13/01/2024
আব্বুর গায়ে ছিল কড়কড়ে ঘামের গন্ধ। ছোটবেলায় আমি যতবার কোলে গিয়েছি, প্রতিবারই ধক করে গন্ধটা নাকে এসে লেগেছে। এমন না যে আব্বু রোদে কাজ করতেন, হাই প্রেশার ছিল, প্রচুর ঘাম দিতো শরীর। অমন না।
আব্বু বসে কাজ করতেন। সুন্দর অফিস ছিল উনার। অফিসে এসিও ছিল। প্রেশার নর্মাল ছিল। গায়ে নয়, শার্টে ছিল ঐ গন্ধ। কারণ, আব্বু ঐ শার্ট কখনই ধুয়েননি। আমার আম্মু মৃত্যুর একদিন আগে ঐ শার্ট বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলেন। আম্মুর হাতের স্পর্শ লেগে আছে। বৃষ্টি কিংবা গির্জার পবিত্র শুদ্ধ জলেও ঐ স্পর্শ ধোয়া নিষেধ। শার্ট’টা ছুঁয়ে দেখাও নিষেধ ছিল আমাদের জন্য।
বোন ছিল আমার চেয়ে বৎসর পাঁচেক বড়ো। আমায় দেখাশোনার জন্য বোন যথেষ্ট হলেও আব্বু আরেকটা বিয়ে করলেন। আমার বয়স অত বেশী ছিল না, আবার অত কমও ছিল না। ছুঁতে না পারা ঐ শার্ট ছিল আমার দারুণ গোপন গর্ব। শার্টের ঐ গন্ধটা ছিল মা পরবর্তী চারপাশ ঘিরে থেকে যাওয়া আমার আপন বৃত্ত। আমার আব্বু পৃথিবীর সেরা আব্বু। কী করে একটা মানুষকে মৃত্যুর পরও আঁকড়ে আঁকড়ে ধরে ভালোবাসতে হয়, আব্বু ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহারণ।
----
বিয়ে মানুষকে বদলে দেয় বোধহয়। বিয়ের পর একদিন আমার বুক ভেঙে গেল। আম্মুর হাতের স্পর্শ লেগে থাকা শার্ট’টা দেখলাম উঠোনের দড়িতে ঝুলছে। ঘিয়ে রঙা শার্ট'টার ভেজা হাতা বেয়ে টুপ টুপ করে নিচে পড়ছে ক’ফোঁটা জল। আব্বুর নতুন বউয়ের কাজ নির্ঘাত। আব্বু এই কাজ করতে পারেন না। কস্মিনকালেও না। অথচ কাজটা করলেন আব্বু নিজে। নিজ হাতে।
– ‘গন্ধ বের হচ্ছিল ঘামের খুব। তাই ধুয়ে ফেলেছি।’
আব্বু উত্তর দিয়েছিলেন আমাদের। বড্ড সহজ সরল উত্তর। এমন করে কেউ কোনো অপরাধ স্বীকার করতে পারে আমার জানা ছিল না।সামান্যতম অনুশোচনাবোধ ছাড়াই আব্বু উত্তর দিলেন। উত্তর নয় ঠিক, দাগ টেনে দিলেন বোধহয়। লাল দাগ। দাগের ওপাশে রইলেন আব্বু, আব্বুর নতুন বউ, আপু। আর আমি দাগের এপাশে। একা।
ঐ দিন, ঠিক ঐ মুহূর্তে আমি বুঝে গিয়েছিলাম পৃথিবী একটা নরকের টুকরো ছাড়া আর কিছু নয়। খুব কেঁদেছিলাম রাত্তিরে। বড়ো হয়ে উঠছিলাম। আপু আলাদা রুমে ঘুমাতো তাই। আব্বু তার নতুন বউয়ের সঙ্গে। এবং আমি একা। কাঁদতে কাঁদতে রাত্তিরে জানালা খুলে হাত বাড়িয়ে অন্ধকার ছুঁয়ে ছুঁয়ে বিড়বিড় করেছিলাম, 'আম্মু। তোমায় ভুলে গেল লোকটা। লোকটাকে কক্ষনও ক্ষমা কোরো না তুমি। আমি করবো না।'
নিশ্চুপ অন্ধকার জানালা গলিয়ে এসে আমার চারপাশে গোলাকার বৃত্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল দারুণ। ঐ বৃত্ত আমার ছাড়া হয়নি আর।
এই বৃত্তের আশপাশ আমি ঢুকতে দিইনি আব্বুকে। তিনি অবশ্য ঘেঁষার চেষ্টা করেছিলেন প্রথম প্রথম। স্কুল থেকে ডাক আসলো তার। গ্রামের সবার নিকট চমৎকার একজন মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সদা সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল সুখী মানুষ। স্কুলে গিয়ে অন্ধকার হয়ে আসলো সুখী মুখ তার।
পুত্র স্কুলে ‘মাইসেল্ফ’ প্যারাগ্রাফে পিতা সম্পর্কে একগাদা ঘৃণা লিখে এসেছে।
– ‘আমার বাবাকে আমি পছন্দ করি না। তিনি আমার দেখা এই পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি।’
এই দু’টো লাইনই শুধু উল্লেখ করার মতো ছিল। বাকিগুলো আরও খারাপ। শিক্ষকের মুখে বাঁধলো বলতে গিয়ে। আব্বু ইতস্তত ভঙ্গিতে হাসলেন চেয়ারে বসে, সামনে উপবিষ্ট প্রধান শিক্ষক ভ্রুঁ কুঁচকে উপদেশ দিলেন একগাদা। উনার ধারণা, আব্বুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ নয়। ওতে আব্বুরই কিছু একটা করা দরকার। তাই তিনি করলেন।
স্কুল থেকে ফেরার পথে একগাদা খেলনা নিয়ে আসলেন। তিনি জানলেনও না, এইসব খেলনা নিয়ে খেলার বয়সে তার পুত্র খেলেছে একটা অন্ধকার বৃত্তের ভেতর, বরফখণ্ডের মতোন জমাট টুকরো টুকরো ঘৃণা ভাঙ্গা আর জোড়া লাগানোর খেলা। ঐ বয়স পার হয়ে গেছে কবে। তাও আব্বু আমার রুমে আসলেন। কত বৎসর পর!
আমি দরজায় চোখ রাখলাম। আব্বু কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকে খেলনাগুলো রাখলেন টেবিলে। আমার হাতে প্লাস্টিকের একটা বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-- ‘চলো বাবু, আমরা গুলি গুলি খেলি। আমি চোর। আমায় পাকড়াও করো তুমি। কেমন?’
আব্বু আমার হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে দরজায় লুকালেন। আমি প্লাস্টিকের বন্দুক হাতে ধীর পায়ে সামনে গিয়ে দরজা সরিয়ে লুকিয়ে থাকা আব্বুর বুক বরাবর গুলি চালালাম। গুলি মিথ্যে ছিল, চোখজোড়া মিথ্যে ছিল না। সত্য ছিল ট্রিগারে চেপে বসা তর্জনি আঙুলটাও।
আব্বু খিলখিল হেসে উঠলেন। দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে মজা করে মরে যাওয়ার ভান করতে করতে একবার তাকিয়েছিলেন আমার চোখের দিকে। একবার। ঐ একটা মুহূর্ত। খিলখিল হাসি কমে এলো তার। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা তীব্র বিষাদে নীল হয়ে এলো ক্ষণিকের ভেতর। এবং আমার ঐ ঘৃণায় জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে আব্বু ঐদিন ভেতর থেকে মরে গেলেন সম্ভবত। আর কাছে ঘেঁষেননি কোনোদিন। চেষ্টাও করেননি।
-----
--------
আমরা এক বাসার ভেতর দুই জগতে বসবাস করলাম। আব্বু মানুষ মন্দ ছিলেন, কপাল মন্দ ছিল না। শুদ্ধতম দুইজন মানবীর সঙ্গ পেয়েছিলেন। একজন আমার আম্মু। অন্যজন নতুন বউ তার। সৎ মা সম্পর্কে বেশ ক’টা প্রচলিত গল্প আছে। সব ক’টা গল্পে সৎ মা ভয়ানক পিশাচ। অথচ আব্বুর নতুন বউয়ের সঙ্গে আমার দারুণ সম্পর্ক হলো। আমি মা মা গন্ধ পেলাম।
আমায় রাতদুপুরে বুকে জড়িয়ে ঘুমোতে শুরু করলেন তিনি। আমিও সায় দিলাম। আমি আদর নিলাম তার। মন ভরে। ইচ্ছামতো। কারণ, একটা গোপন বাসনা মনে মনে ছিল আমার ছোটবেলা থেকে। সুযোগ পেলেই এই বাড়ি ছাড়বো আমি। আব্বুর সঙ্গে আমার থাকা সম্ভব নয়। আব্বুর নতুন বউয়ের মাখোমাখো এই আদরটুকুন দরকার ছিল। গন্ধটা দরকার ছিল। যখন বাড়ি ছেড়ে যাবো, এই গন্ধ আমার সঙ্গে থাকবে। এই গন্ধ আমি মুছবো না।আমি আব্বু নই।
--
বাড়ি ছাড়লাম কলেজে উঠার পর। একলা বাসায় থাকতে শুরু করলাম। আব্বুর নতুন বউ টাকা পাঠাতো মাসে মাসে, আপু টাকা পাঠাতো, আমি নিজে টিউশনি করাতাম একগাদা। টাকা পয়সার সমস্যা রইল না। আপুর বিয়ে ঠিক হলো। বিয়েতে থাকার ইচ্ছে একদমই ছিল না আমার।
আব্বুর নতুন বউ এসে বাসায় গোঁ ধরে বসে রইলেন। আপু রাগ করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছেন। অতঃপর যেতে হলো। আমি এখনও ভাবি, ঐদিন বিয়েতে না গেলে কী হতো আমার। কোথায় পৌঁছুতো জীবন? কার হাত ধরে কাটতো অষ্টপ্রহর আমার! জানি না।
বিয়েতে গিয়ে আমি পেলাম আমার পথচলার সঙ্গী। শিউলি। টিপটাপ সিম্পল ভীষণ সাধারণ একজন মানুষ। শাড়ি পরে আমার পাঞ্জাবীর কোনা টেনে বলল,
- ‘আপনাকে আমি পড়ি রোজ।’
- ‘কোথায়?’
- ‘জানেন না বুঝি?’
- ‘না।’
শিউলি আমায় জানালো কোথায় পড়ে আমায় সে। আমি শিউলিকে পড়লাম। সরাসরি কয়েকবার দেখা আর ফেসবুকে দীর্ঘ ছয় মাস বন্ধুত্বের পর সম্পর্কটা আরও ঘন হলো। পৃথিবীর কোনো মনুষ্যকেই বিশ্বাস করি না আমি। শিউলি আমার কাঁধে মাথা রাখলো। ঐ মাথা আমায় বিশ্বাস করতেই হলো।
-
শিউলির চমৎকার একটা পরিবার ছিল। সাজানো গোছানো। যেন স্বর্গ থেকে টুপ করে তুলে আনা একগুচ্ছ ফুলওয়ালা টব। আমি শিউলিকে জানালাম,
– 'আমার বাবা ও মা নেই। দু’জনই মরে গেছেন। একজন অসুখে, অন্যজন এক দুপুরে দড়িতে শুকোতে দেওয়া ঝুলন্ত ভেজা শার্টের ভেতর আটকে। শিউলি যদি কাটাতে চায় বাকিটা জীবন আমার সঙ্গে, সে কখনই মা পাবে না, বাবা পাবে না আরেকটা। কাটাতে হবে আমার সঙ্গে শুধু। একটা আস্ত জীবন!'
ভালোবাসা অদ্ভুত একটা ব্যাপার বৈকি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। শিউলি একবাক্যে রাজি হলো। বেঁকে বসা নিজের পুরো পরিবারও রাজি করালো যুদ্ধ করে প্রায়। আমাদের বিয়ে হলো অগ্রহায়নের শেষদিকে। আপু এসেছিল বিয়েতে। আপুর হাসবেন্ড। আব্বুর নতুন বউও। আব্বুকে দাওয়াত দিইনি আমি। বয়স হলে মানুষের লজ্জা শরম কমে আসে হয়তোবা।
দাওয়াত না পাওয়া সত্ত্বেও আব্বু আমার বিয়েতে আসলেন। চারদিকে চকচকা জামা পরা অসংখ্য মানুষের মধ্যে আমার আব্বুকে দেখলাম একটা পুরাতন শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে গেইটের কাছে। ঐ শার্ট। ঘিয়া রঙের শার্ট। মৃত্যুর একদিন আগে আমার আম্মু বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলেন। নতুন বিয়ের দু’মাসের মাথায় আব্বু ধুয়ে ফেলেছিলেন যে স্পর্শ। সঙ্গে পা দিয়ে পিষে ফেলেছিলেন আমার ছোট্ট বুক।
আব্বুকে দেখে শিউলি ছুটে গেল প্রায়। পা ধরে সালাম করল। আব্বু মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। এক পাও এগিয়ে আসলেন না। আমি দাঁড়িয়ে তখনও। শিউলি হাত ধরে টেনে আনলো তাঁকে। আব্বু আমার সামনে দাঁড়ালেন।
খসখসে স্বরে কড়কড়ে মিথ্যে বললেন,
-- ‘পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম একটু দেখে আসি। চলে যাবো একটু পর।’
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বয়স হলে মানুষের কাঁদতে নেই। বিচ্ছিরি দেখায়। আব্বুকেও দেখালো।
তিনি অশ্রুসজল চোখে ধরা গলায় বললেন,
-- ‘তোমায় একটু জড়িয়ে ধরি বাবু?’
মৌন সম্মতি পেয়ে আমার নিথর পাথর শরীরখানা আব্বু জড়িয়ে ধরলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে। আমি একটা গন্ধ পেলাম। ধক করে এসে লাগলো গন্ধটা নাকে। পরিচিত গন্ধ। ছোটবেলায় পেতাম কত। কী যে ভালো লাগতো। আমি চোখ বুজলাম। কখন আমার দুই হাত আব্বুর পিঠ আঁকড়ে ধরল আমি জানি না। আব্বুর হাতের বাঁধন শক্ত হয়ে গেল তারপর। একটা আলোকসজ্জল বিয়ে বাড়ির ভেতর অসংখ্য মানুষের অশ্রুসজল চোখ, আপুর হু হু করে কান্না আর আব্বুর নতুন বউয়ের হেঁচকি উঠা গলার স্বর ছাপিয়ে আব্বুর শরীর আমার সঙ্গে কথা বলল। ঐ গন্ধটা আব্বুর গন্ধ ছিল। কাপড় চোপড়ে মানুষ লেগে থাকে না। মানুষ আটকে থাকে বুকের ভেতর।
– ‘ঐ ভারী বুক নিয়ে এগুতে হয় আমাদের। সামনে পা ফেলতে হয় বাবু। জীবন এত ক্ষুদ্র। দেখো না, তোমায় দ্বিতীয়বার জড়িয়ে ধরতে গিয়েই বয়স হয়ে গেল আমার।’
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ক্রন্দনরত আব্বুর থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীর ও পিঠ আঁকড়ে ধরে টের পেলাম আমি, বয়স আমারও বাড়লো বোধহয়। চোখ ভিজে এলো জলে।
(সমাপ্ত)...
#ছোটগল্পঃ_সৌপ্তিক
#লেখকঃ_শাখাওয়াত_হোসেন
--------
গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন। আর কমেন্টে আপনার মূল্যবান মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না।🥰