30/08/2024
ভাষার সাথে জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই – এই কথাটি ভ্রান্ত। অবশ্য যারা এমন বলেন, তারা ‘জ্ঞান’ দিয়ে কী বোঝান সেটি আবার পরিষ্কার করেন না। ভাষা বিজ্ঞানের সাথে আমার সখ্যতায় জেনেছি ভাষা মূলত জ্ঞান; এই জ্ঞানের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় এটি প্রকাশ করার দক্ষতায়। ভাষার জ্ঞান ছাড়া কেউ একটি বাক্যও লিখতে, পড়তে, বলতে পারবে না, শুনে বুঝতেও পারবে না। অন্যদিকে, ভাষাটি ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন ছাড়া, কেউ শুধু ভাষার জ্ঞান দিয়ে সন্তোষজনকভাবে ভাবের আদান প্রদান করতে পারবে না।
ভাষা যখন জ্ঞান:
একটি ভাষার কোন শব্দের অর্থ কী, শব্দগুলোকে কীভাবে একে অপরের সাথে ব্যবহার করলে ভাবের প্রকাশ সম্ভব, শব্দগুলো কীভাবে উচ্চারিত হয় – এমন সব জিনিসের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে কোন ভাষা সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান। এই জ্ঞান অর্জনের একাধিক উপায় আছে: নিজে পড়াশুনা করে, অন্যের নিকট থেকে পাঠ গ্রহণ করে, অন্যকে ব্যবহার করতে দেখে ইত্যাদি। শিশুরা তাদের মাতৃভাষা অনুকরন করতে করতে নিজের অজান্তেই এই জ্ঞান অর্জন করে। আবার, কেউ চাইলেই এই জ্ঞানের পরিধি আরও বাড়াতে পারে সেই ভাষা নিয়ে গবেষণা করে। সে যতই ভাষাটির উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, ব্যাকরণ, এবং শব্দ সম্ভার নিয়ে পড়াশুনা করবে, ভাষাটির ব্যাপারে তার জ্ঞান ততই বাড়তে থাকবে। কিন্তু শুধু এই জ্ঞান দিয়েই কি সে এই ভাষাটি বাস্তবে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারবে? না, সে এটিকে সেভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ভাবের আদান প্রদান তেমন সফল হবে না; খানিকটা হবে।
ভাষা যখন দক্ষতায় আবৃত:
ভাষাটিকে বাস্তবে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারার নাম দক্ষতা। এই দক্ষতা তৈরি হতে থাকে যখন ভাষাটিকে অনেকবার অনেক দিন ধরে ভাবের আদান প্রদানের জন্য ব্যবহার করতে থাকা হয়। এখানে কেইস দুইটা।
১) কেউ ভাষাটি সামগ্রিক অর্থে যোগাযোগের জন্য তেমন ব্যবহার না করে এর জ্ঞান অর্জন করতেই থাকল অথবা পাশাপাশি শুধুমাত্র লিখতে ও পড়তে থাকল। তারপর একদিন নিয়ত করেই কথা বলা ও কথা শুনা শুরু করে ভাষাটি ব্যবহারের সামগ্রিক দক্ষতা সময়ের সাথে সাথে অর্জন করতে থাকল। আর এই দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় তার ভাষার জ্ঞান আরও বাড়াতে থাকল। আমাদের জীবনে অনেক মানুষের ইংরেজি শেখার গল্প এটি। আমাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, ইংরেজি দিয়ে সত্যিকার অর্থে অল্প অল্প করে মুখে ভাবের আদান প্রদান শুরু করে। অনেকেই এখানেও করে না; বা কখনই করে না।
২) কেউ ভাষাটি সত্যিই সামগ্রিক অর্থে যোগাযোগের জন্য শুরু থেকেই ব্যবহার করতে থাকল। সে টের পাক আর না পাক, ভাষাটির জ্ঞান সে অর্জন করছে, সেই সাথে সেই জ্ঞানের আলোকে সেটি ব্যবহার করে ভাষাটি ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াচ্ছে। জ্ঞান ও দক্ষতা একটার পিঠে আরেকটা ভর করে বেড়েই চলছে। ছোট শিশুটি মায়ের কাছে কথা শুনতে শুনতে অল্প এক সময়ের জন্য জ্ঞানের আকর গড়া শুরু করে, তারপর মুখ ফুটলেই নিজে বলতে শুরু করে, বয়স বাড়লে লিখতে ও পড়তে শুরু করে। আর বড়রা সচেতনভাবে বিদেশী কোন ভাষার জ্ঞান ও দক্ষতা দুটোরই চর্চা করতে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মূলত এটিই করার চেষ্টা করা হয়।
এই দুই কেইসেই দেখা যাচ্ছে ভাষা প্রথমত জ্ঞান, এরপর দক্ষতা। ভাষাকেন্দ্রিক ব্রেইনের স্মৃতি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা, সৃজনশীলতা, জন্মের আগে থেকেই ভাষা বিষয়ে মানুষের ব্রেইনের প্রোগ্রামিং ইত্যাদির বিশদ পাঠ পুরো জিনিসটাকে আরও তথ্যবহুল করতে পারত; কিন্তু এখানে সেগুলোর উপস্থাপন সম্ভব নয়।
ইংরেজি বলতে পারলেই জ্ঞানী কি না:
যখন আমরা বলি আমাদের সমাজের জ্ঞানী ব্যক্তিরা, তখন ‘জ্ঞানী’ শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি ব্যবহারে প্রয়োজন নেই, কিন্তু নিজের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য ইংরেজিতে ফটর ফটর করছে, এমন ব্যক্তি জ্ঞানী নয়। এটি ব্যাপকার্থে। আবার “জ্ঞান”-এর অর্থকে সংকুচিত করে আনা যায়। পটপট করে ইংরেজি বলছে, কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে পারছে না, তার ইংরেজি ব্যবহারে ভাষাজ্ঞান নাই। কীভাবে ইংরেজি বলছে, শব্দচয়ন কেমন হচ্ছে, টোন কেমন ইত্যাদির উপর ভালো খারাপ অনেক কিছুই নির্ভর করছে – এমন পরিস্থিতিতে সফল মানুষটি ইংরেজিতে তার দক্ষতার সাথে সাথে গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে; এই ক্ষেত্রে জ্ঞানটি ভাষার এবং ব্যাপকার্থে। কাজেই, ইংরেজি বলতে পারলেই জ্ঞানী – এমন কথা অন্তঃসারশূন্য।
ইংরেজির সাথে প্রেস্টিজের সম্পর্ক, আমাদের দেশে ইংরেজির অবস্থা, আমাদের করনীয়সমূহ ইত্যাদি এর পরের কোনো পোস্টে।