06/10/2024
প্রচলিত অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং এর শরীয়াহ্ বিধান
মৌলিকভাবে মুদ্রার এক্সচেঞ্জ বা লেনদেন শরীয়াহতে অনুমোদিত। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নানা কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। যা জীবনের জন্য অপরিহার্য। তবে অন্যান্য লেনদেনের মতো-এ লেনদেনও যেনো পুরোপুরি মানব কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে, সেজন্য কিছু শরীয়াহ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সেগুলো অনুসরণ করতে হবে। এর ব্যত্যয় করে মুদ্রার লেনদেন করা হলে, তা বৈধ হবে না। অর্থনৈতিক সার্বিক কল্যাণও এতে থাকবে না।
মুদ্রা লেনদেন বা ফরেক্স-এর ক্ষেত্রে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে শরীয়াহর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেছে, তা হল-মুদ্রার সাথে মুদ্রার লেনদেনের সময়-উপস্থিত উভয় পক্ষ মুদ্রা হস্তগত করতে হবে। চাই সেই হস্তগত প্রকৃত অর্থে হোক বা বিধানগতভাবে হোক।
এ শর্তারোপের কারণ কি? প্রথমত, মুদ্রা যদি উভয় পক্ষে অ-হস্তগত থেকে যায়, তখন লেনদেনটি কার্যত Debt to Debt transactions হয়ে যায়। এটি অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করে। ২০০৮ এর ইকনোমিক ক্রাইসিসের পেছনে এটি ছিল অন্যতম।
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী লিখেছেন-
إن هذه السوق جعلت العملات محل التجارة بنفسها بما أحدث فساداً كبيراً في النظام المالي المعاصر
‘এই ফরেক্স ব্যবসার বাজারগুলো মুদ্রাকে
ব্যবসায়িক পণ্য বানিয়ে ফেলেছে, যা বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অনেক বড় বিপর্যয় তৈরি করেছে।’
(ফিকহুল বুয়ু, পৃ.৭৬৪, বিস্তারিত দেখুন-মুফতি সাহেবের ইংরেজী প্রবন্ধ: Causes and Remedies of the Recent Financial Crisis From an Islamic Perspective By M***i Muhammad Taqi Usmani Paperback 47 Pages)
ব্যক্তিগত লেনদেনে হয়তো এটি কারও কাছে সমস্যা মনে নাও হতে পারে, হয়তো বলবেন-আমি একা এমন লেনদেন করলে অর্থনীতির কিইবা আসে যায়। এটি এমন হল, যেমন কেউ বলতে পারে-আমরা দু’জন রাজি-খুশীর সাথে সুদী কারবার করলে অর্থনীতির কিইবা ক্ষতি হবে। মূলত ইসলাম সামগ্রিক জীবন ও সমাজের কথা ভাবে আগে। তাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে কখনও নিষিদ্ধতার কারণ উপলব্ধি না হলেও, সামগ্রিকভাবে যেহেতু তা ক্ষতিকর, তাই তা ব্যক্তিগতভাবেও নিষিদ্ধ থাকবে-এটিই যৌক্তিক।
আলোচিত অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং-এ মুদ্রা হস্তগত করার বিষয়টি (যেভাবে শরীয়াহ বলে) কোনও পক্ষ থেকেই পাওয়া যায় না। তাই এ ধরনের লেনদেন বৈধ নয়। হাদিসে এসেছে—
‘মুদ্রা যখন ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় হবে, তখন যেভাবে
খুশী লেনদেন করতে পারো, তবে হাতে হাতে হতে হবে।’ (সহীহ মুসলিম ১৫৮৭)
প্রকাশ থাকে যে—ভিন্ন ভিন্ন দেশের মুদ্রা পরস্পরে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এছাড়া উভয় দিকে দায় থাকাবস্থায় লেনদেন সম্পন্ন করাও নিষেধ। এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা রয়েছে। ইবনে কাত্তান রহ. বলেছেন-
أجمع كل من يحفظ عنه من أهل العلم، على أن بيع الدين بالدين لا يجوز" انتهى . (208 (2) من الإقناع في مسائل الإجماع
‘নির্ভরযোগ্য আলেমদের সকলে এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন যে, দায়ের বিপরীতে দায় বিক্রয় করা না জায়েয।’
বিখ্যাত ফতোয়ার গ্রন্থ ফতোয়া শামিতে আছে-
‘কিছু পয়সা সমপরিমাণ পয়সার বিনিময়ে বা দিরহাম-দিনারের বিনিময়ে বিক্রি করল, এখন দুনোটার কোনো একটা যদি নগদ পরিশোধ করা হয়
তাহলে ক্রয়-বিক্রয় জায়েয হবে। আর যদি কোনো একটা হস্তগত করা ব্যতিত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে পৃথক হয়ে যায় তাহলে উক্ত ক্রয়-বিক্রয় জায়েয হবে না।’
আর আল্লামা ইবনু আবেদীন রহ. উক্ত বক্তব্যের অধীনে লিখেন-
‘‘কেননা, এটা ঋণের বিপরীতে ঋণের বিক্রয় হওয়া স্বত্তেও কোনো পক্ষই পণ্য হস্তগত করেনি। আর ঋণের বিপরীতে ঋণের ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা কোনো পক্ষ পণ্য হস্তগত না করে, উভয়ের পৃথক হয়ে যাওয়া সহীহ নয়।’’ (ফতোয়া শামী ৫/১৭৯)
প্রচলিত অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং বিষয়ে ফতোয়া,
ইসলামী ফিকহ কাউন্সিল, মক্কা-এর ফতোয়া
রাবেতা আ’লামিল ইসলামী (Muslim World League) এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘আল-মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী’ (Islamic fiqh Council) এর ১৩ তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে। এতে ফরেক্স ট্রেড ও Dealing with margins নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর যে শরীয়াহ সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়, তা হলো
يرى المجلس أن هذه المعاملة لا تجوز شرعاً
‘অত্র অধিবেশনের রায় হলো, এই ধরনের লেনদেন শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে জায়েয নয়।’
এরপর এর নানা শরীয়াহ কারণ তুলে ধরা হয়। তন্মোধ্যে অন্যতম-
بيع وشراء العملات يتم غالباً دون قبض شرعي يجيز التصرف
‘পণ্য ব্যবহারের অনুমতি প্রদানকারী শরয়ী কবযা (পণ্য হস্তগত করণ) ব্যতিতই, মুদ্রার লেনদেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পন্ন হয়ে যায়।’
মুফতি তাকী উসমানী দা.বা. এর ফতোয়া
বর্তমান ইসলামী বিশ্বের অন্যতম ইসলামিক স্কলার, শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী হাফি. এর এ বিষয়ে দুটি ফাতওয়া রয়েছে। এক. ২ রা সফর, ১৪২০ হিজরীতে প্রকাশিত ফতওয়া। দুই, জুমাদাল উখরা, ১৪২৪ হিজরীতে প্রকাশিত ফতওয়া।
হযরতের প্রতিষ্ঠান জামিয়া দারুল উলুম করাচী, পাকিস্থান এর ফতোয়া বিভাগে অধম লেখক ফরেক্স বিষয়ে ইস্তেফতা (প্রশ্ন) করলে তাঁরা হযরতের সত্যায়িত ফতোয়ার মূল কপিটি স্কেন করে ই-মেইলে পাঠিয়ে দেয়। (আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন) উভয় ফতওয়ায় হযরত আলোচিত ফরেক্স ট্রেডকে নাজায়েয বলেছেন। একে জুয়ার একটি প্রকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর থেকে মুসলমানদের বেঁচে থাকা জরুরী বলেছেন।
মিশরের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগের ফতোয়া
২০১৪ খৃ. ২২ এপ্রিল মিশরের কেন্দ্রিয় দারুল ইফতা ‘দারুল ইফতা আল মিসরিয়্যাহ’ তাদের অফিসিয়াল সাইটে ফরেক্স বিষয়ে বিস্তারিত ফতোয়া প্রকাশ করেছেন। তাতে তারা মোট ৬ টি কারণে লেনদেনটি নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়েছেন।
মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম হাফিজাহুল্লাহ
(ফতোয়ার পুরো প্রবন্ধটি কমেন্টে দেওয়া)