03/08/2025
নির্বাক সম্পর্ক
মায়ের চাপে এক বিধবা নারীকে বিয়ে করতে বাধ্য হলাম। নারী নয়, বয়সে সে আসলে আমার চেয়েও এক-দু বছর ছোট—তবু তার এক বছরের একটি মেয়ে রয়েছে।
বিয়ে নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না আমার। তার চেয়েও বেশি, বিধবা কেউকে বিয়ে করে জীবন শুরু করা আমার কাছে ছিল অপছন্দনীয়। তবে মা–তার দীর্ঘদিনের বান্ধবীর মেয়ের জন্য এমনভাবে অনুরোধ করল যে, না বলতে পারিনি। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বিয়ের আসরে বসতে হলো।
আজ আমার বাসর রাত।
ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল—ফুলে সাজানো বিছানায় লাল শাড়ি পরা এক মেয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। দেখতে অপূর্ব, কিন্তু মন ভরা আমার রাগ আর বিরক্তি। তার শিশু কন্যার কথাই মাথায় ঘুরছিল।
রাগ চেপে রাখতে পারলাম না। মাথার পাগড়ি ছুড়ে মারলাম বিছানায়।
সে চমকে উঠল। আমি গলা শক্ত করে বললাম, “শুনুন, আমি আপনাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারছি না। এই বিয়ে শুধু মায়ের অনুরোধে, এর বেশি কিছু না। আপনার কাছাকাছি আসার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই, আর আপনার মেয়েকে আমার থেকে দূরে রাখবেন। কোনো দাম্পত্য অধিকার দাবি করবেন না—প্লিজ।”
দরজা ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলাম।
রাতটা ছাদে কাটালাম। উপরে রুপোর মতো উজ্জ্বল চাঁদ—তবু কেন যেন মন বিষণ্ন। মনে হচ্ছে, আমার জীবনটাই যেন শেষ হয়ে গেল। বিধবার সঙ্গে বিয়ে? নিজের জীবন নিয়ে একধরনের ঘেন্না কাজ করছিল।
পরদিন থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
সে নীরবে ঘরের সব কাজ করে। মাথা নিচু, কোনো অভিযোগ নেই। আমি সারা দিন বাইরে বাইরে থাকি।
তার ছোট্ট মেয়েটা হামাগুড়ি দিতে দিতে বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। যখন আমি ফিরি, সে ছোট্ট হাত বাড়িয়ে আমার দিকে তাকায়। তবু আমি তাকে দেখে বিরক্ত হই—কোনো সাড়া না দিয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে যাই।
খাবার সময় আয়েশা—আমার স্ত্রী—নীরবে প্লেট দিয়ে যায়, কখনও চোখ তুলে তাকায় না। আমিও কিছু না বলে খেয়ে নিই। ওদের আলাদা রুম, আমার আলাদা।
একদিন সন্ধ্যায় ফিরে দেখি আমার রুম লণ্ডভণ্ড। মেজাজ গরম হয়ে গেল। আমি চিৎকার করে উঠলাম,
“আয়েশা!”
সে দৌড়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়ায়, চোখে জল টলমল করছে।
“কি হয়েছে?”—সে জিজ্ঞেস করে।
আমি রেগে বলি,
“এই কী অবস্থা? নিশ্চয়ই আপনার মেয়ের কাজ। কতবার বলেছি, তাকে আমার রুমে আসতে দেবেন না!”
কথা শুনে সে হঠাৎ আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“দয়া করে, প্লিজ… ক্ষমা করে দিন। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না।”
তার চোখের পানি আমার পায়ে ঝরছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ওর কষ্টটা বুঝি একটু ছুঁয়ে গেল আমাকে। কিন্তু অভিমানী মন বলল—না, এসব আবেগ আমাকে নরম করতে পারবে না।
ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম।
রাত গভীরে ফিরলাম। রুমে ঢুকে দেখি—ঘরটি নতুন করে সাজানো, গোছানো, পরিচ্ছন্ন। আগের চেয়েও সুন্দর।
মনটা একটু হালকা লাগল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাতি নিভিয়ে চোখ বন্ধ করতেই পাশের ঘর থেকে ভেসে এলো কান্নার মৃদু শব্দ।
আয়েশা কাঁদছে। নিঃশব্দে।
কিন্তু আমি চোখ খুললাম না।
হয়তো নতুন এক সম্পর্ক গড়ে ওঠার শুরু এভাবেই হয়—নীরব অভিমান আর কান্নার মাঝ দিয়ে।
চলবে…