17/10/2025
‘আজীবন লকিং’ ও ‘রূহানী হিজামা’ নামক ভণ্ডামির শরয়ী খণ্ডন!
ফেসবুকে প্রচারিত এক পোস্টে কথিত রাকী নামধারী একজন মুদাব্বির ও কবিরাজ দাবি করেছেন যে, রোগীর পরিপূর্ণ চিকিৎসার পর তিনটি কাজ—শরীর লক, ব্লাড লক ও রূহানী হিজামা—করে দেওয়া আবশ্যক, যার মাধ্যমে রোগী নাকি "আজীবনের জন্য নিরাপদ" হয়ে যাবে এবং জিন-জাদু আর প্রবেশ করতে পারবে না।
এই দাবিটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল, শরীয়তবিরোধী এবং তাওহীদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এটি সাধারণ মুসলিমদের ঈমান নিয়ে এক ভয়ঙ্কর খেলা এবং রুকইয়াহ শারইয়াহর নামে প্রতারণা ও দ্বীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবিত বিদ'আত ছাড়া আর কিছুই নয়। নিচে কোরআন, সুন্নাহ এবং সালাফদের মূলনীতির আলোকে এই ভণ্ডামির অসারতা বিস্তারিতভাবে প্রমাণ করা হলো:
১. ‘আজীবন সুরক্ষা’র দাবি: গায়েবের জ্ঞানে হস্তক্ষেপ এবং শিরকের প্রবেশদ্বার
ইসলামের মৌলিক আকিদা হলো, মানুষের ভালো-মন্দ, সুস্থতা-অসুস্থতা এবং নিরাপত্তা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার অধীন। তিনিই একমাত্র নিরাপত্তাদাতা এবং রক্ষাকর্তা। কোনো রাকী বা মুদাব্বিরের এমন কোনো ক্ষমতা নেই যে সে একবার কোনো আমল করে একজন মানুষকে আজীবনের জন্য জিন-জাদু থেকে ‘লক’ বা সুরক্ষিত করে দেবে। এই দাবিটি দুটি মারাত্মক কারণে বাতিল:
ক) গায়েবের জ্ঞান ও ক্ষমতার দাবি:
ভবিষ্যতের জ্ঞান ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। আগামীকাল একজন ব্যক্তি অসুস্থ হবে কি হবে না, তার উপর নতুন করে জাদু বা বদনজর লাগবে কি লাগবে না—এই জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন যে, পাঁচটি বিষয় এমন যা তিনি ছাড়া আর কেউই জানে না। আল্লাহ বলেন:
إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
“নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা মাতৃগর্ভে আছে। আর কোনো ব্যক্তি জানে না যে, সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনো ব্যক্তি জানে না যে, সে কোন স্থানে মৃত্যুবরণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।”
(সূরা লুকমান: ৩৪)
এই আয়াতটি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, আগামীকাল কী ঘটবে (مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا) তা কোনো মানুষ জানতে পারে না। কোনো মানুষ যখন ‘আজীবন সুরক্ষা’র গ্যারান্টি দেয়, তখন সে কার্যত দাবি করে যে, সে ভবিষ্যতের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং জানে যে ওই ব্যক্তির উপর আর কোনো বিপদ আসবে না। এই দাবিটি এক প্রকার গায়েবের দাবি করার মতোই স্পর্ধা, যা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং কুরআনের এই অকাট্য আয়াতের সরাসরি বিরোধিতা।
খ) তাওয়াক্কুলের (আল্লাহর উপর ভরসা) ধ্বংসসাধন:
এই ‘আজীবন লক’-এর ধারণা রোগীকে আল্লাহর পরিবর্তে রাকী নামধারী এই মুদাব্বিরের ‘লকিং সিস্টেম’-এর উপর ভরসা করতে শেখায়। রোগী ভাবতে শুরু করে, "হুজুর আমাকে লক করে দিয়েছে, এখন আর আমার কোনো ভয় নেই।" এটি তাওয়াক্কুলের ধারণাকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ ইসলাম আমাদের শেখায় প্রতিদিনের সুরক্ষার জন্য একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করতে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলেন:
«وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ»
“আর যখন তুমি সাহায্য চাইবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও।”
(তিরমিযী, হাসান সহীহ)
এই ভণ্ডরা মানুষকে আল্লাহর পরিবর্তে নিজেদের মুখাপেক্ষী করে তোলে, যা শিরকের অন্যতম প্রবেশদ্বার।
২. ‘শরীর লক’, ‘ব্লাড লক’ ও ‘রূহানী হিজামা’: ভিত্তিহীন ও বিদ'আতী পরিভাষা
‘শরীর লক করা’, ‘ব্লাড লক করা’ বা ‘রূহানী হিজামা’—এই পরিভাষাগুলো কুরআন, হাদিস কিংবা সালাফদের কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ), সাহাবায়ে কেরাম বা কোনো নির্ভরযোগ্য ইমাম রুকইয়ার চিকিৎসার অংশ হিসেবে এ ধরনের কোনো ‘লকিং’ বা বিশেষায়িত ‘রূহানী’ আমলের কথা বলেননি বা করেননি। দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো ইবাদত বা আমল উদ্ভাবন করাই হলো বিদ'আত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করল যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।”
(সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
* উৎস কোথায়? ‘লকিং’ বা ‘বন্ধন’—এই শব্দগুলো শরয়ী রুকইয়ার অংশ নয়, বরং এগুলো জাদুকর বা তান্ত্রিকদের ব্যবহৃত পরিভাষা। আর ‘রূহানী হিজামা’র মতো চটকদার নাম দিয়ে একটি সুন্নাহসম্মত আমলকে (হিজামা) বিকৃত করা হচ্ছে এবং এর সাথে এমন বৈশিষ্ট্য (আজীবন সুরক্ষা) যুক্ত করা হচ্ছে যার কোনো দলিল নেই। এটি দ্বীনের বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
৩. প্রতারণার মনস্তাত্ত্বিক দিক: কেন এই অদ্ভুত পরিভাষা?
প্রশ্ন হলো, এই ভণ্ড ও প্রতারক রাকী নামধারী মুদাব্বিররা কেন এ ধরনের অদ্ভুত ও ভিত্তিহীন পরিভাষা ব্যবহার করে? এর পেছনে একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রতারণা কাজ করে। যখন একজন ভণ্ড ব্যক্তি এমন সব জটিল ও রহস্যময় পরিভাষা ব্যবহার করে যা সাধারণ মানুষ বোঝে না, তখন দুটি জিনিস ঘটে:
* ক) কৃত্রিম বিশেষজ্ঞতা তৈরি: এটি তাকে একজন সাধারণ রাকীর ঊর্ধ্বে এমন একজন 'বিশেষজ্ঞ' হিসেবে উপস্থাপন করে, যার কাছে কোনো 'গোপন জ্ঞান' বা 'উন্নত পদ্ধতি' আছে, যা অন্য কেউ জানে না।
* খ) রোগীর নির্ভরশীলতা তৈরি: রোগী ভাবতে শুরু করে যে, এই বিশেষ 'লকিং' ছাড়া তার মুক্তি নেই এবং এই কাজটি করার ক্ষমতা একমাত্র এই 'হুজুরেরই' আছে। এর মাধ্যমে সে রোগীকে স্থায়ীভাবে নিজের উপর নির্ভরশীল করে তোলে, যা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার একটি নিকৃষ্ট কৌশল।
৪. রোগী কেন আবার আক্রান্ত হয়? (ভণ্ডদের যুক্তির শরয়ী খণ্ডন)
পোস্টে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, রোগী যেন আবার আক্রান্ত না হয়, সেজন্য এই ‘লকিং’ প্রয়োজন। এটি একটি প্রতারণাপূর্ণ যুক্তি, যা দিয়ে তারা তাদের বিদ'আতী আমলের বাজার তৈরি করে। রোগী কেন আবার আক্রান্ত হতে পারে, তার সুস্পষ্ট কারণ ইসলামে বর্ণিত আছে:
* ১. রোগীর নিজের আধ্যাত্মিক দুর্বলতা: রোগী সুস্থ হওয়ার পর যদি সালাত, যিকির-আযকার এবং মাসনূন আমল ছেড়ে দেয়, তবে তার আধ্যাত্মিক সুরক্ষা বর্ম (Spiritual Fortification) দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শয়তান পুনরায় আক্রমণের সুযোগ পায়। আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ
“আর যে ব্যক্তি রহমানের স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, অতঃপর সে তার সঙ্গী হয়ে যায়।”
(সূরা আয-যুখরুফ: ৩৬)
* ২. নতুন আক্রমণ: তাকে নতুন করে জাদু করা হতে পারে বা নতুন করে কারো বদনজর লাগতে পারে। পৃথিবীতে শত্রু বা হিংসুক থাকা পর্যন্ত এই ঝুঁকি থেকেই যায়।
* ৩. আল্লাহর পরীক্ষা: সুস্থতা ও অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আল্লাহ চাইলে কাউকে পুনরায় পরীক্ষা করতে পারেন। আল্লাহ বলেন:
وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً
“এবং আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি।”
(সূরা আল-আম্বিয়া: ৩৫)
এর সমাধান কোনো এককালীন ‘লক’ নয়। এর সমাধান হলো, রোগীকে শিখিয়ে দেওয়া যে, সে কীভাবে নিজেই প্রতিদিনের আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সুরক্ষা চাইবে। এটাই রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ।
৫. ইসলামে সুরক্ষার সঠিক পদ্ধতি কী?
ইসলামে আজীবন সুরক্ষার ফর্মুলা কোনো কথিত রাকী ও মুদাব্বিরে'র ‘লকিং’ পদ্ধতিতে নয়, বরং এটি হলো বান্দার মৃত্যু পর্যন্ত ঈমান ও আমলের উপর অটল থাকা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলেন:
احْفَظِ اللَّهَ يَحْفَظْكَ
“তুমি আল্লাহকে (তাঁর বিধি-বিধানকে) হেফাজত করো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন।”
(তিরমিযী, হাসান সহীহ)
যে ব্যক্তি তাওহীদ, সালাত, সকাল-সন্ধ্যার যিকির এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আল্লাহকে হেফাজত করবে, আল্লাহ নিজেই তার রক্ষক হয়ে যাবেন। এর চেয়ে বড় কোনো ‘লক’ বা ‘সুরক্ষা’ আর নেই।
৬. একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে প্রকৃত রাকী এবং ভণ্ডদের মধ্যে পার্থক্য করবে?
পার্থক্যটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখলেই হবে:
* প্রকৃত রাকী empowering করেন: তিনি আপনাকে আল্লাহর উপর ভরসা করতে শেখাবেন, আপনাকে মাসনূন আমল ও সেল্ফ-রুকইয়াহ শিখিয়ে দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার চেষ্টা করবেন, যাতে আপনার আর কারো প্রয়োজন না হয়। তবে বেশি জটিল হলে শরয়ী রুকইয়াহ সেশন নেওয়ার পরামর্শ দিবেন।
* এই ভণ্ড ও প্রতারক রাকী নামধারী মুদাব্বিররামানুষকে নিজের উপর নির্ভরশীল করে: সে আপনাকে নিজের 'ক্ষমতা' বা 'লকিং সিস্টেম'-এর উপর ভরসা করতে বলবে এবং আপনাকে স্থায়ীভাবে তার মুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল করে রাখবে।
সহজ কথায়, যার কাছে গেলে আপনার ঈমান ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বৃদ্ধি পায়, তিনিই সঠিক পথের অনুসারী। আর যার কাছে গেলে ব্যক্তির ‘ক্ষমতা’র উপর বিশ্বাস জন্মে, বুঝতে হবে আপনি প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন।
পরিশেষে, এই ভণ্ড ও প্রতারক রাকী নামধারী মুদাব্বিরের প্রচারিত ‘আজীবন লক’, ‘ব্লাড লক’ বা ‘রূহানী হিজামা’-র দাবি শরীয়তবিরোধী ভণ্ডামি, অজ্ঞতা, বিদ'আত এবং প্রতারণার একটি নিকৃষ্ট মিশ্রণ। যে ব্যক্তি এ ধরনের দাবি করে, সে হয় শরীয়ত সম্পর্কে চরম অজ্ঞ, নতুবা সে একজন প্রতারক যে রুকইয়ার নাম বেচে নিজের একটি কাল্পনিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
মুসলিমদের উচিত এ ধরনের অলৌকিক ও চটকদার দাবি থেকে সাবধান থাকা এবং শুধুমাত্র কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ ধরনের প্রতারকদের থেকে এবং দ্বীনের নামে সকল প্রকার বিদ'আত থেকে হেফাজত করুন। আমীন।