26/10/2024
রংপুর মুনসীপাড়ার বিশিষ্ট ব্যক্তি
সংকলনে: রবীন জাকারিয়া
৭৫। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস
ক্যাটাগরি: লেখক, সংগঠক, রাজনীতিক ও বরেণ্য সাংবাদিক
কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের জন্ম ১৯০৬ সালে নভেম্বরের ১১ তারিখে রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায়। বাবা-কাজী মোহাম্মদ সঈদ। মা-কামরুন নেসা বেগম খুকী। ১০ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান।
এই মানুষটির জীবন ও কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিচিত অনেকেই তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। লিখেছেন তাকে নিয়ে। বর্ষীয়ান কলাম লেখক শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার লেখায় পুরাতন দিনের সাংবাদিকদের কথা বলতে গিয়ে প্রায়শই কাজী ইদ্রিসের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন। বেশ কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করছি বর্তমান প্রজন্মের কিছু তরুণ এই দেশটাকে, দেশটা গড়ে ওঠার পেছনের মানুষগুলোকে জানতে চাচ্ছেন- বুঝতে চাচ্ছেন। এসব নিয়ে তাদের গবেষণা করার আগ্রহ আমাদের উৎসাহিত করে। এমনই দু’একজন তরুণ-তরুণী বিভিন্নভাবে কাজী ইদ্রিসের কিছু পরিচয় পাওয়ার পর তার ছেলেমেয়েদের কাছে বাবার (ইদ্রিসের) সম্বন্ধে কিছু শুনতে-জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এখানে একটা বিষয়ে উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মানুষের সংক্ষিপ্ত কিছু পরিচয় পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাপিডিয়ার’ খ-গুলো বেশ সাহায্যকারী গ্রন্থ। কিন্তু মার্চ, ২০০৩ এ প্রথম প্রকাশিত এবং জুন, ২০১১-এর দ্বিতীয় সংস্করণে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের পরিচয় আসেনি। ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটা হয়েছে তেমনটা আমার মনে হয় না। সে যাক।
আজ আমি কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের ব্যক্তিগত ও কর্ম জীবন নিয়ে দু’একটা কথা বলে অন্যের লেখা উদ্ধৃত করে মানুষটার সামান্য কিছু পরিচয় দেয়ার প্রয়াস নেব। সেই সঙ্গে থাকবে তার সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা।
কাজী ইদ্রিস শৈশবে মায়ের কাছ থেকে প্রথম মেধা ও মনন চর্চার প্রেরণা পান। রংপুরে কৈলাস রঞ্জন স্কুলে অধ্যয়ন শুরু হয় এবং পরে রংপুর জেলা স্কুল থেকে ১৯২২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আই.এস.সি. এবং ১৯২৭ সালে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে কলকাতায় রিপন কলেজে আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তবে পরীক্ষা দেন নাই।
এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। অবিভক্ত বাংলায় সাংস্কৃতিক চর্চা ও নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ছিল রংপুর। কাজী পরিবারও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। কাজী ইদ্রিস যখন কলেজের ছাত্র তখন রংপুরে একটি ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের জন্য ‘রণ মাদকতা’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। নিয়ম অনুসারে নাটকের পা-ুলিপি রংপুর সদরের এস.ডি.ওর কাছে পাঠানো হয়। অনেক কাটছাঁট করে নাটকটি মঞ্চস্থ করার অনুমতি দেয়া হয়। কাটছাঁট করার সব নির্দেশ উপেক্ষা করে কাজী ইদ্রিসের পরামর্শে মূল রচনা অবিকল রেখে নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়। নাটকটির পটভূমি ছিল অনেকটা এমন। এক সভ্য রাজা অসভ্য দেশকে সভ্য করার জন্য রাজ্যটি দখল করে সে দেশের রাজাকে হত্যা করে। এতে নাকি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের নগ্নরূপ প্রকাশ পেয়েছে। ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র আবিষ্কার করে রাজদ্রোহের অনুষঙ্গ। গ্রেফতার করা হয় কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসকে। তাদের পাড়ার উকিল এবং জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান খান বাহাদুর আসফ খান একটি লিখিত অঙ্গীকারনামা দিয়ে তাকে মুক্ত করেছিলেন। রংপুরে শিক্ষা জীবন শেষে তিনি বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৩২ সালে বাংলা সরকারের অধীনে করনিকের চাকরিতে যোগ দেন।
গত শতাব্দীর ত্রিশ দশকে কলকাতায় গিয়ে তিনি লেখালেখি ও প্রকাশনার কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। অবিভক্ত বাংলা সরকারের স্বাস্থ্য বুলেটিন সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৩৮ সালে কৃষক প্রজা আন্দোলনের মুখপত্র ‘দৈনিক কৃষক’ পত্রিকায় যোগ দেন। হুমায়ুন কবির (পরবর্তীতে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী) পত্রিকাটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আবুল মনসুর আহমদ। দিনাজপুরের মীর্জাপুর গ্রামের মৌলভী আজিম উদ্দিন আহমদ এবং জসিরন নেসার কনিষ্ঠ সন্তান আজিজা খাতুনের সঙ্গে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের বিয়ে হয় ১৯৪০ সালে। বিয়ের পর আজিজা ইদরিসের জীবন শুধু সংসার ধর্ম পালন ও স্বামী সব কাজে সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এদেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলন, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপসহ নারীমুক্তি আন্দোলনের এক অনন্য সাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন আজিজা ইদ্রিস। পৃথকভাবে সে আলোচনা করা শ্রেয়।
১৯৪১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় যোগ দেন ইদ্রিস। পাশাপাশি ভারত সরকারের প্রচার বিভাগের অনুবাদের কাজ দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। চল্লিশ দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আবুল হাশিম সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন তিনি। আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক ‘ইত্তেহাদের সহকারী সম্পাদকও ছিলেন কাজী ইদ্রিস।
কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের কলকাতার সাংবাদিক জীবনের পরিসর বিশাল। তার সে জীবন নিয়ে ঘনিষ্ঠজন ও সহকর্মীরা অনেক কথা লিখেছেন। তার অনেক কিছুই উল্লেখ করার মতো। আমি সেদিকে যাব না। আমি সে সময়ের একজন তরুণ ছাত্র এবং রাজনীতিবিদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেব যা হয়তো অনেককেই অবাক করবে। মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা এবং সেই সঙ্গে মাত্র কয়েকটি সহজ-সরল বাক্সে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের যে পরিচয় দিয়েছিলেন তা স্মরণ করার মতো। সেদিনের সেই তরুণ আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ের সংবাদপত্রের কথা নিয়ে লিখেছেন, ‘দৈনিক আজাদ’ই ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত। এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরাম খাঁ সাহেব ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশেম সাহেবকে শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমাদেরও ওই একই দশা। তাই আমাদের কোন সংবাদ শহরে ছাপা হতো না মাঝে মাঝে মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। পরে সিরাজুদ্দিন হোসেন (বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সাম্পাদক) এবং আরও দু’একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করত। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা সংবাদ ছাপাত। দৈনিক মর্নিং নিউজের কথা বাদই ছিলাম। ওই পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকে পুরোপুরি সমর্থন করত, তবুও ওটা একটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণী বলা যায়। আমাদের সংবাদ দিতেই চাইত না। ওই পত্রিকা হাশিম সাহেবকে মোটেই পছন্দ করত না। ছাত্র ও লীগ কর্মীরা হাশিম সাহেবকে সমর্থন করত, তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে সংবাদ দিত। আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে, বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারার প্রচার করার জন্য। হাশিম সাহেবের পক্ষে কাগজ বের করা কষ্টকর। কারণ টাকা-পয়সার অভাব। শহীদ সাহেব হাইকোর্টে ওকালতি করতে শুরু করেছেন। তিনি যথেষ্ট উপার্জন করতেন, ভালো ব্যারিস্টার হিসেবে কলকাতায় নামও ছিল। কলকাতার গরিবরাও যেমন শহীদ সাহেবকে ভালোবাসতেন, মুসলামান ধনীক শ্রেণীকেও শহীদ সাহেব যা বলতেন, শুনত। টাকা-পয়সার দরকার হলে কোনদিন অসুবিধা হতে দেখি নাই। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে তা পেলে পরে আর জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এই দুজনই শহীদ সাহেবকে রাজি করতে পারব, এ ধারণা অনেকেরই ছিল।
আমরা দুজন একদিন সময় ঠিক করে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভালো ভালো লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাত খরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে। আরও দু-একজন দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন।
মুসলিম লীগ অফিসের নিচের তলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস (বইয়ে বানান এভাবে লেখা আছে) সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তার যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সারা বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকেই কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা: ৪০)। ভিন্ন আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকান্ডের কথা ওই একই বইয়ে যেভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তেমনটা অনেকের মধ্যেই দেখা যায় না। বইটি নিয়ে পৃথক আলোচনার ইচ্ছা রইল। কাজী ইদ্রিস ১৯৪২ সালে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটিতে যোগদান করেন এবং ১৯৪৪ এ সোসাইটির সম্মেলন সফল করার উদ্দেশ্যে সম্মেলন অভ্যর্ত্থনা সমিতির সম্পাদক নিযুক্ত হন। সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ছাত্র যাদের মধ্যে ছিলেন কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস আখলাকুর রহমান, আতাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, একরামুল হক, আবদুর রশীদ খান প্রমুখ পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরবর্তী কর্তব্য এবং কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য সমবেত হন। ওই আলোচনায় স্থির হয় পরিবর্তিত পরিস্থিতে পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার উপযুক্ত সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
১৯৫০ সালের কাজী ইদ্রিস সপরিবারে ঢাকায় আসেন এবং দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে খ-কালীন কাজে যোগদান করেন। ’৫১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে সহকারী পরিচালকের চাকরিতে যোগদান করেন। এ সময়ে দৈনিক সংবাদে সম্পাদকীয় বিভাগের কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস ১৯৬৭ সালে ন্যাপের ঢাকা শহর শাখার সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহসভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তার প্রতিভার স্বাক্ষর উজ্জ্বল
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ সম্পর্কে ২০০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার আমানুল হক লিখেছেন, ‘সেদিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শহীদ রফিকের ছবি তোলার ঘটনাটি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একই ঘটনার কথা বারবার ফিরে আসে। তার অন্তর্নিহিত মহত্ত ও ঐশ্বর্যই তাকে অমরত্ব দান করে। বারবার স্মরণ করে আমরা ধন্য হই। মেডিকেল কলেজের বারান্দার সামনে মাঠেই দেখা হলো পূর্ববাংলার প্রচার দফতরের তৎকালীন সহকারী পরিচালক আদর্শবাদী সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের সঙ্গে। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও গুলিবর্ষণের খবর শুনে ছুটে এসেছিলেন হাসপাতাল এলাকায়। ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত প্রধান একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থে শহীদ রফিকের ছবি তোলার ব্যাপারে আমাদের যৌথ প্রয়াসের বিস্তারিত বিবরণ কাজী ইদ্রিসের জবানিতে গ্রন্থটিতে যেভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে এখানে তা তুলে ধরছি ... আহত ছাত্রদের অনেকে তখনও হাসপাতালের মেঝের ওপর শোয়া। চারদিকে একটা দারুণ উত্তেজনা। এই সময় নুরুদ্দিনের স্ত্রী হালিমার সঙ্গে আমার দেখা। সে তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। এ্যাপ্রন পরা অবস্থায় খুব ব্যস্ত। কিন্তু তার মধ্যেই সে আমাকে বললো- যে ছাত্রটির মাথার খুলি উড়ে গেছে তার দেহটা হাসপাতালের পেছন দিকে একটা ঘরে রাখা আছে। সে বললো যে ইচ্ছে করলে মৃতদেহটা দেখাতে পারে। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হলাম এবং সে আমাকে খুব সাবধানে পেছনের দিকে সেই নির্দিষ্ট কামরায় হাজির করল। আমি দেখলাম ছেলেটির মাথার খুলি উড়ে গেছে। দেখে আমার মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া হলো। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। আমি তখন হালিমাকে জিজ্ঞেস করলাম যে মৃতদেহটির ছবি তোলা যায় কি না এবং সে তার ব্যবস্থা করতে পারবে কি না। সে বললো, লুকিয়ে তাড়াতাড়ি এক মিনিটের মধ্যে কেউ যদি সেই কাজ করতে পারে তবে তার পক্ষে ব্যবস্থা করা সম্ভব। আমানুল হক নামে একজন ফটোগ্রাফার তখন চাকরি করত। আমি মেডিকেল কলেজের বারান্দা থেকে সামনে মাঠের মধ্যে এসে আমানুলের দেখা পেলাম। তখন সে ফুল হাতা হাওয়াই শার্ট পরেছিল এবং সেই শার্টের মধ্যে তার একটা ক্যামেরা লুকানো ছিল। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাটি এনেছিল। কিন্তু ছবি তোলা সে সময় বিপজ্জনক হতে পারে মনে করে ক্যামেরাটি লুকিয়ে রেখে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আমি সমস্ত ব্যাপারটি বর্ণনা করে ছবি তোলার কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে তখনই রাজি হয়ে গেল। এরপর আমি হালিমার সঙ্গে কথা বললাম। ঠিক হলো যে, আমি আমানুলের সঙ্গে যাব না। সে একাই যাবে এবং মেডিকেল কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হালিমা ইশারা করলে তার কাছে যাবে। ইতোমধ্যে আমানুল তার ক্যামেরা ঠিকঠাক করে আনতে কোন জায়গায় গিয়েছিল। সে ফিরে এলে তাকে আমি সব বললাম এবং হালিমাকে দূর থেকে চিনিয়ে দিলাম। এরপর হালিমা একবার ইশারা করায় সে তার কাছে গেল এবং ভিতরের দিকের কামরাটায় গিয়ে ছবিটা তাড়াতাড়ি তুলে আনল। এসে বললো: ছবি ভালোই আসবে। সন্ধ্যের সময় আমানুলের বাড়ি গিয়ে দেখলাম ছবিটি খুব ভালো উঠেছে, ছবিটির কয়েক কপি করা হয়েছিল। তার মধ্যে এক কপি নিয়েছিল স্পোর্টস ফেডারেশনের এএসএম মহসিন (সাজু), একটি কপি দেয়া হয়েছিল মাজেদ খানকে (ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং আরেকটি দৈনিক আজাদে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলÑ আজাদে ওটা ছাপাবার ব্যবস্থাও হয়েছিল। ছবিটির ব্লকও এসেছিল। কিন্তু রাত প্রায় দুটোর সময় কর্তৃপক্ষের যে মাওলানা আকরাম খাঁ, নয়তো সদরুল আনাম খানের আপত্তিতে সেটা শেষ পর্যন্ত আর আজাদে ছাপা হয়নি। মাজেদ খানের কাছে যে কপিটি ছিল তা থেকেও ব্লক তৈরি করা হয়েছিল। সে ব্লকটি মাজেদ খানের মাধ্যমেই ছাত্রদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। ছাত্ররা একটি প্রচারপত্রও লিখে তাতে ছবিটি ছেপেছিল। এই প্রচারপত্র পড়ে পুলিশের হাতে পড়ায় তার সব কপি ‘সিছ’ করে বাজেয়াপ্ত করে।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, বিশেষ সংখ্যা ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০১ পৃষ্ঠা-৮)
১৯৫৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৯২ ক ধারা জারি করে। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে পূর্ববাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। কাজী ইদ্রিস সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘দৈনিক ইত্তেহাত’ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন এবং পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময়ে তিনি রাজনৈতিক বন্দি সাহায্য সমিতির একজন উদ্যোক্তা হিসেবে সমিতির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হন তিনি।
১৯৫৭ সালে ইত্তেহাদের মালিকানা পরিবর্তনের ফলে পত্রিকাটি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র রূপে প্রকাশিত হয় এবং কাজী ইদ্রিস ইত্তেহাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। তিনি মনোনিবেশ করেন গ্রন্থ রচনায়। সেই সঙ্গে নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এ সময়ে তিনি কাগমারি মহাসম্মেলনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, সাংস্কৃতিক উপপরিষদের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগদান করেন। একই সময়ে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে কলম্বোর উদ্দেশ্যে রওনাকালে সরকারি হস্তক্ষেপে বিমানবন্দর থেকে তাকে ফেরত আসতে হয়।
১৯৫৮ তে তিনি অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। কিন্তু আইয়ুবী সামরিক শাসনের ফলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী বছরে সাপ্তাহিক ‘পল্লীবার্তায়’ নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে প্রত্রিকাটি ‘পূর্বদেশ’ নাম গ্রহণ করে এবং তিনি থাকেন নির্বাহী সম্পাদক। কিন্তু অবজারভার গ্রুপের পত্রিকা ‘পূর্বদেশ’ কর্তৃপক্ষের কিছু আত্ম-মর্যাদাহীনকর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে তিনি ওই পত্রিকা থেকে পদত্যাগ করেন। অবর্ণনীয় আর্থিক সংকটকালেও তিনি আইয়ুব খানের জাতীয় প্রেস ট্রাস্টের কাগজ ‘দৈনিক পাকিস্তানের’ যুগ্ম সম্পাদকের পদ গ্রহণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৯ সালে নিজগৃহ থেকে ন্যাপের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। পত্রিকাটির ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন ষাট দশকের ছাত্রনেতা ও এক সময়ের (সম্ভবত ১৯৬৬) ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক শফি আহমদ। এখানে লক্ষ্য করার মতো একটা বিস্ময়কর বিষয় রয়েছে। একটা পত্রিকার লেখা সংগ্রহ, বিজ্ঞাপন আনা, প্রেসে ছোটাছুটি, ছাপিয়ে তা বিলি করা পর্যন্ত যাবতীয় প্রায় সব কাজ এই দুই অসম বয়সী সম্পাদক ও ম্যানেজার কীভাবে সমাধা করতেন তা ভাবা যায় না। ১৯৬৬ সালে পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি পূর্ব পাকিস্তান শাখা গঠিত হয়। কাজী ইদ্রিস সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভাব গ্রহণ করেন। সভানেত্রী হন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কাজী ইদ্রিস বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সহসভাপতি হন।
কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস ১৯৬৭ সালে ন্যাপের ঢাকা শহর শাখার সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহসভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তার প্রতিভার স্বাক্ষর উজ্জ্বল। তার সাহিত্য কর্মের মধ্যে বিশ্বখ্যাত ‘স্ট্রিল্ডবার্গের সাতটি নাটক’-এর অনুবাদক, চীনা কাহিনী অবলম্বনে উপন্যাস ‘পীত নদীর বাঁকে’ ও ‘নটীর প্রেম, উপন্যাস অন্তঃশীলা এবং প্রবন্ধ সকেলনগ্রন্থ সব মুখ চেনা চেনা, গল্প সংকল চতুষ্কোণ ও ছোটদের চীনা রূপকথা ‘জানোয়ারও যাদু জানে’ পাঠক সমাজের কাছে বিশেষ সমাদৃত হয়েছে। কাজী ইদ্রিসের ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংবাদিক-সাহিত্যিক রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আরও অনেক কথাই আলোচনা করা যায়। অনেকে তাকে সাংবাদিক জগতের অন্যতম পথিকৃত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এমন মানুষকে যুগের প্রতিনিধি হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেন। কেউ কেউ দুঃখ করেন এমন লোক তো এখন আর দেখি না। আমি কিন্তু দুঃখ পাওয়া মানুষদের একজন নই। আমার কাছে মনে হয় কিছু মৌলিক বিষয় অপরিবর্তিত থাকার পরও একটা স্বাধীন দেশের মানুষের আবেগ-চিন্তা-চেতনা, জীবনধারা একটা পরাধীন দেশ থেকে ক্রমশ ভিন্নতর রূপ নেয়। সেটাই স্বাভাবিক। আরও কিছু বিষয় রয়েছে। বর্তমান যুগের সময়সীমা ক্রমশ কমে আসছে। যুগের পরিবর্তন আসছে দ্রুত। মানুষকে ছুটতে হচ্ছে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তারাও নতুন নতুন যুগের সৃষ্টি করছে। তবে সেটার প্রেক্ষিত ভিন্ন। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের মতো সাংবাদিক অথবা অন্য কোনো পেশা বা রাজনীতিতে নিয়োজিত সে সময়ের মানুষদের সামনে একটা মিশন ছিল। এখনও মিশন নাই তা বলা যাবে না। তবে যুগটা প্রফেশনালিজমের। এখানে মিশন রয়েছে পিছনের সারিতে। তারপরও প্রফেশনালিজম ভালো। এটা একদিকে যেমন যুগের দাবি তেমনি ব্যক্তি মানুষকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। তবে এটাও ঠিক প্রফেশনাল রক্ষার সব কিছু বিসর্জন দেয়া কেউ-ই সমর্থন করবে না।
তাই সামনের নতুন যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোন অনুকরণ-অনুসরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নিজের মনন-মানস গঠন করার জন্য কাজী ইদ্রিসের মতো মানুষদের পরিচয় জানা একান্তই প্রয়োজন।
২২ মার্চ। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের মৃত্যু দিন। তিনি ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক, উদার ভাবাপন্ন, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ছিলেন। বর্তমান যুগে কাজী ইদ্রিসের মতো এমন বিরল ব্যতিক্রমী নিরাভরণ নিরহংকারী প্রচারবিমুখ ত্যাগী মানুষের বড় অভাব। সমাজ সংসারের সব দায়িত্ব পালন করেও তিনি ঋষিতুল্য জীবনযাপন করেন।
তাঁর মৃত্যুতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রিয়ভাবে শোকবাণী প্রদান করেন।
তথ্যসূত্র:
- কাজী মোহাম্মদ শীশ রচিত ”হৃদয়জুড়ে চেনা মানুষ”
- দৈনিক সংবাদ মুক্ত আলোচনা, শুক্রবার, ২২ মার্চ ২০১৯, ৮ চৈত্র ১৪২৫, ১৪ রজব ১৪৪০
- কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস স্মারকগ্রন্থ।