
08/08/2025
☸️শ্রাবণী পূর্ণিমার তাৎপর্য ☸️
শ্রাবণী পূর্ণিমা বৌদ্ধ ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বৌদ্ধ সাহিত্যে এদিনের সাথে বিজড়িত রয়েছে নানা ঘটনাবলী। আজ সে বিষয়ে এখানে সংক্ষেপে আলোকপাত করব।
১) থেরবাদী বৌদ্ধ পরম্পরায় দু’প্রকার বর্ষাবাসের প্রচলন রয়েছে। একটিকে বলা হয় প্রথম বর্ষাবাস (পুরিমা বস্সা) এবং অন্যটিকে বলা হয় দ্বিতীয় বর্ষাবাস (পচ্ছিম বস্সা)। প্রথম বর্ষাবাস শুরু হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমায় এবং দ্বিতীয় বর্ষাবাস শুরু হয় শ্রাবণী পূর্ণিমায়। অর্থাৎ আজ হতে দ্বিতীয় বর্ষাবাস প্রারম্ভ হয়। প্রথম বর্ষাবাসিক ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা বর্ষাবাস সমাপ্ত করবেন আশ্বিনী পূর্ণিমায় এবং দ্বিতীয় বর্ষাবাসিক ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা বর্ষাবাস শেষ করবেন কার্তিকী পূর্ণিমায়। তবে কঠিন চীবর লাভ করবেন কেবল প্রথম বর্ষাবাসিক ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ। দ্বিতীয় বর্ষাবাসিক ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ কঠিন চীবর লাভের অযোগ্য হন। কারণ আশ্বিনী পূর্ণিমা হতে কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত যে একমাস কঠিন চীবর দানের সময় সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে সেসময় দ্বিতীয় বর্ষাবাসিক ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ বর্ষাবাসেই থাকবেন। কার্তিক পূর্ণিমায় বর্ষাবাস যখন শেষ করবেন তখন কঠিন চীবর দানের সময় সীমাই সমাপ্ত হয়ে যাবে।
২) আজকের দিনে ভগবান বুদ্ধ করণীয় মৈত্রীসূত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন।
খুদ্দক পাঠ অর্থকথা পরমার্থ জোতিকায় উল্লিখিত হয়েছে যে, আষাঢ়ী পূর্ণিমায় পাঁচশত ভিক্ষু ভগবানের নিকট হতে ধ্যানের কর্মস্থান গ্রহণ করে শ্রাবস্তীর সন্নিকটে অরণ্যে চলে গিয়েছিলেন সেখানে তিনমাস বর্ষাবাস উদযাপন করার জন্য। অরণ্যে তাঁরা এক প্রাচীন বড় বৃক্ষের নীচে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করে অবস্থান করছিলেন। যে বৃক্ষের নীচে তাঁরা বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করেছেন সে বৃক্ষে বসবাস করছিল কিছু বৃক্ষদেবতা। তাঁরা ভিক্ষুদেরকে নীচে রেখে নিজেরা উপরে অবস্থান করা অশোভন হবে মনে করে সবাই নিজেদের দিব্য বিমান ছেড়ে নীচে চলে আসলেন। প্রথমে তাঁরা মনে করেছিলেন ভিক্ষুরা হয়তো কোথাও যাত্রা পথে এখানে বিশ্রাম নিয়ে আবার গন্তব্যে চলে যাবেন। কিন্তু কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরও সেখানে ভিক্ষুরা অবস্থান করছেন দেখে বুঝতে পারলেন যে, ভিক্ষুরা সেখানে বর্ষাবাস শেষ অবধি থাকবেন। সেরকম হলে তাঁদের জন্য অসুবিধার কারণ হবে। কেননা তাঁদেরকে ইতিমধ্যেই আবাস চ্যুত হয়ে নীচে আসতে হয়েছে। এজন্য ভিক্ষুগণ যাতে সে স্থান হতে অন্যত্র চলে যান, তজ্জন্য তাঁরা ভিক্ষুদেরকে নানা প্রকার ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে লাগলেন। ভয়ভীতি প্রদর্শনেও কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁরা সেখানে ভীষণ দুর্গন্ধ প্রবাহিত করতে লাগলেন। পঁচা ভীষণ দুর্গন্ধে ভিক্ষুগণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন সে স্থান ত্যাগ করার জন্য। অবশেষে তাঁরা সকলে শ্রাবস্তীতে বুদ্ধের কাছেই ফিরে আসলেন।
বনবাসী ভিক্ষুদের আসতে দেখে ভগবান বললেন-‘ন ভিক্খবে অন্তোবস্সং চারিকং চরিতব্বন্তি মযা সিক্খাপদং পঞ্ঞাপেতং। কিস্স তুম্হে চারিকং চরথাতি?’
অর্থাৎ ‘হে ভিক্ষুগণ! বর্ষাবাসের মধ্যে দেশ ভ্রমণে যেওনা’- আমার দ্বারা এ শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপণ করা হয়েছে। এ সময়ে তোমরা দেশ ভ্রমণ করছ কেন?’ অতঃপর ভিক্ষুগণ আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা ভগবান সমীপে ব্যক্ত করলেন। তখন বুদ্ধ আজকের দিনে ‘করণীয় মেত্তা সূত্র’ শিক্ষা দিয়ে ভিক্ষুদেরকে আবার সেখানে পাঠালেন এবং মৈত্রী অনুশীলন করে মৈত্রী বিহারী হয়ে দ্বিতীয় বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করতে উপদেশ দিয়েছিলেন। ভগবানের নির্দেশে ভিক্ষুরা সেখানে গিয়ে আজকের দিনে অর্থাৎ শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতে দ্বিতীয় বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করে মৈত্রী চিত্তে বিহার করলে দেবগণ তাঁদের সহায় হয়েছিলেন। সুতরাং আজকের দিনে ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষুদেরকে করণীয় মৈত্রী সূত্র দেশনা করেছিলেন এবং সাথে সাথে দ্বিতীয় বর্ষাবাসের নির্দেশও দিয়েছিলেন।
৩) আজকের দিনে ভগবানের একান্ত সেবক ও শ্রুতিধর তথা ধম্মভাণ্ডাগারিক ভদন্ত আনন্দ স্থবির অরহত্ব ফল লাভ করেছিলেন। অরহত্ব মার্গফল অধিগত করেই তিনি প্রথম ধর্ম সঙ্গীতিতে যোগদান করেছিলেন।
৪) আজকের দিনেই রাজগীরের বেভার পর্বতে সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম ধর্ম সঙ্গীতি বা সঙ্গায়ন আরম্ভ হয়েছিল। যে বছর ভগবানের মহাপরিনির্বাণ হয়েছিল সে বছর ছিল অধিমাস বা মল মাস। সেজন্য বর্ষাবাস একমাস পিছিয়ে উদযাপন হওয়ায় আষাঢ়ী পূর্ণিমার স্থলে শ্রাবণী পূর্ণিমায় বর্ষাবাস শুরু হলে সেদিনই প্রারম্ভ হয়েছিল প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম সঙ্গীতি। যা তিনমাস ব্যাপী চলমান ছিল। সে সঙ্গীতিতে কেবল ধর্ম-বিনয়ের সঙ্গায়ন বা আবৃতি হয়েছিল। ধূতাঙ্গ শ্রেষ্ঠ ভদন্ত মহাকাশ্যপ স্থবিরের পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত এ সঙ্গীতিতে বিনয়ধর উপালি স্থবির বিনয় সঙ্গায়ন করে এবং ধম্মভাণ্ডাগারিক ভদন্ত আনন্দ স্থবির ধর্ম আবৃতি করে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ধর্ম সঙ্গীতিতে সর্বমোট পাঁচশত অরহত স্থবির যোগদান করেছিলেন।
৫) আজকের দিনেই অর্থাৎ শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনেই মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ ঋদ্ধি প্রভাবে ভয়ানক নর হত্যাকারী অঙ্গুলিমালকে জালিবনে দীক্ষা দিয়েছিলেন।
এগুলি ছাড়াও বৌদ্ধ সাহিত্য চর্চা করলে দেখা যায় প্রাচীন ভারতে শ্রাবণ শব্দটি শ্রবণ শব্দ হতে এসেছে। এ মাসে অধিকতর ধর্ম শ্রবণ করা হত বলে শ্রবণ হতে শ্রাবণ মাসের অস্থিত্ব এসেছে। সেজন্য বৌদ্ধ পরম্পরায় এ মাস এবং এ পূর্ণিমার রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ গুরুত্ব।