24/09/2025
পূজ্য ভন্তেকে কারগাড়ী দান।
দিকে দিকে সদ্ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে ১৯৮৯ সালে পূজ্য বনভন্তেকে একটি রাশিয়ার তৈরী জীপ ঘরাধ গাড়ী দান করা হয়- ডা. প্রবীরচন্দ্র চাকমার উদ্যোগে। সেই গাড়ীতে করে বনভন্তে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করতে থাকলেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দশটি বছর ধরে এ গাড়ীটি ভন্তের ব্যক্তিগত গাড়ী হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকল। ১৯৯৯ সালের প্রথমদিকে খাগড়াছড়ি নিবাসী ডা. প্রভাত কুমার চাকমার এ বিষয়ে নতুন এক চেতনা উদয় হল। তিনি চিন্তা করলেন, পূজ্য বনভন্তে তো এ-একটি গাড়ী সুদীর্ঘ দশটি বছর ধরে ব্যবহার করছেন। তাঁকে কী আর একটা নতুন গাড়ী দান করা যায় না। অন্যদিকে রাশিয়ার তৈরী সেই জীপটা সেকেলেরও। এ চিন্তা করতে করতে তার মনে পড়ল, আমার তো ক্ষতিপূরণ বাবদ বেশ কিছু টাকা পাওয়ার আছে। বিভিন্ন জটিলতায় সরকারের পক্ষ থেকে সেই ক্ষতিপূরণের টাকাগুলো দেওয়া হচ্ছে না। এবার তিনি প্রায় মানস করে ফেললেন। যদি ক্ষতিপূরণের টাকাগুলো পাই, সেখান থেকে আমি ভন্তেকে একটি কারগাড়ী দান করবোই, করবো। এতে ভন্তের ধর্মপ্রচারে আরো সুবিধা হবে। বর্তমান জীপগাড়ী চাইতে কারগাড়ীতে চড়ে ধর্মপ্রচার করাটা ভন্তের জন্য আরামদায়কও হবে নিশ্চয়। আর ভন্তেকে ধর্মপ্রচারে সহযোগিতা করে আমারও অর্জিত হবে বিপুল পুণ্য। ডা. বাবু এরূপ মনস্থির করার পর দু’য়েক মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকাগুলো পেয়ে গেলেন।
শুধু ডাঃ বাবু কেন, এরূপে অনেকেই বনভন্তের উদ্দেশ্যে মানস করে প্রত্যক্ষ ফল পেয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে ভন্তের অভিমত নিম্নরূপ। অনেককে বলতে শুনি বনভন্তেকে স্মরণ করে বিপদ হতে উদ্ধার পেয়েছে। মানস করে প্রত্যক্ষ ফল পেয়েছে। বনভন্তে মুখে যা বলেন তা সত্য হয়। আচ্ছা, এগুলো কী? এসব কী কোনো মহাপুরুষ বা দেব-দেবীর দয়া, কৃপা বা আশীর্বাদ? কোনো তান্ত্রিক শক্তি? না; এসব কিছুই নহে। এগুলো হল সত্যের প্রভাব, সত্যের শক্তি, সত্যের ঋদ্ধি। এই প্রভাব, এই শক্তি, এই ঋদ্ধি অলৌকিক, অবাস্তব বা কাল্পনিক কিছু নহে। এগুলো অত্যন্ত বাস্তব; নিরেট নিখাঁত সত্য। কীভাবে এই সত্যশক্তি উৎপন্ন হয়? বুদ্ধ ও তাঁর অর্হৎ শিষ্যগণের ত্যাগময়, মৈত্রী-করুণাময় জীবনাদর্শকে বনভন্তে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তাঁদেরই অনুশীলিত জীবন গঠনের চেষ্টায় দীর্ঘকাল মনে মনেও পাপচিন্তা, পাপসংকল্প পোষণ করেনি। বনভন্তের এই সাধনা একান্তই সত্য। সেই সত্য হতে একটি শক্তি উৎপন্ন হয়েছে। তাই বনভন্তের প্রতি তদগত বিশ্বাসী লোকে বনভন্তেকে স্মরণ করলে বিপদ থেকে রক্ষা পায়। বনভন্তের উদ্দেশ্যে মানস করলে প্রত্যক্ষ ফল পায়। বনভন্তে দীর্ঘকাল দৈহিকভাবে কোনো পাপ করেনি। কোনো প্রাণীকে ঢিল, দণ্ড, অস্ত্র-শস্ত্রে প্রহার, আঘাত বা হত্যা করেনি। এই নিখাঁত কায়িক পাপ বিরতিজনিত সত্যের প্রভাবে বনভন্তের স্পর্শেও মঙ্গল সাধিত হয়। কেউ কেউ মনে করে বনভন্তে উগ্র এবং কর্কশ ভাষী। না, তা সত্য নহে। মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ বিপথগামী ভিক্ষু-গৃহীদেরকে সত্যপথে আনতে তাদের প্রতি মৈত্রী-করুণা চিত্তে অনেকসময় কঠোরবাক্য প্রয়োগ করেছিলেন। পরকল্যাণ, পরমঙ্গলের তরে যাদের চিত্ত দিনরাত অনাসক্তভাবে নিবেদিত তাদের কঠোরবাক্য কদাপি হিংসা, বিদ্বেষপ্রসূত হতে পারে না। এ-সকল বাহ্যিক বিষয় বলে গণ্য করা কর্তব্য। বনভন্তে দীর্ঘকাল বাক্যে কোনো পাপ করেনি। কোনো মিথ্যাবাক্য, ঠকবাক্য, প্রবঞ্চকবাক্য, ভেদবাক্য, পৌরুষবাক্য বলেনি। এই নিখাঁত বাক্য পাপ বিরতিতে সত্য শক্তি উৎপন্ন হয়েছে। তাই বনভন্তে মুখে যা বলেন তা’ ফলে, তা’ সত্যে পরিণত হয়।
ক্ষতিপূরণের টাকাগুলো পেয়ে ডা. প্রভাত কুমার চাকমা তার মানসের কথা জানালেন পরিবারের সদস্যদেরকে। কথাটা শুনে তারা প্রত্যেকে বেশ খুশি হলেন। দ্রুত গাড়ীটি দান করতে ডা. বাবুকে পরামর্শ দিলেন। ডা. চাকমাও কী আর দেরী করতে চান! চান না কিছুতেই। তাই তো এক নিকট আত্মীয়-এর মাধ্যমে জাপানের তৈরী টয়োটা করোলা কারগাড়ী ক্রয় করলেন সহসা। আর আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে সপরিবারে সেই গাড়ীটিসহ আর্যবন বিহারে উপস্থিত হলেন। বলে রাখা দরকার, এ বছর পূজ্য বনভন্তে খাগড়াছড়িস্থ আর্যবন বিহারে বর্ষাবাস যাপন করছেন। বিহারে পৌঁছে ডা. বাবু প্রভাত কুমার চাকমা সপরিবারে বনভন্তের সকাছে গেলেন। অমনি মানস করে প্রত্যক্ষ ফল লাভের কথা জ্ঞাপন করলেন ভন্তেকে। সাথে সাথে প্রার্থনা করলেন, তার এ দান গ্রহণ করে তাকে ধন্য করতে। ভন্তেও ডা. বাবুকে পুণ্য অর্জনে সুযোগ দিলেন। তার এই দান অনুমোদন করলেন। অমনি ডা. চাকমা স্বহস্তে গাড়ীর চাবি পূজ্য ভন্তের পবিত্রতম হাতে তুলে দিলেন। দিনটি ২৬ জুলাই ’৯৯ ইং, ১১ শ্রাবণ ১৪০৬ বাং, ২৫৪৩ বুদ্ধাব্দ, রোজ সোমবার। গাড়ীর চাবি গ্রহণ করে পূজ্য ভন্তে ডা. প্রভাত ও তার পরিবার পরিজনদের উদ্দেশ্যে শুরু করলেন ধর্মদেশনা। দান, শীল, ভাবনা সম্বন্ধে অনেকক্ষণ ধর্মদেশনা প্রদান করলেন। দেশনা অবসানে ডা. প্রভাত কুমার চাকমার অন্তর শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতা পরিপূর্ণ হল। সর্বাঙ্গ পুলকে শিউরে উঠল। আনন্দে মনপ্রাণ ভরে উঠল। মনে হল, এ গাড়ী দান করে আজ আমি অপ্রমেয় পুণ্যরাশি সঞ্চিত করলাম।