26/07/2025
কেন বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সার ছয় মাসে থেমে যায়?
আমি প্রথম যখন ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি, তখন মনে হতো, এটা বুঝি সোনার খনি। নিজের মতো করে কাজ করবো, ক্লায়েন্টের থেকে উরাধুরা ডলার আদায়, আর মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা হাতে আসবে। তবে বাস্তবতা একেবারেই আলাদা ছিল।
-------
আমার এক বন্ধুর নাম ছিল। চট্টগ্রাম থেকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিল। প্রথম দিকে খুব আগ্রহ, ইউটিউব ঘেটে ঘেটে ভিডিও দেখে কাঁপিয়ে ফেললো। Fiverr, Upwork, সব জায়গায় প্রোফাইল খুলে ফেললো, সিভি তৈরি করলো, এমনকি ২টা কাজও পেয়েছিল। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় দেখি, সে আর ফ্রিল্যান্সিং করছে না।
সে বলছে "কাজ পাচ্ছিনা", তবে কথা বলে বুঝলাম সে আসলে "কাজ পাওয়ার জন্যে প্রতিনিয়ত রিসার্চ করছিনা" পরিস্থিতিতে ভুগছে।
তখন মাথায় আসলো, এমন শুধু সে না, হাজার হাজার নতুন ফ্রিল্যান্সার শুরুতেই হার মেনে ফেলে। প্রশ্ন উঠলো, কেন এমনটা হয়?
-----
১। কম ধৈর্য
নতুন ফ্রিল্যান্সাররা ভাবে, "কয়েক মাস কাজ করলেই ডলার আসা শুরু হবে।" কিন্তু তারা বোঝে না, এ প্ল্যাটফর্মে প্রতিযোগী লাখ লাখ, অলরেডি অনেকেই এক্সপার্ট ওখানে আছে। ক্লায়েন্ট কাকে কাজ দিবে, তা নির্ভর করে স্কিল, প্রেজেন্টেশন, ও রিভিউ-এর উপর। কাজ পেতে সময় লাগে, ধৈর্য লাগে। এই ধৈর্যের অভাবেই অনেকে হাল ছেড়ে দেয়।
২। অতিরিক্ত প্রত্যাশা
৬ থেকে ১৮ মাস পরিশ্রম করার মানসিকতা রাখতে হবে। চাকরি পেতে অনেক বছর পড়ালেখা প্রয়োজন হয়, ভালো চাকরির ক্ষেত্রে অনেক লম্বা সময় অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয় আগে, ব্যবসায় বড় ইনভেস্ট লাগে পাশাপাশি অনেক বছর অনেক ক্ষেত্রে লসেই যায়, সেখানে ফ্রিল্যান্সিং করতে এসে এমন ভাব রাখা চলবেনা যেন এটা একটা ম্যাজিক। বিশেষ করে উল্টাপাল্টা নিউজ দেখে একটা প্রত্যাশা আসে যে এটাই মাসখানেকে উড়ায় ফেলবে! সত্যি বলতে আমি পরিচিত অনেক জনকে দেখেছি, কয়েক মাসেই লাখটাকা কমিয়ে ফেলতে। আবার অনেক জনকে দেখেছি বছরখানেক কষ্ট করার পর কাজ পেয়েছে - এরপরে নিয়মিত পাচ্ছে। তবে দুজনের মধ্যেই মিল হলো মানসিকতার, তারা এখানে রাজ্ করতে এসেছে - তা কয়েক মাস লাগুক বা বছর। তাই আপনি যদি এই সেক্টরে থাকতে চান মানসিকতা রাখবেন যে ৬ থেকে ১৮ মাস পরিশ্রম করার।
২. শেখার চেয়ে ইনকাম-এর পেছনে ছোটা
অনেকেই প্রপারলি শেখার আগেই টাকা কামাতে চায়। স্কিল ভালো না, অথচ তারা ভাবে বিড করার সময় কয়েকটা ভালো কথা লিখলেই কাজ চলে আসবে। কাজ তো আসে না, তার উপর মনোযোগ হারায়, হতাশ হয়। প্রথম দিকের পুরো সময়টা নিজের শেখার মধ্যে দিবেন, ইনকাম অবশ্যই আসবে আপনি যদি স্কিলড হোন
৩. নিজের ভুল খুঁজে না পাওয়া
একটা প্রপোজাল পাঠালো, কাজ পেল না। আবার পাঠালো, তাও না। তৃতীয়বারেও পেল না। তারপর বলে, “ফ্রিল্যান্সিং আমার জন্য না।” কিন্তু একবারও ভাবলো না, কোথায় ভুল হচ্ছে? প্রপোজালের লেখা ঠিক আছেতো? প্রোফাইল কি ঠিকভাবে সাজানো হয়েছে কি? আমার স্কিল কি পর্যাপ্ত ডিমান্ড আছে? এগুলো বিশ্লেষণ না করে হাল ছেড়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল। আমি বর্তমানে ভালো অবস্থায় আছি, তারপরেও মাঝে মাঝে নিজের সিস্টেমগুলো রিচেক করে দেখি কোথাও কিছু বেটারভাবে করার স্কোপ আছে কিনা। এবং অবশ্যই খুঁজে পায় কিছু না কিছু যা আরেকটু ভালো করে করা যায়। অথচ নতুন অনেকে একাউন্ট খুলে মাসের পর মাস বসে থেকে এরপর বলে "এক বছর হয়ে গেছে কাজ পায় না", এক বছরে কি কি ট্রাই করসে জিজ্ঞেস করলে তখন দিল্লিতে পালায়।
৪. সময় ব্যবস্থাপনার অভাব
ফ্রিল্যান্সিং মানে স্বাধীনতা ঠিকই, কিন্তু সেটা নিয়মহীন নয়। দিনের পর দিন যদি একটা রুটিন না থাকে, তাহলে ক্লান্তি আর অনিয়ম কাজের মনযোগ শেষ হয়ে যায়। অনেকেই এটাকে নিজের অবনতি হচ্ছে ভেবে ফ্রিল্যান্সিং ছেড়ে দেয়। চাকরি করলে কিন্তু আমরা আরেকজনের জন্যে টাইমে টাইমে পুরোদমে খাটতে রেডি থাকি, অথচ নিজের বস হতে নিজের ক্যারিয়ার করতে ফ্রিল্যান্সিং করার মাঝে আমরা হাঁপছাড়া ভাব নিয়ে সময় পার করি, ফলাফল? যেমন ইনপুট তেমন আউটপুট।
৫. সঠিক গাইডলাইন ও কমিউনিটির অভাব
শুরুতে কেউ যদি পাশে থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা না দেয়, তাহলে ভুল করে অনেকে। অনেকেই ইউটিউব দেখে অর্ধেকটা শেখে, কিন্তু সমস্যায় পড়লে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারে না। এই একাকীত্ব অনেককে ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। তাই একজন ভালো মেন্টর থেকে শেখা ভালো, অথবা ভালো কোনো কমিউনিটিতে নিয়মিত একটিভ থাকা যেন প্রশ্ন-উত্তর জানা যায়।
-----
তাই, যারা নতুন শুরু করছেন, তাদের বলবো, প্রথম ছয় মাস হলো আপনার ট্রেনিং গ্রাউন্ড। ভুল করবেন, হোঁচট খাবেন, হতাশ হবেন, তবু থেমে যাবেন না।
যদি ধৈর্য, শেখার ইচ্ছা আর সঠিক পরিকল্পনা থাকে, তাহলে এই ছয় মাসই আপনাকে বদলে দিতে পারে। আর হ্যাঁ, ফ্রিল্যান্সিং একটা যাত্রা, গন্তব্য না। তাই প্রতিটি দিন, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি প্রজেক্ট শিখে নিতে হবে।
শেষে একটা কথাই বলি, যারা প্রথম ছয় মাস টিকে যায়, হ্যা টিকা মানে একাউন্ট খুলে ফেইসবুকে দিনরাত পরে থাকা বুঝাচ্ছি না - দিনরাত স্কিল শেখা, কমিউনিকেশন ডেভেলপ করা, ক্লায়েন্ট হান্টিং, ইত্যাদি নিয়ে কায়ায়, তারাই একদিন অন্যদের অনুপ্রেরণা হয়।
আপনি হতে পারেন তাদের একজন।