18/04/2025
বড়াইবাড়ী সীমান্ত যুদ্ধ।
২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল আমি ৫ম শ্রেণির ছাত্র বিকালে কোচিং গিয়ে বন্ধুদের কাছে জানতে পারলাম ভোর থেকে বড়াইবাড়িতে যুদ্ধ শুরু হয়েছে , আমার বয়স মাত্র ১১ বছর সীমান্ত /যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণাই নাই, সেদিন আর কোচিং চলল না বাসায় আসলাম, সন্ধ্যা নেমে আসছে বাড়ির সামনের রাস্তায় মানুষের গমগম আওয়াজ, বোঝার চেষ্টা করছি, দলে দলে শিশু, বৃদ্ধ, নর নারী গৃহপালিত পশু পাখি নিয়ে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত থেকে ছুটছে আর বলছে যুদ্ধ লাগছে গো যুদ্ধ।
বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম জানার চেষ্টা করছি আসলেই কি হয়েছে, দেখি পাঠ্য বইয়ের মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের অবিরত ছুটে চলার সাথে মিলে যাচ্ছে।
এদিকে আব্বা কৌতূহলী হয়ে সন্ধ্যা ৭.৩০ রেডিওতে বিবিসি বাংলার খবর শুনছে আর আম্মা দুই মেয়েকে কাছে বসিয়ে কিছু বলছে আর ঘামছে আমাকে দেখে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছে, তখনই বুঝলাম কিছু একটা ঘটেছে যেটা আম্মা লুকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা বারবার জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে আম্মা? রাস্তায় দেখি দলেদলে মানুষ ছুটছে আর বলছে যুদ্ধ লেগেছে নাকি? কিসের যুদ্ধ? হঠাৎ আব্বা বলে চুপ কর তো খবর শুনতে দাও তখন রেডিওতে শুনলাম "সিলেটের পাদুয়া ও রৌমারীর বড়াইবাড়ী নামক স্থানে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে উত্তেজনার এক পর্যায়ে বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে গুলি বিনিময়ের খবর পাওয়া গেছে"
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে গরু ছাগল হাঁস মুরগী নিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে ছুটে চলা মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকল নানা দুষ্চিন্তায় রাত গড়িয়ে ১৯ এপ্রিল ভোর হলো।
সবকিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল হঠাৎ শুনতে পারলাম এলাকার সকল তরুণ যুবক বড়াইবাড়ী সীমান্ত যুদ্ধ করার জন্য রওনা হচ্ছে আমিও যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করায় আম্মা আমার উপর নজরদারি বাড়িয়ে দেওয়ায় তা আর সম্ভব হল না, এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর উচ্চশব্দে মাইকিং হচ্ছে বাড়িতে ব্যাংকার করে আত্মরক্ষার অনুরোধে চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আম্মা আব্বার চোখে মুখে।
আমরা ছয় ভাইবোন বড়ভাই ঢাকা ও ছোট্ট ভাই ময়মনসিংহ, বড়আপা শ্বশুর বাড়ী, মেজো আপা ছোট্ট আপা আর আমি বাড়িতে, আব্বা খুবই শক্ত মানুষিকতার লোক কিন্তু আম্মা দুই বোনকে এই পরিস্থিতিতে সুরক্ষিত রাখা নিয়ে বেশ আতংকিত মনে হচ্ছে।
এদিকে খবর আসছে তিন বিডিআর জওয়ান শহীদ হয়েছেন তার মধ্যে একজন একবারেই তরুণ তার মৃত্যুকে কেউ মেনে নিতে পারছেন না, মুহুর্তে খবর আসল আজকে নাকি ভারতীয় বাহিনী রৌমারী উপজেলা সদরে আক্রমণ করবে এই খবরে আশেপাশের বাড়ীঘড় শূন্য হতে শুরু করেছে, রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে জলচকিতে বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষকে শুইয়ে কেউ হাঁস মুরগী খাঁচায় ভরে কেউ বা গরু ছাগল নিয়ে দ্বিকবিদিক ছুটছেন এর মধ্যে একটি খবর সেই সময় খুবই আলোড়িত করেছে কোন মা তার ছোট্ট শিশুকে কাঁথা পেচিয়ে বেশকিছু রাস্তা এসে দেখে কাঁথার ভিতরে বাচ্চা নাই তারপর গগনবিদারী চিৎকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল।
এই ঘটনা আমাকে এতটাই আতংকিত করেছিল আমি বারবার আম্মাকে বলতেছিলাম মা যদি আমি ঘুমিয়ে যাই আমাকে ফেলে যাইয়েন না, কিছুক্ষণ পর গুজব উঠলো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের স্থল ভাগে নাকি প্রচুর পরিমাণে ভারতীয় বাহিনী প্রবেশ করেছে এই খবরে মানুষ বাজারে দোকান পাট এমনকি ক্যাশবাক্স বন্ধ না করেই যে যার মতো পালাচ্ছে।
আশেপাশের বিভিন্ন জন আমাদের বাসায় এসে আব্বা আম্মাকে বলছেন আপনারা এখন বাড়ি ঘড় ছাড়েন নাই যে, গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘড় তো ইতোমধ্যে শূন্য হয়ে গেছে, আব্বার সিদ্ধান্ত তিনি কোনভাবেই বাড়িঘর ছাড়বেন না কিন্তু আম্মার করুণ আকুতি চল আমরা অন্তত বাড়িঘড় ছেড়ে পশ্চিম দিকে এগুতে থাকি।
আজ রাতেই ভারতীয় বাহিনীর বিমান হামলার সমূহ সম্ভাবনার কথা বলে গেছে আমার এক মামা কিন্তু আব্বা এত সহজে বাড়ি ছাড়তে নারাজ তারপরও আম্মা আমার দুই বোন ও আমার কান্না জরিত আকুতিতে রাজি হল আব্বা কিন্তু গন্তব্য নিয়ে চলতে থাকল নানা পরিকল্পনা, আম্মা কিন্তু ইতোমধ্যেই ব্যাগ, ট্রাঙ্ক, শুকনো খাবার, খাবার পানির পট আর হারিকেন প্রস্তুত করে রেখেছেন।
দুপুরের পর শুরু হল মুসলধারে বৃষ্টি, শীতল নিস্তব্ধতা, বৃষ্টি কমতে না কমতেই কয়েকজন খবর নিয়ে এল ভারতীয় বাহিনীর স্থলভাগে প্রবেশের খবরটি সম্পূর্ণ ভূয়া, খবর শুনে আমাদের মাঝে স্বস্তি আসল ঠিকই কিন্তু বিমান হামলা ঘটনাটি তখনও আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, আপাতত বাড়িঘর না ছাড়ার সিদ্ধান্ত আম্মা মেনে নিল বহুকষ্টে।
হঠাৎ সন্ধ্যার পর দক্ষিণ পূর্ব আকাশে বিশাল আলোর ঝলকানি পূরো অঞ্চলে নতুন করে আতংকে নিমজ্জিত হয়েছিল আর আমরা বিমান হামলার পূর্ব প্রস্তুতি ভেবে তৎক্ষনাৎ প্রস্তুতকৃত ব্যাগ, ট্রাঙ্ক, শুকনো খাবার, পানির পট,আর হারিকেন নিয়ে আমি আব্বা, আম্মা ও দুই বোন রওনা হলাম তখনও আমি জানিনা আমাদের গন্তব্য কোথায় কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম আমরা রওনা হয়েছি বড় আপার বাসায় রৌমারী গ্রাম।
আব্বা আমাদের বড় আপার বাড়িতে রেখে রওনা হলেন নিজ বাড়িতে আমরা সেই রাত বড়আপার বাসায় থাকলাম পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ঠান্ডা হল আমরা বাসায় ফিরে আসলাম।
দীর্ঘ ২৪ বছর পর স্মৃতিকে জাগ্রত করলাম ভয় আতংক শিহরণ সবই অনুভূত হল সেই আগের মতোই।
লেখাঃ ©কালেক্টেড