Aronno's Story

Aronno's Story পেজে অনেক কিছু পোস্ট করা হয় সেটাকে কেউ সিরিয়াস ভাবে নিবেন না।
(1)

প্রিয়_বেগম  #দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ  #পর্ব_১৫Collected মরিয়মকে ঘিরে বসে গল্প করছিল সকলে। হাজারো প্রশ্ন সবার, হাজারো কৌতূহল তাক...
11/08/2025

প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১৫
Collected

মরিয়মকে ঘিরে বসে গল্প করছিল সকলে। হাজারো প্রশ্ন সবার, হাজারো কৌতূহল তাকে জানার জন্য। মরিয়মও সবাইকে জানার জন্য অত্যধিক কৌতুহলী। একসময় বুঝতে পারলেন ইউভান অনেক ভালো ছিল এতগুলো বছর। ভালো মানুষের কাছে মানুষ হয়েছে। খোদেজা ছাড়া সকলেই উনার সাথে হেসেখেলে কথা বলেছে। কি এক জড়িমায় খোদেজা কক্ষেও আসেননি। পুত্রের উপর অভিমান কমে এলেও বেড়েছে পুত্রবধূর সাথে। সে তো কোনোদিন তার সাথে হেসেখেলে কথা পর্যন্ত বলেনি, আজ নিজ শ্বাশড়িকে কত যত্ন, কত হাসাহাসি। নিজের মা আর নিজের শ্বাশুড়িকে কত যত্ন করে খাওয়ালো। খাওয়াবেই তো। নিজের বলে কথা। পালিত মাও নয়,পালিত শ্বাশুড়িও নয়। সে তো কত খারাপ খারাপ কথা বলেছিল তার সাথে। তারা তো বলেনি।

শেহজাদ কক্ষে এসে দেখলো অপরূপা এখনো আসেনি। আজব মেয়ে, তার সামনেও আসছে না। সামনে না এলে রাগ ভাঙাবে কি করে? সে মা মরিয়মের কক্ষে চলে গেল।
তাকে প্রবেশ করতে দেখে সিভান বলে উঠলো,
' ভাইজান তোমার নামের সাথে আমার নাম বেশ মিল আছে। তুমি ইউভান আমি সিভান। তাই না?'
শেহজাদ চোখ সরু করে তাকিয়ে বলল,
' তাই তো। সেটা তো ভেবে দেখিনি। '
সিভান ফোকলা হাসলো। তারপর হাই তুলতে তুলতে বলল,
' ঘুম আসছে। আমি যাই। সবাইকে টা টা। '
যাওয়ার পথে শেহজাদ তার গাল টেনে দিল। সে গাল ঢলতে ঢলতে তার কক্ষে চলে গেল। বাকিরাও চলে গেল। অপরূপা মরিয়মের চুলে বেণী পাকিয়ে সামনে ফিরিয়ে বলল,
' হয়েছে? '
মরিয়ম হেসে বলল,
' হ্যা। রাত হয়েছে। ঘুমুতে যাও। '
অপরূপা শেহজাদের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,
' না। আর কিছুক্ষণ থাকি। ঘুম আসছে না। আপনি ঘুমান। '
মরিয়ম বালিশে শুয়ে বলল, ' তোমার মা ঘুমিয়েছে। '
' হ্যা মাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি।'
শেহজাদ কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকলো অপরূপার দিকে। মরিয়ম বালিশে শুয়ে চোখ বুঁজতে বুঁজতে বলল,
' ইউভান নিয়ে যাও তোমার বউকে। '
অপরূপা নিজেই উঠে এল। কক্ষ হতে বেরিয়ে যেতে যেতে ব্যঙ্গ করে নামটা ডাকলো,
' ইউভান! '
শেহজাদ তার পেছন পেছন এসে কক্ষের দরজা বন্ধ করে বলল,
' ভালোই লাগছে শুনতে। ওটা ডেকো। '
' আমার মাথা খারাপ হয়েছে আর কি। '
বিছানা গুছিয়ে পর্দা ফেলে জানালা বন্ধ করে অপরূপা মাথার নীচে হাত রেখে শুইয়ে পড়লো। শেহজাদ আলো নিভিয়ে পাশে এসে বসে থাকলো পিঠের নিচে বালিশ রেখে। অপরূপার দিকে তাকিয়ে রইলো।
গরম গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ে পড়তেই পিলে চমকে পাশ থেকে সোজা হতেই মুখের উপর একটা প্রিয়মুখের উপস্থিতি দেখতে পেল অপরূপা। সরে যাবে তখুনি তার গলার ভাঁজে নাক ডুবিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস টানলো শেহজাদ। রাগী সুরে বলল, স্বামীর আদর নেয়ার সময় ব্যাঘাত ঘটানো মহাপাপ।
অপরূপা তার কথা শুনে সব ভুলে ফিক করে হেসে উঠলো। শেহজাদ মুখ তুলে তাকাতেই অপরূপা তাকে জড়িয়ে ধরে রাঙা মুখ লুকোলো বুকের মাঝে।

___________

তটিনী ফজরের আজানের পরপর ঘুম থেকে উঠে গেল। মহলের অনেকে উঠে গেছে নামাজ আদায় করার জন্য। সায়রা সোহিনীরা সাড়ে পাঁচটার দিকে উঠে নামাজ পড়ে। বয়স্করা উঠে যায়। আজ তটিনীও উঠে গেল। নামাজ সেড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে শাহানার কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। দেখলো শাহানার দরজা আধখোলা। তটিনী উঁকি দিয়ে দেখলো আম্মা নামাজ পড়ছে। সে শেরহামের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। দরজা খোলা দেখে ভাবলো শেরহাম কক্ষে নেই। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতেই অবাক হলো শেরহামকে উদাম গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে। সারারাত কি দরজা এভাবে খোলা ছিল? পাগল নাকি, কেউ ঢুকে মেরে ফেললেও তো বলতে পারবেনা। তটিনীর রাগ লাগলো। এত বড় লোক নইলে ঠাস ঠাস করে চড়াতে চড়াতে গাল লাল করে দিত। ভাবনায় মেরেও দিল চড়। কিন্তু সত্যি সত্যি মারতে পারলে উচিত হতো। ভাবতে ভাবতে দেখলো টেবিলের উপর খাবার ঢাকা। বাসন তুলতেই দেখলো ভাত, ডাল,মাংস সব রয়ে গেছে। তারমানে খায়নি। তটিনীর আরও রাগ লাগলো। শেরহামের দিকে এগোনোর আগে বাইরে উঁকি দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর পাশে এসে বসলো। সে যেইহাতে তলোয়ারের কোপ মেরেছিল সেই হাতের সেলাই এখনো শুকোয়নি, তারমধ্যে আজকে আরেকটা আঘাত। এই লোক একেবারে মরে যেত তাও হতো। তার আর সহ্য হচ্ছে না। না ভালো সহ্য হচ্ছে, না খারাপ। একেবারে সামনে থেকে দূরে চলে গেলে ভালো হতো। না নিজে মরছে, না কাউকে মরতে দিচ্ছে। একদম পাশে পা টেনে বসায় শেরহাম নড়েচড়ে উঠে এল তার কোলে। মাথাটা কোলে তুলে দিয়ে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেল। তটিনীর সারা শরীরে কম্পন ধরলো শেরহামের মাথাটা উদরে ছোঁয়া লাগায়। কি গরম শরীর!
চোখ গেল কাঁধে, যেখানে তীর গেঁথেছে। সেখানে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ব্যান্ডেজেও রক্ত লেগে আছে। তটিনী কাঁপা কাঁপা হাত রাখলো শেরহামের কপালে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। কি আজব! এই লোকের কি জ্বরে, আঘাতে কিছু হয় না? এমন অযত্নে পড়ে থাকলে তো তাকে খুঁজেও পাওয়া যেত না। আর ইনি দিব্যি শান্তির ঘুম দিচ্ছেন। সে মাথাটা বালিশে রেখে নেমে গেল। দুটো শুকনো কাপড় ভিজিয়ে একটা কপালে জলপট্টি দিল। অপরটা দিয়ে দিয়ে গা মুছে দিল।
তারপর থালাবাসনগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরে এসে কপাল থেকে ভেজা কাপড়টা সরিয়ে তা পুনরায় ভিজিয়ে কপালে দিতেই দেখলো শেরহামের চোখদুটো খোলা। চমকে গেল সে। দাঁত চিবিয়ে বলল,
' জ্বর এসেছে। না খেয়েদেয়ে মরার মতো পড়ে রয়েছ কেন? মরে গেলে তো সবাই বলবে সবাই মিলে তোমাকে মেরে ফেলেছে। '

শেরহাম কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে বসলো। বসার সময় বাহু চেপে চোখ বন্ধ করলো। তারপর বসে খ্যাঁক করে উঠে বলল,

' ওই তুই এই ঘরে কি করিস? সারারাত দরজা খোলা রেখেছি আসিসনি। এখন কি করিস? ঢং করতে এসেছিস? তোকে কে বলেছে আমার সেবা করতে? এতবছর আমি তোর সেবা ছাড়া থাকিনি? তখনি কি তোর বাপ গিয়েছে আমার সেবা করতে?'

তটিনী চোখমুখ শক্ত করে বলল,

' তাহলে পঁচে মরো। '

বলেই ভেজা কাপড়টা শেরহামের মুখে ছুঁড়ে মেরে বেরোতে চলে যাচ্ছিলো। শেরহাম হাতটা ধরে টান দিয়ে তার গায়ে ফেলে জড়িয়ে ধরে নীচে ফেলে দিল। তটিনীর মেজাজ গরম হয়ে গেল। বলল, আমি চিৎকার করব।

' কর। সবাই জানুক তুই রাতে আমার ঘরে ছিলি। '

' নষ্ট লোক। '

' তুইও নষ্ট। '

তটিনী রাগ তরতরিয়ে বাড়লো। বলল,

' ছাড়ো। তালাক দাও। নইলে আমি তোমাকে তালাক দেব। তোমার সাথে একটা মুহূর্তও আমার থাকতে ইচ্ছে করছেনা। '

শেরহামের মেজাজ চট গেল। উঠে গেল সে।
তারপর তটিনীকে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে কক্ষের বাইরে ছুঁড়ে মারলো। তারপর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।

তটিনী দরজায় লাতি দিতে দিতে বলল,

' জা**নোয়ারের বাচ্চা আর ডাকিস আমাকে। মরে গেলেও আসবো না। '

শেরহাম তক্ষুণি দরজা খুলে বলল, ' যাহ, খাবার নিয়ে আয়। কাউকে দিয়ে পাঠালে খবর আছে। '

তটিনী বলল, ' আনবো না।'

শেরহাম হেসে উঠে বলল,

' আমি সবাইকে বলব তুই আমাকে আদর করতে এসেছিস সকাল সকাল। '

তটিনী রাগে ফুঁসতে লাগলো। বলল,

' শয়**তানের বাচ্চা। '

শেরহাম হাসতে হাসতে কেদারায় বসে পড়লো।
তারপর হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে দিয়ে মুখহাত ধুঁতে চলে গেল।

_______

রসাইঘরে শাহানা হামিদার সাথে ফুলকলি, মতিবানু কাজ করছে। তটিনীকে দেখে শাহানা জিজ্ঞেস করলো,

' কোথায় গিয়েছিলে? '

তটিনী চোখ নামিয়ে নেয়। ছোটস্বরে বলল,

' ওর জ্বর এসেছিল। দেখতে গিয়েছি। ফুলিআপা তাড়াতাড়ি রুটি পুড়ে ওর জন্য দিয়ে দাও। রাতে খায়নি। '

শাহানা বলল,

' ঠিক আছে। ফুলি দিয়ে আসবে। তুমি বোনদের ডেকে দাও। '

তটিনী নড়লো না একপাও। শাহানা তার দিকে তাকিয়ে বলল,

' কি হলো? '

' আমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। না নিয়ে গেলে চেঁচামেচি করবে সকাল সকাল। '

হামিদা বলল, ' আপা থাক এখন বারণ করো না। তনী সত্যি বলছে। চেঁচামেচি শুরু করে দিলে মেহমানরা কি বলবে? '

শাহানা কিছু বলল না। খোদেজা ফুলকলিকে বলল,

' এই তাড়াতাড়ি কর। '

রুটি হয়ে আসতেই তটিনী হালুয়া আর মাংসের ঝুরাঝোল বেড়ে নিল। তারপর নিয়ে গেল। খোদেজা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, মেয়েটাকেও বশ করলো নাকি? '

শাহানা বলল, ' আমি কি করে তাকে মুক্ত করব? '

খোদেজা বলল, ' আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। '

তটিনী কক্ষে খাবার নিয়ে এল। দস্তানা বিছিয়ে থালা রেখে বলল, ' খেয়ে উদ্ধার করো। '

শেরহাম চাবুক নিয়ে কি যেন করছে। তটিনী বলল,

' এসব কি? চাবুক দিয়ে কাকে মারবে? '

' তোকে। '

তটিনী আঁতকে উঠে বলল,

' মানে কি? জ্বরে পাগলের প্রলাপ। যত্তসব। সন্ধ্যায় কাজী আসবে। আমাকে কাগজে কলমে তালাক দেবে। '

শেরহাম চাবুক রেখে তার দিকে তেড়ে এসে বলল,

' সত্যি? '

তটিনী পিছিয়ে গিয়ে বলল,

' তো কি মিথ্যে বলব কেন? তোমার মতো খু**নী, জালেম, জা*নোয়ার, নাফ*রমান জাদুকরের সাথে আমি একঘরে সংসার করতে পারব না। তুমি জাহান্নামি বলে আমিও কেন জাহান্নামি হবো? তোমার প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছি এজন্যও আমার গুনাহ হচ্ছে। '

শেরহাম চোখজোড়া দপদপ করে জ্বলে উঠলো হিংস্র শ্বাপদের ন্যায়। তটিনীর বাহু খামচে ধরে মুখোমুখি টেনে এনে বলল,

' আমাকে সহানুভূতি দেখাতে বলেছি? তোর সহানুভূতি ছাড়া এত বছর থাকিনি? আমার জন্য তোকে জাহান্নামি হতে কে বলেছে? সংসারও কে করতে বলেছে? আমি এতদূর পর্যন্ত এসেছি তোর সাথে সংসার করব বলে? এইসব সংসার টংসার করার জন্য আমি এখানে এসেছি? '

বলেই ঠেলে দিয়ে তটিনীকে বসিয়ে দিল বিছানায়। তটিনী কান্না গিলে চেঁচিয়ে বলল,

' তাহলে আজকেই তালাক দিবি শ**য়*তান। '

শেরহাম কেদারায় বসে বলল

' দেব। যাহ বেরোহ এখন। '

তটিনী যেতে যেতে আবারও ফিরে তাকালো। বলল,

' তুমি মরলেও কেউ কাঁদবে না তোমার জন্য। '

শেরহাম ত্যাড়া জবাব দিল,

' না কাঁদুক। '

' তুমি যে এত ক্ষমতা ক্ষমতা করছে এইসব কবরের নীচে গেলেও করিও। '

' করব। '

' কঠোর শাস্তি পাবে তুমি। জাহান্নামের আগুনে পুড়ে মরবে। তোমার এত এত শক্তি, ক্ষমতা তখন কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহর কাছে তুমি অতি নিকৃষ্ট। তোমার লাশও নেবেনা মাটি। '

বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। শেরহাম রক্তচোখে চেয়ে বলল,

' মরতে না চাইলে চলে যাহ এখন। মাথায় রাগ তুলবি না। বের হ বলছি। '

তটিনী বের হলো না। মুখের উপর বলল,

' তুমি মরলে আমি তোমার মুখও দেখবো না। '

শেরহাম চমকিত হয়ে তাকালো সে কথায়। তটিনী একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।

_________

সায়রা কক্ষ ঝাড়ু দিচ্ছিলো। শেহজাদ পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাকে ডাক দিল।

' সায়রা! '

' জ্বি ভাইজান। '

' আসর কক্ষে এসো। '

' জ্বি যাচ্ছি। '

শেহজাদ দেখলো সেখানে সকলেই উপস্থিত আছে। কেদারায় বসতেই নেয়েঘেমে হন্তদন্ত পায়ে সাফায়াত এসে বলল,

' ভাইজান কিছু কথা ছিল। জরুরি। এখানে বলতে চাচ্ছি না। দ্রুত আসুন। '

অপরূপা,তটিনী সায়রা, সোহিনী, শবনম সবাই এসে উপস্থিত হলো।
শেহজাদ বলল,

' বসো। আগে আমার কথা বলি। তারপর তোমার কথা শুনবো। '

' জরুরি ছিল ভাইজান। '

খোদেজা কেদারায় বসা অবস্থায় তাড়া দিয়ে বলল,

' কি বলতে চাচ্ছো পুত্র? আমার ত ভয় করছে। '

শেহজাদ রয়েসয়ে সাফায়াতের উদ্দেশ্যে বলল,

' সায়রাকে নিয়ে তোমাকে এক জায়গায় যেতে হবে, পারবে? '

সাফায়াত আর সায়রা চোখাচোখি হয়। চোখ সরিয়ে সাফায়াত প্রশ্ন করে,

' জ্বি কোথায় নিয়ে যেতে হবে? '

' সাত সমুদ্দুর, তেরো নদী পার হয়ে যেদিকে চোখ যায়। তুমি ছাড়া আপাতত কাউকে বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে না ওর হাত তুলে দেয়ার। '

সকলের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। খোদেজা, শাহানা, হামিদা সকলেই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সায়রা লজ্জায় মাথা নামিয়ে দ্রুতগতিতে কক্ষ ত্যাগ করলো। সাফায়াত আলাভোলা চোখে তাকিয়ে রইলো শেহজাদের মুখপানে। অপরূপা মিটিমিটি হাসলো। শাহানা ছাড়া সকলেই বলে উঠলো, আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ ভালো খবর। এত দুর্যোগের মাঝে একটু আনন্দ। '

তটিনী এগিয়ে এসে সাফায়াতকে জড়িয়ে ধরে বলল

' অনেক খুশি হয়েছি ভাইজান। মোবারকবাদ। '

সাফায়াত তাকে একহাতে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

' কিন্তু ভাইজান আমি..

' আবার কিন্তু কেন?..

সাফায়াত বলল,

' আমি তনীকে একটা সুস্থ জীবনের দিকে এগিয়ে দিয়ে তারপর ভাবতে চাই। এমতাবস্থায় সম্ভব নয়। আমার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে ওকে দেখলে। আমি ভাই হয়ে কিছুই করতে পারিনি তার সুখের জন্য। '

শেহজাদ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ' কথাটা কিন্তু আমার দিকেও আসে। আমি কি ওর কেউ না? ও সুস্থ জীবন পাক, একজন উত্তম জীবন সঙ্গী পাক আমিও চাই।

তটিনীর বুক ভারী হয়ে এল। টলমলে চোখে সাফায়াতের দিকে চেয়ে বলল,

' আপনি মত দিন। আপনার নিকাহ'র সাথে আমার এসবের কোনো সম্পর্ক নেই ভাইজান। আমি খুশি হবো, কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও আনন্দিত হবো। আমার কপালে যা আছে তাই হবে। আপনি কষ্ট পাবেন না। আমার জীবন নিয়ে আমার আফসোস নেই। সবকিছু খোদাতায়ালার পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে। উনি একদিন সব ঠিক করে দেবেন। '

বলতে বলতে ফোঁপাতে লাগলো সে। শাহানা শাড়ির আঁচল টেনে চোখ ডাকলেন। মুহূর্তেই নীরবতা নামলো চারপাশে। অপরূপা ঠিক এই জায়গায় এসে থমকায়। নিজেকে ভারী অপরাধী মনে হয়। সে সম্রাটের জীবনে না এলে তটিনীকে এতটা দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। এই অনুতাপ তার কোনোদিনও ঘুচবে না।

সবাই বেরিয়ে যেতেই শেহজাদ সাফায়াতকে বলল,

' কি খবর এনেছিলে বললে না তো? '

সাফায়াত বলল,

' শেরহাম সুলতানের পতন চাই বলে সবখানে ঘোষণাপত্র লাগানো হয়েছে। কে করেছে তা জানিনা। তবে আমার মনে হচ্ছে মেয়ে আর বাচ্চাদের অপহরণের বিষয়টির সাথে যে বড় ভাইজান জড়িত এটা সবখানে জানাজানি হয়ে গেছে। '

________

তটিনী চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যাবার পথে দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়ে শেরহামকে দেখলো সদরকক্ষে। হাতে মদের বোতলজাতীয় কিছু একটা। জ্বরের ভেতর মদ খাচ্ছে! আজ কি ম*র*বে নাকি?
শেরতাজ সাহেব গালমন্দ করছে তা দেখে।
' দিনদপুরের মহলের ভেতর এসব অনাচার করতে তোমার বিবেকে বাঁধেনা? আর কত অবক্ষয় হবে তোমার? '
শেরহাম উনার কথায় মৃদুমন্দ মাথা দুলিয়ে মদের বোতল উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল হেলেদুলে। বাইরে বেরিয়ে চিৎকার পাড়তে লাগলো। সামাদ আর মুরাদ এসে বাতাস করা শুরু করলো।

তটিনী নীচে গিয়ে তার হাত ধরে বলল,

' এসব রঙ্গ ছাড়ো। কক্ষে যাও। ওঠো। '

শেরহাম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নেশার ঘোরে মাতাল কন্ঠে বলল,

' আমি বিবাহিত। আমাকে ছুঁবি না। '

চলবে......

Next part at 10 AM

প্রিয়_বেগম  #দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ  #পর্ব_১৪Collected এমিলিকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। শেহজাদ...
11/08/2025

প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১৪
Collected

এমিলিকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। শেহজাদের চেঁচামেচিতে চুপ হয়ে আছে সবাই। সাফায়াত কি বলবে খুঁজে পেল না। মনে মনে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। বেচারী রূপা জানলে ভাইজানকে যুদ্ধে আহ্বান করবে।
শেহজাদ এশার নামাজ পড়েনি। নিজেকে অপবিত্র ঠেকছে। নির্লজ্জ মেয়েটা এরকম কাজ করে বসবে ভাবতেই পারেনি।
রাতে তার কামরায় খাবার নিয়ে মরিয়ম এসে বসে। বলে,

' ওর উপর রেগে থেকো না। '

শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে মারিয়ামের দিকে তাকালো রোষাবিষ্ট চোখে। কটমট গলায় বলল,

' ওর কি মাথা খারাপ? আমি বিবাহিত জেনেও কিভাবে এসব করতে পারলো? '

বিবাহিত শুনে মরিয়ম দাঁড়িয়ে যান। শুনে খুশি হন। অসুস্থ শরীরটা নাড়িয়ে এগিয়ে এসে শেহজাদের গালে দুহাত রেখে পরম মমতা ঢেলে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন,

' বাচ্চা হয়েছে তোমাদের? '

' নাহ। '

মরিয়ম কিছুক্ষণ চুপ থাকে। শেহজাদের উনার মুখের দিকে তাকায় ধীরেধীরে । মা খোদেজার মতো মা ভাব ভাব আছে উনার মধ্যে। তা চাইলেও উপেক্ষা করা যায় না। সে চোখ সরিয়ে নেয়। মরিয়ম বলে,

' তোমার মধ্যে তোমার বাবার প্রতিচ্ছবি আছে। আঠাশ বছর পর আমার জীবনে আনন্দ নিয়ে এসেছ তুমি। আমার সব আয়ু তোমার হোক। আমি বেশিদিন আর বাঁচবো না। শেষবার যদি তোমার মুখটা দেখে মরতে পারতাম জীবনের সব দুঃখ ঘুচে যেত। '

শেহজাদ চোখ সরু করে নরম কন্ঠে বলল,

' কে বলেছে বেশিদিন বাঁচবেন না? '

' অসুখ বেড়েছে। বারো মাসে তের অসুখ। নিজের কাজকর্মটুকু করতে পারিনা। অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। '

' বোঝা হবে কেন? আপনাকে কি কেউ এখানে দেখভাল করেনা? '

মরিয়ম চুপসে যায়। স্মিত হেসে বলে,

' বাদ দাও ওসব কথা। চলো তোমাকে খাইয়ে দেয়। মুসলমান পাড়ার একটা মেয়ে এসে রেঁধে দিয়ে গেল তোমার জন্য। খুব পরিচ্ছন্ন তার রান্না। খাবে মায়ের হাতে? '

শেহজাদ মাথা নাড়ালো। মরিয়ম খুশি হয়ে ভাত মেখে তার মুখের সামনে ধরলো। শেহজাদ খেতে খেতে বলল,

' আমার মনে হচ্ছে কেউ আপনার যত্ন করে না। আমি কারো দোষ দেব না। কিন্তু আপনার এত সহায় সম্পত্তি। আপনার উচিত ছিল না একজন কাজের মানুষ রাখতে আপনার জন্য? '

মরিয়ম চুপ করে রইলো। বলল,

' তুমি এখানকার পরিস্থিতি বুঝবে না ইউভান। সে যাইহোক, এমিলির মা বাবা তোমার আচরণে কষ্ট পেয়েছে। '

' তাতে আমার কিচ্ছু করার নেই। সে তার কর্মফল ভোগ করছে। '

মরিয়ম খাইয়ে দিতে দিতে বলল,

' তোমার পালিত মাতা তোমাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে? তোমাকে ভালো শিক্ষা দিয়েছেন উনি। '

' মা মা-ই হয়। পালিত পর শব্দগুলো মায়ের সাথে যায় না। '

মরিয়ম ঠোঁট এলিয়ে হাসে। বলে,

' আমি কেমন মা? '

শেহজাদ পানি খেয়ে বলে,

'পেট ভরে গেছে আমার। '

মরিয়ম ভুক্তাবশেষ বাসনের এককোণায় রেখে বলে,

' এগুলো আমার মায়েদের জন্য অমৃতসরূপ। '

চোখের কোণায় জল চিকচিক করে উনার। বলেন,

' আমাকে আপনি নয়, তুমি বলে ডাকো ইউভান।'

শেহজাদ মৃদু মাথা হেলে বলল,

' ঠিক আছে। '

মরিয়ম বাসন নিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে ফিরে তাকায়। বলে,

' যাওয়ার সময় একবার মা ডেকে যেও সোনা। '

শেহজাদ তাকিয়ে থাকে।

___________

অপরূপা সৈন্যদের কাছ থেকে জাহাজের খবর নেয়ার পর কক্ষে ফিরে এসেই শুনতে পায় অনুপমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। ফজল সাহেব বলেন, শেহজাদ নেই। নইলে আজই পাড়ি দিতাম।
অপরূপা বলল, ' উনি ঔষধ খাননি? '
' খেয়েছে। জ্বর পড়তে সময় লাগবে। '
' ওহহ। '
ফজল সাহেব তার চেহারা দেখে বললেন,
' বলি কি রূপা মা। মায়ের পাশে গিয়ে একটু বসো। হতেও পারে তুমি তোমার মাকে ভুল বুঝে আছ। হুট করে একদিন পৃথিবী ছাড়লে তারও আফসোস থেকে যাবে, তোমার অনুতাপ থেকে যাবে। হায়াত মওত আল্লাহর হাতে। বলা তো যায় না কোন সময় কি বিপদ ঘটে। '
অপরূপা উনার কথায় গুটিগুটি পায়ে হেঁটে অনুপমার কক্ষের দিকে পা বাড়ায়। কক্ষে প্রবেশ করে দেখে অনুপমা চোখ বুৃঁজে আছে। গা কাঁথা দিয়ে ঢাকা। সে পাশে বসতেই অনুপমা চট করে চোখ মেলে তাকায়। জ্বরের ঘোরে তার চোখদুটো লাল হয়ে আসে। অপরূপাকে দেখে উঠে বসতে চাইলো। অপরূপা বাঁধা দিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলল,
' জ্বর তো বেশি। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? '
অনুপমা তার হাত কপালে চেপে ধরে রাখে। হাতটাতে চুমু দেয়। তারপর বুকে চেপে ধরে বলে,
' তুমি আমার সাথে দুটো কথা বলো। আমাকে বলতে দাও। আমার আর কিচ্ছু চাই না মা। '
অপরূপার চোখ ভারী হয়ে আসার উপক্রম। ঝুঁকে মায়ের বুকে মাথা রাখতেই ঝরঝরে কেঁদে ফেলে অনুপমা। অপরূপাও কাঁদে। অনুপমা তাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে পরম মমতাভরে আদর করে কাঁদতে থাকে। কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের এরূপ দৃশ্য দেখে ফজল সাহেব প্রশান্তির হাসি হাসেন। বুকের উপর হতে মস্তবড় পাথর নেমে গেল যেন। অপরূপা মাকে জড়িয়ে ধরে গল্প করতে করতে মায়ের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। অনুপমা ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে। আজ সবচাইতে সুখী মানুষ সে।

__________________

ঘাটে জাহাজ এসে নোঙর ফেলতেই সৈন্যরা খবর নিয়ে আসে শেহজাদের কাছে। শেহজাদ প্রস্তুতি নেয়। মরিয়ম ছুটে আসে। শেহজাদ সেই তৈলচিত্রটি নিজের সাথে নিয়ে নেয়।
তার দুই চাচাদের উপর ভীষণ ক্ষেপেছে সে। তার মাকে অবহেলায় ফেলে রাখার জন্য। সব সহায় সম্পত্তি নিজেদের নামে করে তার মাকে দিনের পর দিন সবকিছু হতে বঞ্চিত করেছে সবাই।
মরিয়ম তাকে বারণ করলো, কোনো বিবাদে না জড়াতে। তার সহায় সম্পত্তি কিছু চায় না। মেঝ চাচা বলে, তোমার মাকে দেখভাল না করলে বেঁচে আছেন কি করে? মরার আগপর্যন্ত আমাদেরকেই তো দেখতে হবে। তুমি এমিলিকে বিবাহ করো। এখানে মা স্ত্রী সংসার নিয়ে থেকে যাও। তোমার অধিকার তুমি ফিরে পাবে।
শেহজাদ তাদের মুখের উপর বলল, আমি আমার মাকে নিয়ে যাব এখান থেকে। '

সাফায়াত একটা চাদর নিয়ে তার হাতে দেয়। শেহজাদ তা দিয়ে মরিয়মের মাথা ঢেকে দিতে দিতে হঠাৎই মরিয়মের চোখের দিকে চোখ পড়তেই দেখে মায়ের চোখে সমুদ্র। চোখের পলক পড়তেই তা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তিনি কখনোই ভাবেননি ইউভান তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে। মনেপ্রাণে ঈশ্বরের কাছে এটাই প্রার্থনা করছিলো সে। যে তাকে মানুষ করেছে তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে তাকে। ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে।
শেহজাদ চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলে, ' আমার সাথে যেতে কোনো অসুবিধে মা? '

মরিয়ম সাথে সাথে মাথা নাড়তে থাকে। শেহজাদ হাসে। মরিয়ম তাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। সাফায়াত এসে ছোটস্বরে বলল,

' ভাইজান এমিলি তেড়ে আসার আগে দ্রুত চলুন। জাহাজ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। '

শেহজাদ মাকে ছেড়ে শক্ত করে হাতটা ধরে বলে, ' চলো রূপনগরে। তোমার সেবা করার মানুষের অভাব হবে না মা। '

মরিয়ম গাল মুছে। শেহজাদ মহল ত্যাগ করে। তারপর চার্চের দিকে চলে যায়। মরিয়ম চার্চে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে প্রার্থনা সেড়ে চলে আসে। ফাদারের কাছে নিয়ে যায় শেহজাদকে।
ফাদারের সাথে চার্চ হতে বেরিয়ে আসে তারা। যায় শেহজাদের পিতার সমাধিস্থলে। কংক্রিট ও সাদা মার্বেল পাথরের ঢালাই করা অনেকগুলো সমাধি গোরস্থানটাতে। শেহজাদের পিতার সমাধির পাশেই তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে ফুলগাছ। মরিয়ম মুখে কাপড় গুঁজেন। শেহজাদ নীরব চোখে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। মরিয়ম বলে, ' তোমার পিতা তোমাকে হারানোর পর অনেক পাগলামি করেছিল। অনেক খুঁজেছিল। '
শেহজাদ সমাধিফলকে হাত বুলিয়ে দিল। বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়ে উঠলো। তারপর মাকে নিয়ে চলে এল জাহাজে। মায়ের পাশে বসলো। সাফায়াত মরিয়মের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে হাসছিল। মরিয়ম বলল, তুমি তো খুব পাজি ছেলে। বিয়ে করেছ?

শেহজাদ বলল, ' না পাত্রী দেখবো। ও যে বড় হয়ে গিয়েছে আমার খেয়ালই নেই। '

সাফায়াত মাথা চুলকে হাসলো। মরিয়মের চোখে ঘুম নামলো। শেহজাদ মাকে বুকে আগলে ধরে মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো রূপার কথা। কোথায় এখন সে? রূপনগরে পৌঁছে একমুহূর্তও দাঁড়াবে না সে। আবারও বেরিয়ে পড়বে রূপাকে খোঁজার জন্য।

সন্ধ্যা নাগাদ ঘাটে এসে জাহাজ থামলো। তার সৈন্যদের পাশাপাশি শেরহামের সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে। একটা পাথরের উপর শেরহামকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে এদিকে। কিসের জাহাজ সেটি?
শেরহাম তার সাথে মরিয়মকে দেখে কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকলো। বলল, ' ভাবলাম রূপনগর স্বাধীন। না তা হওয়ার নয়। '
শেহজাদ বক্র হেসে বলল, ' রূপনগর সেদিন স্বাধীন হবে যেদিন সেখানে শেরহাম সুলতান থাকবে না। '
শেরহাম রোষাবিষ্ট চোখে চেয়ে থাকে।

সৈন্যরা জানালো বেগম তারপরের দিন ফিরে এসেছেন। উনি রূপনগরেই ছিলেন। শেহজাদ রূপাকে দেখার জন্য উত্তেজিত অনুভব করলো। পালকিতে তুলে দিল মরিয়মকে। আর সে চড়ে বসলো ঘোড়ার পিঠে। টগবগিয়ে ছুটে চললো সুলতান মহলের উদ্দেশ্যে।
তাকে ফিরতে দেখে মহলে একপ্রকার হৈচৈ পড়ে গেল। শেহজাদ দেখলো মহল প্রাঙ্গনে কাঠপোড়ার ছাই, ধূপগন্ধী, জবা ফুল আরও হরেক রকমের জিনিস ছড়ানো ছিটানো। সে মরিয়মকে পালকি থেকে নামিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরে চারপাশটা দেখিয়ে বলল,

' এটা সুলতান মহল। ইউভান এখানেই থাকে মা। '

মরিয়ম মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলেন। বোনেরা সকলেই ছুটে আসে। বাবা জেঠুরা আসে। খোদেজাও ছুটে আসে। দেখে এক পৌঢ়া মহিলাকে সযত্নে আশপাশে দেখিয়ে কথা বলতে বলতে নিয়ে আসছে শেহজাদ। শেহজাদ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মরিয়মকে দেখিয়ে।

' ইনি আমার মা। ইউভানের মা। আজ থেকে মহলে থাকবেন । '

শেরহামের ঘোড়া এসে থামে তার পেছনে। মহলে প্রবেশ করতে করতে সবটা শুনে মরিয়মের দিকে তাকায়। যে কেউ প্রথম দেখায় বলে দেবে তারা মা ছেলে। শেহজাদ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,

' আমি ভিখারিনীর ছেলে নই। আমি রাণীর ছেলে। তাই না মা? '
মরিয়ম হাসে।
খোদেজা নিজেকে আড়াল করে রাখে। রূপা উনাকে কক্ষের দিকে চলে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করে, আপনার পুত্রের সাথে দেখা করেননি? '

খোদেজা উত্তর দেয় না। কক্ষে চলে যায়। অপরূপা এসে মরিয়মকে দেখে। শেহজাদ তাকে দেখে তাকিয়ে থাকে। অপরূপা সবার মুখে মুখে সবটা শুনে। সায়রা তটিনী মরিয়মের সাথে নিজেদের পরিচয় করিয়ে অপরূপাকে দেখিয়ে বলে,

' আপনার ইউভানের বেগম। '

মরিয়ম মুগ্ধচোখে তাকিয়ে বলে,

' কি স্নিগ্ধ! '

অপরূপা ভুলেও শেহজাদের দিকে তাকালো না। মরিয়মকে অন্দরমহলে রেখে শেহজাদ খোদেজার কাছে চলে যায়। অপরূপা মরিয়মকে নিয়ে যায়।
খোদেজা পা টেনে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শাহজাহান সাহেব উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ' শেহজাদ দেখলে কি মনে করবে? বলবে তার মাকে তুমি সহ্য করতে পারছো না। '
খোদেজা কথা বলে না। শাহজাহান সাহেব আবারও বলেন,
' ও তোমাকে আর মা না ডাকলে একটা কথা। '
খোদেজা গর্জে বলে, ' এখান থেকে যান আপনি। ঘ্যানঘ্যান করবেন না। '

শাহাজাহান সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার সময় শেহজাদকে দেখে। মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যান।
শেহজাদ কক্ষে প্রবেশ করামাত্রই খোদেজা গালমুছে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। শেহজাদ মায়ের পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বলে,

' কেমন আছেন আম্মা? '

খোদেজা হু হু করে কেঁদে উঠে। বলে,

' কে তোমার আম্মা। আমি তোমার আম্মা নই। '

' আপনিই আমার আম্মা। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি আম্মা। আমি আপনার কাছে মাকে আমানত রাখলাম। উনি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। '

খোদেজা তার কপালে চুমু এঁকে বলে ' আমি তোমাকে কারো কাছে দেব না। '

' কেউ আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না। আপনার কাছ থেকে নেয়ার কথা ভাবতেই পারে না। '

মায়ের সাথে মান-অভিমান মিটিয়ে নেয়ার পর কক্ষের দিকে পা বাড়ালো সে। অপরূপা আলমিরা হতে কি যেন বের করছিল। শেহজাদ দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে তুলে নিয়ে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে আদর করতেই অপরূপা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে গেল শাড়িটা হাতে নিয়ে। শেহজাদ ডাকলো,

' এই মহিলা। '

অপরূপা শব্দ করে হাঁটলো। ফিরেও তাকাল না।

শেহজাদ সদর কক্ষে যাওয়ার পথে তটিনীকে দেখে। তার মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে,

' কি হয়েছে? ভাইজান কি তোমার সাথে খুব কঠোর আচরণ করে? '

' উনি ভালো আচরণ করার মানুষ? '

' তাহলে কেন কাউকে কিছু বলছো না? তোমাকে এভাবে দেখলে আমার নিজেকে দোষী মনে হয়। আমি কাল কাজী ডাকবো। তুমি খুলা(তালাক) দাবি করো। কোনো ভয় নেই। উনি কিচ্ছু করতে পারবেন না। আমি আছি। '

শিঁস বাজাতে বাজাতে শেরহাম উপস্থিত হয় সেখানে। তটিনী চোখ বড়বড় করে তাকায়। শেরহাম যেতে যেতে তটিনী হাত ধরে শেহজাদের দিকে রক্তচোখে চেয়ে বলল,

' আমার বউ। আমি তালাক দেব নাকি রাখবো সেটা আমার ব্যাপার। তুই তোর পিঠে তেল দে। সর। '

তটিনী হাত ছাড়িয়ে শেহজাদের পেছনে এসে দাঁড়ায়। শাহানা হামিদা খোদেজা ছুটে আসে শেরহামের চেঁচামেচি শুনে। শাহানা পরিস্থিতি বুঝে তটিনীকে নিজের পেছনে নিয়ে এসে বলে,

' আমি এতদিন কিচ্ছু বলিনি তোমাকে। কিন্তু আর সহ্য করব না। তোমার কাছে মেয়ে রাখবো না আমি। তোমার বউ পরে, আগে ও আমার মেয়ে। তোমার মতো মানুষের সাথে ওর জীবন জড়াতে দেব না আমি। '

শেরহাম বিকট শব্দে চেঁচিয়ে বলে,

' আমি যেটা চাইবো সেটাই হবে। যাও কি করার করো।'

বলেই তটিনীর দিকে তাকালো অগ্নিময় দৃষ্টিতে। তারপর হনহনিয়ে বারান্দায় গেল। বন্দুক নিয়ে মহল প্রাঙ্গনের দিকে গুলি ছোঁড়া শুরু করতেই সকলেই আতঙ্কে দেবে গেল। শেহজাদ বারান্দায় গিয়ে ওর হাত থেকে গুলি নিয়ে গর্জে বলল,
' মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমার? '
শেরহাম ওর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়ার জন্য হাতাহাতি শুরু করলো। উন্মুক্ত সিংহদ্বারের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ একজন ধনুক তাক করলো তাদের দিকে। তীরটা ছুটতে ছুটতে এসে শেরহামের কাঁধের একপাশে গেঁথে যেতেই সে ছিটকে পড়ে গেল। শেহজাদ হতভম্ব। সকলেই ছুটে এল চিৎকার শুনে।
তটিনী এসে কেঁদে ওঠে তীর ছাড়িয়ে নিয়ে শেরহামের মুখ ধরে ডাকাডাকি করে বললো,

' কে মেরেছে? '

শেহজাদের আদেশে সৈন্যরা ছুটে গেল সিংহদ্বার পেরিয়ে। শেরহামকে ধরাধরি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সে হাসপাতাল থেকে চলে এল রাতে। কোন কু**ত্তার বাচ্চা একাজ করেছে তাকে ধরে উত্তমমধ্যম দিয়ে মারা ছাড়া তার শান্তি নেই। সোজা জ** বা - ই করে ছাড়বে। কক্ষে এসে দেখলো খাবার রাখা নেই। হাসপাতালে থাকবে বলে তটিনী খাবার রেখে যায়নি। সে তটিনীকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে ডাক দিল।

' এই তনী! তনীর বাচ্চা! তাড়াতাড়ি বের হ। মরে গিয়েছিস নাকি? বের হ। তোকে তালাক দেব। '

তটিনী শোয়া থেকে উঠে বসলো। বুক ধড়ফড় করে উঠলো। মনের দোলাচালে ভুগলো সে। ইচ্ছে হচ্ছে ছেড়েছুড়ে চলে যেতে। কিন্তু অদৃশ্য এক বাঁধা, লজ্জা তাকে আটকে রেখেছে।

শেরহামের চেঁচামেচি শুনে সকলেই বেরিয়ে আসে। কাউকে পরোয়া না করে সে দরজায় কড়া নেড়ে চেঁচামেচি করতে থাকে একনাগাড়ে।
সায়রা,সোহিনী, শবনম আর আয়শা তটিনীর দিকে চেয়ে থাকে। তটিনী ওদের পিছু করে বসে কাঁদতে থাকে। বুঝতে পারে না কেন এত খারাপ লাগছে তার। শেরহামের কন্ঠস্বর নিভে আসে। শাহানা বলে, ও তোমার মুখোমুখি হতে চায় না।

শেরহাম দাঁত চিবিয়ে বলে, সব কটাকে মহল থেকে বের করে দেব। কাল সকালে সবাই বেরিয়ে যাবি। আমার ঘাড়ে খেয়ে আমার সাথে শত্রুতা করছিস সবাই মিলে।

তটিনীর উদ্দেশ্যে বলল,
' তুইও নাটক শিখেছিস ওদের কাছ থেকে? এখন বের না হ। কাল সকালে বের হবি না? এক কো**পে মারবো। '

বলেই দরজায় লাতি দিয়ে চলে গেল। তটিনী শুয়ে পড়লো ধপাস করে। বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। সোহিনী গিয়ে খাবার দিয়ে এল। শেরহাম তাকে জিজ্ঞেস করলো,

' তনী কোথায়? তুই এসেছিস কেন?'

সোহিনী সাহস দেখিয়ে প্রথমবারের মতো বলল,

' আপু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর সাথে তোমার শত্রুতা নেই। তাই ওকে ছেড়ে দাও। '

শেরহাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজলো। তা ঠিক। তটিনী তার কোনো কাজে আসছে না। নিজের সাথে জড়িয়ে রাখার কোনো মানে নেই। কাল তালাক দিয়ে দেবে সে।

চলবে..

Next part at 10 PM

প্রিয়_বেগম  #দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ  #পর্ব_১৩Collected সকাল নাগাদ অপরূপা মহলে হাজির হলো। একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। গাড়ির ভাড়া মিট...
11/08/2025

প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১৩
Collected

সকাল নাগাদ অপরূপা মহলে হাজির হলো। একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিল পয়সা দিয়ে। তারপর মহলে প্রবেশ করতেই সকলেই তাকে দেখে হতভম্ব। একেএকে হাজারও প্রশ্ন করে বসলো সবাই। অপরূপা নিজেও হতভম্ব। সে চিরকুট রেখে গিয়েছিল সবাই কি তা পায়নি?
সবার প্রশ্নের মুখে জানালো, সে একটা মসজিদের এক ইমাম সাহেবের কাছে গিয়েছিল। সন্দেহ হচ্ছিল শেহজাদের উপর জাদুটোনা করা হয়েছে তাই ওখানে গিয়ে কোরআনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিল। ইমাম সাহেব জানালেন দু-তিনদিন সময় লাগবে তাই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু তারমধ্যে সামাদ আর মুরাদের খপ্পরে পড়ে সে। কোনোমতে তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে বাঁচলে টিংটিংকে বাঁচাতে পারেনি। তারা সাথে করে টিংটিংকে নিয়ে গিয়েছে।
অনুপমা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা দম নিলেন। অপরূপা চুপটি করে মায়ের বুকে পড়ে থাকলো। ছোট করে বলল,

' আমি ঠিক আছি। '
অনুপমা তাকে ছাড়লো। কিছু বলল না। খোদেজা এসে তার মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,

' টিংটিংকে কাশিম একটা লোকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। সামাদ বোধহয় তাকে বিক্রি করে উল্টাপাল্টা কথা শিখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনা তো যা ঘটবার তা ঘটে গেছে। শেহজাদ তোমাকে খুঁজতে ইন্দিরাপুরে গিয়েছে। জাহাজের খবর আসেনি এখন অব্দি। '

শাহজাহান সাহেব বললেন, বউ ফিরে এসেছে। তাই আমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। শেহজাদ সাফায়াত সকলেই আত্নরক্ষা জানে। রূপা তুমি বিশ্রাম করো। '

অপরূপা একটা পানির বোতল, কিছু আরবিতে লেখা কাগজ খোদেজাকে দিয়ে বলল, কাগজটা ডুবিয়ে পানি খাওয়াতে হবে উনাকে। সুস্থ হয়ে যাবেন।

খোদেজা তার কথায় স্মিত হেসে বলল, আমরা তার চিকিৎসা করেছি। ওর বাহুতে একটা তাবিজ পড়ানো ছিল। সেটা খুলে নিয়েছি। ও আগের চাইতে সুস্থ। চিন্তার কিছু নেই। '

হামিদা বলল, কি সাহসী মেয়ে! একা একা ওই জাদুকর দুটোর সাথে লড়াই করেছ? আমার তো ওদের দেখতেই ভয়ংকর লাগে। আর হ্যা তোমার পতিদেব এখন সুস্থ ঠিক কিন্তু বেগমকে না পেয়ে তো আরও অসুস্থ হয়ে উঠেছে। '

অপরূপা মলিন হাসলো। তারপর বলল,

' এগুলো রাখুন। '

অনুপমা জিজ্ঞেস করলো,

' আর কোথাও যেওনা মা। চারপাশে তোমার বিপদ। '

অপরূপা উনার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে বলল,

' শেরহাম সুলতানের সাথে কথা আছে। '

খোদেজা তার হাত ধরে রাখলো।

' কোনো দরকার নেই। সে আবারও জাদুটোনা করে মুখের কথা বন্ধ করে দেবে। নিজেকে বিবাদে জড়িওনা যতদিন অব্দি শেহজাদ ফিরে আসে। '

অপরূপা বলল,

' নাহ। উনি কি চান আমাকে জানতে হবে। যা চেয়েছে সবই তো পেয়েছে। তাহলে কেন এখনো এসব বন্ধ করছে না? '

খোদেজা তার হাত ধরে বলল,

' দোহাই লাগে। শেহজাদ নেই ও সাহস পেয়ে যাবে তোমাকে আঘাত করার। ওর মতো কাফের সব পারে। গলা টিপে মানুষ মারতেও দু'বার ভাবেনা সে। এমন করো না। রাগ সংবরণ করো। ধৈর্য ধরো। শেহজাদ ফিরুক। একটা না একটা মীমাংসা হবেই। '

অপরূপা গেল না। তটিনী চুপচাপ শুনলো কিছু বললো না। সোহিনী তাকে কিছু বলতে না দেখে আঁড়চোখে তাকিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল সেখান থেকে।

সায়রা এসে অপরূপার কাঁধ ধরে নিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলল,

' ভাইজান ফিরে এসে তোমাকে এমন বকুনি দেবেন। '

অপরূপা কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালো। বলল,

' আমাকে? '

' হুম। '

অপরূপা ভাবনায় মজে গেল। সে কথাই বলবে না।
তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। হোক জাদুর বশবর্তী হয়ে, কষ্ট তো দিয়েছেই। শেহজাদের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলো সে।
কুমুদিনীও মহলে ফিরে এল। তার মুখ হাত পা বেঁধে অতিথিশালায় ফেলে রেখেছিল শেরহাম।
তাকে দেখে অপরূপা ফোঁসফোঁস করে উঠতেই সে অপরূপার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেঁদে জানালো ওরা তাকে ভয় দেখিয়েছে, কথামতো কাজ না করলে জানে মেরে ফেলবে বলে, সে কথা শুনতে চায়নি, সে নিজেই জাদুর বশীভূত হয়েছিল। অপরূপা সবটা শুনে তাকে ক্ষমা করে।
কিন্তু তটিনী তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। তারমানে শেরহাম সুলতান তাকে বোকা বানাচ্ছে!
তার দুর্বলতা টের পেয়েই হয়তো তাকে বোকা বানিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে। ছিঃ! কতটা নিকৃষ্ট। নিজের উপর নিজের রাগ লাগলো তার। শেষমেশ তাকেও বোকা বানিয়ে ছাড়লো এই চতুর শেরহাম সুলতান। যার গায়ে মিশে আছে শয়তানের রক্ত। অথচ কতখুশি হয়েছিল সে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব পাল্টে যাচ্ছে!!
অতিথি শালার দিকে হনহনিয়ে গেল সে। শেরহাম বিছানায় অস্ত্রসস্ত্রের মাঝে বসা ছিল।
তটিনী যেতেই চোখ তুলে তাকালো। হনহনিয়ে উঠে এসে বলল,

' বারবার বলেছি এখানে আসবি না। '

তটিনী সরোষে চেয়ে থেকে বলল,

' সত্যি করে বলো তুমি জাদুটোনা করেছ কিনা? সামেদ্দে মুরেদ্দেকে বেঁধে রেখেছে কেন? '

শেরহাম চোখ সরু করে বলল,

' আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে রাজী না। '

' আমাকে দিতে হবে। '

শেরহাম দাঁতে দাঁত চিবিয়ে এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বলে,

' কেন? কে তুই? '

প্রশ্নের উপর তটিনীর টলটলে দিঘীর মতো চোখের জলে স্পষ্ট লেখা ছিল। শেরহাম বুঝেও বুঝলো না। ঘাড় ধরে বের করে দিল তটিনীকে।

তটিনী দরজায় মাথা ঠুকে দিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

' আমি নতুন জীবনের দিকে যাব আর তুমি যাবে মৃত্যুর দিকে। তাহলে কেন আমাকে জড়ালে? '

শেরহামের পা জোড়া থমকে গেল।

______________________

জ্ঞান ফেরার পর শেহজাদ সমুদ্রতটে বসা ছিল সাফায়াতের সাথে। চার্চের সেই ফাদার চার্চে ফিরে গিয়েছেন তার জ্ঞান ফেরার পর। সৈন্যদের উনার সাথে নিয়ে গেলেন।
সৈন্যরা ফিরে এসে জানালো চার্চের পাশেই একটা বড়সড় খ্রিষ্ট মহলের দেখা মিলছে। সেখানে তারা আশ্রয় চাইতে পারে। শেহজাদ দেরী করলো না। আবেদন পাঠিয়ে দিল তাদের আশ্রয় এবং রূপনগরে ফেরার জন্য সাহায্য চায়।
সেই মহলের শাসনকর্তারা তাদের আবেদন মঞ্জুর করলেন। তাদের আশ্রয় দিলেন। তবে জানা গেল তারা খ্রিষ্টধর্মের। রূপনগরের সম্রাট পরিচয় পেয়ে তারা বেশ জাঁকজমক করে শেহজাদকে অভ্যর্থনা জানালো।

সকলেই তাকে সহজেই আপন করে নিল। যা শেহজাদের জন্য অতি আশ্চর্যের ছিল। মনে মনে সংশয়ও ছিল। খ্রিষ্ট মহলের প্রবেশও অত্যধিক সুন্দর ছিল যা সে কল্পনাও করেনি। তাদের আলাদা আলাদা শয়নকক্ষও দেয়া হলো। সাথে ভালো খাবার আর আরামদায়ক পোশাক। শেহজাদ খাওয়াদাওয়া সেড়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যখন ঘুম ছুটলো তখন মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে। সে নামাজ আদায়ের জন্য মহলের পেছনে সবুজ ঘাস আবৃত একটা জায়গায় চাদর বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিল।
শাসনকর্তার দুইজনের একজন এসে তাকে নামাজ আদায় করতে দেখে বলল,
' আমাদের বললে আমরা ব্যবস্থা করে দিতাম। '
শেহজাদ পেছনে দুহাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে জানালো, তার কোনো সমস্যা হয় না। দেশবিদেশ ঘুরতে গেলে তাকে এভাবেই নামাজ আদায় করতে হয়।
উনারা শেহজাদের সাথে কথা বলতে বলতে শেহজাদকে মহলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে গল্প করতে লাগলেন।

হঠাৎ চোখ গিয়ে পড়লো বারান্দায় একটা যুবতী মেয়ের দিকে। সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিল সে। কিন্তু যুবতীর চোখদুটো তাকে নিবদ্ধ করে রেখেছে সেই কবে থেকে। কালো যিবিন আর মাথায় প্যাঁচানো বাদামি রঙের পাগড়ি পরিহিত সুকুমার পুরুষ তার হৃদয় উদ্বেলিত করেছে। তাকে দেখার পর হতে তার হৃদকম্পন কিছুতেই থামছেনা। তাকে দেখার জন্য সারা মহলে ছোটাছুটি করেছে তখন থেকে, কখন সেই মানবকে আবারও দেখতে পাবে।
যুবতীর পিতা তাকে দেখে ডাকলো, ' এমিলি এসো এদিকে। '
এমিলি ছুটে এল। বয়স বাইশ তেইশের কৌটায় হবে। অত্যাধিক রূপসী আর লাস্যময়ী। তার পিতা মেয়েটির সাথে শেহজাদের পরিচয় করিয়ে দিল।

' সে আমার কন্যা। এমিলি খ্রিস্ট। কন্যা ইনি হচ্ছেন রূপনগরের সম্রাট। শেহজাদ সুলতান।',

এমিলি হেসে চোখ নিভিয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল,

' আমরা আনন্দিত আপনাকে পেয়ে। '

শেহজাদ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলল,

' ধন্যবাদ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া উনি এমন মানুষদের আশ্রয়ে রেখেছেন। '

এমিলি হাসলো। বলল,

' বাবা আমি তার সাথে আরও আলাপ করতে চাই।'

' হ্যা। কেন নয়। সম্রাট আপনি গল্প করুন। নৈশভোজের আয়োজন চলছে। '

এমিলি বলল,

' আপনি খানিকটা আমার বড় পিতার মতো দেখতে। '

' আপনার বড় পিতা কেমন? '

' আপনার মতো সুদর্শন। ওদিকে আসুন। আমার বাগান। আপনার পরিবারে কে কে আছে?

শেহজাদ তার পেছনে শ্লথগতিতে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

' আম্মা আব্বা বোন..

তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে এমিলি বাগানের ফুল ছিঁড়ে নিল। শেহজাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
' আমার বাগানের ফুল কখনো ছেঁড়া হয় না। শুধু আজ ছিঁড়লাম। '
শেহজাদ অপ্রস্তুত হলো। বলল,
' আমি ফুল পছন্দ করিনা। '
এমিলি আবারও হাসলো। বলল,
' সত্যি? ফুলের মতো মানুষ ফুল পছন্দ করে না? অবিশ্বাস্য! '
শেহজাদ কাষ্ঠ হাসলো। তন্মধ্যেই সাফায়াত এসে এমিলির সাথে শেহজাদকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালো। বেচারি রূপা এই দৃশ্য দেখলে ভাইজানের কপালে বেশ দুঃখ ছিল। সাফায়াত আসতেই শেহজাদ এগিয়ে গিয়ে বলল,

' ঘুম ভালো হয়েছে?'

' জ্বি ভাইজান। '

' কাছাকাছি জাহাজ না আসা অব্দি আমাদের এখানে থাকতে হবে সাফায়াত। আর কোনো উপায় নেই। আমি জানিনা রূপা কোথায় আছে। তার চিন্তা আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমাকে এত অবিশ্বাস কি করে করলো সে?'

' চিন্তা করবেন না। আল্লাহ আছেন। '

' হ্যা তিনিই ভরসা। '

এমিলি ফুলগুলো সাফায়াতকে দিয়ে বলল,

' আপনার বন্ধুর জন্য নিয়েছিলাম। উনি নাকি ফুল পছন্দ করেন না। '

সাফায়াত ফুলগুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। এমিলি যেতেই শেহজাদ সাফায়াতের বোকাবোকা চেহারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেই সাফায়াত বলল,

' ভাইজান! '

শেহজাদ দরাজ গলায় হেসে উঠে তার পিঠ চাপড়ে বলল,

' বাদ দাও। কাশীমকে নজর রাখতে বলো জাহাজ এলেই যেন খবর দেয়। '

_______

এমিলি চার্চে গেল প্রার্থনা করার জন্য। বহুদিন পর তাকে চার্চে দেখে চার্চের ফাদার অবাক হলেন। জানতে চাইলেন কারণ কি।
এমিলি সহাস্যে বলে উঠে,
' ফাদার আমি মনে মনে যেমন পুরুষ খুঁজছিলাম। তেমন একজনকে পেয়ে গিয়েছি। '
ফাদার হয়ত আন্দাজ করতে পারলেন। মহল আঙিনায় এমিলির পিতাদের সাথে হেঁটে হেঁটে গল্পে মগ্ন শেহজাদের দিকে তাকিয়ে বলল।

' সে? '

' হ্যা। আমার তাকে চাই। '

' কিন্তু তার ধর্ম আলাদা। সে মুসলিম সন্তান। পরহেজগার বান্দা। তোমাকে সে গ্রহণ করবে না। '

' আমি কিছু জানিনা। আমার তাকে চাই। তার চলে যাওয়ার সময় হওয়ার পূর্বে আমি তাকে চাই। কিছু একটা করুন।'

ফাদার বেশ সময় নিয়ে ভাবলেন। শেহজাদের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি বুলিয়ে ধীরকন্ঠে বললেন,

' প্রস্তাব পাঠাও তার কাছে। তোমার পিতামাতাকে বলো। '

এমিলি ভীষণ খুশি হয়ে ঘন্টা বাজিয়ে দৌড় দিল।
মহলে প্রবেশের সময় শেহজাদের মুখোমুখি হতেই লজ্জা পেয়ে পুনরায় দৌড় লাগালো।

এমিলির পিতা হেসে বলল, ' আমার প্রিয় কন্যা। '
শেহজাদ স্মিত হাসলো।

________________

শেহজাদ মহল পরিদর্শন করতে এমিলির পিতার সাথে বেরিয়েছে। পুরো মহলটি অসম্ভব সুশোভিত। প্রতিটি কক্ষে ছবি বড়সড় তৈলচিত্র তাদের পূর্ব পুরুষদের। শেহজাদ সাথে সাফায়াতও আছে। গল্প করতে করতে তৈলচিত্রগুলোতে চোখ বুলাতেই সাফয়াত হঠাৎ থমকে গেল। আঙুল তাক করে বলল,

' ভাইজান ওই বাচ্চাটির তৈলচিত্র দেখুন। '

শেহজাদ সেদিকে দৃষ্টি মেলে তাকালো। ললাটের ভাঁজ গভীর হলো। চেয়ে রইলো সেই তৈলচিত্রটার দিকে। যেখানে মা বাবার সাথে একটা বাচ্চা ছেলে রয়েছে। রূপনগরে তার কক্ষেও দাদাজানের পাশে ঠিক এমন একটা বাচ্চার তৈলচিত্র আছে। শেহজাদ বলল,

' কে উনারা? '

এমিলির পিতা জানালেন,

' উনি আমার ভাই আর ভাইবধূ সাথে ভাইপো ইউভান। '

শেহজাদ ফের জানতে চাইলো।

'কোথায় উনারা? '

' ভাইজান মারা গিয়েছেন। '

' আর মহিলা আর উনার বাচ্চা?

' ইউভান ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রপথে। তার মা আমাদের সাথে আছে। '

শেহজাদ তৈলচিত্রটি দেখতে থাকে মনোযোগ দিয়ে। যেই পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে তৈলচিত্রে সেই লোকটির গালের দাঁড়ির প্যাঁচটা শেহজাদের গালেও বিদ্যমান। গলা শুকিয়ে এল শেহজাদের।

সাফায়াত বিস্মিত হয়ে বলল,

' ভাইজান বাচ্চাটি তো আপনার মতো। '

এমিলির পিতা কপাল ভাঁজ করে তাকায়। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে। কি বলছে এরা?

শেহজাদ কপাল ভাঁজ করে বলল,

' হতেই পারে। অবিশ্বাস্য কিছু নয়। এভাবে বলার কি আছে? জনাব আমি ইউভানের আম্মার সাথে দেখা করতে পারি? '

এমিলির পিতা সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে আদেশ দিলেন যাতে ইউভানের মাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
অন্দরমহল হতে একটা পৌঢ় মহিলা ধীরপায়ে হেঁটে প্রবেশ করলো সেই কামরায়। শেহজাদ ফের অবাক হলো মহিলাটিকে দেখে। সাদা ময়লা শাড়িতে মহিলাটিকে ভীষণ নম্র মনে হলো তার। মাথার চুল, বাদামী সাদা, চেহারায় অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। অতি লাবণ্যময়ী তারপরও। চোখদুটোতে মায়া উপচে পড়ছে। কামরায় প্রবেশ করে তারদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ভদ্রলোক বলেন

' ইনি মরিয়ম খ্রিষ্ট। আমার বড়ভাই ইউশাম খ্রিষ্ট আর মরিয়ম খ্রিস্টের সন্তান ইউভান খ্রিষ্ট। '

শেহজাদ দেখেছিল উনাকে মহলে আসার পর। তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন আড়ালে দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে । চোখে চোখ পড়ার পর মিষ্টি করে হেসেছিলেন। তারপর মমতাময়ী চোখে অপলক চেয়ে ছিলেন। যেন তৃষ্ণা মিটছেনা দেখেও। শেহজাদ ভেবেছিল উনি এখানকার কাজের লোক! কিন্তু তা তো নয়। কিন্তু উনি এই বেশে কেন?

শেহজাদ হাঁসফাঁস করতে থাকে। তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়।
সাফায়াত তার পেছন পেছন ছুটে বলল,

' ভাইজান দাঁড়ান। '

শেহজাদ কথা শুনলো না। তার কামরায় গিয়ে বসে থাকলো। সে খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মেছিল!

সাফায়াত এসে পাশে বসে। বলে,

' ভাইজান কি ভাবছেন? আমি যেটা ভাবছি সেটা হলে তো। '

শেহজাদ তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,

' ওই চার্চটাতে চলো। ফাদারের সাথে কথা বলব। সবকিছু সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। '

' যদি আপনি ইউভান হন তাহলে মরিয়ম খ্রিষ্ট আপনার মা। উনার অবস্থা দেখেছেন? মনে হচ্ছে অনেক অযত্ন করা হয়। উনার সাথে আপনার চোখের মিল আছে খানিকটা। আমি নিশ্চিত উনিই আপনার মা। আর মামু তো বললো দাদাজান আপনাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। সবগুলো বিষয় ভেবে দেখুন। '

' চলো ফাদারের কাছে যাই। বসে থাকা যাবেনা। '

দুজনেই ফাদারের কাছে যেতেই ফাদার তাদের বিচলিত দেখে হেসে বলেন,

' আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আমার কাছে আসবে। '

শেহজাদ ইতস্ততভাবে বলে,

' উনাদের সন্তানকে আর খুঁজেননি? '

' অনেক খুঁজেছে কিন্তু তার পায়নি। দস্যুরা তার মা বাবাকে আঘাত করে বাচ্চা নিয়ে পালিয়েছিল। '

' আর সেই বাচ্চাকে দস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল রূপনগরের সম্রাট সলিমুল্লাহ সুলতান। '

ফাদার হেসে বলেন,

' বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সেই সন্তান এখন আমার সামনে বসে আছে। '

শেহজাদ দ্বিগুণ অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

' কি করে নিশ্চিত হলেন? '

তুমি যখন অজ্ঞান হয়ে তোমার ভাইয়ের কোলে পড়েছিলে তখন তোমার বক্ষ উন্মুক্ত ছিল। ছোট্ট ইউভানের নামকরণ করেছিলাম আমি তাই তার বুকের এই জন্মচিহ্ন আমার স্পষ্ট মনে ছিল যেটি তোমার বক্ষে এখনো আছে। শেহজাদ বুকের পাশে হাত রেখে স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলো। ফাদার বললেন,

' তোমরা মাকে মুক্ত করো এই একাকিত্ব থেকে। সে ভীষণ কষ্ট দিনযাপন করছে। '

শেহজাদ ফিরে আসে মহলে। ফাদার খবর পাঠানোর সাথে সাথে মহলে একপ্রকার হৈচৈ পড়ে যায়। এমিলির পিতা আর চাচা শেহজাদকে অস্বীকার করতে চায়। এখন আবার তাকে সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে!
শেহজাদকে নানানরকম অহেতুক প্রশ্ন করে বিষয়টা ধামাচাপা দিতে চান উনারা। মরিয়মকে নিয়ে আসে এক কাজের লোক। এমিলির পিতা খানিকটা রুষ্ট কন্ঠে বলে,

' অস্বীকার করো সে তোমার পুত্র ইউভান।'

মহিলা কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। শেহজাদের দিকে মায়ামায়া চোখে চেয়ে রইলেন। শেহজাদ এগিয়ে গিয়ে বললেন,

' আমার সাথে আসুন। '

ব'লেই মরিয়মের হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। এমিলির পিতা ও চাচা পেছন পেছন ছুটে বলে,

' কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন উনাকে? অদ্ভুত তো! আশ্রয় দিয়েছি তাই এমন খেসারত দিচ্ছেন!

শেহজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ধমকে বলে,

' সব কটাকে দেখে নেব আমি। '

সকলেই চুপ হয়ে যায়। মরিয়মকে নিয়ে ফাদারের কাছে যায় শেহজাদ। মরিয়ম কান্না চোখে শেহজাদের দিকে এখনো চেয়ে আছে। ফাদার বললেন,

' একে চিনতে পেরেছ মরিয়ম? '

মরিয়ম দু'পাশে মাথা নেড়ে বলে,

' চেনা মনে হয় কিন্তু চিনিনা। কি বলছে সে? '

শেহজাদ বুকের পাশ উন্মুক্ত করে দেখায় উনাকে। মরিয়মের চোখদুটো বড়সড় আকার ধারণ করে। চেয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ দুটো জলে ভর্তি হয়ে গাল বেয়ে গড়াতে থাকে টেরও পাননা উনি। এই ছেলেটাই কোলের সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তান! তাই তার আগমনের পর বারবার তাকে লুকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিলো!
উনি কাঁদতে থাকেন। তারপর চলে যেতে থাকেন। শেহজাদ ডাক দেয়,

' দাঁড়ান। আমার কথা শুনুন। মা! '

মরিয়ম থমকালেও পিছু ফেরেনা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায় কাঁদতে কাঁদতে।

_________

শেহজাদ মহলে ফিরে এসে মরিয়মের খোঁজ করে। কাজের মেয়েটি মরিয়মের কক্ষে নিয়ে যায় শেহজাদকে। মরিয়ম শোয়া ছিল। শেহজাদকে দেখে তার কান্নার গতি বেড়ে যায় আরও। শেহজাদ কাছে যেতেই উনি ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ' আমার ইউভান। এত বছর কেন মায়ের খোঁজ করোনি? আঠাশ বছর পর তোমার মায়ের কথা মনে পড়লো। '

শেহজাদ চুপ করে থাকে। জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলায়। এই মা তা দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিয়েছে। তার কষ্ট সে দূর করে দেবে। মরিয়ম কাঁদতে থাকে। শেহজাদ তাকে শান্ত করে । মা ছেলের গল্পেসল্পে কেটে যায় অনেকগুলো মুহূর্ত। দীর্ঘ আঠাশ বছরের অপেক্ষার কষ্ট যেন আজ ম্লান হয়ে গেল সন্তানের মুখদর্শনে। আহা কি শুভ্র পবিত্র হয়েছে তার চেহারা। আজ সে পরহেজগার মুসলিম সন্তান। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ছেলের বুকে পড়ে থাকলেন উনি।

সন্ধ্যা নাগাদ তার কাছে এমিলিকে বিবাহের প্রস্তাব আসে। সাফায়াত তার কামরায় এসে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে। হাসির চোটে বলে,

' ভাগ্যিস রূপা এসব শুনছেনা। সে তো কেয়ামত ঘটিয়ে দিত ভাইজান। '

শেহজাদ ভাবলো,
' মোটেও না। রূপা তো তাকে ভালোবাসেনা। ভালোবাসলে অত অবিশ্বাস করতে পারে মানুষ?'

তার প্রত্যাখান শুনে এমিলি ক্ষেপে উঠে। আজ পর্যন্ত কারো সাহস হয়নি তাকে ফেরানোর। সে যা চেয়েছে তা নিজের করে নিয়েছে। আর সে তো ভুল কাউকে চেয়ে বসেনি। ইউভানকে চেয়েছে যে তার বড়পিতার ছেলে। সে কোনদিক দিয়ে কম?
উন্মাদের মতো ছুটে গেল শেহজাদের কক্ষে। শেহজাদ মা বাবা, আর তার তৈলচিত্রটি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। এই পিতাকে সে কখনোই আর দেখবে না এই জীবদ্দশায়। মাতাকে পেয়েছে। উনাকে সাথে নিয়ে যাবে। একা রাখবে না। তৈলচিত্রটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, একসময় দেখে কামরার দরজা খুলে প্রবেশ করেছে এমিলি। গায়ে প্রশস্ত গলার ইয়েলেক ( ব্লাউজ), কোমর ঘাগড়া। বক্ষ বিভীজিকা আর নাভিপদ্ম উন্মুক্ত। শেহজাদ দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, বেরিয়ে যাও আমার কক্ষ হতে।

এমিলি ধপ করে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে এসে বলে,

' কেন আমাকে বিবাহ করবে না ইউভান? '

' আমি ইউভান নয়। যাও এখান থেকে। আমার গায়ে ময়লা মাখতে এসো না। দূর হও। '

এমিলি তার কাঁধে হাত দিয়ে চেপে বলে,

' তাকাও আমার দিকে। তোমাকে বিবাহ করতেই হবে। কি কমতি আছে আমার মধ্যে? '

' আমি বিবাহিত আগেই বলেছি। তোমাকে যেতে বলেছি। আঘাত করতে বাধ্য করো না। '

এমিলি তার পিঠ আঁকড়ে ধরে মাথা রেখে বলে,

' বিবাহ করো নয়ত আমার সাথে মিলিত হও। আমি তোমাকে চাইছি। আমি এভাবে কাউকে চাইনি। আমাকে ফেরাবে না ইউভান। '

শেহজাদ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,

'আমি সেই ইউভান নয় যে তোমার কথায় সায় দেবে। দূর হও আমার সামনে থেকে। '

এমিলি এগিয়ে এসে খামচে ধরে তার বুকের যিবিন ছিঁড়ে ফেলতেই জন্মদাগটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। এমিলি তা ছুঁয়ে বলে উঠে, ' তুমি সত্যিই ইউভান। আমাকে সঙ্গ দাও। '

শেহজাদ চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলে,

' খোদার কসম আমি তোমাকে আঘাত করব। '

এমিলি তার বুক ঝাপটে জড়িয়ে ধরে এলোপাতাড়ি চুমু খেতেই শেহজাদ সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা প্রয়োগ করে গর্জন করে তলোয়ার দিয়ে হাতে আঘাত করতেই এমিলি চিৎকার দিয়ে মেঝেতে শায়িত হয়। শেহজাদ দরজা খুলতেই মরিয়মকে দেখতে পায়। আরও অনেকে। মরিয়ম জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে ইউভান? এমিলি চিৎকার দিল কেন? '

শেহজাদ চিবুক শক্ত করে রক্তাক্ত তলোয়ার ছুঁড়ে মেরে বলে এমিলির পিতার উদ্দেশ্যে বলে,

' আপনাদের মেয়ের ঘাড়ে শয়তান বসেছে। তাকে সাবধান করুন আর জানিয়ে দিন পরনারী আমার কাছে বিষাক্ত কাঁটার ন্যায়। '

চলমান..

Next part at 6 PM

Address

Rajshahi
6211

Telephone

+8801302482507

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Aronno's Story posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Aronno's Story:

Share