17/04/2025
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
পর্ব: ৫
প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রধান উপন্যাসগুলোর নাম কী?
'করুণা': এটি তাঁর প্রথম লেখা অসমাপ্ত উপন্যাস। এটি মাসিক 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত 'রবীন্দ্র রচনাবলি'তে (১৯৬১) প্রথম 'করুণা' প্রকাশিত হয়। ২৭টি পরিচ্ছেদে এ উপন্যাসটি রচিত। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: মহেন্দ্র, মোহিনী, রজনী। অনেকের মতে, এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস। যেহেতু এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি, সুতরাং এটি প্রথম উপন্যাস-এ দাবিটি হাস্যকর ও অযৌক্তিক।
'রাজর্ষি' (১৮৮৭): ত্রিপুরার রাজপরিবারের ইতিহাস নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস। উপন্যাসটি 'বালক' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের প্রথমাংশ নিয়ে 'বিসর্জন' (১৮৯০) নাটক রচিত হয়।
'নৌকাডুবি' (১৯০৬): এটি সামাজিক উপন্যাস, যা 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
'প্রজাপতির নির্বন্ধ' (১৯০৮): এটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। পরবর্তীতে এর নাট্যরূপ প্রহসন 'চিরকুমার সভা'।
'ঘরে-বাইরে' (১৯১৬): চলিত ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস, যা 'সবুজপত্র' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর মূল সুর। এ উপন্যাসের নায়িকা বিমলা স্বামী নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও বিপ্লবী সন্দীপের দ্বারা আকর্ষিত। একদিকে বাইরের আন্দোলনের উত্তেজনা অন্যদিকে তিনটি মানুষের জীবনে টানাপোড়েন ও ব্যক্তিগত জীবনের দ্বন্দ্ব, এই দুই মিলে 'ঘরে-বাইরে' উপন্যাস। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: নিখিলেশ (রাজবংশীয় যুবক অতিমাত্রায় শুদ্ধাচারী), বিমলা (সাধারণ পরিবারের মেয়ে), সন্দীপ (স্বদেশী আন্দোলনের নেতা)।
'চতুরঙ্গ' (১৯১৬): সাধু ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ উপন্যাস।
'যোগাযোগ' (১৯২৯): সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। মাসিক 'বিচিত্রা' পত্রিকায় প্রকাশকালে এর নাম ছিল 'তিন পুরুষ'। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় এর নামকরণ হয় 'যোগাযোগ'। নায়িকা কুমুদিনী ও নায়ক মধুসূদনের ব্যক্তিত্বের তীব্র বিরোধ এ উপন্যাসের কেন্দ্র। শেষে স্বামীর কাছে কুমুদিনীর দ্বিধান্বিত সমর্পণ। চরিত্র: মধুসূদন, কুমুদিনী।
'দুইবোন' (১৯৩৩): উপন্যাসটি ১৯৩২-১৯৩৩ সাল পর্যন্ত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। বড় বোন শর্মিলার স্বামী শশাঙ্কের সাথে ছোট বোন উর্মিলার ঘনিষ্ঠতা তাদের জীবনে যে আলোড়ন তুলেছিল, তারই নাটকীয়তার রূপায়ণ এ উপন্যাস। চরিত্র: শর্মিলা, ঊর্মিলা, শশাঙ্ক।
'চার অধ্যায়' (১৯৩৪): অসহযোগ আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলায় নতুন করে যে হিংসাত্মক বিপ্লব প্রচেষ্টা গড়ে উঠেছিল, তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। সন্ত্রাসবাদের সমালোচনা করে এ উপন্যাসের কাহিনী রচিত। চরিত্র। অতিন, এলা, ইন্দ্রনাথ।
'মালঞ্চ' (১৯৩৪): মৃত্যুপথযাত্রী নারী নীরজা ও তাঁর স্বামী আদিত্যকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কাহিনী রচিত।
উল্লেখযোগ্য চরিত্র:
নীরজা, আদিত্য, সরলা।
প্র. 'বৌঠাকুরানীর হাট' উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস 'বৌঠাকুরানীর হাট' (১৮৮৩)। এ উপন্যাসের কাহিনী রবীন্দ্রনাথ প্রতাপচন্দ্র ঘোষের 'বঙ্গাধিপতি পরাজয়' (১৯৬৯) থেকে সংগ্রহ করেন। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথ মাতৃবিয়োগের পর বড় বোন সৌদামিনী দেবীর স্নেহে লালিত-পালিত হন। এ সময়কাল সম্পর্কিত কিছু কাহিনী এবং কয়েকটি ঐতিহাসিক চরিত্রের সম্মিলনে তিনি এটি রচনা করেন। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও ব্যকলার জমিদার রামচন্দ্রের বিবাদকে উপজীব্য করে রচনা করেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিকতার ছোঁয়া থাকলেও এসবের সঙ্গে ইতিহাসের সরাসরি কোন সম্পর্ক নাই। চরিত্র: বসন্ত রায়, উদয়াদিত্য, রামচন্দ্র। পরবর্তীতে তিনি এর কাহিনী অবলম্বনে 'প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০৯) নাটকটি রচনা করেন।
প্র. 'চোখের বালি' উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস 'চোখের বালি' (১৯০৩)। এটি ৫৫টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। এ উপন্যাসটি প্রথমে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সমাজ ও যুগযুগান্তরের সংস্কারের সাথে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ এ উপন্যাসের মূল সুর। বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রের বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও মহেন্দ্রের অনাগ্রহের কারণে অন্যত্র বিয়ে হয় এবং কিছু দিনের মধ্যে বিনোদিনী বিধবা হয়। শিক্ষিত, মার্জিত বিনোদিনী ঘটনাচক্রে মহেন্দ্রের বাড়িতে আসলে তাকে দেখে মহেন্দ্র মুগ্ধ হয় এবং উপলব্ধি করে সমচেতনা সম্পন্ন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা। সুন্দরী ও কর্মদক্ষ বিনোদিনী তিলে তিলে মহেন্দ্রকে ঘোরায় চড়কির মত। তবে বিনোদিনী সমর্পিত হতে চায় বিহারীর নিকট। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিধবা বিনোদিনীকে জীবনের সকল কোলাহল এড়িয়ে, সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রাধান্য দিয়ে কাশীর নির্লিপ্ত জীবনে নিক্ষেপ করেন। চরিত্র: আশালতা, মহেন্দ্র, বিনোদিনী, বিহারী, রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা।
প্র. 'গোরা' উপন্যাস সম্পর্কে কি জান?
উ. উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের ধর্মান্দোলন, স্বদেশপ্রেম ও নারীমুক্তি চিন্তার পটভূমিকা তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস 'গোরা' (১৯১০)। এটি ১৯০৮-১৯১০ পর্যন্ত 'প্রবাসী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের নায়ক গোরা সিপাহী বিপ্লবের সময় নিহত আইরিশ দম্পতির সন্তান। পরে সে লালিত-পালিত হয় হিন্দু ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর কাছে। গোরা আস্তে আস্তে হিন্দু ধর্মের অন্ধ সমর্থক হয়ে উঠে। সময়ের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এক নারীর ভালোবাসা কিভাবে তাকে অন্ধতা ও সংকীর্ণতা থেকে নির্দিষ্ট ধর্মকে অতিক্রম করে মানবতাবাদী আদর্শিক মহাভারতবর্ষের দিকে পৌঁছে, তারই কাহিনী 'গোরা' উপন্যাস। এ উপন্যাসে ব্যক্তির সাথে সমাজের, সমাজের সাথে ধর্মের এবং ধর্মের
সাথে সত্যের বিরোধ ও সমন্বয় চিত্রিত হয়েছে।
প্র. 'শেষের কবিতা' উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ. রবীন্দ্রনাথের কাব্যধর্মী উপন্যাস 'শেষের কবিতা' (১৯২৯)। এটি ১৯২৮ সালে 'প্রবাসী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হয়। ভাষার অসামান্য কবিত্ব, দৃপ্তশক্তি ও পাণ্ডিত্যের দীপ্তি এ উপন্যাসটিকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে যা রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সুকুমার সেন এ উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন, 'বৈষ্ণব সাধনায় পরকীয়াতত্ত্ব রবীন্দ্রনাথের কবিমানসে যেভাবে রূপান্তর লাভ করিয়াছিল শেষের কবিতায় তার পরিচয় পাই'। অমিত ও লাবণ্যের প্রণয়কাহিনী সাহিত্যিক ব্যঞ্জনায় অমর হয়ে উঠেছে এবং বিচিত্রতা দান করেছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অমিত রায় ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়েছি। তার ছেলে বন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধু বেশি। এদের মধ্যে কেতকীর সাথে অমিতের প্রেম হয় এবং অমিতের দেয়া আংটিও পরে। ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে অমিত শিলংয়ে বেড়াতে গেলে উপন্যাসের মূল নায়িকা লাবণ্যের সাথে পরিচয় থেকে প্রেম হয়। কিন্তু লাবণ্য বুঝতে পারে অমিত রোমান্টিক জগতের স্বপ্নাতুর ব্যক্তি। তবুও তাদের বিয়ে ঠিক হলে উপস্থিত হয় কেতকী। ভেঙ্গে যায় বিয়ে। কেতকীর সাথে অমিতের বিয়ে উপন্যাসকে ভিন্নতর রূপ দান করেছে। লাবণ্য বিয়ে করে শোভনলালকে। উপন্যাসের কিছু বাক্য আজ প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। যেমন: ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো। মুখশ্রী। 'কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও' কবিতার মাধ্যমে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ উপন্যাসে ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ইতোমধ্যে ১-৪ পর্বে আলোচনা হয়েছে
পর্ব:১
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122162816756303311&id=61559099331923&mibextid=Nif5oz
পর্ব:২
https://www.facebook.com/share/p/1F43ynjgwt/
পর্ব:৩
https://www.facebook.com/share/p/161npoXe8b/
পর্ব:৪
https://www.facebook.com/share/p/14ri2Xr1ynx/