22/08/2023
স্ত্রী গর্ভবতী। জরুরী পাঁচ হাজার টাকা দরকার। সাতপাঁচ না ভেবে সঙ্গে সঙ্গে টাকাটা ধার দেই। এরপর পেরিয়ে গেছে ১১ মাসের বেশি। কম হলেও ত্রিশবার সেই টাকা ফেরত চেয়েছি। আজ না কাল এভাবে সময় যাচ্ছে।
বাবার প্রথম বিমান ভ্রমণ-সমুদ্র দর্শন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গতমাসে কক্সবাজার ঘুরে এলেন। রাগে-ক্ষোভে আর টাকাটা চাইনি। নিজের কাছেই নিজের লজ্জা লাগছে।
তখন তিন হাজার টাকা বেতন পাই। একজন কলিগ হঠাৎ হুড়মুড় করে আমাকে টেনে অফিসের ব্যালকনিতে নিয়ে গেলেন। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন- বাবা অসুস্থ এখনই বাড়ি যেতে হবে। সদ্য পাওয়া বেতনের তিন হাজার টাকাই তুলে দিলাম। এ পর্যন্ত একশবারের অধিক চেয়েছি। ফেসবুকের ইনবক্স ভর্তি অনুনয়-বিনয়। মন গলেনি। তেরো বছর পার হয়েছে। ফেরত দেয়নি। আমি ভুলিনি। আড্ডা মারি এখনও, গল্প হয়। একেকদিনে আড্ডার বিল দেয় সাত/আটশ টাকা।
এক বড় ভাই বছর দুই আগে বিপদে পড়েছিলেন। ৫০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলাম বিনাবাক্যে। এরপর বেশ কয়েকবার ফেরত চেয়েছি, দেয়নি। কিছুক্ষণ আগে স্ট্যাটাসে দেখলাম-ইন্ডিয়াতে গেছেন। ইনবক্সে নক করলাম, বললো ঈদের শপিং করবেন। দিন তিনেক পর ফিরবেন।
কিছু বলিনি। নিজেকে বোকা বোকা লাগছে।
ইউনিভার্সিটির একটা ছেলে মায়ের অসুখ, ঘরে খাবার পর্যন্ত নেই। কাতরভাবে ইনবক্স করলো। খবর নিয়ে নিশ্চিত হলাম, আসলেই মায়ের অসুখ। ছয় হাজার টাকা দিলাম। বললো ভাইয়া ফেরত দিব। ৭/৮ মাস। রংবেরঙের ছবি দেখি ফেবুতে। টাকাটা দেয়না।
মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্থে নয় চরিত্রে। স্রোতের সঙ্গে গা ভাসানোর আয়োজন। দশ টাকা থাকলে দশ হাজারের ফুটানি। ভাসাভি, ইল্লিইনের সামনে সিরিয়াল। বসুন্ধরা, যমুনায় জায়গা নেই। নিউমার্কেটে পা ফেলতে পারবেন না। মানুষ ছুটছে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর।
হলফ করে বলতে পারি এই পিৎজা প্রজন্মের অনেকের পকেটে পরের দিনের খাবারের টাকা নেই। অনেকে লাখ টাকা বিলাসিতায় খরচ করছে। অথচ পরের মাসের বেতন নির্ভর। চাকরি বা উপার্জন না থাকলে হাত পাততে হয়। বড় চিকিৎসার দরকার হলে বন্ধু-পরিচিতজনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে। অথচ এখন রাজকীয় জীবন, একটু সঞ্চয় নেই। একটু খবর নিয়ে দেখেন, যারা নিজেদের ঢোল পিটাচ্ছে- ঐশ্বর্যের জয় গান গাচ্ছে, ভিতরটা পুরাই ফাঁপা।
শুক্রবার বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার করলাম কাঁটাবন মোড়ে। বাইকটা ফুটপাতের উপরে ঢাল ঘেষে রেখেছিলাম। যাতে মানুষের চলাচলে অসুবিধা না হয়। অফিসে ফিরতে হবে। ইফতার শেষে তাড়াহুড়া করে বাইক নামাতে গেলে স্লিপ কাটে। পড়ে যাই। আমার বাইক ঘেষেই দুটি কাপল দাঁড়ানো। আশেপাশেও কয়েকজন সিগারেট ফুঁকছে। পোশাক-আশাকে কেতাদুরস্ত। একটা মানুষ এগিয়ে এলোনা। উপর-নীচ বলে তুলতে কষ্ট হচ্ছিল। ভেবেছিলাম কেউ না কেউ দৌঁড়ে আসবে। নাহ, আমার ধারণা ভুল ছিল। বেশ কয়েকবার অনেকেই তাকিয়েছে।
খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখনও ভুলতে পারিনি। অসহায় লাগছিল খুব।
এই আমাদের জেনারেশন। এটাই আমাদের মধ্যবিত্তের রূপ। সব বদলে গেছে। ভিতরে ফাঁপা, বাইরে ঝকঝকে। অথচ কিচ্ছু নেই। একটু বাতাসেই হালকা প্রলেপ খসে পড়বে।
Fact; টাকা।
সংগ্রহীত।