পরিলেখ প্রকাশনী

পরিলেখ প্রকাশনী বাংলা প্রকাশনার জগতে অনন্য প্রতিষ্ঠা

15/02/2025

আমার শাশুড়ি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ডক্টর আব্দুর রহীম খোন্দকার (মরহুম) এর স্ত্রী মিসেস মারজিনা বেগম আজ ভোর সোয়া তিনটার দিকে কাজলা অকট্রয় মোড়স্থ নিজ বাসভবনে হৃদরোগজনিত কারণে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) । তার নামাজে জানাজা আজ বাদ আসর কাজলা অকট্রয় মোড়স্থ দারুস সালাম মসজিদের সামনে অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গোরস্থানে দাফন করা হবে।

বাংলাদেশ কথা পাচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের২০৯ নম্বর স্টলে।
12/02/2025

বাংলাদেশ কথা
পাচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের
২০৯ নম্বর স্টলে।

লেখক ফাহমিদ-উর-রহমান পেশায় একজন মনোরোগবিদ্যা বিশেষজ্ঞ। এদেশের নাগরিক সমাজের যে সকল ব্যক্তি এ জাতির ভালোমন্দ নিয়ে ভাবেন ত...
24/09/2024

লেখক ফাহমিদ-উর-রহমান পেশায় একজন মনোরোগবিদ্যা বিশেষজ্ঞ। এদেশের নাগরিক সমাজের যে সকল ব্যক্তি এ জাতির ভালোমন্দ নিয়ে ভাবেন তিনি তাদের একজন। অ্যাকাডেমিকভাবে রাষ্ট্র বা রাজনীতি বিষয়ে তার কোনো ডিগ্রি নেই। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক ইস্যুগুলো নিয়ে তার গবেষণা ও গ্রন্থনা ইতোমধ্যে বিদ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। আমরা তাকে রাষ্ট্রচিন্তক হিসেবে অভিহিত করতে পারি অনায়াসে। মূলত তার এই গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বিতর্ক’ কে তাত্তি¡ক ও বাস্তবভাবে অনুশীলনের জন্য প্রাথমিক তত্ত¡ কথার অবতারণা করতে হয়েছে। এবার তার মূল গ্রন্থ প্রসঙ্গে আসি।
লেখকের ভূমিকা বা ‘আরজ’ থেকে আমরা জানতে পারি যে এই লেখাটি তার দেয়া একটি স্মারক বক্তৃতার লিখিত রূপ। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ অধ্যয়নের একজন পুরোধা পুরুষ এবনে গোলাম সামাদ স্মরণে তিনি এই বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। তার নিজের ভাষায় ‘রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ একটি বাহাসমূলক বিষয়। সেই বাহাসের পটভূমিতে আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদের বিবর্তনের একটি রেখাচিত্র আমি আঁকার চেষ্টা করেছি। উপরন্তু বাঙালি-বাংলাদেশী বাহাসে কার কী অবস্থান তাও বোঝার চেষ্টা করেছি।’ যথার্থভাবেই ফাহমিদ-উর-রহমান মন্তব্য করেছেন যে তার সাথে সবাই একমত হবেন এমন নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার মৌলিক বক্তব্যের সাথে একমত হলেও কোন কোন প্রক্রিয়া ও বর্ণনায় একমত নই। কিন্তু আমি তার মত করে বিশ্বাস করি যে ‘মত বৈচিত্র্যের জায়গা থেকে এসব আলোচনার হয়তো একটি গুরুত্ব আছে।’

যেহেতু এটি একটি বক্তৃতার অনুলিখন, সুতরাং গতানুগতিক গ্রন্থনা থেকে এর একটু ব্যতিক্রম হবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন বইটির কোন সূচিপত্র নেই। আবার অধ্যায়বিন্যাসও অনুপস্থিত। তবে তার বক্তব্যকে ক্রমশ এগিয়ে নেয়ার জন্য এক-এগারোর বিভাজন আছে। এক দুই তিন করে অবশেষে কথক আমাদের নিয়ে গেছেন তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। বক্তৃতাটি যখন তিনি লেখনী রূপ দিলেন তখনও গ্রন্থনার ভারে ন্যুব্জ হয়নি বক্তব্যটি। বক্তব্যের ভাষা আর গ্রন্থনার ভাষা এক নয়। আমরা যখন গ্রন্থটি পাঠের জন্য পৃষ্ঠা উল্টোচ্ছি তখন মনে হবে যেন আমরা তার বক্তব্যটি শুনছি। আলোচনার ঢংয়ে কোনো জটিল ও কুটিল অ্যাপ্রোচে না গিয়ে তিনি সহজ সরল ও স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বিতর্ক সম্পর্কে তার নিজ বক্তব্য তুলে ধরেছেন। প্রকৃত অর্থে গ্রন্থনার ব্যাকরণে বিশ্লেষণ করলে এগারোটি অনুচ্ছেদকে এগারোটি শিরোনামে চিহ্নিত করা যায়। বক্তৃতার শুরুতে স্বাভাবিকভাবেই তাকে প্রথমেই আলোচ্য বিষয়ের অবতারণা করতে হয়েছে। সুতরাং শুরুতেই জাতীয়তাবাদের বিতর্ক বিষয়টি এসেছে। গ্রন্থাগারে প্রকাশ করতে গেলে এই অধ্যায়ের শিরোনাম হতে পারতো ‘জাতীয়তাবাদ বিতর্ক’। কোনোরকম তত্ত¡গত আলোচনা ব্যতিরেকে তিনি চলে গেছেন তার প্রপঞ্চে। ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাঙালি-বাংলাদেশী এই দুই ধারার বাহাস বর্তমান। এই বাহাসের আজও কোনো সমাধান হয়নি। কখনও হবে তাও নিশ্চিত করে কি বলা যায়? একটি দেশে এরকম বাহাস অবাঞ্ছিত হলেও এটি এখন বাস্তব ঘটনা।’ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এই বিতর্কটির একটি আনুপূর্বিক বর্ণনা তিনি এখানে দিয়েছেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভিতর পূর্ব বাংলার মানুষ বাঙালিসত্তা প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসে, তখন তাদের জাতিক পরিচয় হয় বাঙালি এবং ভূখÐগত পরিচয় হয় পূর্ব বাংলা। এভাবে তিনি বিশ্লেষণ করেন বাহাসের ধারাবাহিকতা। তিনি বলেন বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশের অধিবাসীদের পরিচয় বাংলাদেশী হলে জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সামঞ্জস্য হতে পারত। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জাতিসত্তা নির্ধারিত হয়নি বলে তিনি মনে করেন। ১৯৭৫ সালে শেখ সাহেবের ইন্তেকালের পর জিয়াউর রহমান শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী এনে বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন। এক্ষেত্রে জিয়ার ভিতর একটি ‘ঘধঃরড়হধষ ৎবপড়হপরষরধঃরড়হ’ বা জাতীয় সমঝোতার প্রয়াস কাজ করছিল বলে ফাহমিদ-উর-রহমান মনে করেন। এভাবে জিয়াউর রহমান মুসলিম জাতিসত্তার প্রতিপক্ষ হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দাঁড় না করিয়ে অন্তত মুসলিম বান্ধব সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎসমূল সন্ধান করতে গিয়ে লেখক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও আঞ্চলিক বিরোধকে তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন যে পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার মধ্য শ্রেণীর ভিতরে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কিছু কারণে ক্ষোভ জমা হয়েছিল। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ স্বাধিকারের দাবি তোলে এবং আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কলকাতা বাহিত সংজ্ঞাটি গ্রহণ করে। লেখক এর সাথে এ ধারণার দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ রাখে। মনে করা হয় ওই আন্দোলনটি যতটা না ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদনির্ভর তার চেয়ে আঞ্চলিক ক্ষোভ ও বৈপরীত্যের প্রাধান্য ছিল বেশি। আজকের প্রেক্ষিতে তিনি বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দ্বন্দ্বের তীব্রতা অনুভব করেন। তিনি আরো মনে করেন বাংলাদেশের এই জাতি পরিচয়গত দ্ব›দ্ব এত সহজে মুছবার নয়। তিনি উপসংহারে আসেন এভাবে যে সহস্র বছরের পুরনো বিজয়ী ইসলাম এখনো বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের প্রাণ। বিতর্কের অবশেষে তিনি মন্তব্য করেন যে ইংরেজ আমলে যে দ্বন্দ্ব ছিল হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব পাকিস্তান আমলে সেই দ্ব দ্ব›দ্ব রূপ নিলো বাঙালি মুসলিম দ্বন্দ্বে অবশেষে বাংলাদেশ কালে সেটি পরিণত হলো বাঙালি বাংলাদেশী দ্বন্দ্বে। তিনি মনে করেন এ দ্বন্দ্বের মধ্যে বিভিন্ন সময়ের শ্রেণী ও অর্থনৈতিক বাছ বিচারের একটি জায়গা থাকলেও এটি প্রধানত সাংস্কৃতিক দ্ব›দ্ব।

জাতীয়তাবাদ সংজ্ঞায়ন লেখক ফাহমিদ উর রহমান দ্বিতীয় অধ্যায়ে অথবা দ্বিতীয় পর্যায়ে জাতীয়তাবাদ এর একটি সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি বলেছেন জাতি থেকে জাতিত্ব ও সবশেষে জাতীয়তাবাদ। জাতি বলতে বোঝায় একই রক্তের বা বংশের অন্তর্ভুক্ত জনসমষ্টিকে। এই নিবন্ধের প্রথমে জাতীয়তাবাদ এর একটি অ্যাকাডেমিক ধারণা দেয়া হয়েছে সেটি লেখকের চিন্তার অনুরূপ। গ্রন্থ বা গবেষণার প্রথমেই এরকম একটি তত্ত¡ কথার অবতারণা থাকে। প্রসঙ্গক্রমে লেখক রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন বাংলায় ন্যাশন কথার প্রতিশব্দ নাই। আবার হিন্দু ডক্ট্রিনে ধর্ম religion থেকে জাতীয়তা গড়ে ওঠার সীমাবদ্ধতা বর্ণনা করেছেন। অবশেষে তিনি যথার্থভাবেই বলেছেন ভারতবর্ষে মুসলমানরাই প্রথম ভারতবাসীকে একটি জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে। ইংরেজ আমলের জাতীয়তাবাদ মুসলমান আমলের মত অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠতে পারেনি বলে লেখক মনে করেন। গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার প্রাক্কালে তত্ত্ব কথার এই অধ্যায়টি গ্রন্থের প্রথমেই সংযোজিত করলে আরো ভালো হতো।

জাতীয়তাবাদ : অতীত অন্বেষণ খুব সঙ্গতভাবেই লেখক এই পর্যায়ে জাতীয়তাবাদের অতীত অন্বেষণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের উৎস মূল সন্ধান করেছেন। এখানে বাঙালি জাতির নৃ-তাত্তি¡ক ইতিহাস, ভৌগোলিক সীমানা এবং ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অতিক্রম করে ইসলামের আগমন ও আত্মস্থ হওয়ার বিশ্লেষণ দিয়েছেন।
জাতীয়তাবাদ : ইসলামী জাতিসত্তার অন্বেষণ চতুর্থ পর্যায়ে লেখক পূর্বক্ত বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ইসলামী জাতিসত্তার অন্বেষণ করেছেন। এই অংশে লেখক কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অধীন অখন্ড বাংলা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় মুসলিম শাসকদের অবদান বর্ণনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ সালে এই অখÐ মুসলিম প্রভাবিত বাংলার সূচনা করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য মুসলিম শাসকদের অবদানে কিভাবে বাংলা হয়ে ওঠে ‘মুসলিম বাংলা’ তার একটি সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান আলোচনা এই অধ্যায়ে লক্ষ্য করা যায়। তিনি অবশেষে বলেছেন একমাত্র মুসলমান আমলের বাংলা সাহিত্য ঘিরে জাতীয় ভাব তৈরি হয়। মুসলমান আমলে তৈরি হয় রাজনৈতিক ঐক্য। তাই মুসলমান আমলকেই বলতে হবে আজকের বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের আদি বুনিয়াদ।

ঔপনিবেশিক অভিঘাত জাতীয়তাবাদের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ঔপনিবেশিক অভিঘাত ছিল একটি জনবিচ্ছিন্ন ও আরোপিত বিষয়। ইংরেজরা তাদের মত করে ভারতে অখন্ড জাতীয়তা বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির বৃথা চেষ্টা করেছিল। লেখক পঞ্চম পর্যায়ে ঔপনিবেশিক অভিঘাতের খানিকটা বর্ণনা দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন কলনিবাহিত- ধ্যান ধারণা ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী কাঠামোতে বড় রকমের ধাক্কা দিতে পারেনি। প্রতিবেশী হিন্দু স¤প্রদায় জাতীয়তাবাদের ইউরোপীয় ভার্সনকে মৌখিকভাবে গ্রহণ করলেও মূলে তা ছিল হিন্দুত্ব ভারতনির্ভর। আজও তা সেখানে জাগ্রত রয়েছে। লেখক ফাহমিদ-উর-রহমান এই অংশে বাঙালি কবি সাহিত্যিক তথা বুদ্ধিজীবীদের দ্বৈধতার উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন একদিকে ভারত ভাগ্যবিধাতা গান গেয়েছেন, অপরদিকে আমার সোনার বাংলা বলে আহাজারি করেছেন। এদের কাছে তাই ভারতীয় ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল হিন্দু সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রচিন্তার নামান্তর। এ সময় থেকে জাতীয়তাবাদ দুটো স্বতন্ত্র ও পরস্পর বিরোধী খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে
হিন্দুত্ববাদ দ্বৈধতা গ্রন্থের ষষ্ঠ অংশে ফাহমিদ-উর-রহমান ইতঃপূর্বে আলোচিত হিন্দুত্ববাদের দ্বৈধতার বিষয়টি আরো পরিষ্কার করেছেন। উনিশ শতকে এরা যখন ইংরেজদের উমেদারিতে ব্যস্ত তখন মুসলমানরা বিদ্রোহ ও বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপৃত ছিল। মুসলমান জাগৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক ওয়াহাবি আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলন ও তিতুমীরের মোহাম্মদী আন্দোলন ইত্যাদির বর্ণনা দিয়েছেন। অপরদিকে ইংরেজ শাসনকে হিন্দুদের কাছে মনে হয়েছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। লেখক সেকালের বিখ্যাত কবি ও বুদ্ধিজীবী ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর লেখার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। গুপ্ত লিখেছেন ‘চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়, ব্রিটিশের রাজল²ী স্থির যেন রয়। এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়, শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রাম রাজ্য কয়।’ লেখক এর মন্তব্য এই যে বাংলাদেশের যে সমস্ত এলাকায় আন্দোলন ফরায়েজি ও ওহাবি আন্দোলন দানাবাদে যেসব জায়গা জুড়ে পরবর্তীকালে খেলাফত আন্দোলন ও পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়। আবার এই এলাকা নিয়ে আরো পরে তৈরি হয় বাংলাদেশ।

সমন্বয় প্রয়াস জাতীয়তাবাদের ক্রম বিকাশের ধারায় আমরা চরম ইংরেজ বিরোধী মুসলিম মনোভাব প্রত্যক্ষ করেছি। আবার হিন্দু স¤প্রদায় কর্তৃক ইংরেজদের তোষণ নীতিও লক্ষ্য করেছি। একটি পর্যায়ে মুসলমান সমাজের কতিপয় নেতা ইংরেজদের প্রতি ঘৃণার পরিবর্তে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন মিসরের মুফতি আব্দুহু ও ভারতের সৈয়দ আহমদ খান, বাংলা অঞ্চলের নবাব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমির আলী। তারা নতুন পরিস্থিতিতে ভারতের মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরোধিতা ও অসহযোগিতার পথ পরিত্যাগ করে সহযোগিতার পথে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রভাবিত রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের বিপরীতে মুসলমানরা মুসলিম লীগ গঠন করে অনেক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে এই মুসলিম লীগই ভারত বিভাগ অনিবার্য করে তোলে। আবুল মনসুর আহমদসহ বুদ্ধিজীবী মনে করেন পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অসম্ভব ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে আমাদের রাষ্ট্রপরিচয়ের সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমীকরণ যে একটি আরোপিত ও প্রচন্ড রাজনৈতিক চাপের সংযোজন ছিল- লেখক তার বক্তব্যে এই অংশে ব্যাখ্যা করেছেন।

বিপথগামী চাকমারা ভারতীয় আধিপত্যের বাহনএবনে গোলাম সামাদঅনেকেরই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্পর্কে ...
23/09/2024

বিপথগামী চাকমারা ভারতীয় আধিপত্যের বাহন
এবনে গোলাম সামাদ

অনেকেরই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা নেই। অনেকেই বুঝেন না, বর্তমান সরকারের ভুল নীতির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার অর্থ দাঁড়াবে, বর্তমান বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ ভূমি হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া। আমরা অনেকেই জানি না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিদের মোট জনসংখ্যা সেখানে বাস করা বাংলাভাষাভাষী জনসংখ্যার তুলনায় এখন আর বেশি নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্ধেক জনসংখ্যাই হলো উপজাতীয়। উপজাতি কথাটা প্রচলিত হয়েছিল ইংরেজ আমলে। ‘ট্রাইবাল পিউপল’-এর বাংলা করা হয়েছে উপজাতি। ‘ট্রাইব’ শব্দটা ইংরেজি ভাষাতেও যথেষ্ট সুস্পষ্ট নয়। এখন নৃতাত্ত্বিক আলোচনায় শব্দটিকে বাদ দেবার চেষ্টা চলছে। ট্রাইব বলতে বুঝাতো এমন জনসমষ্টি, যারা একটা দেশের মূল জনসমষ্টির অংশ নয়। যাদের একটা পৃথক ভাষা আছে। কিন্তু ভাষাটা লিখিত নয়। যে ভাষায় লোককাহিনি আছে। কিন্তু লিখিত সাহিত্য নেই। যে জনসমাজ পড়ে আছে অলিখিত ভাষার যুগে। এদের জীবনধারাও অনেক আদিম। এদের অনেকেই খায় ফলমূল আহরণ ও শিকার করে। এরা কৃষিকাজ করলেও তা হলো আদিম পর্যায়ের। মাটি খুঁড়ে গর্ত করে বীজ বপন করে এরা কৃষিকাজ করে। লাঙ্গলের সাহায্যে চাষ আবাদ পদ্ধতি এদের মধ্যে অপ্রচলিত। এরা অনেকে কাপড় বুনতে জানে। কিন্তু এদের তাঁত হলো খুবই প্রাথমিক ধরনের। এদের সমাজজীবনে রাষ্ট্রের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি অর্থনীতির ক্ষেত্রে সামাজিক শ্রম বিভাগ। এরা যে ধরনের কৃষি কাজ করে, তাতে ভূমির উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হয়। এরা কৃষিজীবী জনসমাজের মতো এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে না, যাযাবর জীবন যাপন করে। এরা আরণ্যক জীবন পছন্দ করে। নগর জীবন গড়বার কোনো প্রবণতা এদের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় না। ইংরেজ আমলে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যাদের উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদের সংখ্যা হলো তেরো। এই তেরোটি উপজাতি হলো : চাকমা, মারমা (মগ), ত্রিপুরী, বনযোগী, তনচঙ্গায়া, খুমী, পাঙ্খো, মে্রা, মুরং, দায়নাগ, খায়াং, লুসাই (মিজো) এবং সাক। লুসাইরা পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন নেই বললেই চলে। আর সাকরা অধিকাংশই বাস করে মায়ানমারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল দুটি উপজাতি হলো চাকমা ও মারমা। এসব উপজাতি সকলেই মোঙ্গলীয় মানবধারা ভুক্ত। কিন্তু মঙ্গোলীয় মানবধারাভুক্ত হলেও এদের দৈহিক গড়নে পার্থক্য আছে। চাকমা ও মারমাদের মাথার আকৃতি খুবই গোল। কিন্তু অন্য অনেক উপজাতির মাথার আকৃতি বেশ কিছুটা লম্বা। অর্থাৎ সাধারণভাবে এরা মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলেও সকলে ঠিক একই উপবিভাগভুক্ত নয়। দৈহিক গঠনের দিক থেকে এরা কেউ হলো লম্বা মাথা আর কেউ হলো খুবই গোলমাথা। উপজাতিদের সবার ভাষাও এক নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ ভাষা হলো বাংলা। উপজাতিরা একে অপরের ভাষা বুঝে না। চাকমারা যদিও বৌদ্ধ কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে হিন্দু ভাবাপন্ন। মারমারা বৌদ্ধ। কিন্তু হিন্দু ভাবাপন্ন নয়। তারা ভারতের চাইতে মায়ানমারকেই ভাবে বেশি আপন বলে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হবার পর, চাকমা ও মারমারা পাকিস্তানকে মেনে নিতে চায়নি। চাকমারা উড়িয়েছিল ভারতের পতাকা। আর মারমারা উড়িয়েছিল বর্মার। পরে এখানে উড়েছিল পাকিস্তানের পতাকা। আজ চাকমারা স্বাধীন জুমল্যান্ড গড়বার দাবি জানাচ্ছে। মারমারা ও অন্য উপজাতিরা এ রকম কোনো দাবি উত্থাপন করেনি।

“জুম” শব্দটা চাকমা ভাষার শব্দ নয়। কোল ভাষার শব্দ। পাহাড়ি ঢালু জমিতে বন পুড়িয়ে জঙ্গল ছাপ করে কাঠের ছুচাল খোটা দিয়ে মাটি খুঁড়ে পৃথক পৃথক গর্তে বীজ বপণ করে চাষ করাকে বলা হয় “জুম”। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেই যে এরকমভাবে চাষ করা হয়, তা নয়। মধ্যভারতের কোলরাও এভাবে চাষ করে। গারোরা এভাবে চাষ করে। বর্মায় এভাবে অনেক উপজাতি চাষ করে থাকে। কিন্তু চাকমারা দাবি করছে ‘জুমল্যান্ড’।
নৃতাত্ত্বিকদের মতে ‘জুমচাষ’ হলো নব্যপ্রস্তর যুগের প্রথম পর্যায়ের কৃষি পদ্ধতি। চাকমাদের ইতিহাস নিয়ে যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের মধ্যে ব্রিটিশ আইসিএস মিলস অন্যতম। তার মতে, চাকমাদের উদ্ভব হয় চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চলে। মারমা মেয়েদের সঙ্গে মুঘল সৈন্যদের মিলনের ফলে। মারমা ভাষায় ‘চাওক’ শব্দের অর্থ নাকি মিশ্রিত। এই ‘চাওক’ শব্দ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে চাকমা নামের। J.P. Mills-এর পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্বন্ধে লেখাটি পুনঃমুদ্রিত করা হয় ১৯৩১ সালের আদমশুমারির রিপোর্ট। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের ইতিহাস খুবই সাম্প্রতিক। বাংলাদেশের বাংলাভাষী মূল জনগোষ্ঠীই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল মুঘলদের অধীনে আসে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং শাসিত হতো চট্টগ্রামের অংশ হিসেবেই। ১৭৬০ সালের পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে। ১৮৬০ সালে গঠিত হয় পৃথক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। ১৮৬৮ সালে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তরিত হয় জেলা সদর। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি হাইস্কুল। এখানে বাস করত চাকমারা। চাকমারা শিক্ষার সুযোগ পেয়ে অন্যান্য উপজাতির তুলনায় অগ্রসর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। চাকমারা মুঘল আমলে ছিল মুসলমান ভাবাপন্ন। কিন্তু পরে চাকমাদের সমাজপতি, ইংরেজ আমলে যিনি রাজা উপাধি ধারণ করেন, বিবাহ করেন হিন্দু মহিলা। এরপর থেকেই হিন্দু প্রভাব চাকমাদের মধ্যে বিস্তারিত হতে থাকে। চাকমাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষার দিকে ঝোঁকে। ১৯৩৮ সালের মধ্যে বারোজন চাকমা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি,এ ডিগ্রি লাভ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা প্রাধান্য স্বীকৃতি পায়। কিন্তু অন্যান্য উপজাতি এখন এই চাকমা প্রাধান্য মানতে চাচ্ছে না। বিশেষ করে মারমারা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে কেবল চাকমা সমস্যা হিসেবে তাই আর এখন বিচার করা যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল কেবল চাকমাদের আবাসভূমি নয়। একাধিক উপজাতি সেখানে বাস করে। তাছাড়া বাস করে বাংলাভাষী মুসলমান। যাদের সংখ্যা এখন চাকমাদের তুলনায় অনেক বেশি।
ভারতের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্বন্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে, আমরা তা জানি না। কিন্তু যতটুকু আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, এই অঞ্চলে ভারতের কর্তৃত্বই কার্যত চাকমা অধিকারের নামে স্বীকৃত হতে যাচ্ছে। এর ফলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ভবিষ্যৎ সেখানে হয়ে উঠবে খুবই অনিশ্চিত। এছাড়া মারমা চাকমা বিরোধও হয়ে উঠতে চাইবে তীব্র। যা হতে দেয়া যায় না।
শেখ মুজিব ভারতের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ভারতকে বেরুবাড়ী দিয়ে দিয়েছিলেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের চাপে কী করবে, বলা কঠিন। দেশবাসীর উচিত, এ বিষয়ে সচেতন হওয়া। আমরা আমাদের দেশের দশভাগের এক ভাগ জমি হাতছাড়া করতে পারি না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ সম্পদ অতি মূল্যবান। তাছাড়া ঐ অঞ্চলে ভবিষ্যতে পেট্রোলিয়াম পাবারও প্রচুর সম্ভাবনা আছে। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের হাতে যাবার অর্থ দাঁড়াবে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হওয়া।
আমরা জানি, এমনকি আওয়ামী লীগের একাংশ তাদের সরকারের পররাষ্ট্রনীতিকে মেনে নিতে পারছেন না। আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি অংশ ভারতের তাঁবেদারির বিরোধী। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে। দেশ আমাদের সকলের। দেশের স্বার্থের কথা না ভেবে কেবলই ক্ষমতার রাজনীতি করলে, সারা দেশবাসীকেই দিতে হবে শেষ পর্যন্ত এক চরম মূল্য।

আজ আমাদের সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সরিয়ে নিতে বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন আমরা তা করতে যাব? পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানে আমাদের সৈন্য না রাখার বাস্তব অর্থ দাঁড়াবে চট্টগ্রামে ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া। শেখ হাসিনা ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ কী তাই চাচ্ছেন! তারা কী ভাবতে চাচ্ছে না দেশের স্বার্থ? দেশকে বিদেশের নিয়ন্ত্রণে তুলে দেবার জন্য দেশবাসী তাদের ভোট দেয়নি। ভোট দিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কথা ভেবেই।

৩ মার্চ ১৯৯৭ খ্রি.

পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাএবনে গোলাম সামাদপত্রিকার খবরে প্রকাশ, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে উপজাতিদের নাকি ক্ষুদ্র জাত...
22/09/2024

পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা
এবনে গোলাম সামাদ

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে উপজাতিদের নাকি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

জানি না ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কী ধরনের সংজ্ঞা প্রদান করা হচ্ছে। কারণ, ইংরেজ আমলের হিসেবে সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আছে কম করে ১০টি উপজাতি। যাদের প্রত্যেককে মেনে নিতে হবে এক একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে। সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার উপজাতিদের মধ্যে চাকমা এবং মারমা (আরাকানি মগ) প্রধান। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক সদ্ভাব নেই। এদের মধ্যে ভবিষ্যতে সংঘাত অনিবার্য হতে পারে।
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোনো রাজনৈতিক সমাধান আনতে পারবে না; বরং রাজনৈতিক সমস্যাকে আরও জটিল করে দিতেই পারে।
উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে বড় রকমের সংঘাতে। আমরা আফ্রিকায় দেখতে পাচ্ছি একটি উপজাতির সঙ্গে আর একটি উপজাতির সংঘাত বাধতে। সারা কৃষ্ণ আফ্রিকায় শুরু হতে পেরেছে নিদারুণ উপজাতি সংঘাতের রাজনীতি। বাংলাদেশে ঠিক অতটা না হলেও হতে পারে উপজাতিদের মধ্যে রক্তক্ষরা সংঘাত। অন্যদিকে ক্ষুদ্রজাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জন্যে হয়ে উঠতে পারে বিশেষ ক্ষতিকর। বাংলাদেশর এখন সবচেয়ে বড় উপজাতি হচ্ছে সাঁওতালরা। বাংলাদেশর উত্তরাঞ্চলের অনেক অংশে বহু সাঁওতালের বাস। তারাও এই সঙ্গে চাইতে পারে পৃথক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মর্যাদা। আর এর সূত্র ধরে উঠতে পারে পৃথক সাঁওতাল আবাসভূমির কথা। বাংলাদেশর সাঁওতালরা দলে দলে খ্রিষ্টান হচ্ছেন। বিদেশি খ্রিষ্টান মিশনারিরা তাদের পৃথক দেশের দাবিকে উস্কে দিতেই পারেন। তাই বিষয়টি আমাদের বিশেষভাবে ভাবিত করে তুলছে। কেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই ধারণাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারলো, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সাঁওতালদের একটা বিশেষ ভাষা আছে; আছে পৃথক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কিন্তু বাংলাদেশে সাঁওতালরা এখন সকলেই ভালো বাংলা বলতে পারেন। কেবল তাই না, বাংলাদেশর সাঁওতালি ভাষায় ঢুকে পড়েছে বহু বাংলা শব্দ। সাবেক সাঁওতালি ভাষা তাই বিশুদ্ধভাবে বিরাজ করছে না। সাঁওতালরা এক সময় বাস করতেন বনে। তাদের জীবিকার উপায় ছিল বন্য ফলমূল আহরণ ও পশু-পাখি শিকার। পরে তারা বাঙালিদের কাছ থেকে শিখেছেন লাঙলের সাহায্যে চাষাবাদ। এখন অধিকাংশ সাঁওতাল জীবিকার দিক থেকে হয়ে পড়েছেন এদেশের বৃহত্তর বাংলাভাষী জনসমাজের মতোই কৃষিজীবী। বৃটিশ শাসনামলেই সাঁওতালরা হয়ে পড়েছিলেন এদেশি হাল চলনে অভ্যস্ত। কিন্তু মিশনারিদের কল্যাণে তাদের মধ্যে উপ্ত হতে চলেছে বিশেষ সাঁওতালি জাতীয়তাবাদ। যেটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারবে সাংবিধানিকভাবে তাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলে। আমরা তাই মনে করি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি হবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিশেষ পরিপন্থি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস আমাদের অনেকেরই যথাযথভাবে জানা নেই। তাই এ বিষয়ে কিছু সাধারণ তথ্য প্রদান করা মনে হয় প্রাসঙ্গিক হবে। মুঘল আমলে বাংলাদেশ ছিল অনেকগুলো প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। যাদের বলা হতো ‘সরকার’। চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল এরকম একটি সরকার। এ সরকার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশেষ চুক্তি বলে হস্তগত করে নবাব মীর কাশেমের কাছ থেকে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর ১৮৬০ সালে বৃটিশ ভারতের সরকার তদানীন্তন চট্টগ্রাম জেলাকে বিভক্ত করে সৃষ্টি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বা মাহাল। কিন্তু পরে আবার এই জেলাটিকে একটি বিশেষ ধরনের মহকুমায় পরিণত করা হয়। এই মহকুমাকে আবার একটি পৃথক জেলায় পরিণত করা হয় ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে। সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ১৯৪৭ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয় চট্টগ্রাম জেলার সংলগ্ন অংশ হবার কারণে। চট্টগ্রাম ছিল মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রাম তা ছিল না। কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে সংযুক্ত করা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। আর কংগ্রেস নেতারা তেমন প্রতিবাদ করেন না এই সংযুক্তির। এর একটি কারণ ছিল, জিন্নাহ সাহেব পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলাকে ছেড়ে দেন ভারতের কাছে। যদিও গুরুদাসপুর জেলা ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। জিন্নাহ সাহেব ছিলেন দূরদর্শী নেতা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দেন বেশি। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন যে, এর জন্যে নিরাপত্তা বাড়বে চট্টগ্রাম বন্দরে। যা ছিল তদানীন্তন পূর্ববাংলার একমাত্র বন্দর। যার ওপর নির্ভরশীল ছিল পূর্বপাকিস্তানের সম্পূর্ণ বহির্বাণিজ্য। সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে জোর করে কেউ পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেয়নি। বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে পেরেছিল খুবই শান্তিপূর্ণভাবে। এর জন্যে সৃষ্টি হতে পারেনি কোনো সংঘাত। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি জনবিরল অঞ্চল। পাকিস্তান হবার পর আসাম থেকে আগত অনেক মুসলিম উদ্বাস্তু উপনিবেশিত হয়েছেন সেখানে। এছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বহু মানুষ গিয়েছেন এই অঞ্চলে। হয়েছেন উপনিবিষ্ট। বর্তমানে ওই অঞ্চল আর কেবল উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল নয়। সেখানে বহু বাংলাভাষী মুসলমান বাস করছেন। যাদের অধিকারকে সাংবিধানিকভাবে হরণ করা যেতে পারে না। পাহাড়ি আর সমভূমির অধিবাসীদের মধ্যে সংবিধানিক পার্থক্য করা যেতে পারে না। কারণ এরা সকলেই হলেন, এক রাষ্ট্রের নাগরিক। ১৯৮৪ সালের পর পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি জেলায় পরিণত করা হয়েছে। এই তিনটি জেলা হলো: খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান। রাঙামাটিতে হলো চাকমা প্রাধান্য। পক্ষান্তরে বান্দরবান অঞ্চলে প্রাধান্য হলো মারমা বা আরাকানি মগদের। খাগড়াছড়িতে কোনো উপজাতিরই ঠিক একক প্রাধান্য নেই। খাগড়াছড়িতে বহু বাংলাভাষি মুসলমানের বাস। সম্ভবত তারাই সেখানে এখন সংখ্যাগুরু। এখানকার অবস্থা রাঙামাটি ও বন্দরবানের মতো নয়। কিন্তু এখন চাকমা নেতাদের কথা থেকে মনে হচ্ছে, তারা যেন চাচ্ছেন সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে তাদের নেতৃত্বে একটা পৃথক দেশে পরিণত করতে। যেটা হতে দেয়া যায় না। উপজাতিদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষায় চাকমারা হলেন সবচেয়ে অগ্রসর। চাকমাদের এখন নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। তারা নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলেন, বৃটিশ ভাষাতাত্তি¡ক জর্র্র্র্র্র্র্জ গিয়ার্সন তাকে চিহ্নিত করেছেন বাংলারই একটি উপভাষা হিসেবে। যা হলো চট্টগ্রামের বাংলার খুব কাছাকাছি। যেহেতু যথেষ্ট আগেই চাকমারা হয়ে উঠেছেন বাংলাভাষী, তাই বাংলাভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে তারা হতে পেরেছেন, অনেক সহজেই অনকে অগ্রসর। যেটা অন্য আর সব উপজাতিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ এখন চাকমারা দাবি করছেন, তাদের ভাষা নাকি বাংলা থেকে খুবই ভিন্ন। ভাষাতত্তে¡র দিক থেকে যে দাবিকে মেনে নেবার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না। চাকমারা রাজনৈতিকভাবে বাংলাভাষীদের দ্বারা যে নিপীড়িত হচ্ছেন এমন নয়। কিন্তু তথাপি উঠছে চাকমা স্বতন্ত্র জাতিসত্তার দাবি। আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সেটাকে স্বীকার করেনিয়ে চাচ্ছেন সংবিধানে পরিবর্তন আনতে। যে পরিবর্তন সমগ্র দেশের জন্য হয়ে উঠবে একটা বড় রকমের সমস্যারই কারণ। ইংরেজ আমলের আদমশুমারি রিপোর্টে উপজাতি বলতে বুঝিয়েছে, এমন ক্ষুদ্র লোকসমষ্টিকে, যাদের জীবনধারা থেকেছে আরণ্যক। যারা থেকেছে অর্ধ যাযাবর। যাদের জীবিকার উপায় থেকেছে প্রধানত বন্য ফলমূল আহরণ ও পশুপাখি শিকার। যারা কিছুকিছু কৃষিকাজ করেছে মাটিতে গর্ত করে বীজ বপন করে। যারা কখনই লাঙল দিয়ে চাষাবাদে অভ্যস্ত ছিল না। কিন্তু এখন বাংলাদেশের উপজাতিরা আর সেই আদিম আরণ্যক জীবনে পড়ে নেই। এর একটি কারণ হল, বাংলাদেশে নেই আর আগের মতো বন। আর তাই বন্য জীবনযাপন করা যাচ্ছে না বাস্তব কারণেই। এছাড়া উপজাতিদের মধ্যে ঘটেছে শিক্ষার প্রসার। পড়েছে বৃহত্তর জনসমষ্টির সভ্যতার প্রভাব। যা তাদের আদিম সংস্কৃতি থেকে বিশেষভাবে ভিন্ন করেই তুলেছে এবং তুলছে। অনেকে ইংরেজ আমলের উপজাতি কথাটাকে বাদ দিয়ে আদিবাসী শব্দটা গ্রহণের পক্ষে। বাংলায় উপজাতি কথাটা ব্যবহার আরম্ভ হয় ইংরেজি ঞৎরনব শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে। আদিবাসী শব্দটি নৃ-তত্বে ব্যবহৃত হয় প্রধানত অনড়ৎরমরহব শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে। ইংরেজিতে অনড়ৎরমরহব শব্দটা প্রয়োগ করা হয় প্রধানত অষ্ট্রেলিয়ার আদিম কালো মানুষদের বর্ণনা করতে যেয়ে। আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের ক্ষেত্রেও অনড়ৎরমরহব শব্দটার কিছু প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। কারণ এসব মানুষ সবাই হলো ঐসব অঞ্চলের আদিম অধিবাসী। ইউরোপ থেকে অনেক পরে সাদা মানুষ গিয়ে দখল করেছে তাদের দেশ। উপনিবিষ্ট হয়েছে সেখানে। কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তর জনসমাজ এখানকারই মানুষ। তারা ঠিক এভাবে বাইরে থেকে আসা নয়। এবং তারা জোর করে কোনো জাতিকে বাধ্য করেনি ঘন অরণ্যে যেয়ে বসবাস করতে। তারা কেড়ে নেয়নি কারো জমি। যেমন সাদা মানুষ আমেরিকায় যেয়ে কেড়ে নিয়েছে অনেক রেড ইন্ডিয়ানদের জমি। তাই আদিবাসী কথাটা সংবিধানে প্রয়োগ করা কতটা যুক্তিসিদ্ধ হবে সেটা নিয়েও থাকছে প্রশ্ন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দটা হয়ে উঠেছে খুবই বিভ্রান্তিকর। এটাকে ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপএবনে গোলাম সামাদবাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এদেশের মানুষের জাতিসত্তার একটি উপাদান হলো ভা...
13/09/2024

আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ
এবনে গোলাম সামাদ

বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এদেশের মানুষের জাতিসত্তার একটি উপাদান হলো ভাষা। আর একটি উপাদান হলো ইসলামের স্বাতন্ত্র্য। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এতে তিনি বলেছেন, বাংলাভাষী মুসলমানের জাতিসত্তার উপাদান দুটি। একটি হলো বাংলাভাষা আর একটি হলো ইসলামের স্বাতন্ত্র্য চেতনা। আওয়ামী লীগের জয়বাংলা আওয়াজের সাথে শেখ মুজিবের এই ধারণা মনে হচ্ছে সংগতিপূর্ণ নয়। এই বাংলা আসলে কোনো বাংলা; আর বাঙালি বলতেই বা ঠিক কাদের বুঝতে হবে। কেননা বাংলাভাষী মানুষের প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ বাস করেন বাংলাদেশে আর শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ বাস করেন ভারতে। এর মূলে আছে ইসলামের স্বাতন্ত্র্য।
১৯৪৭ সালে বাংলা প্রদেশ ভাগ হয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদকে নির্ভর করে। যার উদ্ভব এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে হতে পেরেছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ববাদ ছিল সঠিক। অথচ এখন আওয়ামী লীগের কিছু তাত্ত্বিক বলছেন ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো ছিল প্রতিক্রিয়াশীলতা। এদের কথা মানলে শেখ মুজিবকেও বলতে হয় একজন প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদ।
এই উপমহাদেশে কাকে বলব জাতীয়তাবাদ আর কাকে বলব সংকীর্ণ ধর্মীয় মনোভাবের অভিব্যক্তি, সেটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। ভারতে শিখরা এখন চাচ্ছেন স্বাধীন হতে। একটা পৃথক রাষ্ট্র গড়তে। যা তারা ইতঃপূর্বে চাননি। এই শিখ জাতীয়তাবাদের মূলে আছে শিখ ধর্মবিশ্বাস; আছে গুরুমুখী অক্ষরে লেখা পাঞ্জাবি ভাষা। যা প্রধানত শিখরাই বিশেষভাবে চর্চা করে থাকেন। ১৯৪৭ সালে ভাগ হয় বৃটিশ শাসনামলের বাংলা প্রদেশ; আর বৃটিশ শাসনামলে পাঞ্জাব প্রদেশ। পূর্ব পাঞ্জাব পড়ে পাকিস্তানে আর সাবেক পাঞ্জাব প্রদেশের পশ্চিম ভাগ পড়ে ভারতে। ভারতের পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে দুটি প্রদেশ। একটির নাম হচ্ছে পাঞ্জাব। যেখানে বাস করেন প্রধানত শিখরা। যার সরকারি ভাষা হলো পাঞ্জাবি। আর তা লেখা হয় গুরুমুখী অক্ষরে। অন্যদিকে সাবেক পাঞ্জাবের হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে এখন গঠিত হয়েছে ভারতের হরিয়ানা প্রদেশ। যার সরকারি ভাষা হয়েছে সংস্কৃত শব্দবহুল হিন্দি ভাষা। তা লেখা হয় দেবনাগরি অক্ষরে। ভারতে জাতিসত্তার সমস্যা এখনও মেটেনি। শিখ জাতীয়তাবাদকে কেউ বলছেন না ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতা কথাটা যেন কেবল মুসলমানদের জন্যই ব্যবহৃত হতে পারছে। এর মূলে আছে ভারতের এক সময়ের বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা ও পরে প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরুর চিন্তা-চেতনা। যার একটা প্রভাব থাকতে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের তাত্ত্বিকদের ওপর। এদের প্রভাবেই আওয়ামী লীগ বলছে, বিশেষভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। গ্রহণ করছে না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে।
বাংলাদেশের মানুষের নৃ-জাতিক ইতিহাস এখনও যথাযথভাবে পরিক্ষিত হয়নি। এর অধিকাংশটাই হয়ে আছে অজানা। এক সময় মনে করা হতো বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে ইসলাম প্রচার প্রধানত ঘটেছিল নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে; উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে নয়। উচ্চবর্ণের হিন্দু বলতে বুঝায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের। বাংলাদেশে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে কায়স্থদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ১৯৪১ সালে জার্মান ইহুদি মহিলা গবেষক ঔ. ড. ঊ. গধপভধৎষধহব পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমানের রক্তের গ্রুপের হার নির্ণয় করেন। এবং দেখেন যে, তার মিল হচ্ছে নিম্নবর্ণের হিন্দু বলে কথিতদের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে। এরফলে ভাবা আরম্ভ হয় যে, নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে মুসলমান হবার ধারণাটা সঠিক। কিন্তু পরবর্তীকালে দিলীপকুমার সেনের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানদের রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের হার হলো তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরেই অনুরূপ (দ্রষ্টব্য, Indian Anthropology. Edt T. N. Madan and Gopala Sarana; Asia publishing House, London 1962)। তাই আগের মতো আর বলা যায় না যে, কেবল নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই উচ্চবর্ণের ঘৃণার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এখন জানা গিয়েছে যে, কুমিল্লা অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন প্রথমে দেব ও পরে চন্দ্র বংশের রাজারা। এরা হিন্দু ছিলেন না। ছিলেন বৌদ্ধ। এদের রাজত্ব দক্ষিণবঙ্গেও ছিল বিস্তৃত। বাংলাদেশে তাই হিন্দুরা নন বৌদ্ধরাই সম্ভবত দলে দলে গ্রহণ করেন ইসলাম। যেমন তারা গ্রহণ করেছেন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে।
বাংলাদেশসহ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার জনসমষ্টিকে একত্রিত করলে আমরা দেখতে পাই যে, এই অঞ্চলেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমানের বাস। সম্ভবত আরবি ভাষার পরেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান কথা বলেন বাংলাভাষায়। বাংলাদেশ টিকে থাকলে একদিন বাংলাভাষাকে বিশ্বে মুসলমানের ভাষা হিসেবে গণ্য করা হবে। বাংলাভাষাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন পড়েছে বাংলাদেশের মানুষেরই ওপর।
বঙ্গ নামটা নিয়ে বেশকিছু গবেষণা হয়েছে। ভারতের খ্যাতনামা মহিলা নৃতাত্ত্বিক Irawati Karve, ইরাবতী কার্ভ- এর মতে বঙ্গ শব্দটা আর্যভাষা পরিবারের নয়। নামটা এসেছে চীনা পরিবারভুক্ত কোনো ভাষা থেকে। চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায় ‘য়ং’ ধ্বনি সাধারণত নদীর নামের সাথে যুক্ত থাকতে দেখা যায়। যেমন, ইয়াংসিকিয়ং, হোয়াংহো, সাংপো প্রভৃতি। বঙ্গ ছিল একটা নদীর নাম। আর তার তীরবর্তী মানুষদের বলা হতো বাঙালি। এরা চীনাদের মতোই একই পদ্ধতিতে ধানচাষ করত। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখি, মুসলিম নৃপতিদের শাসনামলে বঙ্গ নামটা একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ফারসি ভাষায় লেখা ইতিহাস বইয়ে উল্লিখিত হতে। ফারসিতে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বলা হতো মুলুক বাঙ্গালাহ। এরমধ্যে পড়তো রাজধানী গৌড়। মুসলিম শাসনামলের আগে ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত হতো না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের প্রস্তাবনায় লিখেছেন-
অলীক কূনাট্য রঙ্গে মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।
অর্থাৎ মাইকেল মধুসূদনের সময়ও সাধারণত বাংলাভাষায় বঙ্গ বলতে বুঝাত পূর্ববঙ্গকে। আর পশ্চিমবঙ্গ বলতে বুঝাতে ব্যবহৃত হতো রাঢ় নামটা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ নামের পরিবর্তে প্রদেশটির নাম করতে চাচ্ছেন কেবলই বঙ্গ। আমার মনে হয় এরকম নামকরণ করলে আমাদের ইতিহাস রচনায় হতে পারবে যথেষ্ট বিভ্রান্তি। এমনকি আমাদের জাতিসত্তার রূপ নিয়ে সৃষ্টি হতে পারবে অস্পষ্টতা।
একসময় বলা হতো বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হতে পেরেছে প্রধানত বল প্রয়োগের মাধ্যমে। মুসলমান নৃপতিরা জোর করে হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু এখন এই মতোটাকে আর আগের মতো ধরে রাখা যাচ্ছে না। বৃটিশ শাসনামলে আদমশুমারি শুরু হয় ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এ সময় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে মুসলমানের তুলনায় হিন্দুর সংখ্যা ছিল বেশি। এরপর আদমশুমারি হয় ১৮৮১ সালে। এই আদমশুমারিতে দেখা যায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা কমতে এবং মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে। এরপর থেকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ক্রমশই মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে। কেন এমন হতে পেরেছে, তার কারণ জানা যায় না। তবে একটি মতো হলো হিন্দুদের মধ্যে লেখাপড়া শিখে বহু ব্যক্তি গ্রহণ করতে থাকেন কেরানির চাকরি। রুদ্ধ ঘরে কেরানিগিরি করতে গিয়ে ঘটে এদের স্বাস্থ্যহানি। কমে এদের প্রজনন ক্ষমতা। কিন্তু মুসলমানরা লেখাপড়া শিখে কেরানি হতে চাননি। তারা মুক্ত প্রকৃতিতে করেছেন ক্ষেতে খামারে কাজ। হয়েছেন নৌকার মাঝিমাল্লা। মুক্ত প্রকৃতিতে তাদের স্বাস্থ্য থেকেছে অটুট। কমেনি তাদের প্রজনন ক্ষমতা। তাই হতে পেরেছে হিন্দুর তুলনায় মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি। এই ধারণার কিছুটা সমর্থন পাওয়া যায় এই ঘটনা থেকে, যেসব মুসলমান যুবক হিন্দু মেয়েকে বিবাহ করেছেন, তারা হতে পেরেছেন অধিক সন্তানের জননী। ইংরেজ আমলে জোর করে হিন্দুকে মুসলমান করবার সুযোগ ছিল না। তাই বলা চলে না বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হিন্দুদের বল প্রয়োগ করে মুসলমান করা।
গণতন্ত্রের একাধিক রাজনৈতিক দল থাকবেই। বৃটেনে আছে একাধিক রাজনৈতিক দল। বৃটেনে প্রথম প্রতিষ্ঠা পায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র। নির্বাচন আরম্ভ হয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধি হবার জন্য। আর এই জন্যই বিলাতেই প্রথম সৃষ্টি হতে পারে রাজনৈতিক দল। কিন্তু বিলাতের আইনে রাজনৈতিক দলের কোনো স্বীকৃতি নাই। রাজনৈতিক দল সেখানে হলো আইনের বাইরে বাড়তি প্রতিষ্ঠান। তা আইনিও নয় আবার বেআইনিও নয়। রাজনৈতিক দলকে বলে Extra Legal Growth। বিলাতের কোনো লিখিত সংবিধান নাই। বিলাতের শাসন ব্যবস্থা চলেছে বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্টকৃত কতকগুলো অ্যাক্টের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে লিখিত সংবিধান। তাতেও নাই কোনো রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি। সেখানেও রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে এক্সট্রা লিগ্যাল গ্রোথ হিসেবে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের আইনি নিবন্ধন ব্যবস্থা কেন করা হয়েছে, আমার কাছে তা স্বচ্ছ নয়। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, জামায়াত-ই ইসলাম একটি সংবিধান সম্মত দল নয়। তাই সে পারছে না জাতীয় নির্বাচনে দল হিসেবে অংশগ্রহণ করতে। অথচ এদেশেও সে পেরেছে এক সময় দল হিসেবে দাঁড়াতে। কেবল তাই নয়, হতে পেরেছে মন্ত্রিসভার সদস্য। জামায়াত দল হিসেবে দাঁড়াতে না পারলেও, জামায়াতের প্রার্থীরা কম করে ২৩ জন দাঁড়িয়েছেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। এছাড়া বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়েছেন নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে। জামায়াত-ই ইসলামকে আইনের মাধ্যমে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। জামায়াতই ইসলামকে সমালোচনা করা হচ্ছে একটি ইসলামী জঙ্গিবাদী দল হিসেবে। কিন্তু সে যদি জঙ্গিবাদ চায়তো, তবে নির্বাচনে অংশ নিত না। আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা আমার বোধগম্য নয়। কেননা, যে বামপন্থি দল একদিন চেয়েছিল বাংলাদেশে আফগান স্টাইলে বিপ্লব করতে অর্থাৎ সম্পূূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে, তাদের কিন্তু সংবিধান পরিপন্থি দল হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ একদিন করেছিল বাকশাল প্রতিষ্ঠা। বাকশাল ছিল একটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখনও আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থার জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ করেনি। কিন্তু তাকে পোহাতে হচ্ছে না কোনো আইন আদালতের ঝঞ্ঝাট। ইলেকশন কমিশনার বলেছেন, জামায়াত-ই ইসলামীর যেসব সদস্য নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অথবা নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন, তারা নির্বাচন করতে পারবেন। তার এই সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই মনে হবে গণতন্ত্রের অনুকূল। ধর্ম কেবল যে আমাদের দেশের রাজনীতিতেই সংযুক্ত হতে পারছে তা নয়। ইউরোপের বহু দেশেই আছে ক্যাথলিক খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক দল। বিশেষ করে জার্মানিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানি বিভক্ত হয় পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানিতে। পশ্চিম জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে খ্রিষ্টীয় গনতান্ত্রিক দল। আর তাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে গড়ে উঠে পশ্চিম জার্মানি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে। এখন পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানি একত্রিত হয়েছে। জার্মানির চ্যান্সেলর হয়েছে এ্যঞ্জেলা মর্কেল। তিনি হলেন একজন খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী। বাংলাদেশে ইসলামপন্থি হবার কারণে কেন তাকে একটি অনিবন্ধিত দল হতে হবে, সেটা বুঝা যথেষ্ট কঠিন। ধর্ম মানুষকে একটা উৎসর্গের মনোভাব প্রদান করে। যা মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে সেবামূলক রাজনীতিতে। আমাদের রাজনীতির একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে যে, এই রাজনীতি যতটা না সেবামূলক, তার চাইতে অনেক বেশি হলো দাবিমূলক। যদিও দেশে সেবামূলক রাজনীতির প্রয়োজনই বেশি। রাজনীতিতে থাকতে হয়, যাকে বলে পাবলিক স্পিরিট (Public Spirit)-এর প্রাধান্য।
২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ খ্রি.। নয়াদিগন্ত

Address

Patgram

Telephone

+8801767063383

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when পরিলেখ প্রকাশনী posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to পরিলেখ প্রকাশনী:

Share