
14/04/2025
ইফতেখার তামিম আজ নেই। কিন্তু তার শব্দগুলো রয়ে গেছে। ইউসুফ হে সুন্দর বইটা পড়ে সর্বপ্রথম পাঠ অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন।
---------------------------------------
রাত চারটা পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে যাচ্ছিলাম একের পর এক পাতা। শেষ পাতা যখন উল্টাই, ভেসে এলো কানে আজানের সুমধুর ধ্বনি। ৩৬৬ পৃষ্ঠার এই বইয়ের নাম "ইউসুফ হে সুন্দর"। কাননের প্রকাশনায় যিনি কলমে মুগ্ধ করেছেন, আদিব হুযূরের পর যার শৈল্পিক শব্দ প্রয়োগের মুগ্ধতা—আবহ আমায় ডোবায়, আমাদের প্রিয় লেখক ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী হুযূর।
আমি একটু সিয়াক-সাবাকের গল্প বলি সংক্ষেপে।
[১] নদভী হুযূরের বইটা আসছে আমার জানা ছিল না। যখন ইলয়াসের আরশিনগর থেকে এটার কথা জানতে পারলাম তখন কিন্তু প্রায় পকেট শূন্য। প্রথম উপার্জনের টাকাও এই-সেই করে শেষ। হাজার দেড়েকের মতো ছিল বাকি। কালক্ষেপণ না করেই ‘ইলু’কে জানিয়ে দিলাম—এটা আমি নেবো, তুমি অটোগ্রাফসহ পাঠিয়ে দিয়ো। সাথে আদিব হুযূরের একটি বই এবং একটি ডায়রিও অর্ডার করলাম, ("রহমতের দশদিন" ও "রোযনামচা")।
ভূমিকা তো শেষ হলো এবার আসল কথায় আসি।
[২] নদভী হুযূরের এই বই আমাকে আকৃষ্ট করার প্রধান কারণ ছিল তার নাম— "ইউসুফ হে সুন্দর" কী মিষ্টি চয়ন। বর্তমান তরুণ লেখকেরা সহজের মধ্যেই অনেক আজিব আজিব নামে বই প্রকাশ করে। লা-কিন, আমায় আকর্ষিত করতে পারে না। মনে হয় যেন— এই নামে নূর নেই, আত্মার আকর্ষণ নেই। এই হিসেবে আদিব হুযূর ধরেন কিবা নদভী বা যাইনুল আবিদীন হাফি. তাদের গ্রন্থের নাম দেখবেন, কতটা দক্ষতা মেশানো থাকে। কতটা আকর্ষিত করে মানুষকে।
[৩] প্রচ্ছদ করেছেন, কাজী যুবাইর মাহমুদ। উনার শিল্পের সাথে আমরা বইপ্রেমী সকলেই কিছু না কিছু পরিচিত। তাঁর শিল্পের জাদু সবাইকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। গল্প এবং প্রচ্ছদকে তিনি খুব সুন্দর করে মিলিয়ে আঁকতে পারেন। তাঁর আঁকা প্রতিটি প্রচ্ছদই আমার ভালো লাগে। প্রচ্ছদের সৌন্দর্য দু'ধরনের হয়, কারো প্রচ্ছদ শুধুই সুন্দর আর কারও ভাবগম্ভীর। কাজী যুবাইর মাহমুদের প্রচ্ছদের সৌন্দর্যে ভাবগাম্ভীর্যও থাকে। এটা মানুষকে বেশ আকৃষ্ট করে।
[৪] বরাবরই আমি মূল গ্রন্থের পাঠ শুরু করার আগে ভূমিকা পড়তে ভালোবাসি। ভূমিকায় পুরো গ্রন্থের বিষয়বস্তু— লেখক এবং সংশ্লিষ্টের শ্রম-পরিশ্রমের কথা জানতে পারি। একটা বই পড়ছি কিন্তু লেখকের কথা না শুনে এড়িয়ে যাওয়াকে আমি অন্যায় ভাবি। সুন্দর এবং মুগ্ধ করা ভূমিকা লিখতে পারেন—এই পর্যন্ত আমি সীমিত সংখ্যক লেখকই পেয়েছি। আদিব হুযূরের পর যাইনুল আবিদীন এবং নদভী হুযূরের 'শুরু কথা' আমার ভালো লাগে। "জীবনের খেলাঘরে" বইয়ের লেখক খান রাহ. এর ভূমিকাগুলো-ও আমার ভালো লাগতো৷ এবং আরও অনেকেই আছেন এই তালিকায়।
নদভী হুযূর বেশ লম্বা ভূমিকা টেনেছেন। ভূমিকায় তিনি পুরো গ্রন্থের একটা ট্রেইলার দেখিয়ে দিয়েছেন। কী কী হতে পারে, কোথা থেকে কোথায় ঘুরবে এর মোড়। মানে তার দক্ষতার প্রমাণ আপনি প্রতিটি পাতায় পাবেন। "সূচনা কথা'র" মাধ্যমে যা শুরু হবে। অর্পণটাও করেছেন খুব সুন্দর করে। বইয়ের শুরুতে আপনি আরেকটি রত্ন পাবেন—যাইনুল আবিদীন হাফি. এর অনুভূতি। এটা পড়েও বইটি সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা পেয়ে যাবেন।
[৫] ভূমিকার পর আসে বইয়ের বিন্যাস— এখানে নদভী হুযূর অনন্য। বইটি সামনে নিয়ে হুযূরের পরিবেশনা একটু দেখেন,
প্রথমে স্বতন্ত্র শিরোনামে 'আয়াত এবং অনুবাদ'।
তারপর 'তাফসির সুসংক্ষেপ'।
সবশেষে 'পাঠ অনুভূতির ছোট ছোট ঢেউ'।
এই বিন্যাসে পাঠ যেমন সুন্দর হয়, সহজ হয় তেমনই আকর্ষণও থাকে। লেখার উদ্দেশ্য-ও স্ব-উল্লাসে ভাসে।
হুযূরের একটা বৈশিষ্ট্য আমি সবসময় বলি, পাঠকের সাথে পাতায় পাতায় অমন করে নদভী হুযূরের মতো কথা বলতে পারেন—আমি অন্যজনকে পাই নি। মানে তিনি উপস্থিত নেই, কিন্তু তার লেখা পড়তে পড়তে আপনার মনে হবে, তিনি আপনার পাশে বসেই আপনাকে গল্পটা বলছেন। এই যে সাক্ষাৎ-অনূভুতি এটা আপনি অন্য কোথাও পাবেন বলে মনে হয় না।
বইটি পড়তে গিয়ে কখনো আপনার মনে হবে—
তাফসির পড়ছেন!
কখনো মনে হবে গল্পের সাগরে ডুবে আছেন!
আবার কখনো কখনো-ও উপন্যাসের স্বাদ পাবেন!
এই যে মিশ্র অনুভূতি— আসলেই অসাধারণ! এশার নামাজ পর খেয়েদেয়ে বইটি হাতে নিলে টান টান উত্তেজনায় আপনি কখন বইয়ের শেষ পাতায় চলে যাবেন বুঝতেই পারবেন না—অবিশ্বাস্য মনে হবে। শুরু থেকে শেষতক বিরক্তি রুচিসম্মত পাঠকদের পাশ ঘেঁষবে না।
[৬] না, আহসানুল কাসাসের কোন সমালোচনা আমি করতে পারব না। এর যোগ্য আমি নই। প্রচ্ছদ থেকে নিয়ে অলংকরণ, লেখা এবং বারবার দেখা, বাঁধাই, বিন্যাস সবকিছু অনন্য ছিল। ইবনে আব্বাসের কওল লিখতে আরবী এবারতে ছোট্ট একটা বানান বিভ্রাট ছাড়া চোখে অন্য কোন বেশকম পড়ে নি। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা মোহ আমাকে আকৃষ্ট করে রেখেছে। মুগ্ধতা তার মাঝে জড়িয়ে নিয়েছে, এমতাবস্থায় তার ফারাক খোঁজার মতো দুঃসাহস আমি করতে পারি না। তদুপরি গ্রন্থটি যখন রচিত হয়েছে কোরআনের বর্ণনায় তখন এর সমালোচনার সাহস আমার নেই। আমি অক্ষম, আমি অযোগ্য, আমি অপারগ।
[৭] সবশেষে বলব, আপনি পড়তে যাচ্ছেন অসাধারণ একটি বই। যা আপনাকে জড়িয়ে রাখবে কোরআনী গল্পের মাধুর্যে। ইউসুফী চেতনা জাগ্রত হবে ফেতনাময় এই যুগে। শিক্ষা এবং উপদেশের এক অনন্য গ্রন্থের পাঠক হতে যাচ্ছেন আপনি। তাফসির, গল্প এবং উপন্যাস একইসাথে অনেকগুলো মিশ্র অনুভূতির স্বাদ পাবেন। আপনার সামনে খুলে যাবে ইউসুফ-জুলেখা সম্পৃক্ত হাজার-ও ভুল গল্পের অসত্যতা। পড়তে যাচ্ছেন স্রষ্টার বর্ণনায় সৃষ্টির ব্যখ্যায় অনন্য একখানা গ্রন্থ। কোরআনের ভাষায় যে গল্পের নাম, আহসানুল কাসাস।
* * *
ইফতেখার তামিম
বিয়ানীবাজার, সিলেট।
সন্ধ্যারাত্রি। ৩/৫/২৩।
বই : ইউসুফ হে সুন্দর
লেখক : ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী
প্রচ্ছদ : কাজী যুবায়ের মাহমুদ
মুগ্ধতা প্রকাশ : মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
ফ্ল্যাপ : সাইফ সিরাজ
পৃষ্ঠা : ৩৬৮ (অফসেট)
বাঁধাই : আর্ট কার্ড জ্যাকেট বাঁধাই।
মূল্য : ৫০০/-