05/06/2025
হিন্দু বাড়ি থেকে কোন আক্কেলে কোরবানির গরু কিনলা,বাপ? সত্যি কইরা বলো তো, তোমার বউ এই বুদ্ধি দিছে ,তাই না? সকাল থেইকা গরু আমার বাড়িতে আর এই সন্ধ্যা বেলায় আমি খবর পাইলাম... এইটা রতনের মার গরু। আজকে তোমার আব্বা নাই বইলা সংসারে আমার কোনো দাম নাই।
জাহানারা বানু বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছেন। তার হাঁপানির সমস্যা রয়েছে। রেগে গেলে তিনি হাঁপাতে থাকেন।
জাহানারা বানুর ছেলে মিজান মাথা নিচু করে বললো,
"আম্মা আপনি তো জানেন,রতনদার মায়ের অবস্থা। উনি কি এই বয়সে, গরু নিয়ে হাঁটে যেতে পারবে? রতনদা এইভাবে তার দুইটা বাচ্চা রেখে মরে গেলো।মাসী কি কষ্ট করতেছে বাচ্চা দুইটা নিয়া। সেজন্যই পারভীন বললো, মাসীর কাছ থেকে গরুটা কিনে নিতে।মাসীর খুব টাকার দরকার। দেখলেন তো ,কতো কম দামে দিয়ে দিলো মাসী।আর গরুটা দেখতে কি সুন্দর! এই গরু হাট থেকে কিনলে, কম করে দশ পনেরো হাজার টাকা বেশি দাম পড়বে।"
মিজানের কথায় জাহানারা বানুর রাগ এতটুকু কমলো না, বরং তিনি আরো রেগে গেলেন।
"আসছেন বিবি হাতেম তাঈ! তোমার আব্বারে আগেই বলসিলাম আমি,এই এতিম মেয়ের সাথে তোমার বিয়েটা না দিতে। সুন্দর মেয়ে দেখলো আর পাগল হয়ে ছেলের বউ করে নিয়া আসলো।বাবা মা ছাড়া বড় হইসে পারভীন। কোনো ধর্ম কর্মের এলেম পাইসে? তুমি কেমন করে তার কথায়, রতনের মায়ের থেকে গরুটা কিনলা? আমার সাথে একবার পরামর্শ করতে পারতা। টাকা কি পুরাটা দিয়া দিসো নাকি? ফেরত দিতে পারবা না গরুটা? এই ভর সন্ধ্যায় রতনের মা কেন আসছে ? আর কি সর্বনাশ করার বাকি আছে?"
জাহানারা বানুর শ্বাস টান শুরু হয়ে গেল।তিনি জোরে জোরে শ্বাস টানছেন আর হাউমাউ করছেন।
পারভীন বাইরে গরু দেখাশোনার তদারকি করছিল। জাহানারা বানুর হৈচৈ শুনে দৌড়ে ঘরে এলো।
"আম্মা শরীর খারাপ লাগছে আপনার?কি নিয়ে এতো রাগারাগি করছেন? ঈদের আগে আপনার শরীর খারাপ হলে এতো ঝামেলা কে সামাল দিবে বলেন তো?"
জাহানারা বানু পারভীনকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন।
"কোন সাহসে তুমি মিজানরে হিন্দু বাড়ির গরু কিনতে বললা? রতনের মার কষ্ট কমাইতে গিয়া, আমরা সবাই কি পাপের ভাগী হবো?"
পারভীন এতক্ষনে শাশুড়ি মায়ের রাগের কারণ বুঝতে পারলো।
"আম্মা, হিন্দু বাড়ির গরু কিনতে আমাদের ধর্মে কোন মানা নাই। হিন্দু বাড়ির গরুর দুধ বাজার থেকে কিনে আনি না আমরা? যেকোনো জিনিস, টাকা দিয়ে একবার কিনে নিলে তো, সেটার মালিকও বদল হয়ে যায়।গরু আপনার ছেলে কিনে এনেছে,এটা এখন আমাদের গরু। চাইলে আপনি সিদ্দিক মামাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারেন।"
কথা বলতে বলতে, শাশুড়ির বুকে মালিশের তেলটা বের করে আনলো পারভীন।এই তেলটা মালিশ করলে হাঁপানিতে খুব আরাম হয়।
সিদ্দিক মামার নাম শুনে জাহানারা বানু একটু ঠান্ডা হলেন। সিদ্দিক মামা অনেক বড় আলেম, জাহানারা বানুর খালাতো ভাই। গলার স্বরও একটুখানি নরম হলো এবার।
"রতনের মা কেন আসছে? টাকা পয়সা দেওয়া শেষ না? সিদ্দিককে একটা ফোন করো। আমি কথা বলবো..."
পারভীন ইশারায় সিদ্দিক মামাকে ফোন দিতে বললো মিজানকে। তারপর ইতস্তত করে বললো,
"আম্মা, গরুটা তাদের খুব আদরের ছিল। রতনদার মেয়ে সবিতা, সারাদিন গরুটার সাথে সাথে থাকতো। আজকে ওদের গোয়ালঘরটা খালি হয়ে গেছে, মেয়েটা সকাল থেকে কান্না করছে। সারাদিন তাকে কিচ্ছু খাওয়ানো যায় নি। সেজন্যই মাসী ওকে নিয়ে এখানে এসেছে,গরুটা দেখাতে। আমি সবিতার কাছে গিয়েছিলাম, মেয়েটার গায়ে জ্বর চলে আসছে।"
সিদ্দিক মামা ফোন ধরেছেন, সব শুনে মামা বললেন
"পারভীন আর মিজান একদম ঠিক কাজ করেছে,আপা। কোরবানিতে কোনো সমস্যা তো নেই ই, উল্টা বয়স্ক প্রতিবেশীর কষ্ট কমানোর জন্য তারা অতিরিক্ত সওয়াব পাবে, ইনশাআল্লাহ। কোরবানির গরু আপনি অমুসলিমদের কাছ থেকে নিশ্চিন্তে কিনতে পারেন।শুধু তাই নয় আপা, কোরবানির মাংসও আপনি অমুসলিম প্রতিবেশীকে দিতে পারেন।এটা প্রতিবেশীর হক।আর প্রতিবেশী যদি হিন্দু হয়, এবং গরুর মাংস না খায় তাহলে, আপনার গরু কাটা বা রান্নায় তাদের যেন কোন কষ্ট, অসুবিধা না হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। ইসলাম সম্প্রীতি শিখায়, শান্তি শিখায়...বিবাদ নয়। যেকোনো অমুসলিম যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি তার সাথে বিবাদে জড়াতে পারবেন না। আর সে যদি প্রতিবেশী হয়, তাহলে তো কথাই নেই... প্রতিবেশীকে কোনো অবস্থাতেই কষ্ট দিতে পারবেন না। তার সুবিধা অসুবিধা সবার আগে দেখতে হবে।"
জাহানারা বানু ফোন রেখে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। তার শ্বাসকষ্ট কমে এসেছে। কাঁপা গলায় বললেন,
"আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, আমাদের একটা টকটকা লাল গরু ছিল। আমরা তারে লালী ডাকতাম। আমিও সারাদিন গরুটার সাথে সাথে থাকতাম। আম্মা যখন গরুটারে খাওয়াইতো, আমিও আম্মার সাথে খাওয়াইতাম।গরুটারে গোসলের জন্য পুকুরে নামাইলে, আমারেও আব্বা পুকুরের কিনারে বসাইয়া গোসল করাই দিতো।লালীরে যখন বিক্রি করলো, তখন হায়রে আমার কান্দা।লালীরে স্বপ্ন দেইখা ঘুমের মধ্যে চিল্লাইতাম।এই করতে করতে ভয়ানক জ্বর আসলো...ওই সময় থেইকা হাঁপানি শুরু হইলো। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখাইয়া জ্বর সারলো।আব্বা এরপর আর কখনো বাড়িতে গরু কিনে নাই। গোয়ালঘর ভাইঙ্গা সেইখানে গাছ গাছালি লাগাই ফেলসে।"
জাহানারা বানু যেন ছোট বেলায় ফিরে গেছেন।
রতনের মা দরজায় এসে দাঁড়ালেন, সাথে ছোট্ট সবিতা। কেঁদে কেঁদে ছোট্ট মেয়েটার চোখ লাল হয়ে গেছে।জাহানারা বানু সবিতাকে নিজের কাছে ডেকে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
"ওমা, মেয়ের তো দেখি জ্বরে গা পুইড়া যায়। পারভীন ওগোরে খাওয়া দেও। তারপরে মেয়েটারে জ্বরের ওষুধ দিও।"
ছেলেকে বললেন, "গরুটা একটু দূরে নিয়া কোরবানি দিস,বাবা। সবিতা যেন না দেখে, কেমন?আর ঈদের পরে একটা সুন্দর একটা বাছুর কিনে রতনের মা'রে দিস। গোয়ালঘর টা খালি থাকলে ভালো দেখায় না।"
জাহানারা বানু শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। পারভীন আর মিজান দুই পাশ থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
#মায়া
লিখেছেন Ruchira Sultana