18/10/2025
একজন কালজয়ী পুরুষ
লালন ফকির:
-----------------হাফিজ সরকার
(১)
লালন ফকির ইংরেজি ১৮৯০ তৎকালীন বাংলা ১২৯৭ সালের ১লা কার্তিক কুমারখালি উপজেলার ছেঁউডিয়া গ্রামে তাঁর আখড়া বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। আজকের দিন ধরলে তিনি ১৩৫ বৎসর আগে দেহত্যাগ করেছিলেন। কোন সালে তাঁর জন্য হয়েছিল এ সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট তারিখের সন্ধান আমরা পাইনি। তবে লোকমুখে জানা যায় তিনি ১১৬ বৎসর বেঁচে ছিলেন। এ হিসাব ধরলে ১৭৭৪ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং তিনি ২৫১ বৎসর আগে জন্ম নিয়েছিলেন।
প্রকৃতঅর্থে, লালন ফকির ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভাধর সাধক। একবিংশ শশতাব্দীর বিজ্ঞানময় সভ্যতার কালে এই লোককবির গান বিজ্ঞানমুখি জনগণের মধ্যে লোকজ্ঞান যাকে ইংরেজিতে Folk wisdom বা Folklore বলা হয়, যা অবিস্মরণীয় বিকীরণ ছড়াচ্ছে। আমরা অবাক বিস্ময়ে তাঁর গান শুনছি এবং অভিভূত হচ্ছি। তাঁর গানের বাণী আজ পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানধর্মী মানুষের মধ্যে এ পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি কুশলতা সম্পর্কে অজানা তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়ে এসছে। আমরা কেবলই অবাক হচ্ছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী লালনের গান মনুষকে অবাক করে যাবে।
এখানে লালনের গানের কয়েকটি বাণীর উল্লেখ করতে চাই।
১। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়
২। আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
৩। বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা এক পড়শী বসত করে।
৪। কে কথা কয় রে দেখা দেয় না নড়ে চড়ে ঈষাণ কোনে খুঁজলে জনমভোর মেলে না।
৫। লীলা দেখে লাগে ভয় নৌকার উপর গঙ্গা বোঝায়, ও গঙ্গা ডাঙ্গা বয়ে যায়।
৬। সোনার মানুষ ভাসছে রসে যে হয়েছে রসপন্থি সে জেনেছে অনায়াসে
এমন অসংখ্য গান নিত্যদিন শুনছি বাউল ফকিরদের কন্ঠে আর অবাক বিষ্ময়ে হতবাক হচ্ছি। আমার মনে পড়ে কুষ্টিয়া শহরতলীর মঙ্গল বাড়িয়ান রিকসা চালক হারান ফকির আমাকে রিকসা করে শহরতলীতে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবার পথে গুনগুনিয়ে 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি' গান শুনয়েছিলেন আজকের দিনের মতো শহর এবং শহরতলীতে এত লোকসমাগম ছিল না। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল, বাতাসে ছিল রোমান্টিকতার আবেশ। হারান ফকির গান গেয়ে চললেন একটা, দুইটা, তিনটা। আমার বাসা পর্যন্ত সে সময় রিকসার ভাড় ছিল ১ টাকা আনা। এক সের চালের দাম ছিল ১ টাকা। হারান ফকির অর্থের কথা চিন্তা করলেন না, সময়ের কথা ভাবলেন না, গান গেয়ে চলেন এক অসাধারণ যাদু ছড়ানো কণ্ঠে। আমার বাসার কাছে এসে বলেন, 'আপনাকে আরো দুটা গান শুনাই।'
সেদিন শুধু অবাক নয়, গানে আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম আমি। আমার মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। পরের দিন বন্ধুদের নিকট এই গানের কথা বললে আমি জানতে পারলাম লালন ফকিরের কথা এবং ছেঁউডিয়াতে তাঁর আগড়া। আমার হান আছে সেদিন অনেকটা পাগলপ্রায় হয়ে ছেঁউডিয়ার আগড়ায় এসেছিলাম।
সেদিনও ছিল এমনি চাঁদরাত্রি এবং মায়াভরা সন্ধ্যা। সেই থেকে লালন ফকির এবং তাঁর গান নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করি। 'বাউল কবি লালন শাহ' নামে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় আমার একটি লেখা ছাপা হয়।
কী আছে লালনের গানে? কিসের জন্যে আজ এখানে লক্ষ মানুষের ভিড়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসছেন গবেষক, চিত্রনির্মাতা, সংগীত বিশেষজ্ঞ।
আমার জানামতে জার্মান গবেষক উনিয়াস, লন্ডনের স্যাম লেন্ডেল মিলস, আমেরিকার ক্যারোল সলোমন, পশ্চিম বাংলা থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ও লোকবিজ্ঞানের জনক প্রফেসর আশুতোষ আচার্য, প্রফেসর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধায়, বাউল সংগীতশিল্পী পূর্ণদাস বাউল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, বালকৃষ্ণ মেনন, গৌরী ভট্টাচার্য অধ্যাপক সনৎ কুমার মিত্র, অধ্যাপক তুষার চট্টোপাধ্যায়, ড. দুলাল চৌধুরী ও বাংলাদেশের প্রফেসর মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, প্রফেসর মাজহারুল ইসলাম, প্রফেসর আশরাফ সিদ্দিকী এখানে এসেছেন। প্রতিবারই লালন একাডেমিতে এমন দিনে বিশ্বের সুধীজন এসেছেন এবং সম্মোহিত হয়ে ফিরে গেছেন। আমি এমন কয়েকজনের কথা জানি, তাদের জীবনধারাও পাল্টে গেছে। হার্ভার্ড এর এডওয়ার্ড সি ডিমণ (জুনিয়র) সম্বন্ধে জানতে পারি। লালন ফকির এবং বাউলদের নিয়ে অসাধারন গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর The Hidden Moon একটি বিস্ময়কর যান সে সময়ে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। ক্রমান্বয়ে জার্মানির কলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ কনার্ড, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়র। ও কোনেল, গবেষক চার্লস ক্যাপওয়েল প্রমুখদের সাথে পরিচয় ও গনিউজ হয়েছিল। এরা বাউলগান নিয়ে গবেষণা করেন। চার্লস ক্যাপওয়েলের The Music of the Bauls of Bengal জুলি ম্যাকডানিয়েলের The Ecstasy Baul music অসাধারণ গ্রন্থ।
এমনিভাবে পথিবীর মানুষ পাগলের মতো লালনের গান শুনতে এসেছে এখানে বলা প্রয়োজন যে লালন ফকিরের গান মূলতঃ সুফী বাউল সুফী বলতে আমরা বুঝি 'সর্বধর্মসমন্বিত' সাধন সম্প্রদায়। ইংরেজিতে 'Syncretistic religion' বলা হয়। এই সুফী সম্প্রদায়ে উৎপত্তি হয়েছিল শতকের শেষদিকে, কারো মতো নবম শতকে। এঁদের একদল ছিল মরমীবাদি বা Mystic। আধ্যাত্ম সাধনাই ছিল এদের মুখ্য। এরা স্রষ্টাকে মরমে ধারণ করতে চেয়েছে তাঁকে বন্ধুর মতো দেখতে চেয়েছে। এরা স্রষ্টার প্রতি নিজেকে আশিক বা ভক্ত বন্ধু হিসেবে ভেবেছে এবং স্রষ্টাকে করেছে নিজের ভালবাসায় আরাধ্য বা 'মাশুক'। বলা যেতে পারে ভারতীয় ভক্তিদর্শনে যেমন 'দেবতাকে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা'। এখানে উল্লেখ করা সংগত যে পারস্যে বা ইরানে ইসলাম প্রচারের আগে নানা ধর্মের প্রচার ও প্রসার হয়েছিল। এদের মধ্যে 'জরথুস্ত' বাদি নামে একটি সম্প্রদায় ছিল। চীনদেশের 'তাও' মতবাদ এই ধর্মকে প্রভবিত করেছিল। খ্রিষ্ট্রের মৃত্যুর পূর্বে আর্য বা Aryans নামে একটি দল জর্মান দেশ থেকে মধ্য এশিয়া বা পারস্যে এসেছিল এবং সে দেশ তাঁরা দখল করে নেয়।এরা এসেছিল Scandinavian দেশ থেকে। যা হোক, মধ্য এশিয়া বা পরা যারা এসেছিল এরা Vede বা বেদ নামে একটি ধর্মগ্রন্থ নিয়ে আসে। এই আর্য্যরা পরবর্তীকালে সিন্দুদেশ জয় করে সমগ্র ভারতবর্ষকে দখল করে ফেলে। এই বেদের একটি বড় অংশ উপনিষদ। সুফী ধর্মের সঙ্গে উপনিষদের ভাবধারার মিল রয়েছে। বাউল মতবাদে সন্ন্যাস ভাবনাও প্রবল।উল্লেখ্য, দীক্ষিত বাউলেরা সংসারধর্ম পালন তথা সন্তান জন্মদান ইত্যাদি করতে পারে না। তবে এই সন্ন্যাস ধর্ম শুরু হবার অনেক আগে বা'আল ধর্মের উদ্ভব হয়। (চলবে)..C.P..