14/05/2023
বুঝলা বৌ যার বাড়িতে এই ইলিশ মাছটা ভাঁজতাছে, তারা খুব ভালো ইলিশ কিনছে। আজকাল ভালো ইলিশ পাওয়া যায় না। কত বাড়িতেই তো ইলিশ রানদে,কিন্তু এমন বাসনা পাই না।
ভাত খেতে খেতে আসলাম বলল কথা গুলো ওর বৌ ময়নাকে। ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে গিলছে আর চোখ বন্ধ করে ইলিশের ঘ্রান নিচ্ছে সে। আসলামের বৌ ময়না ওদের একমাত্র ছেলে সুমনের মুখে ভাতের লোকমা তুলে দেওয়ার সময় আসলামের দিকে একবার তাকাল। মানুষটা মনে হয় আলুভর্তা মাখা ভাত মুখে দিয়ে সাথে ইলিশের ঘ্রান মাখিয়ে খাচ্ছে। ময়না আনমনে একটু হেসে ফেলল। ময়নার হাসি দেখে আসলাম আবার বলতে শুরু করল
---- হাইসো না বৌ, হাইসো না। দেখছনি কেমন সুন্দর বাসনা বাইর হইছে! ছোডবেলায় বাবায় সকালে এক ইলিশ আনত আবার রাইতে একটা ইলিশ আনত। রাইতের ইলিশটারে মা'য় একটু লবন দিয়া জ্বাল দিয়া রাখত। সকালে ঘুম থেইক্যা উঠ্যাই ঠান্ডা ভাতের মধ্যে জ্বাল দেয়া মাছের ঝোল ডাইলা কাঁচা মরিচ ডইলা খাইতাম। কি যে মজা আছিলরে বৌ, তুমারে কইয়া বুঝাইতে পারুম না। দুপুর পর্যন্ত হাতের মধ্যে বাসনা লাইগ্যা থাকত। দুপুরে ইলিশ মাছের তরকারির লোভে তাড়াতাড়ি কাম শেষ কইরা বাড়ি ফিরতাম। মায় আমারে বেশি কইরা তরকারি দিত। ভাঁজা মাছটা আমি হুদাই হুদাই খাইতাম। মায় কত বকা দিত কিন্তু বাবায় আবার আমারে আলদা কইরা আরেক টুকরা ভাঁজা মাছ আগাইয়া দিতো, আমিতো একটু বেশি ইলিশ পছন্দ করতাম হের লেইগ্যা ।
---- আব্বু আমিওতো অনেক ইলিশ মাছ পছন্দ করি, তুমিতো আমারে ভাঁজা ইলিশ মাছ আগাইয়া দেও না?
কথাটা বলে সুমন আসলামের দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।
ছেলের এমন প্রশ্ন সরাসরি তীরের মতো গ্যাঁত করে বিঁধল আসলামের বুকে। আর সাথে সাথেই রক্তাক্ত হয়ে গেল পুরো ভিতরটা। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিমিষেই ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। হঠাৎ মনে হল কোন একটা বাঁধ ভেঙে পানি আসলামের চোখ দিয়ে বের হতে চাচ্ছে। খুব কষ্টে সেই বাঁধটাকে আগলে নিয়ে পানি সংবরণ করল। সুমনকে কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না আসলাম। তখন ময়নাই এমন পরিস্থিতিতে আসলামের হয়ে এগিয়ে এসে বলল
---- বাবারে ইলিশেরতো এখন অনেক দাম। এত টেকা পাইব কই তোর বাপে? আমগো যখন অনেক টেকা হইব, তখন আমরাও দিনে দুইটা কেন তিনটা ইলিশ কিনুম। তখন তুমারে আমি ভাইজা দিমু, রাইনদা দিমু, জ্বাল দিয়া দিমু। তুমি তখন মজা কইরা খাইও।
---- আমার লগে আব্বুরেও দিও, আব্বুরওতো অনেক পছন্দ, আর তুমিও খাইও আম্মু। সুমন হাসতে হাসতে বলল।
আসলাম কেমন জানি বোবা হয়ে গেল,সুমনের প্রশ্নটা মনে হয় আসলামের দুই ঠোঁটকে অসাড় করে ফেলেছে। মুখ বুঝে কোন রকম ভাতগুলো গিলে উঠে পড়ল। এর কোন কিছুই ময়নার চোখ এড়ায় না। সুমনকে খাওয়ানো শেষ করে ঘুম পারিয়ে দিয়ে ময়না আসলামের কাছে এল। ময়না যা ভাবছে তাই, আসলাম মুখটা ঘুরিয়ে শুয়ে ছিল, কাছে এসে দেখে আসলাম নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। ময়নাকে কাছে পেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো আর বলতে লাগল
---- বৌ আইজকা আমারে আমার কাছে অনেক ছোড বইলা মনে হইল, আমি আমার সুমনরে একটা ইলিশ মাছ খাওয়াইতে পারি না। আমি কেমন বাপ হইছি কও দেহি? উত্তরে ময়না একটু মুখ বাঁকালো পরে বলল
---- তুমি অনেক ভালো বাপ। শুধু ইলিশ খাওয়াইলেই কি কেউ ভালো বাপ হয়? বেক্কলের মতো কানবা না। হাতে টেকা আইলে ভাগায় পাইলে একভাগ কিইন্না আইনো। আমি ওরে ভাইজা দিমুনে।
কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল আসলাম
---- সর্বনাশা পদ্মা নদী আমগো সব কাইরা নিছে জমি জিরাত ঘর বাড়ি সব,সবকিছু। আইজ আমি বস্তহারা খাতায় নাম লিখাইছি। বাবায় জমির ফসল বেচছে, আর তা দিয়া আমগো সারাবছর খাইয়াও আরও বাড়তি রইছে, মায় কত কত বিলাইছে ধান, চাল, মরিচ, আলু। কোনদিন কিইন্যা খাইনাই। আর আইজ আমার পানিডাও কিইন্যা খাইতে হয়। ঘরের বৌও দুইডা পয়সার আশায় এইহানে ওইহানে কাম করে। আমার আর এইগুলা ভালো লাগে না। গ্যারেজে কাম কইরা যা পাই তা দিয়া ঘর ভাড়ার পর খাওন খরচের এই সংসারই চলে না। তার উপর সুমনের স্কুল খরচ।
---- সাবধান পুলার পড়ার খরচ লইয়া কোন কথা কইবা না। আমার পুলার পড়ার খরচ আগে তারপর যা থাকব তা দিয়া ডাইল ভাত খাইয়া জীবন পার করুম। ব্যাস শেষ কথা। আগে পড়ালেখা। বলে রাগ দেখাল ময়না।
-আরে বৌ চেতো ক্যা? আমার কথাডা আগে শেষও তো করতে দিলা না। আমিতো তুমার পুলার পড়ার খরচ দিমু না তা কই নাই। আমি কইতে চাইলাম যে এরপর আর কেন হাউশ মিডাইতে পারি না। পতিদিন আলুভর্তা ডাইল দিয়া পুলারে যহন খাইতে দেহি তহন বুকটায় একটা মোচর দেয়।আমি কিছু কইতে পারি না।
ময়না বুঝতে পারে আসলামের মনের কষ্টটা। কারন এই কষ্টতো তারও লাগে, ছেলেটা যখন একই খাওয়া সবদিন খেতে চায় না। তাই আসলামের দুঃখের ভারটা সে নিজেও বুঝতে পারে। তাই ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিতেই বলে
---- হইছে এহন এইসব কথার কোন কাম নাই। সকালে কামে যাওন লাগব না? এহন ঘুমাও! ঘুমাইলে কামে দিবো। হুদাই নানান প্যাঁচাল পারা শুরু করছ! বলে ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর চকিতে শরীরটা বিছাইলেই ঘুম, আর এই এক ঘুমেই সকাল।
সকালে আবার যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। রাতের গল্প আর সুমনের মনে থাকে না। যেমন চলে সারাদিন তেমন ভাবে কাটতে থাকে জীবন।
আসলাম গ্যারেজে কাজ করে খুবই নিষ্ঠার সাথে। আর তাই ওর মালিক খান সাহেব ওকে খুব পছন্দ করে। অন্য কর্মচারীগুলো মাঝে মাঝেই কাজে ফাঁকি দেয়,শুধু তাইই না ফাঁকে ঝোঁকে বাইরে কাজ বাগায় নেয় দুইপয়সা বাড়তি কামাইয়ের জন্য। কিন্তু আসলাম এই কাজটা কখনোই করে না। দুপুরে খাওয়ার সময় আসলাম খান সাহেবের থেকে একটু দূরে বসে খায়। অন্যরা হোটেলে খায়।মাঝে মাঝে খানসাহেব আসলামকে ডেকে ওকে এইটা সেইটা খেতে দেয়। আসলাম না চাইলেও পরে মালিকের সামনে আর মানা করতে পারে না।মালিকের সামনে বসেই কখনও মাছ কখনও মাংস খেতে হয়। আর মনটা সুমনের জন্য অস্থির হয়ে থাকে। এই রকমই একদিন দুপুরে খান সাহেব খেতে বসে আসলামকে ডেকে কাছে নিয়ে এলেন। হটপটগুলো খুলতেই ইলিশের ঘ্রান বেরিয়ে এল।আসলামের চোখ দুইটা চকচক করতে লাগল ইলিশ মাছের তরকারির বাটি দেখে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ছেলেটার মুখটা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। খান সাহেব খাবার নিজের প্লেটে নিয়ে আসলামের বাটিতেও একটুকরা ইলিশ মাছ তুলে দিয়ে বললেন
---নে বেটা এই মাছটা খাইয়া দেখ, কত মজা কইরা রানছে। একেবারে পদ্মার ইলিশ। ছোট একটা ডিম হইছে,তারপরও তেল আছে মাছের । বলে নিজের প্লেটের মাছ খেতে লাগলেন। কিন্তু আসলাম কলমি শাক দিয়েই পুরো ভাত খেতে লাগল। মাছটাকে কোন রকম স্পর্শ করতে ও মন চাইল না। মাছটা নাড়াচাড়া করতে যেয়ে যদি ভেঙে যায়,সেই ভয়ে মাছটাকে সাইডে বাঁচিয়ে রেখে ভাত খেয়ে উঠল। খান সাহেব নিজের খাবার শেষ করে বললেন
---- কিরে বেটা তুইতো মাছটা ধরছই নাই? এমনে এমনেই খাইয়া উঠলি। জবাবে আসলাম শুধু বলল
---- ঘ্রানেই মনটা ভইরা গেছে স্যার,খামু পরে খামু । বলে এটো বাটিগুলো নিয়ে উঠে কলপারে চলে গেল।
আসলাম একটা খবরের কাগজের মধ্যে ইলিশের টুকরাটা খুবই যত্ন করে উঠিয়ে রাখল। পরে এটো বাটিগুলা ধুয়েমুছে তার মধ্যে আবার মাছটা যত্ন করে রাখল। দূর থেকে খান সাহেব সব'ই লক্ষ্য করলেন কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না।
আসলামের চোখে মুখে এক অন্য রকম আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে, মনের মধ্যে এখন শুধু প্রহর গননা শুরু হয়েছে কখন ও ঘরে ফিরবে আর ওর ছেলেকে এই মাছ দিয়ে ভাত খেতে দেখবে।কাজের ফাঁকে ফাঁকে কতবার যে বাটিটার দিকে তাকাল তা শুধু ও জানে আর জানে ওর আল্লাহ।
রাতে ঘরে ফিরে আসলাম জলদি করে বাটিটা ময়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
--- বৌ এইডা ধর, এইখানে এক টুকরা ইলিশ মাছ আছে,পুলাডারে দেও খাইতে। ময়না ইলিশের কথা শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেল
--- ইলিশ মাছ পাইলা কই?
ময়নার প্রশ্নে আসলাম বলে
--- মালিকে দুপুরে খাওনের সময় আমারে দিছিল,পুলার মুখটা মনে পড়ায় আমি আর খাইতে পারি নাই। তুমি এইডা ওরে দেও, ও অনেক খুশি হইয়া খাইব। আমার তহন ওর মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগব।
বলেই খুশিতে দাত কেলিয়ে হাসতে লাগল। কিন্তু ময়নার চোখে মুখে সন্দেহের ছাপ দেখে আসলাম আবার জিজ্ঞেস করল
---- কি হইছেরে বৌ? মুখটা এমন করছোস ক্যা?
বাটির ডাকনা খুলে ময়না আগে মাছের ঘ্রান নিতে নাক লাগাতে গিয়ে বলল
---- কোন কালে রানছে মাছ, আল্লায় জানে মাছটা ঠিক আছে না নষ্ট হইয়া গেছে? যহন দিছে তহনই খাইয়া নিতা।
বলে আবার মাছটা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকতে লাগল।
-বৌ যে কি কও? পুলাডারে থুইয়া এই মাছ কি আমার গলা দিয়া নামতো? রিজিকের মালিক আল্লাহ! দেহ আবার দেহ! মনে হয় নষ্ট হয় নাই।দুপুর কালেতো মাছটা গরমই আছিল। বলে আসলাম আশা ভরা চোখ নিয়ে ময়নার দিকে তাকাল।
--- মনে হয় মাছটা নষ্ট হয় নাই, কোন খারাপ গন্ধ পাইতাছি না।
ময়নার কথা শেষ না হইতেই পিছন থেকে সুমন বলে উঠলো
---- পঁচা হইলেও আমি আইজকা ইলিশ মাছ দিয়াই ভাত খামু। আম্মু তুমি দাওতো আমারে, দেইখো আমার কিচ্ছু হইব না। বলেই সুমন ভাত খাওয়ার জন্য আরাম করে বসে পড়ল। ময়নাও ভাতের হাড়ি নিয়া ভাত বাড়ার জন্য বসল আর আসলাম কে বলল
--- তোমার লেইগ্যা বালতিতে পানি রাখছি যাও হাতমুখ ধুইয়া আসো একলগে বইসা খাও বাপ পুলায়।( বলে হাসতে হাসতে ভাত বাড়তে লাগল আর সুমনের উদ্দেশ্যে বলল) আজকে আমার বাপে ইলিশ দিয়া ভাত খাইব।
সুমনও খুব খুশি,ওর চোখমুখ আনন্দে চকচক করছে। আসলাম হাতমুখ ধুয়ে এসে খাবারের জন্য বসল। দেখে ছেলে তার নিজ হাতে মাছ বেছে ভাত খাচ্ছে। আসলাম একটা হাসি দিয়ে বলল
--- কি গো বৌ, পুলায় যে আইজকা নিজের হাতে ভাত খায়? আইজকা আর ঘুমে ঝুইম্মা পড়ে না ক্যা?
ময়নাও ছেলের খুশিতে খুব খুশি হয়ে হাসতে হাসতে বলল
--- না আইজকা তার মাছ সে কাউরে ধরতে দিব না। নিজে নিজেই খাইব। আর ঘুম? তারেতো ইলিশ মাছ খাইয়া ফেলছে।বলে জোরে হাসতে লাগল।
আসলামের কেন জানি চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কোন ভাবেই আটকে রাখতে পারছে না।আসলামের পাশে বসে ময়নারও চোখ ছলছল হয়ে উঠল। সুমনতা খেয়ালই করল না। মনযোগ দিয়ে মাছটা বেছে পুরোটা খেয়ে নিল।খাওয়ার পর আর সুমন হাত ধুতে রাজি হয় না। তাতে হাত হতে মাছের গন্ধ চলে যাবে। বার বার ময়নাকে বলতে লাগল আম্মু হাতটা আজকে নাই ধুই সকালে পানি ভাতে হাতটা ভিজাইয়া ইলিশের ঘ্রানে ভাত খামু। ময়না আর ওর সাথে এই নিয়ে আর কোন কথা বলে না। সুমন ঘুমায় গেলে পরে ওর হাতটা সযতনে ধুয়ে দেয় ওর মা। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন ওর হাত পরিস্কার দেখল তখনই কাঁদতে শুরু করে দিল। স্কুলেও যাবে না জানিয়ে দিল ময়না আর আসলাম কে। শেষ পর্যন্ত ওকে ঠান্ডা করার জন্য ময়না বলল "কি করলে তুই স্কুলে যাবি আর কান্দন থামাবি?" তখন সুমন জোড়াল দাবি করল যে ওকে ইলিশ মাছ কিনে দিতে হবে।ছেলের এমন আবদারে আসলাম মায়না দুইজনই থমকে গেল। কি জবাব দিবে ভাবতে ভাবতেই ময়না বলে উঠলো "আচ্ছা বাপ তুমি যদি ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হও তাইলে তুমারে ইলিশ মাছ দিয়া ভাত খাওয়ামু।" সুমনতো মহাখুশি,কারন ও জানে ও এইবারও ফার্স্ট হতে পারবে।সেই খুশিতে বই খাতা নিয়া স্কুলে চলে গেল। কিন্তু আসলাম মনে মনে এক বিরাট দুঃশ্চিন্তায় পড়ল একটা ছোট ইলিশের দাম আট নয়শো টাকা, এতটাকা একদিনে খাইলে সারা মাস চলব কেমনে? নিজের চিন্তা নিজের মনে নিয়েই ঘর থেকে বাহির হয়ে গেল। ময়না আসলামের থম থমে চেহারা দেখে সবই বুঝতে পারে। কিন্তু ছেলেরে আর কি বলে ঠান্ডা করা যেত তা ওর জানা ছিল না।
ওইদিনের পর আসলাম অনেক রাত পর্যন্ত ওভার টাইম করে। দশটাকা বিশ টাকা করে প্রতিদিন জমাইতে থাকে। এদিকে ময়নাও বস্তিতে টুপি বানানোর কাজ শিখে নিয়ে দিনেরাতে মিলিয়ে একটা কোনদিন আবার দুইটাও বানিয়ে দেয়।এইভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে ওদের সংগ্রাম।এরই মধ্যে সুমনের হঠাৎ করে খুব জ্বর উঠে। ফার্মেসীর ঔষধেও জ্বর কমে না। তিনদিনের দিন ফার্মেসীর মামায় ময়নাকে বলে দিল "এমনে ঔষধ না খাওয়াইয়া ডাক্তার দেখাইয়া ঔষধ খাওয়া। " আসলাম আর দেরি করে না ছেলেরে কোলে নিয়ে দৌড়ে হাসপাতালে নিয়ে আসে। জ্বরের ঘোরে সুমন বার বার বলতে লাগল
---- ও আম্মু আমি যদি পরীক্ষা না দিতে পারি তাইলেতো আর ফার্স্ট হইতে পারুম না। তাইলেতো তুমি আমারে ইলিশ মাছ দিয়া ভাত খাওয়াইবা না। ময়নার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে। আর বলে
---- বাপ তুই আগে ভালো হ, পরে তোরে ইলিশ দিয়া ভাত খাওয়ামু। এক রকম যুদ্ধ চলল হাসপাতসলে সাতদিন। নানান পরীক্ষা নিরিক্ষা চলল সুমনের উপর। এক একটা ইনজেকশন আর ঔষধের দাম মিটাতে মিটাতে একেবারে শূন্য হয়ে গেল ওদের দুজনেরই হাত। তারপরও ওদের শান্তি যে ছেলে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এল।
এইবার আর সুমন সত্যি সত্যিই ফার্স্ট হতে পারল না। অনেকদিন পড়াশোনা ঠিক মতো করতে না পারায় ওর রোল হয়ে গেল তিন। স্কুলে বসেই সুমন কাঁদতে লাগল। স্কুলের আপা স্যাররা ওকে অনেক বোঝাল এই বার না পারছো তাতে কি সামনে আবার ফার্স্ট হয়ে যাবা। ময়না আর আসলাম ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল
---- বাপ তুমি যে সুস্থ হয়ে আবার আমাগো বুকে আসছো তাতেই আমরা অনেক খুশি। ফার্স্ট দিয়া আমরা কি করুম?
সবার কথাই সুমন শুনছে, কিন্তু সুমনের মনের কথাটা আর কেউ শুনতে পারছে না। ওর মনের মধ্যে শুধু ঘুরছে একই কথা "আমার আর ইলিশ মাছ খাওয়া হল না।"
কয়েকদিন পর গ্যারেজের মালিক খান সাহেব এক সাথে বিশটা ইলিশ কিনলেন। ওইখান থেকে একটা ইলিশ মাছ আসলামের হাতে দিয়ে বললেন
-যা বেটা এইডা বৌরে দিয়া আয়। তাজা তাজা রানলে খাইতে মজা পাবি। যা যা জলদি যা। আসলাম কি করবে বুঝতে পারল না। অনেকক্ষণ তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল শুধু,তাকে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে বলে মনে হতে লাগল। খান সাহেব তখন বললেন
--- যেদিন তুই ইলিশ মাছটা না খাইয়া রাইখা দিছিলি সেই দিনই বুঝছি তুই তোর পুলারে না দিয়া খাইতে পারলি না। এরপারে তুই রাইত জাইগা কাম করছস দুইডা পয়সা এক করছস তাও আমি জানি। তোর পুলার চিকিৎসায় হেই টেকা শেষ হইছে। তাও আমার কাছে টেকা চাস নাই। তুই চাওইন্যা মানুষ না,তুই খাটইন্যা বেটা। তুই আমার মনডা জিত্তা নিছোসরে বেটা জিত্তা নিছস। এই মাছটা আমি তোরে এমনে এমনে না, এইডা তোরে আমি পুরস্কার দিলাম এহন তুই এইডা নিয়া যা বৌ পুলাপানরে নিয়া খা।
আসলাম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না মালিকরে লম্বা একটা সালাম দিয়ে দৌড়ে ঘরে ফিরে আসে।আসলামের হাতে এত বড় একটা ইলিশ মাছ দেখে সুমন খুশিতে চিৎকার করে উঠে। আর বলে
- আব্বু আমিতো ফার্স্ট হই নাই,তারপরও তুমি আমার লেইগ্যা ইলিশ মাছ আনছ?
আসলাম কি বলবে বুঝতে পারে না শুধু বলে
- হ বাবা আনছি, আজকে আমরা ইলিশ দিয়া ভাত খামু। ও বৌ এই মাছটা আইজকা তিন টুকরা ভাঁজবা, তিন টুকরা আলু দিয়া তরকারি রানবা আর বাকি মাছ লবন দিয়া জ্বাল দিবা সকালে আমরা ঠান্ডা ভাত দিয়া খামু। ময়না ওদের বাপ ছেলের খুশি দেখে নিজের চোখ সরায় নেয় নজর লাগার ভয়ে। মাছটা কাটতে কাটতে ময়না খেয়াল করল এত আনন্দের মাঝেও ওর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে ওর হাতের উপর।
©সায়লা সুলতানা লাকি