28/09/2023
প্রচলিত মীলাদ-কিয়াম ও ঈদে মীলাদুন্নবী সম্পর্কে হযরত মাও. মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক হফিযাহুল্লাহ "সীরাত চর্চার নবরূপ এবং ভিত্তিহীন জাল বর্ণনা" শিরোনামে লিখেন,
নবী যুগ থেকে সময়ের দূরত্ব যতই দীর্ঘ হতে লাগল এবং ঈমানী দুর্বলতা যতই বেড়ে যেতে লাগল, সীরাতের আলোচনা, সীরাতের পঠন-পাঠন এবং সীরাতকে জীবনাদর্শরূপে গ্রহণের প্রেরণা ততই শিথিল হতে লাগল। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হকসমূহের মধ্যে যে দু’টি বিষয় সবচেয়ে সহজ ছিল অর্থাৎ সীরাতচর্চা ও দরূদ পাঠ এই দু’টি বিষয়েও আনুষ্ঠানিকতা অনুপ্রবেশ ঘটল। মীলাদ পড়া ও পড়ানোকে দরূদ শরীফের বিকল্প ধরে নেওয়া হল, আর তাও হতে লাগল কোন না কোন দুনিয়াবী গরজে এবং বিশেষ বিশেষ দিন ও অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে। তেমনি প্রচলিত জলসা-জুলুস, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’, তাকেই সীরাত আলোচনার স্থলবর্তী করা হল।
একটু হিম্মতওয়ালা যারা, তারা এই মাহফিল শুধু ১২ই রবিউল আউয়াল সীমাবদ্ধ না রেখে প্রায় মাসের শেষ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করল। কেউ আরেকটু অগ্রসর হয়ে বছরের অন্য কোন মাসেও সীরাতুন্নবী নামে সভা-সেমিনার কিংবা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। মোটামোটি এই হল প্রচলিত মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবীর হালহাকীকত। এভাবে দরূদ পাঠ ও সীরাত চর্চার বিষয়টি নিছক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল।
এই মুহূর্তে এই পদ্ধতির সমস্যা ও প্রচলিত মীলাদুন্নবীর প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, শুধু এটুকু বলাই উদ্দেশ্য যে, নবীর জন্মদিবসের নামে অনুষ্ঠান করা নবীর সুন্নত নয়; বরং সুন্নতের বিরুদ্ধাচরণ, যা খৃষ্টানদের ক্রিসমাস ডে-এর অনুকরণে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে।
এটা শুরু হয়েছে সপ্তম শতাব্দিতে। প্রচলিত মীলাদের সমর্থকরাও স্বীকার করে যে, ইরবিল অঞ্চলের শাসক আবু সাঈদ মুযাফফারুদ্দীন (৫৪৯-৬৩০হি.) হচ্ছে মীলাদের প্রবর্তক। এজন্য হুঁশ-জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তিমাত্রই মীলাদের পক্ষে লিখতে গিয়ে প্রথমেই তা বেদআত হওয়া স্বীকার করে নেয়। এরপর একে বেদআতে হাসানা বলে জান বাঁচানোর চেষ্টা করে। মোটকথা বিষয়টি বেদআত ও নব-উদ্ভাবিত হওয়ার ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই।
মীলাদের প্রচলনকালে এর সমর্থকরা এমন একটি কথা চালু করেছিল, যার দ্বারা এর হাকীকত একদম স্পষ্ঠ হয়ে যায়। কথাটি হল, “যখন ক্রুশধারীরা অর্থাৎ খৃষ্টান জাতি তাদের নবীর জন্ম-রজনীকে বড় ঈদ সাব্যস্ত করেছে তখন মুসলিম জাতি তো তাদের নবীর সম্মানের অধিক হকদার।” -আততিবরুল মাসবুক, সাখাভী পৃ. ১৪; আননি‘মাতুল কুবরা (মাখতুত)
হিন্দুস্তানের মশহুর মৌলভি আব্দুছ ছামী রামপুরী ‘আনওয়ারে সাতিআ’ নামক ‘কেতাবের’ ১৭০ পৃষ্ঠায় স্বীকার করেছেন যে, ভারত উপমহাদেশে খৃষ্টান ইংরেজরাই ১২ই রবিউল আউয়ালকে মীলাদুন্নবী নির্ধারণ করেছিল এবং ওই দিনে তারা ছুটি ঘোষণা করেছিল।
মীলাদ অনুষ্ঠানের ইতিহাস প্রসঙ্গে উপরোক্ত দু‘টি স্বীকারোক্তির পর এ বিষয়ে আর কী বলার থাকে? তবু জেনে রাখা দরকার যে, মীলাদপন্থীদের সমর্থিত অনুষ্ঠানের আদিরূপ ছিল এই-
১. মীলাদের তারিখে একস্থানে সমবেত হওয়া।
২. কুরআন কারীম থেকে তেলাওয়াত করা।
৩. বিশুদ্ধ বর্ণনার ভিত্তিতে নবীর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা।
৪. তবারক ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা।-আলহাভী লিল্ফাতাওয়া ১/২৫১
বলাবাহুল্য যে, এখানে প্রথমটিকে বাদ দিলে অন্য তিনটাতে আপত্তির কিছু ছিল না; কিন্তু বর্তমানে তা বাড়াবাড়ির এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। এ অবস্থায় এটি অবশ্য বর্জনীয় হওয়ার ব্যাপারে মীলাদ প্রেমিকদের পক্ষেও দ্বিমত প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
মীলাদ ও তার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে সপ্তম হিজরীর উদ্ভাবন; কিন্তু আমাদের সমাজের পরিভাষায় যাকে মীলাদ পড়া বা মীলাদ পড়ানো বলা হয় এবং যা কোন মাকসুদ হাসিলের জন্য, খায়ের-বরকত লাভের জন্য, কোন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিংবা মৃত ব্যক্তির ঈসালে সওয়াবের জন্য বিভিন্ন সময়ে এবং বিশেষ ফযীলতের দিনে-রাতে হয়ে থাকে, তা আরো পরের প্রচলন। মীলাদের সাথে ‘পড়া’ শব্দটির সংযুক্তি থেকেও তা বুঝা যায় যায়।
কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মবৃত্তান্ত তো বলার বিষয়, পড়ার বিষয় না। তবে এমন হতে পারে যে, এ বিষয়ের উপর কোন কিতাব থেকে কেউ পড়বে আর অন্যরা শুনবে। মীলাদের ‘শৈশবে’ এমন প্রচলনও কোথাও কোথাও ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একেও কঠিন মনে করার কারণে কতিপয় বে-ইলম মৌলভী কিছু মীলাদনামা তৈরি করল, যা লোকেরা মুখস্থ আওড়াত এবং আগে-পিছে সালাত-সালাম এবং আয়াত-কালাম যোগ করে নিত। এর নাম হল মওলুদখানী বা মীলাদ পড়া। আমাদের দেশে অনেক অঞ্চলে [ইয়া নবী সালাম আলাইকা] এই মীলাদনামাটি প্রচলিত রয়েছে।
এটি বা এ জাতীয় আরো যেসব মীলাদনামা মওলুদখানীর মজলিসগুলোতে পড়া হয় এগুলো হাদীস ও সীরাতের কিতাবাদি তো দূরের কথা, খাইরুল কুরূনও বহুদূর, পরবর্তী শত বছরেও এসবের নাম-নিশানাও ছিল না। (নির্বাচিত প্রবন্ধ ১/১৬৫-১৬৯)