05/01/2023
শীতের অসুখঃ সতর্কতা ও করণীয়
শীত সমাগত। ঘুম থেকে উঠলেই দেখা যায় প্রকৃতি কুয়াশাচ্ছন্ন, আর সবুজ ঘাসে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির। অনেক পর্যটকদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। এই সময়টা উপভোগ্য হলেও দেখা দিতে পারে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা। তাই প্রয়োজন কিছুটা বাড়তি সতর্কতা।
শীতে প্রধানত বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। যদিও এসব রোগের প্রধান কারণ ভাইরাস, তথাপি বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব এনজাইম আছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাপমাত্রায় কম কার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যায়।
শীতে বাতাসের তাপমাত্রা কমার সঙ্গে আর্দ্রতাও কমে যায়, যা আমাদের শ্বাসনালীর স্বাভাবিক কর্ম প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে ভাইরাসের আক্রমণকে সহজ করে। শুষ্ক আবহাওয়া বাতাসে ভাইরাস ছড়ানোতে সাহায্য করে। এ ছাড়া ধূলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ঠান্ডা, শুষ্ক বাতাস হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালীকে সরু করে দেয়, ফলে হাঁপানির টান বাড়ে।
প্রথমেই বলি সাধারণ ঠান্ডাজনিত সর্দি- কাশি বা কমন কোল্ডের কথা। শীতের শুরুতে তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। শুরুতে গলা ব্যথা, খুশখুশ ভাব ও শুকনা কাশি দেখা দেয়, নাক বন্ধ হয়ে যায়, নাম দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে এবং ঘন ঘন হাঁচি আসে। হালকা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, দূর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়।
এটা মূলত শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশের রোগ এবং সৌভাগ্যের ব্যাপার, এই রোগ এমনিই ভালো হয়ে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়, “চিকিৎসা করলে ৭ দিন লাগে, না করলে ১ সপ্তাহ লাগে”। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাশি কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে।
যদি প্রতিরোধের চেষ্টা সত্ত্বেও সর্দি-কাশি দেখা দেয়, তবু প্রতিরোধের উপায়গুলো চালিয়ে যেতে হবে। সাধারণত প্রাথমিক চিকিৎসাতেই রোগ ভালো হয়ে যায়। তবে প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যেহেতু হাঁচি কাশির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়, তাই আক্রান্ত হলে বাসায় থাকাই ভালো। নেহায়েত বাইরে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করা ভালো।
শীতে ইনফ্লুয়েঞ্জাও বেশিমাত্রায় দেখা যায়। এই রোগটি মূলত ভাইরাসঘটিত। ঠান্ডার অন্যান্য উপসর্গ ছাড়াও এ রোগে জ্বর ও কাশি খুব বেশি হয় এবং শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এ ছাড়া ভাইরাসে আক্রান্ত দেহের দূর্বলতার সুযোগে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াও আক্রমণ করে থাকে। বিশেষ করে নাকের সর্দি যদি খুব ঘন হয় বা কাশির সঙ্গে হলুদাভ কফ আসতে থাকে, তা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ নির্দেশ করে। এই রোগেরও তেমন কোন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলেই এন্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয়।
শীতের প্রকোপে সাইনাস, কান ও টনসিলের প্রদাহও বাড়ে, যেমন সাইনুসাইটিস, টনসিলাইটিস, অটাইটিস ইত্যাদি। এক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। নিউমোনিয়াও এ সময় প্রচুর দেখা যায়। এসব রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বাড়ে নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ, হাঁপানি রোগী ও ধূমপায়ীদের।
ঠান্ডা ও হাঁপানি প্রতিরোধে করণীয়:
১. ঠান্ডা খাবার ও পানীয় পরিহার করা।
২. কুসুম কুসুম গরম পানি পান করা ভালো। হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা উচিত।
৩. প্রয়োজন মতো গরম কাপড় পড়া। তীব্র শীতের সময় কান-ঢাকা টুপি পরা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা।
৪. ধুলাবালি এড়িয়ে চলা।
৫. ধূমপান পরিহার করা।
৬. ঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ না রেখে মুক্ত ও নির্মল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা।
৭. হাঁপানির রোগীরা শীত শুরুর আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো প্রতিরোধমূলক ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
৮. যাদের অনেকদিনের শ্বাস জনিত কষ্ট আছে, তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোকক্কাস নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত।
৯. তাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, যা দেহকে সতেজ রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
১০. হাত ধোয়ার অভ্যাস করা। বিশেষ করে চোখ বা নাক মোছার পরপর হাত ধোয়া।
শীতে অন্যান্য রোগ:
কাশির মতো প্রকট না হলেও শীতে আরও অনেক রোগেরই প্রকোপ বেড়ে যায়। যেমন –
১. আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা। এক্ষেত্রে পূর্বল্লোখিত পরামর্শগুলো মেনে চললেই হবে।
২. চর্মরোগ যেমন একজিমা, চুলকানি, স্ক্যাবিস ইত্যাদি। তাই শীত কালে ত্বকের বাড়তি যত্ন প্রয়োজন। শুষ্কতা কমানোর জন্য ভ্যাসলিন বা গ্লিসারিন, ভালো কোন তেল বা ময়েশ্চার লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। জিভ দিয়ে বারবার ঠোঁট লেহন করা উচিত না।
৩. অনেক সময় কড়া রোদও ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই বাইরে গেলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করলে ভালো হয়। অনেকক্ষণ রোদে না থাকাই ভালো।
৪. কিছু রোগে তীব্র শীতে হাতের আঙ্গুল নীল হয়ে যায়। তাদের বাড়তি সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে।
৫. ঠান্ডা আবহাওয়ায় রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঠান্ডার ওষুধে সিউডোএফেড্রিন বা ফিনাইলেফ্রিন জাতীয় ঔষধ রক্তচাপ বাড়ায়। শীত তীব্র হলে হৃদযন্ত্রের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।
৬. শীতের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হাইপোথার্মিয়া অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া, যা মৃত্যুও ঘটাতে পারে। শিশু ও বয়োবৃদ্ধ যাঁরা নিজেদের যত্ন নিতে অপারগ, তাঁরাই এর শিকার।
৭. ছোট বাচ্চাদের বেলায় সর্দি কাশির সাথে সাথে ডায়রিয়া জনিত রোগও বাড়তে পারে, কারণ এই সময় রোটা ভাইরাসের আক্রমণও বেড়ে যায়। বাচ্চাকে সবসময় ফোটানো পানি খাওয়ানো উচিত।
তবে মনে রাখা দরকার, সব সময়ই যে শীতে রোগ ব্যাধি বাড়বে তা সত্য নয়। সাধারণ ভাবে শীতকালে মানুষের রোগ কম হয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও যথেষ্ট কমে যায়। এমনকি ডাক্তারের চেম্বারেও শ্বাসযন্ত্রের বা ত্বকের রোগ ছাড়া অন্যান্য রোগ খুব একটা দেখা যায় না। অযথা আতংকিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।