
20/08/2025
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব বাহিনী মিলে আত্মসমর্পন করেছে ৬০০০০ এর কাছাকাছি সেনা ও কর্মকর্তা। ৯৩০০০ হলে বলে যে সংখ্যা আমরা শুনতে পাই তা হলো সেনাবাহিনীর পরিবার পরিজন ও পশ্চিম পাকিস্তানী সাধারণ জনগণসহ। যাই হোক বাংলাদেশ সরকার যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে তখন স্পেসেফিক নাম দেওয়ার প্রয়োজন হয়। প্রথমে পাক সেনাবাহিনীর ৫০০০ এরও বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। যুদ্ধাপরাধ মানে বেসামরিক মানুষ হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ। এরপর যাচাই বাছাই করে বাংলাদেশ সরকার এই তালিকা আরো ছোট করে প্রায় ১২০০ জনের তালিকা প্রস্তুত করে। এরপর যখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করার প্রয়োজন হয় তখন বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতে সক্ষম হয়। এই ১৯৫ জনকে বিচারের আওতায় আনার কথা ছিল। এই ১৯৫ জনের মধ্যে শতাধিক ছিল সিনিয়র অফিসার যাদেরকে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাহলে কি মাত্র ৪৫ জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছে? কী হাস্যকর!! এই ১৯৫ জনকে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় 'শিমলা চুক্তি'র মাধ্যমে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তাহলে এবার বলা যেতে পারে পাকিস্তানীরা নয়, বাঙালিদের মেরেছে ও ধর্ষণ করেছে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালিরা। সেই চিত্রটাও আমরা একটু দেখে নিতে পারি। এদেশীয় জনগণ যারা স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী দালাল আইন প্রণয়নের পর ৬ ফেব্রুয়ারী, ১ জুন ও ২৯ আগস্ট তারিখে তিন দফা সংশোধনীর পর আইনটি চূড়ান্ত হয়।
এ আইনের অধীনে প্রায় একলাখ লোককে আটক করা হয়। এদের মধ্যে থেকে অভিযোগ আনা সম্ভব হয় ৩৭৪৭১ জনের বিরুদ্ধে। বাকীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয়। অভিযুক্ত ৩৭৪৭১ জনের মধ্যে থেকে দালালী বা অপরাধের কোন প্রকার প্রমাণ না পাওয়ায় ৩৪৬২৩ জনের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করাই সম্ভব হয়নি। সারাদেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ২২ মাসে বাকি ২৮৪৮ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়।
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ৩৭ হাজারের অধিক ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় হয়, ‘যারা বর্ণিত আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তারা কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন।’
যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের বিচার হয়। তাদের মধ্যে বিচারে মাত্র ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। বাকী ২০৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়। যে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও গুরুদন্ড দেয়ার মতো ছিল না। একজনের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি। শুধুমাত্র চিকন আলী নামের একজনকে হত্যার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তাহলে সে আবার আগের প্রশ্ন এত হত্যা কে করলো? এত ধর্ষণ কে করলো?
এই ১৯৫ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হত্যার নির্দেশের জন্য অভিযুক্ত অর্থাৎ তারা যুদ্ধ করেননি বা সরাসরি অভিযানে যাননি। তাহলে কারা তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলো? অথবা কারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলো? ১০০ জনের কম মানুষ কীভাবে লাখ লাখ মানুষকে খুন করলো? এবার আসুন ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে কথা হোক। ১৯৫ জনের মধ্যে মাত্র ১৩ জনের বিরুদ্ধে মহিলাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আসলো! তাহলে কী এই ১৩ জনই ৩ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করলো! আবার খেয়াল করুন এই ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে মাত্র। প্রমাণিত নয়। যদি অভিযোগ সত্যও প্রমাণিত হয় তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা অনধিক ২০। এখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, কোনো স্থানে ধর্ষণ হয়েছে কিন্তু শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ পাকিস্তান বাহিনীর সব সদস্যকেই বাঙালি সৈনিকরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তারা চিনতো। একই ক্যান্টনমেন্টেই তারা থাকতো।
১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকার শহীদ পরিবারকে প্রতিজন শহীদের বিপরীতে ২০০০ (দু’হাজার) টাকা করে অনুদান দেয়ার ঘোষণা করে। সারাদেশ থেকে প্রায় ৭২০০০ আবেদন জমা পড়ে। যাচাই বাছাই করে দেখা যায় এর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার হলো স্বাধীনতাবিরোধী যারা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হন। পরবর্তীতে রাজাকারদের নাম বাদ দিয়ে করে মোটামুটি ৫০০০০ নিহত ব্যক্তির জন্য তাদের পরিবারকে ২০০০ (দু'হাজার) টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। এই তথ্যকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব স্ট্রাট্রেজিক স্ট্যাডিজের ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসের জার্নালে বলা হয়েছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের মেয়াদ ছিল ৮ মাস ৩ দিন । এ যুদ্ধে নিহত হয় ৫০ হাজার মানুষ।
যুদ্ধে পাকিস্তান সামরিকবাহিনীর প্রায় ৪৫০০ সদস্য নিহত ও প্রায় ৮০০০ জন আহত হয়েছেন। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ১৪২১ সদস্য নিহত ও ৪০৫৮ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশে একাত্তরে যত নারী-ধর্ষণ হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী হয়েছে সত্যকে ধর্ষণ। গবেষক শর্মিলা বসু তেমনটাই মনে করেন। ১৯৭১ সালের ধর্ষণ নিয়ে শর্মিলা বসু তার নিজের গবেষণায় যে উপসংহারটি টেনেছেন তা হলো, “একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় আমি দেখলাম, বাংলাদেশী অংশগ্রহণকারীগণ এবং যারা ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তারা যুদ্ধের বর্ণনা দিল। গুলি করে হত্যার বর্ণনাও দিল। কিন্তু তারা আমাকে এ কথাও বললো, “আর্মি মহিলাদের কোনো ক্ষতি করেনি। তবে যদি কেউ দুর্ভাগ্যক্রমে ক্রস ফায়ারে পড়ে যায় তবে অন্যকথা। একাত্তরে ধর্ষণের যে বিশাল সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছিল সে প্রেক্ষিতে এটি আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। আমার কেস স্টাডিজে আমি একটি মাত্র ঘটনারও প্রমাণ পেলাম না।
বাংলাদেশে যতগুলো বধ্যভূমির কথা যা বলা হয়েছে তার দিকে যদি আমরা নজর করি তাহলে দেখতে সবগুলো বধ্যভূমি ছিল ভারত থেকে আসা বিহারের মজলুম মুহাজিরদের আবাসস্থলে বা তার কাছাকাছি। বলা যায় এপ্রিল ও মার্চে বিহারীদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞই বধ্যভূমির কারণ। যেগুলো এখন বাঙালি হত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
১৯৭০ সনের নির্বাচনের পরপরই বিহারিরা নির্যাতিত হতে শুরু করে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাসরত বিহারিরা দলবদ্ধভাবে থাকা শুরু করে। তারপরও তারা নিজেদেরকে বা পরিবারের সদস্যদেরকে রক্ষা করতে পারেননি। স্কুল-কলেজ ও কর্মস্থলে যাতায়াতকালে তাদের উপর আক্রমণ হতে শুরু হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, লালমনিরহাট, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য স্থানে ১ মার্চ ১৯৭১ তারিখ হতেই বিহারি ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের ওপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ও নিউক্লিয়াস। ১৯৭১ সনের ঘটনার ওপর পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এসব ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার উল্লেখ করা হয়।
- বঙ্গকথা ৫২৭ - ৫৩৯