে আছে তা কে অস্বীকার করতে পারবে?
তবে তার মানে এই না যে প্রতিবাদ বা বিক্ষোভের কোন মূল্য নেই। কোন কিছু পরিপূর্নভাবে অর্জন করতে না পারলে, সেটা পুরোপুরি ছেড়ে দেয়া যায় না।
আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)–কে আক্রমণ করার পর যেখানে কিছুই হচ্ছে না, সেখানে দুর্বলের প্রতিবাদ হিসেবে হলেও প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ করা প্রয়োজন। একেবারে কিছু না করার অপশান এখানে নেই। আমাদের ঈমান এবং আত্মপরিচয়ের মূলে যদি আঘাত করা হয়, তাহলে চুপ থাকার সুযোগ নেই।
তাই প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের প্রয়োজন আছে। এগুলোতে অংশ নেয়া জরুরী, আমি মনে করি আবশ্যক। যারা সংস্কারের পথে, যারা সেক্যুলার ব্যবস্থার ওপর এখনো ইসলামী শাসনের হুকুম লাগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য ব্লাসফেমি আইনের দাবি তোলাটাও লজিকাল। তবে বাস্তবতা স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন। আদর্শিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখা অপরিহার্য।
বাস্তবতা হল সংস্কারের কোন পদ্ধতিতে এই সমস্যার সুরাহা হবে না। সেক্যুলার রাষ্ট্র এক আধুনিক তাগুত, এবং এই ব্যবস্থা নব্য আধুনিকতার প্রায়োগিক রূপ। এই সেক্যুলার ব্যবস্থার কাছে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা নিরাপদ না।
এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া সমাধান হবে না। আরও একশো বছর, আরো দশবার করে দেশভাগ, যুদ্ধ আর গণঅভ্যূত্থান হলেও হবে না। যতোক্ষণ না ইসলাম আর সেক্যুলার ব্যবস্থার এই দ্বন্দ্বের সুরাহা হচ্ছে, এই সমস্যা চলমান থাকবে।
এই পরিবর্তন কিভাবে আসবে, তা নিয়ে আলোচনা আলাদা। সে আলোচনায় বিভিন্ন মত এবং পথের সুযোগ ও সম্ভাবনা, দুটোই আছে। তবে সেই আলোচনাতে আপনার অবস্থান যাই হোক না কেন, আধুনিক রাষ্ট্র, আমাদের বাস্তবতা এবং সংস্কারের পথ সম্পর্কে সত্যটা তাতে বদলাবে না।
Asif adnan