26/08/2025
✍️তোমাকে_চাই
#পর্ব ।১২।
নাওফিল কিছু না বলে উঠে আলমারির কাছে চলে যায়। প্রিয়তার উত্তেজনা নিমিষে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ভেবেছিল নাওফিল খুশি হবে, কিন্তু নাওফিলের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না সে খুশি হয়েছে।
নাওফিল ফিরে এসে, খাটে বসে র'ক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা ভয়ে ঢোক গিলল। নাওফিল রুক্ষকন্ঠে বলল,
- এখানে আসো।
প্রিয়তা এলো। নাওফিল প্রিয়তার হাত টেনে হাতে মলম লাগিয়ে দিয়ে বলল,
- গতকাল এতকিছু ঘটল তোমার সাথে। ঠিকভাবে হাটতে পারছ না, বামহাতের রাঙা ব্যান্ডেজ নিয়ে রান্না করেছ। আমি এসবের অযুহাত দিয়ে তোমার ইচ্ছার বিরোধিতা করবো না প্রিয়। তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে নিজের মর্জিমাফিক চলার, কাজ করার। আমার কেবল একটাই অনুরোধ, অন্যদের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকে ভুলবে না। বাকি রইল স্বামীর কর্তব্য! নিজের প্রতি যত্নশীল এবং কাজে সাবধানতা অবলম্বন করতে না পারলে তোমার রান্নাঘরে ঢোকা নিষেধ। আমি এক কথা একাধিক বার বলা পছন্দ করিনা,দ্বিতীয়বার যেন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখবে। ওকে?
প্রিয়তা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
- কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
- ঠান্ডা হোক, নষ্ট হোক, বিষ হয়ে যাক। ওদিকে গুরুত্ব না দিয়ে হাতের দিকে তাঁকাও। লাল হয়ে গেছে চামড়া। কি ফেলেছ হাতে?
- চা ঢালতে গিয়ে পড়ে গেছে।
- তুমি লেফট হ্যান্ডেড?
- না। কেন?
- তাহলে ডানহাতে পড়ল কি করে? কে ফেলেছে চা? সাবা আপু? না। সুহা নাকি?
- আশ্চর্য ওরা কেন আমার হাতে চা ফেলবে?
নাওফিল চোখ রাঙাল। প্রিয়তা চুপসে যায়। নাওফিল হাতে ফু দিতে দিতে বলল,
- আমি নির্বোধ না।বউয়ের নালিশ শুনে বোনের সাথেও তর্ক করবো না। ওসব তোমাদের ভাবি-ননদের ব্যাপার। আমি শুধু সত্য জানতে চেয়েছি। আশা করছি নেক্সট টাইম থেকে সত্য বলবে।
- সব সত্য বলতে নেই নওফিল।
- তুমি খারাপ মেয়ে নও, খারাপ বউও নও। বরের কান ভাঙানো তোমার স্বভাব না জানি আমি কিন্তু আমারও জানা উচিত আমার পরিবারে কার কার মনে তোমার জন্য বি'দ্বে'ষ ভাব আছে। আমি পরামর্শ দিতে পারবো তাদের অভিমান ভাঙানোর। সুহা খেতে পছন্দ করে, ওর পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াও।ও ডাবচিংড়ি..
- বিরিয়ানি, বিফকারি পছন্দ ওর।
নাওফিল ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকাতেই প্রিয়তা বলল,
- তুষার ভাই বলেছে।
নাওফিল প্রাউডভাব নিয়ে বলল,
- একদিনে ঘেটে ফেলেছ, এক্সিলেন্ট। তাহলে আর কি? আমাকে তো কোনো কাজেই লাগছে না। তুমি একাই যথেষ্ট সবটা সামলানোর জন্য। তাহলে দুদিনের জন্য বাড়ি ছাড়তে পারি আমি। কি বলো?
- কোথায় যাবেন?
- কাঁদের চাচা আর মৌসুমি চাচির খোজে। তুহিন ফোন করেছিল, বলছিল খোজ পেতে একদিন লাগবে।
- আচ্ছা।
- জিজ্ঞেস করবে না, একদিন লাগলে দুদিনের জন্য কেন যাবো? স্বামীর খোজখবর রাখা শেখো। নয়তো কোনদিন দেখবে সতীন এনে হাজির করেছে। তোমার যা অবস্থা, মনে হচ্ছে দ্রুত আরেকটা বউ আনতে হবে।
প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে তাঁকায়,কফিমগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
- আম্মু বলেছে, আপনি জীবনে প্রথমবার যে মেয়ের কথা তাকে বলেছেন সেটা..
নাওফিল প্রিয়তাকে দ্রুত থামিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল,
- আম্মু দেখছি আমাকে বরবাদ করে ছাড়বে। বউয়েরা জাত সব এক। স্বামীর দুর্বলতার প্রতি এদের আকর্ষন বেশি। আমার আব্বু ভুগছেন, তাকে ভুগিয়ে শান্তি নেই, এবার আমাকে ভোগানোর প্লান করছে, তাও তোমার মত বউমার সাথে যৌথ পরিকল্পনা করে।
- আপনার মনে হয়না আপনি বেশি কথা বলেন?
নাওফিল চুঁমু খাওয়ার ভঙ্গিতে দু-হাত বাড়িয়ে প্রিয়তাকে কাছে ডেকে বলল,
- আসো আমার বেশি কথা বলা বন্ধ করো। কাম ফাস্ট প্রিয়।
প্রিয়তা নিমিষে দূরে সরে দাঁড়াল। পায়ে টান লাগল, মৃদু স্বরে আর্তনাদ করল ব্যাথায়। হাত ও পা আগে থেকেই অবশ হয়ে আসছিল, এবার পুরোদমে অসাড়তা বৃদ্ধি পেল। নিরুপায় হয়ে খাটের এককোণায় গাল ফুলিয়ে বসল প্রিয়তা। এরপর আর'ক্ত চেহারায় বলল,
- আপনি একজন চূড়ান্ত মাপের নির্লজ্জ পুরুষ।
নাওফিল সকালের নাশতা করেই চলে যায়। এটা নিয়ে সাবা আপুরা অয়ন ভাইদের সঙ্গে হাসিতামাশাও করে। বিয়ের পরেরদিনই বরের চলে যাওয়া ভালো ইঙ্গিত দেয় না। যদিও ওরা যা ভাবছে তা সত্য নয় তবু মনটা খারাপ হলো প্রিয়তার। কেমন বিষন্নতা ঝেঁকে বসলো। দুপুরের খাবার নিলেও প্রিয়তা খেতে পারেনি।বিকেলে নাওফিল ফোন করলে টুকটাক কথা বলে কল কেটে দেয়। সন্ধ্যার পুরোটা সময় ঘুমিয়ে কাটায়। রাতে নিচে নামল না, সাবা আপুরা আজ চলে যাবে। যাওয়ার আগে প্রিয়তাকে দেখতে চায়না সাবা। নাজনিন বেগম সব শুনে সাবাকে বকাবকি করলেন। ধমকে নানা কথা শুনিয়েও দিলেন।মা-মেয়ের মধ্যে অভিমানের সূচনা ঘটল, অথচ সেসব কিছুই জানতে পারলো না প্রিয়তা। একরাশ বিষন্নতা নিয়ে বালিশে মুখ গুজে পড়ে রইল। রাত আটটা,নাজনিন বেগম ভাতের থালা নিয়ে হাজির। প্রিয়তা চোখের ওপর হাত রেখে শুয়েছিল। তাকে দেখে দ্রুত গায়ে ওরনা জড়িয়ে উঠে বসে। চেহারা মলিন হয়ে আছে প্রিয়তার। সেটা দেখে নাজনিন বললেন,
- সাবা-রা চলে গেছে। যাওয়ার আগে স্বীকার করেছে নিজের ভুলগুলো।
- ওসব কোনো ব্যাপার না আম্মু। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে এমন বলেছে। ওনার জায়গায়, অন্যকেউ থাকলে সেও এসবই বলত।
- ওর এসব বলা উচিত হয়নি।সাবা অন্যকেউ নয়, যার ব্যাপারে ও কথা বলেছে সে ওরই ছোট ভাইয়ের বউ। এটা ওর মাথায় রাখা উচিত ছিল।
প্রিয়তা খেয়াল করে নাজনিন বেগমের কথার ধাঁচের সঙ্গে নাওফিলের কথার ধরণ হুবহু এক। মা-ছেলে দুজনেরই হঠাৎ নরম হঠাৎ গরম হওয়া স্বভাব। প্রিয়তা ভাতের থালা দেখে বলল,
- আপনি কষ্ট করে এসব আনতে গেলে কেন? আমি তো একটু পর নিজেই গিয়ে খেয়ে আসতাম।
- দুপুরে বিশ্বাস করেছিলাম, খেয়েছ?
- খেতে বসেছিলাম।
- কিন্তু গলা দিয়ে ভাত নামেনি। এখনও রেখে যাবো, রাতে খাওয়া হবে না। আর আমার ছেলে ওখান থেকে ফোনের পর ফোন দিয়ে আমার রাতের ঘুম হারাম করে দেবে। দেখো মেয়ে, আমার রাতের ঘুম ভীষণ মূল্যবান। নিজের স্বামীর জন্য সেটা নষ্ট করিনা সেখানে তোমার পাগল স্বামীর জন্য নষ্ট করবো? দ্রুত খেয়ে নাও। আমি তোমাকে খাইয়ে তোমার বরকে খবর পাঠিয়ে, তারপর যাবো।
প্রিয়তা শব্দ করে হেসে ফেলল। নাজনিন অবাক হয়ে বললেন,
- হাসছ কেন?
- আপনারা দুজন একই রকম।
- একদম না, তোমার বর আমাকে কপি করে।
প্রিয়তা হেসেই চলেছে। নাজনিন বেগম তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন আর নাওফিলের নানা গল্প বলে শোনাচ্ছেন। কথার মাঝে, খাওয়া শেষ। এরপর নাজনিন প্রিয়তাকে বললেন নাওফিলকে কল করতে। প্রিয়তা নাম্বার ডায়াল করে নাজনিনকে ফোন দিল।
নাজনিন ফোন কানে নিয়ে প্রিয়তার হাসিমুখ দেখছে। এই হাসি দেখে শুধু তার ছেলে কেন উনি নিজেও মুগ্ধ হয়েছেন। মনে মনে ভাবলেন তার ছেলের পছন্দ একদম তার মত। কল রিসিভ করেই নাওফিল গদগদকণ্ঠে বলল,
- হ্যাঁ বউ বলো। খাওয়া শেষ? কোনো সমস্যা হয়নি তো? সব ঠিক আছে? একা থাকতে পারছ? কাজের চাপ না থাকলে আমি এক্ষুনি চলে আসতাম। কি করবো বলো.. বুঝোই তো, গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নাহলে বিয়ের পরেরদিন কোন আহম্মক বউ রেখে চলে আসে। কথা বলছ না কেন? প্রিয়, শুনছ? ও বউ।
- আহাম্মক! বউ নয় আপনার মা বলছি।
ওপাশ থেকে ভীষম খেল নাওফিল, স্পষ্ট টের পেলেন নাজনিন। ছেলের কথার সুর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার ওই বদমেজাজি ছেলে বউয়ের মন ভোলানো শিখতে শুরু করেছে? যাক বাপের মত হয়নি ভেবে খুশি হলেন তিনি। কিন্তু কথোপকথন দীর্ঘায়ত করতে পারবেন বলে মনে হয়না। তাই ফোন প্রিয়তার কাছে দিয়ে প্লেট নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। প্রিয়তা ফোন কানে দিয়ে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
- কি হলো? আম্মু চলে গেল কেন?আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল তো। কি বলেছেন আপনি?
- বলদ তুমি? ফোন আম্মুর হাতে দিয়েছ কেন? আগে নিজে কথা বলে দিতে পারোনি?
- নিজে বললেও বা কি? আম্মু চাইল কথা বলতে তাই আগে আম্মুকেই দিলাম। আর একমিনিট, ফোন আগে দেওয়ার সাথে বলদ শব্দের সংযোগ কি? প্রথমদিন থেকে দেখছি ব-বর্গীয় অপমান করে চলেছেন। নিজেকে খুব শেয়ানা মনে করেন?
- খুব শেয়ানা না হলেও তোমার থেকে বেশি বুদ্ধিমান। এরপর থেকে ফোন করে আগে নিজে কথা বলবে তার পর বাকিদের ফোন দেবে। কথার যেন নড়চড় না হয়।
- আম্মুকে কি বলেছেন বলুন তো।
- যা তাকে বলার কথা নয়। যখন শোনাতে চেয়েছিলাম তখন তো শুনলে না এখন শুনে কি লাভ? ফোন রাখো।
- আচ্ছা।
- এই মেয়ে.. ফোন রেখে দেখো। আজ রাতে এসেই তোমাকে সিধে করে ফেলবো।সারাদিন পর শান্তিতে বসে একটু কথা বলছি, আর উনি ফোন কেটে দিচ্ছে।
- আপনিই তো বললেন, ফোন রাখো।
- রাখতে বললেই রেখে দেবে? বাকি যেসব বলি সেসব শুনে চলো? শুধু আমার থেকে দূরে যাওয়ার পথগুলো অনুসরণ করো। সত্যি করে বলো তো। আমার ওপর আগ্রহ নেই কেন? আমার থেকে ভালো কেউ নজরে পড়েছে?
- পড়লে?
- কিছু না, আমি আবার বউকে সন্দেহ করিনা। খুবই ভালো বর কিনা.. তবে.. আসলেই কি পড়েছে?
প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হাসছে। নাওফিল সিয়ামের সাথে কথা বলছে। তাদের কথা বলা শেষে নাওফিল পুনরায় বলল,
- পাওয়া গেছে। আমাকে যেতে হবে। রাত জাগবে না। ঘুমিয়ে পড়।
- নিজের খেয়াল রাখবেন।
- তুমিও।
।১৩।
সুহার জন্য ডাবচিংড়ি করেছে প্রিয়তা, মৃদুলের জন্য হাঁসের ঝোল। বাকিদের জন্য নরমালি যে খাবার হয় রেগুলার তাই।সুহা আজ কিছু না বলে চুপচাপ খেয়েছে। প্রিয়তা বুঝল, একদিনে বন্ধুত্ব করা সম্ভব নয়। সম্পর্কে সময় দিতে হবে। দুপুরে খেয়ে ছাদে এসেছিল সে। ছাদের দরজা খুলতেই মাথার ওপর পানির ঝাপটা এসে পড়ে। সঙ্গে হাসির শব্দ। প্রিয়তা সামনে তাঁকিয়ে দেখল, মিরাজ, বৃষ্টি ও সফি দাঁড়িয়ে হাসছে। সফি হাসি থামিয়ে ভালো মেয়ের মত বলল,
- সরি, আমরা ভেবেছি সুহা। তুমি তো ভিজে গেলে পুরো। কাকভেজা হয়ে গেছ। জলদি গিয়ে চেঞ্জ করে নাও নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবে। তখন আবার ভাইয়াকে সব কাজ ফেলে চলে আসতে হবে বউয়ের সেবা করতে।
প্রিয়তা নাক টেনে বলল,
- হুম। তোমার ভাইয়া তোমাদের জন্য গিফট কিনেছিল সফি, এসো সেগুলো নিয়ে যাবে।আমি বের করে রেখেছি সব।
- ভাইয়া কিনেছে? বৃষ্টি চল তো গিয়ে দেখি।
- হ্যাঁ, দ্রুত চল।
প্রিয়তাকে একপ্রকার উপেক্ষা করে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সবাই। যাওয়ার আগে বৃষ্টি প্রিয়তার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে গেল। ধাক্কায় জোর ছিল, পেছনের দরজার সাথে পিঠ ঠেকে গেল প্রিয়তার। হালকা ব্যাথা পেল পিঠে। শিরদাঁড়ার সোজা লেগেছে। কেমন অবশ হয়ে উঠল ক্ষণিকের জন্য। কয়েকমুহূর্ত পর ঠিক হতেই সে নেমে এলো নিচে। ঘরে, বিছানার ওপর বসে ওরা র্যাপিং পেপার খুলে গিফট দেখছে। পুরো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাগজের টুকরো, পলিথিন। ওয়াশরুমের সামনে মাটির ফুলদানিটাও ভেঙে পড়ে আছে। মিরাজ বলল,
- সফি আপু ভুল করে ভেঙে ফেলেছে। কিছু মনে করোনি তো ভাবি..
- না। তোমরা বসো, আমি চেঞ্জ করে আসি।
কাপড় নিয়ে প্রিয়তা ওয়াশরুমে ঢুকতেই ভেঙাল সফি,
- তোমরা বসো.. যেন উনি বলবে তারপর আমরা বসবো। আমাদের ভাইয়ের ঘর, আমরা বসবো, শুবো, নাচবো, যা ইচ্ছে তাই করবো।
বৃষ্টি বলল,
- কাঁচের গ্লাসটা ফেলা উচিত ছিল, হাতেপায়ে ফুটলে ভালো লাগত।
মিরাজ উৎসুক গলায় বলল,
- আমি ফেলবো আপু?
সফি বলল,
- জিজ্ঞেস করার কি আছে? যেভাবে ইচ্ছে জ্বা'লাবি ওকে।
- আম্মু কিছু বলবে না তো?
- আমি আছি না? কিছু বললে আমি দেখবো।
প্রিয়তা থ্রিপিচ পড়ে বাইরে আসতেই বেখেয়ালে কাঁচের টুকরোর ওপর পা ফেলল। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে নিচে তাঁকাতেই দেখল ঘরের ঠিক মাঝখানে পানির গ্লাস টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। বৃষ্টি মেকি চিন্তা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
- ভাবি কি হলো? ঠিক আছ?
প্রিয়তা মাথা নেড়ে জানায় সে ঠিক আছে। আসলে যে কেমন আছে তা কিভাবে প্রকাশ করবে? পা কেটে র'ক্ত বের হচ্ছে। মেঝেতে র'ক্তের ছোঁপগুলোর শুকিয়ে যাচ্ছে দেখে প্রিয়তা দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল। পা ধুয়ে, ফুটে থাকা ছোট কাঁচের টুকরোটা বের করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা ওরনা ছিড়ে ফেলল, সেটা পায়ে বেঁধে চটজলদি বেড়িয়ে এলো। একটু পরেই নাওফিল ফিরবে। দ্রুত ঘর গোছাতে হবে। এভাবে দেখলে ওর খারাপ লাগবে। ব্যাথা পা নিয়ে ঘর ঝাড়ু দিল প্রিয়তা। কাঁচের টুকরো তুলে ঘরের কোণে থাকা ঝুড়িতে রাখলো। এরপর ঘর মুছে শান্ত হয়ে বিছানায় বসে। সফি জিজ্ঞেস করে,
- তোমাকে কি দিয়েছে ভাইয়া?
প্রিয়তা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তিনটি বক্স বের করে দিল। একটাতে ব্রান্ডেড পার্ফিউম, ঘড়ি ও ব্রেসলেট। বৃষ্টি বলল,
- এসব দেখাচ্ছ কেন? দামি কিছু দেয়নি নাকি?
- ব্যস্ততায় দিতে ভুলে গেছে। এগুলো বিয়ের শপিংয়ের দিন দিয়েছিল। বিয়ের পর কিছু দেয়নি।
সফি প্রিয়তার হাতের দিকে তাঁকিয়ে বলল, "আংটিটা তো সুন্দর। দেখি তো.."
প্রিয়তা খুলে দেয়। সফি নিজের আঙ্গুলে আংটি পড়ে বলল,
- আমার হাতে মানিয়েছে না বৃষ্টি?
বৃষ্টি সায় দিল। প্রিয়তা বলল,
- তাহলে ওটা তুমি রাখো। আমার কাছে আরও কয়েকটা আছে, দেখবে?
বৃষ্টি বলল,
- দেখালে দেখে না কে? যদি চাও দেখাতে পারো। পরে যেন বলো না আমরা দেখতে চেয়েছি।
প্রিয়তা হেসে নিজের গহনার বাক্স বের করে দিল। সফি ও বৃষ্টি নিজেদের ইচ্ছেমত পছন্দ করে নিল। সুহাও এসে একটা নেকলেস নিয়ে যায়। সবাই চলে গেলে বিছানা ঝেরে সবকিছু ঠিকঠাক করে শুয়ে পড়ে প্রিয়তা। ওদের বুঝতে দেবে না বলে স্বাভাবিক থাকলেও ব্যাথা পায়ে আবার ব্যাথা পেয়ে জ্বরজ্বর ভাব এসেছে। চোখ জ্বলছে, তাই আলো নিভিয়ে দিল।
প্রিয়তার ঘুম ভাঙে নাওফিলের ডাকে। নাওফিল এসে প্রিয়তাকে জাগিয়ে শাওয়ার নিতে ঢুকেছে ওয়াশরুমে। রাত এগারোটা, নাওফিলের এত দেরি হলো কেন আসতে? সন্ধ্যার মধ্যেই তো ফেরার কথা ছিল। পরে ভাবলো হয় তো কোনো কাজ ছিল।সবাই শুয়ে পড়েছে, কেবলমাত্র নাজনিন জেগে ছিলেন। প্রিয়তাকে রান্নাঘরে আসতে দেখে প্রশ্ন করলেন,
- শরীর খারাপ নাকি? তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। ঘুমিয়ে ছিলে বলে ডাকিনি।
- একটু আম্মু, জ্বর জ্বর লাগছে।
নাজনিন কাজ ফেলে এগিয়ে এসে প্রিয়তার মাথায় হাত রেখে বললেন,
- জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বেয়াদবটা তোমাকে নিচে নামিয়ে দিল? কোনো বোধ বুদ্ধি নেই। বাপের মত হয়েছে।
- উনি জানেন না। এত রাতে এসেছে তাই খাবার গরম করতে আসলাম।আপনি এখনও জেগে আছেন কেন?
- অভ্যাস। ছেলেটা বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত কি চোখে ঘুম আসে? তুমি উপরে যাও, আমি ট্রে নিয়ে আসছি। গিয়ে শুয়ে থাকো। নড়াচড়া করো না।
- আচ্ছা।
প্রিয়তা উঠে দাঁড়াতেই নাজনিন পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
- তুষার ফুসকা এনেছিল, তোমার জন্য রেখেছিলাম কয়েকটা, ভাতের সঙ্গে নিয়ে আসবো? খাবে এখন?
প্রিয়তার চটপটে উত্তর, "হ্যাঁ, খাবো।" নাজনিন হেসে কাজে মনোযোগ দিলেন। ঘরে এসে প্রিয়তা ব্লাংকেটের নিচে ঢুকে পড়ে। নাওফিল ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল,
- শরীর খারাপ নাকি ম্যাডামের?
- আম্মু বলল জ্বর।
নাওফিল সেটা শুনে দ্রত ছুটে এসে প্রিয়তার কপালে হাত রাখে,
- এত জ্বর! আমাকে আগে বলোনি কেন? ঘরে জ্বরের ঔষধ আছে? নাহ, তোমকে নিয়ে পারা গেল না। দাড়াও দেখছি মেডিসিন আছে কিনা।
নাওফিল মেডিসিনের বক্স খুজে মেডিসিন পেল না।
- আম্মুর কাছে থাকতে পারে।
নাজনিন ঘরে ঢুকে বললেন,
- আমি মেডিসিন সঙ্গে নিয়ে এসেছি। দুজন বসে আগে খেয়ে নে।
নাওফিল ভাত মেখে প্রিয়তার দিকে তাঁকাল। নাজনিন প্রিয়তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। অথচ নাওফিল ভেবেছিল কাজটা সে করবে।
খাওয়া শেষে নাজনিন চলে গেলেন। প্রিয়তাও শুয়ে পড়ে। নাওফিল বিছানার ওপর বসে বলল,
- বাড়ির কি অবস্থা?ফোনে চাচির কাছে শুনলাম, সফি বৃষ্টিরা পুরো বিকেল তোমার সাথে ছিল। পরিবর্তন আসছে?
- ওরা এখন কথা বলছে, আগে বলতো না। আস্তে আস্তে মিশে যাবে হয়তো।
- বেশ ভালো। তো জ্বর এলো কেন? পুরোনো ব্যাথায়? নাকি নতুন কান্ড বাঁধিয়েছ?
- আপনার কি আমাকে সমস্যার প্রতীক মনে হয়?
- তাছাড়া কি? এবার দ্রত বলো, কি ঘটেছে।
- আমি কি জানি?জ্বরের আসতে মন চেয়েছে,এসেছে। এখানে আমি কি করতে পারি? আমি কি তাকে ডেকে এনেছি?
নাওফিল প্রিয়তার ব্লাংকেটের মধ্যে ঢুকে গেল। প্রিয়তা খানিকটা সরে যায়। নাওফিল ভ্রু কুঁচকে বলল,
- ফ্লোরে শুতে চাও? তাহলে আস্তে নেমে যাও। সরতে সরতে পড়ে গেলে ব্যাথা পাবে। শুধু শুধু শরীরকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ বলো?
- আপনি একটু সরে গেলেই তো হয়।
- ঘর আমার, বিছানা আমার, বউ আমার। আমি কেন সরবো? আমার তো প্রবলেম হচ্ছে না কাছে আসলে। প্রবলেম তো তোমার হচ্ছে, তুমি সরো।
- অসুস্থ মানুষকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিতে লজ্জা করছে না?
- আশ্চর্য! আমি কোথায় নামাচ্ছি? আমি তো থাকতে বলছি। শুধু চাচ্ছি, দূরে দূরে না থেকে একটু কাছে এসে শোও। কিন্তু সরাসরি বললে তুমি বলতে আমি অসভ্য। কি বলতে না?
প্রিয়তা উত্তর দিল না। নাওফিল প্রিয়তাকে কাছে টেনে নিল। প্রিয়তা নড়তেই ওর পায়ের ওপর পা উঠিয়ে দিল। অকস্মাৎ ব্যাথা পা-য়ে নাওফিলের পা পড়ামাত্র প্রিয়তা 'আহ' করে উঠল। নাওফিলকে বলল,
- ব্যাথা পাচ্ছি নাওফিল।
নাওফিল ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
- আমি ওতটাও জোর দিয়ে ধরিনি প্রিয়। মিথ্যা বলোনা।
- পায়ের ওপর থেকে পা নামান, পায়ের পুরোনো ব্যাথা এখনও আছে।
নাওফিল উঠে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে প্রিয়তার পা দেখে বলল,
- আবার? তোমাকে ইচ্ছে মত মাইর দিলে শুধরাবে তুমি, প্রিয়? তোমার স্বভাব বদলাতে মা'র আবশ্যক মনে হচ্ছে। এখন-ই শুরু করি?শরীরের কোন জায়গাগুলোয় কা'টাছেড়া বাকি আছে?
প্রিয়তা এবারও নিশ্চুপ। নাওফিল বলল,
- এখনও কাঁচ ফুটে আছে। ঠিক করে ড্রেসিং করা হয়নি।
প্রিয়তার পায়ে ড্রেসিং করে নাওফিল শুয়ে বলল,
- আমার বোনদের আমি চিনি প্রিয়। কি করবো বলো? বোন তো, বড়দের ভুলে ওদের এমন অবস্থা হয়েছে। ওদের কিছু বললে ওরা আরো বাড়াবাড়ি করবে, আমি বাড়ি থাকিনা, তোমাকে দেখে রাখি কি করে? এসে ধরে তিনবার ওদের মিসবিহেভ দেখলে।যদি চাও ঝামেলা মেটানোর আগ অবধি ওবাড়িতে গিয়ে থাকো।
- কি কি জানতে পারলেন? দুদিনের কথা বলে ষোলো দিন পর ফিরলেন। এত সময় লাগল কেন? ওদের তো পেয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে?
নাওফিল হতাশ হলো, বুঝতে পারল প্রিয়তা যাবে না। সে এখানেই পড়ে থাকবে আর এসব সহ্য করবে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাওফিল ধীরগলায় বলল,
- একটা নাম জেনেছি কিন্তু পরিচিত নয়। খুজতে হবে তাকে।
- কি নাম?
- মাহিন ইকবাল।
প্রিয়তা চমকে তাঁকাল। বলল,
- ইকবাল আঙ্কেল? আমি এ নামে একজনকে চিনি। কিন্তু উনি তো দেশের বাইরে থাকতেন।
নাওফিল নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, "তুমি চেনো তাকে?"
- হ্যাঁ। দাদুর বন্ধুর ছেলে। ছোট থাকতে কয়েকবার দেখেছি তাকে। মাঝে, মেধা আপুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল বলে ওনারা আর আসেনি।
নাওফিল হেসে বলল,
- তোমার এই ইকবাল আঙ্কেলকে যে এবার দ্রুত গ্রামে ফিরতে হবে প্রিয়। তাহের চাচাদের মজুরি একবার অন্ততো, সরাসরি নিজহাতে দিক।
চলবে...