18/12/2025
কুয়াশার চাদরে মোড়া পাহাড়ের ঢালে, শুকনো ঘাসের নরম বিছানায় বসে আছে রোহান। দূরের উপত্যকা আর আঁকাবাঁকা নদীটা কুয়াশার আবরণে ধীর গতিতে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো গোপন রহস্যের হাতছানি। বাদামী রঙের মোটা উইন্টার কোটটা তাকে উষ্ণতা দিচ্ছে, কিন্তু তার দৃষ্টিতে এক গভীর চিন্তার ছাপ। বাতাস বইছে এলোমেলো, তার চুলগুলো উড়ছে হালকা ছন্দে।
রোহানের মনে তখন এক অস্থির সমুদ্রের ঢেউ। সে এসেছে এই নির্জন পাহাড়ে, জীবনের কিছু জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। শহরের কোলাহল, নিত্যদিনের ব্যস্ততা—সবকিছু থেকে পালিয়ে সে আশ্রয় নিয়েছে প্রকৃতির এই নিস্তব্ধ কোলে।
তার মনে পড়ল প্রিয়তমা অবনীর কথা। তাদের সম্পর্কটা ইদানীং কেমন যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ভালোবাসা ছিল, কিন্তু সেই পুরনো আবেগটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অবনী বলতো, "তুমি আজকাল বড্ড বেশি চুপচাপ হয়ে গেছো, রোহান। কী ভাবো এত?" সে নিজেও জানত না কী ভাবতো। শুধু এক অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো।
হঠাৎ, বাতাস যেন আরও জোরালো হলো। দূরের অস্পষ্ট উপত্যকা থেকে ভেসে এল এক অচেনা সুর, যেন কোনো প্রাচীন বাঁশির করুণ তান। রোহান চমকে উঠল। সে জানে, এই পাহাড়ে কোনো জনবসতি নেই। তবে এই সুর কোথা থেকে আসছে? তার রোমাঞ্চপ্রিয় মন তাকে ইশারা দিল, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।
সে উঠে দাঁড়াল। অজানা সেই সুরের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল সে, ঘন কুয়াশার পথ ধরে। ঘাসগুলো তার পায়ে আলতোভাবে লাগছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে পথ দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে দেখল, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আবছাভাবে একটা পুরোনো পাথরের কাঠামো দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে সে বুঝল, এটা একটা প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
আর সেই সুর আসছে মন্দিরের ভেতর থেকে। কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে গেল আরও গভীরে। ভেতরে ঢুকে সে দেখল, একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বসে আছেন, তার হাতে একটা ভাঙা বাঁশি। সন্ন্যাসীর চোখ বন্ধ, ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি। রোহান কাছে যেতেই সন্ন্যাসী চোখ খুললেন।
"তুমি এসেছো," সন্ন্যাসী শান্ত কণ্ঠে বললেন, "আমি জানতাম তুমি আসবে।"
রোহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "আপনি কে? আর এই সুর...?"
সন্ন্যাসী হাসলেন। "আমি এই মন্দিরের শেষ প্রহরী। আর এই সুর, এটা হলো স্মৃতির সুর। যারা নিজেদের পথ হারিয়ে ফেলে, তাদের পথ দেখানোর জন্য এই সুর আমি বাজাই।"
সন্ন্যাসী রোহানের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোমার মনে অনেক প্রশ্ন, তাই না? জীবনের মানে, ভালোবাসার গভীরতা... সব হারিয়ে ফেলেছ বলে মনে হচ্ছে।"
রোহান মাথা নাড়ল। সন্ন্যাসী বললেন, "ভালোবাসা কোনো হারিয়ে যাওয়ার জিনিস নয়, বৎস। এটা হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকে। প্রয়োজন শুধু একে আবার খুঁজে বের করা।"
তিনি বাঁশিটা রোহানের হাতে দিলেন। "এই বাঁশি যখন বেজে ওঠে, তখন শুধু সুর নয়, স্মৃতিরাও ফিরে আসে। তোমার হৃদয়ের গভীরে ডুব দাও। দেখবে, অবনীর প্রতি তোমার ভালোবাসা আজও তেমনই উজ্জ্বল।"
রোহান বাঁশিটা হাতে নিয়ে বসে পড়ল। সন্ন্যাসী আবার চোখ বন্ধ করলেন। রোহান ধীরে ধীরে বাঁশিতে ফুঁ দিল। কিন্তু কোনো সুর বের হলো না। সে হতাশ হলো।
সন্ন্যাসী চোখ না খুলেই বললেন, "সুরটা বাইরে নয়, ভেতরে। নিজের হৃদয়ের স্পন্দনকে সুরের সাথে মেলাও।"
রোহান চোখ বন্ধ করল। সে অবনীর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে করার চেষ্টা করল। তাদের প্রথম দেখা, প্রথম প্রেম নিবেদন, হাতে হাত রেখে হাঁটা... স্মৃতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল তার চোখের সামনে। আর তখনই, এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। বাঁশি থেকে এক মিষ্টি, করুণ সুর বেরিয়ে এল, যা আগে শোনা সুরের মতোই মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
সে অনুভব করল, তার ভেতরের অস্থিরতা কেটে যাচ্ছে। অবনীর প্রতি তার ভালোবাসা ম্লান হয়নি, সে শুধু কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়েছিল। এই নির্জন পাহাড়, এই রহস্যময় সন্ন্যাসী আর এই জাদুর বাঁশি তাকে আবার পথ দেখাল।
সকাল হওয়ার আগেই রোহান পাহাড় থেকে নেমে এল, তার মনে এক নতুন আশার আলো। সে জানে, অবনীর কাছে ফিরতে হবে তাকে। এই পাহাড় তাকে শুধু স্মৃতির সুর শোনায়নি, বাঁচিয়ে তুলেছে তার ভালোবাসা, চিনিয়ে দিয়েছে তার রোমাঞ্চকর পথ। আর সে পথ হলো ভালোবাসার পথ।
"ধন্যবাদ, সন্ন্যাসী," মনে মনে বলল রোহান। সে জানত, এই অভিজ্ঞতা তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।