09/07/2025
ঢাকার একটি নামকরা প্রাইভেট ব্যাংকে ইন্টারভিউ চলছে। ভেতরে বোর্ডরুমে বসে আছেন ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজারসহ একাধিক বোর্ড মেম্বার। কড়া ইন্টারভিউ, কঠিন প্রশ্নোত্তর পর্ব।
বাইরে অপেক্ষা করছেন প্রার্থীরা। হঠাৎ একজন মাঝবয়সী মহিলা, হিজাব পরা, একটু স্নিগ্ধ মুখশ্রী, সাধারণ পোশাকে একটি ফাইলে চোখ রাখছেন। অনেকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছে—বয়স বেশি, স্টাইল নেই, হয়তো যোগ্যতাও নেই—এই ভেবে।
অবশেষে ডাক পড়ল—"রুহি বেগম"।
রুহি বেগম বোর্ডরুমে ঢুকতেই সবাই একটু অবাক। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। সিভিতে লেখা—“বিএসসি ইন ম্যানেজমেন্ট, পাশের বছর ২০০৭!”
চেয়ারম্যান একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন,
– “আপনি তো প্রায় ষোল বছর আগে পাশ করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে কোনো কাজ করেননি?”
রুহি বেগম শান্তভাবে বললেন,
– “জি না, স্যার। আমি সংসার করতাম। আমার স্বামী মারা গিয়েছিলেন ২০০৮ সালে, তখন আমার কোলের বাচ্চাটা মাত্র তিন মাসের ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নেই, ওকে মানুষ করতেই হবে।”
বোর্ড সদস্যদের একজন বললেন,
– “কিন্তু এতবছর পর হঠাৎ চাকরি করতে চান কেন?”
তিনি ধীরে ধীরে বলতে থাকেন,
– “স্যার, আমার ছেলে এখন ভার্সিটিতে পড়ছে। এতদিন আমি স্কুলে গৃহশিক্ষকতা করেছি, সেলাই করেছি, হেঁসেল চালিয়েছি—সবকিছু। ছেলেটাকে এতটুকু করেছি নিজের হাতেই। এখন ও বলেছে, ‘মা তুমি নিজের জন্য কিছু করো।’ তাই আমি আবার পুরনো বই খুলে বসেছি, কম্পিউটার শিখেছি, ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি।”
চেয়ারম্যান একটু মুচকি হেসে বললেন,
– “এই বয়সে কি আপনি ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারবেন?”
রুহি বেগম বললেন,
– “স্যার, একটা সংসারের বাজেট চালানো, স্কুলের বেতন মেটানো, বাজারের দাম সামলানো, একা সন্তান মানুষ করা—এই চ্যালেঞ্জ যদি পারি, ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ সামলানো আমার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।”
আরেকজন প্রশ্ন করলেন,
– “আপনার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কোনটা ছিল?”
তিনি একটু থেমে বললেন,
– “যখন আমার ছেলের স্কুল ফিস দিতে পারিনি। সেদিন রান্না করার মতো তেল ছিল না। এক কাপ চা বানিয়ে ওর সামনে বসে বলেছিলাম, ‘মা পারবো না আর... সব কিছু বড় কঠিন লাগছে।’ তখন আমার ছেলেটা গরম চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলেছিল, ‘এই চায়ের কাপটাই আমাদের নতুন স্বপ্ন হবে মা। তুমি যদি হাল ছাড়ো, আমরা শেষ। কিন্তু তুমি লড়ে গেলে, একদিন আমরা জিতবো।’
সেই এক কাপ চা আমাকে আবার দাঁড় করিয়েছিল, আবার লড়ার শক্তি দিয়েছিল।”
ঘরটা নিঃশব্দ। কেউ আর প্রশ্ন করে না। কিছুক্ষণের নীরবতা ভেদ করে চেয়ারম্যান বললেন,
– “আপনার ছেলে কি জানে আপনি আজ ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?”
রুহি বেগম মাথা নেড়ে বললেন,
– “জি না। আমি বলেছি, বাজারে যাচ্ছি। আমি চেয়েছিলাম, যদি কিছু করতে পারি তবে এক কাপ চা বানিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিতাম। বলতাম, ‘আজ মা একটা চাকরি পেয়েছে।’”
চেয়ারম্যান চোখ মুছলেন চশমার আড়ালে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– “আপনি এই চাকরি পেয়েছেন, রুহি বেগম। শুধু হিসাবের জন্য নয়, এই প্রতিষ্ঠানে সাহস শেখাতে আপনার মতো মানুষ দরকার।”
বাকিরা করতালি দিলেন।
রুহি বেগম চোখ মুছলেন, একটু কাঁপা গলায় বললেন,
– “আজ আমি বাসায় ফিরব। চুপচাপ রান্নাঘরে ঢুকে ওর জন্য এক কাপ চা বানাবো।
তারপর ওর সামনে বসে বলব—
‘মা, অনেক বছর আগে তুই যে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলেছিলি— “এই চা দিয়ে শুরু হবে আমাদের স্বপ্ন”—
আজ মা সত্যিই সেই কাপটা পূর্ণ করে ফিরেছে।
আজ আর সেটা শুধু চা না,
আজ সেটা তোমার মায়ের আত্মবিশ্বাস, সম্মান আর বিজয়ের স্বাদ।’”