27/08/2025
সত্যজিৎ রায়ের শুরুটা একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় ৮০ টাকা বেতনের চাকরি দিয়ে। সেখানে একজন ভিজ্যুয়াল ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন, এখনকার সময়ে যাকে আমরা গ্রাফিক ডিজাইনার বলি। এই কাজের সাথে সাথেই একটি প্রকাশনা সংস্থার জন্য বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করা শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'র ছোটদের জন্য সংস্করণ 'আম আঁটির ভেঁপু'র প্রচ্ছদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। পরে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, এই প্রচ্ছদের কাজ করার সময়ই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন, সুযোগ পেলে এই গল্প নিয়ে সিনেমা বানাবেন। কারন সেই সময়টায় কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্ব-সিনেমার চর্চা শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। ভিন্ন ধারায় সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখছেন সত্যজিৎ। সেই স্বপ্ন থেকেই চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে সত্যজিৎ খুলে ফেলেন 'ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি'। বহু বিদেশি সিনেমার স্ক্রিনিং করালেন। সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। চারিদিকে উত্তাল পরিস্থিতি। এরই মাঝে সত্যজিৎ ঠিক করলেন তাঁকে নিজের মতো করে কিছু গল্প বলতে হবে। যে গল্পগুলো শুধু বইয়ের পাতায় নয়, সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরতে হবে।
সেই সময় কাজের সুবাদে তার কোম্পানি তাকে লন্ডনে পাঠায়। হঠাৎ করেই পাওয়া এই সুযোগের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের রাস্তা যেন পরিষ্কার দেখতে পান সত্যজিৎ। সিনেমা বানানোর মুন্সিয়ানা শেখার জন্য পাগলের মত সিনেমা দেখতে থাকেন, পড়তে শুরু করেন সেই সময়ের আলোচিত নির্মাতাদের লেখা নানা ফিচার। কিছু স্টুডিও ঘুরে ঘুরে সিনেমা বানানোর বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। প্রাপ্ত জ্ঞান এবং নিজের মেধা আর কাজের প্রতি ডেডিকেশন নিয়ে দেশে ফিরে এসেই শুরু করলেন 'পথের পাঁচালী' বানানোর কাজ। কিন্তু অর্থের অভাবে বহু বছর ধরে চলে 'পথের পাঁচালি' মনের মতো নির্মান করার প্রক্রিয়া। সেই সময় প্রযোজক থেকে পাওয়া অর্থের সাথে রাজ্য সরকার থেকে পাওয়া অল্প কিছু ফান্ডের পাশাপাশি নিজের বাড়ির দলিল, স্ত্রীর গয়না সব বন্ধক রেখেই একটা সময় শেষ হয় 'পথের পাঁচালী'। তবে সকল কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে সত্যজিৎ রায় যে, সিনেমা নয় ইতিহাস বানাচ্ছেন তা মনে হয় নিজেও জানতেন না।
অবাক করার মত বিষয় হলো 'পথের পাঁচালী' চলচ্চিত্রের কোন চিত্রনাট্য লেখা হয়নি। সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবি ও টীকাগুলি থেকে নেয়া পয়েন্ট ধরে ধরে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তিনি ১৯৫০ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রার সময় এই সকল নোটগুলো লেখেন। সত্যজিৎ রায় পরবর্তীতে লিখেছেন যে, তিনি চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে উপন্যাসের বেশ কিছু চরিত্রকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ও গল্পটিকেও কিছুটা রদবদল করেছিলেন। উপন্যাসের শুরুর দিকেই গ্রামের মন্দিরে সকলের সামনেই ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু চলচ্চিত্রে অপু ও দুর্গা তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে। চলচ্চিত্রের অপু ও দুর্গার ট্রেন দেখার জন্য দৌড়নোর দৃশ্যটিও উপন্যাসে নেই। বর্ষায় ভিজে প্রচণ্ড জ্বর বাঁধিয়ে দুর্গার মৃত্যু ঘটে বলে চলচ্চিত্রে দেখানো হলেও উপন্যাসে মৃত্যুর কারণ অজানাই রাখা হয়েছে। হরিহর রায়ের পরিবারের গ্রাম ত্যাগ দিয়ে চলচ্চিত্র শেষ হলেও উপন্যাস সেই ভাবে শেষ হয়নি। তবে উপন্যাসের সাথে কিছু কিছু জায়গায় অমিল থাকলেও সিনেমা হিসেবে 'পথের পাঁচালী' নান্দনিক এক শিল্পকর্ম হিসেবেই উঠে এসেছিলো স্ক্রিনে।
অপুর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সত্যজিৎ রায় সেই সময় পাঁচ থেকে সাত বছরের শিশুর সন্ধানে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন, কিন্তু কোন বিজ্ঞাপনের মারফত আসা কোন ছেলেকেই তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায় তাদের বাড়ির নিকটে সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি ছেলেকে দেখে পছন্দ করেছিলেন এবং অবশেষে সেই আইকনিক অপুর চরিত্রে তাকেই পছন্দ করা হয়। ইন্দিরা ঠাকরুণের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লী থেকে চুনীবালা দেবী নামক একজন পুরাতন নাট্যাভিনেত্রীকে খুঁজে বের করেন। 'পথের পাঁচালী' চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়ার আগেই কানু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা ছিলেন। তিনি হরিহর তথা অপুর পিতার ভূমিকায় অভিনয় করেন। সত্যজিতের বন্ধু-পত্নী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একজন অপেশাদার অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি সিনেমায় ল অপুর মা সর্বজয়া চরিত্রে কাজ করেন। দুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করার পূর্বে উমা দাশগুপ্ত কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। তবে এই সিনেমার প্রাণ ছিলেন তিনি। অন্যান্য বিভিন্ন চরিত্রে বড়াল গ্রামের বাসিন্দারা অভিনয় করেন যা এককথায় বিস্ময়কর।
তবে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সিনেমাটি রিলিজের পরে প্রথমদিকে বক্স অফিসে খুব একটা ভালো ফলাফল আনেনি। কারন তখনো ভারতবর্ষে এই ধরনের সিনেমা বোঝার দর্শক খুব বেশি তৈরী হয়নি। তবে বিশ্ব দরবারে হইচই ফেলে দেন সত্যজিৎ রায় তার প্রথম সিনেমা দিয়েই। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে 'সেরা ডকুমেন্টারি'র পুরস্কার পেয়ে যান তিনি। এরপরে টনক নড়ে তৎকালীন ভারতবর্ষ এবং এপার বাংলার সিনেমাবোদ্ধাদের। এই সিনেমাই একটা সময় সিনেমা নিয়ে স্টাডি করা বা সিনেমা নিয়ে যারা ভাবেন এবং কিছু নির্মান করার স্বপ্ন দ্যাখেন তাদের জন্য ‘মাস্ট ওয়াচ’ হিসেবে গন্য করা হয়ে আসছে।
'পথের পাঁচালী' স্বাধীন ভারতে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত হয় এবং ভারতকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেয়। এই আইকনিক সিনেমা ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের নতুন ধারার সমান্তরাল চলচ্চিত্রের প্রথম উদাহরণ, যার প্রধান বিষয়বস্তু ছিলো অকৃত্রিমতা ও সামাজিক বাস্তবতাবাদ, যা ভারতীয় চলচ্চিত্রে সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত অনেক ধারা এবং নিয়ম ভেঙে দিয়েছিলো। 'পথের পাঁচালী'কে ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাঁক বদলের সিনেমা হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
নান্দনিকতা, নির্মানশৈলী, আবহসংগীত, সিনেমাটোগ্রাফি এবং অভিনয় সবগুলো শাখায় ‘পথের পাঁচালী’ যে অসাধারণ ভিত্তি স্থাপন করে গেছে বাংলাভাষী দর্শকদের কাছে তা আজো এক অদ্ভুত বিস্ময়। সময়ের চেয়ে অনেকটা সময় এগিয়ে থাকা এই সিনেমাটি আজ ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৭০ বছর পূর্ণ করলেও এখনো বাঙলা এবং বাঙালিদের জীবনে 'পথের পাঁচালী'র আবেদন একই রকম অটুট। আগামী ৭০ বছরেও এই আবেদন এতোটুকু কমবে বলে মনে হয়না।