01/05/2025
বৃষ্টিভেজা ভালবাসা
শ্রাবণের শেষ দিকের দিনগুলোতে কলকাতার আকাশ যেন নিজের সব জমে থাকা কান্না উজাড় করে দেয়। এমনই এক সন্ধ্যাবেলা, কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান গুলোতে জমে থাকা জল ছপ ছপ শব্দ করে হাঁটার সময় হঠাৎই মুখোমুখি হলো দুই পুরনো পরিচিত—অনিরুদ্ধ আর রেয়া।
চার বছর পর এই হঠাৎ দেখা। দু’জনেই এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। চারপাশের কোলাহল, বৃষ্টির শব্দ, বাসের হর্ণ—সব কিছু যেন হঠাৎ চুপ করে গেল।
“তুমি?” অনিরুদ্ধের কণ্ঠে অবাক হওয়ার সুর।
রেয়া একটু হাসল। “হ্যাঁ, আমি... ভাবিনি, এতদিন পরে আবার এভাবে দেখা হবে।”
একটা সময় ছিল, যখন রেয়া আর অনিরুদ্ধ একে অপরের ছায়া হয়ে ছিল। কলেজের দিনগুলোতে ওদের প্রেম ছিল অনেকটা সিনেমার মতো—গোপন চোখাচোখি, ক্যান্টিনে একসাথে কাটানো সময়, বৃষ্টির দিনে এক ছাতার নিচে হাঁটা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। অনিরুদ্ধ মুম্বাই চলে যায় চাকরির জন্য, আর রেয়া থাকে কলকাতায়, পরিবারের পাশে। কথাবার্তা কমতে কমতে একসময় আর যোগাযোগই থাকেনি।
“চলো, কোথাও বসে একটু কথা বলি?” অনিরুদ্ধ বলল।
রেয়া একটু দ্বিধায় পড়লেও মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। দু’জনে ঢুকে পড়ল কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো ক্যাফেতে, যেটা তাদের প্রথম ‘ডেট’-এর সাক্ষী ছিল।
ক্যাফের কোণার টেবিলটায় বসে দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ। এক কাপ করে কফি এসে গেল, কিন্তু কেউ ছুঁয়েও দেখল না।
অনিরুদ্ধই প্রথম মুখ খুলল। “এই চার বছরে কত কিছু বদলে গেছে, তাই না?”
“হ্যাঁ... কিন্তু কিছু কিছু জিনিস বদলায় না,” রেয়া বলল, চোখের দিকে না তাকিয়েই।
“মানে?” অনিরুদ্ধের কণ্ঠে কৌতূহল।
“মানে, স্মৃতি। মনে পড়ে, এখানেই প্রথম তুমি বলেছিলে, ‘তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে সময় থেমে যায়।’ ”
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল। “তুমি এখনও সব মনে রাখো!”
রেয়াও হেসে ফেলল। সেই পুরনো হাসি, যেটা একসময় অনিরুদ্ধের মন ভরিয়ে দিত।
বাইরে তখনও বৃষ্টি ঝরছে। কাঁচের জানালায় বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে। সেই কফির কাপে যেন গলে যাচ্ছে চার বছরের সব অপূর্ণতা, সব না বলা কথা।
“তুমি এখনও একা?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।
রেয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ। সম্পর্কের মধ্যে যাওয়া মানেই শুধু কাউকে পাওয়া নয়, নিজের কিছু অংশ হারানোও। আমি সেটা পারিনি।”
অনিরুদ্ধ বলল, “আমিও পারিনি। অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু... তোমার মতো কেউ ছিল না।”
চোখের কোণে জল টলমল করে উঠল রেয়ার। “তবে, আমরা কেন ছাড়লাম একে অপরকে?”
“কারণ, আমরা ভেবেছিলাম দূরত্ব ভালোবাসাকে মুছে দেবে। কিন্তু বুঝিনি, ভালোবাসা কখনও ফুরায় না, শুধু চুপ করে থাকে,” অনিরুদ্ধ বলল, গভীরভাবে।
রেয়া হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। “চলো, হাঁটি একটু। বৃষ্টিতে ভিজে না হয় পুরনো দিনগুলো একটু ফিরিয়ে আনি।”
অনিরুদ্ধ মুচকি হেসে ওর ছায়া অনুসরণ করল। বাইরে তখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি, রাস্তায় জল জমে রয়েছে, কিন্তু দু’জনেই ছাতা ছাড়াই হাঁটতে শুরু করল। পা ভিজে যাচ্ছে, কাপড় সেঁচে যাচ্ছে, কিন্তু মন যেন উড়ছে এক অদ্ভুত আনন্দে।
কলেজ মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে রেয়া হঠাৎ থেমে বলল, “তুমি কি আজও আমায় ভালোবাসো, অনি?”
অনিরুদ্ধ এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল, “আজও, ঠিক আগের মতো... হয়তো আরও বেশি।”
রেয়া তখন ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে এল। “তবে এবার হারাতে দিও না, প্লিজ।”
অনিরুদ্ধ ওর হাত ধরল, যেন আর কোনোদিন ছেড়ে দেবে না। “এবার না। এবার সবটা একসাথে কাটাবো—ভালোবাসা, ঝগড়া, বৃষ্টি... সব।”
রেয়া হেসে ফেলল। চারপাশে তখনও বৃষ্টি, কুয়াশা, কিন্তু ওদের মধ্যে যেন একটা রোদ জেগে উঠেছে—ভালোবাসার রোদ।